অলৌকিক নয়, লৌকিক (প্রথম খণ্ড)/অধ্যায়: তেরো
অধ্যায়: তেরো
Clairvoyance (অতীন্দ্রিয় অনুভূতি)
পরামনোবিদ্দের মতে ক্লেয়ারভয়ান্স clairvoyance শক্তির সাহায্যে বহু দূরের ঘটনা দেখা ও শোনা সম্ভব। (বোঝার সুবিধের জন্য উদাহরণ স্বরূপ একটা ঘটনার উল্লেখ করছি।) আমাদের কলকাতার এক প্রবীণ সাংবাদিক এক বাঙালি তান্ত্রিকের পরম বিশ্বাসী ভক্ত। যে সময়ের ঘটনা বলছি তান্ত্রিকবাবা তখন বেঁচে। সাংবাদিক ভদ্রলোক বিদেশে একবার অসুস্থ হয়ে কয়েকদিন হাসপাতালে ছিলেন। ফিরে এসে ঘটনাটা তান্ত্রিকবাবাকে বলতে তিনি বলেছিলেন, “ওরে, সে আমি দেখেছি। তোর ঘরে যে নার্স মেয়েটি ফুল রেখে যেত, সে বড় ভালো রে।”
তান্ত্রিকবাবা ওই এক কথাতে বাজিমাত করে দিয়েছিলেন। প্রবীণ সাংবাদিক সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাস করে ফেললেন তান্ত্রিকবাবার অতীন্দ্রিয় শক্তি (Clairvoyance) আছে।
অনেক সভ্যদেশের হাসপাতালের কেবিনে ফুলদানে ফুল থাকে, এটুকু জানা থাকলেই যে এই ধরনের কথা বলা যায় অন্ধবিশ্বাসীকে তা কে বোঝাবে?
সাধু-সন্ন্যাসীর অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি
স্টেট ব্যাঙ্ক কলকাতা মেইন ব্রাঞ্চের এক ডেপুটি ম্যানেজার পারিবারিক শান্তির আশায় বিখ্যাত তান্ত্রিক পাগলাবাবা (বারাণসী)-র দ্বারস্থ হন। তাঁর মতে এই তান্ত্রিক যে কোনও কিছু অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার দ্বারা দেখতে পান। ধরুন, একজন কেউ জিজ্ঞেস করল, “বলুন তো আমার বারান্দার টবে কী ফুলের গাছ লাগিয়েছি?” অথবা, “আমার স্ত্রীকে কেমন দেখতে বলুন তো?” অতীন্দ্রিয় অনুভূতির সাহায্যে তান্ত্রিক প্রশ্নকর্তার বাগানের ফুলের টব বা তাঁর স্ত্রীকে দেখতে পেতেন এবং লিখে ঠিক ঠিক উত্তর দিয়ে দিতেন। ডেপুটি ম্যানেজারের এই দেখাকে আমি অবিশ্বাস করিনি। কারণ বর্তমানে পশ্চিমবাংলাতেই পাঁচজন তান্ত্রিকের খোঁজ পেয়েছি, যাঁরা এই ধরনের নানারকম প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম। প্রশ্নগুলো অনেক সময় অদ্ভুত ধরনেরও হতে পারে, যেমন, “বলুন তো আমার বাড়িতে ক’টা বেড়াল আছে?” বা “আমার পড়ার ঘরে কী ধরনের ফ্যান আছে দেখতে পাচ্ছেন? টেবিল ফ্যান না সিলিং ফ্যান?”
এইসব তান্ত্রিক বা ক্লেয়ারভয়ান্স (অতীন্দ্রিয় অনুভূতি) ক্ষমতার অধিকারীদের নানারকম ছাপানো প্রচারপত্র বা জীবনীর বইতে তাঁদের গুণগ্রাহীদের তালিকায় যেসব বিখ্যাত বিজ্ঞানী, ডাক্তার লেখক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের নাম দেখেছি, তাতে সত্যিই চমকে গিয়েছি। কৌশলের সাহায্যে এই খেলা আমিও সফলভাবে দেখাতে সক্ষম। জানলে আপনিও পারবেন। এও জানি কৌশল ব্যবহারের রাস্তা বন্ধ করে দিলে এইসব অতীন্দ্রিয় দৃষ্টির অধিকারীরা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হবেন।
১৯৮৫-র ১৮ এপ্রিল আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের বিজ্ঞান বিভাগের একটি বিশেষ বেতার অনুষ্ঠানে আমি এমনি অতীন্দ্রিয় দৃষ্টির অধিকারী বলে বহুল প্রচারিত পাগলাবাবার (বারাণসী) মুখোমুখি হয়েছিলাম। পাগলাবাবা আকাশবাণী ভবনে ঢুকলেন চারটে গাড়িতে জনা পনেরো ভক্ত নিয়ে। আকণ্ঠ পান করে ও পাগলামী করে একটা ‘তান্ত্রিক’ মার্কা ইমেজ তৈরি করে ফেললেন। আকাশবাণীর প্রচুরকর্মী জুটে গেলেন। এক একজন এক একটা প্রশ্ন করছিলেন। বিজ্ঞান বিভাগের প্রযোজকের রুমে জমিয়ে বসে বাবা লিখে উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন। ঠিকঠাক উত্তর পেয়ে প্রত্যেকেই অবাক। পাগলাবাবা দাবি করলেন—এসব কথোপকথন রেকর্ড করা হোক। আমি বললাম, যা হবে স্টুডিওতে। এই মাছের বাজারে নয়। স্টুডিওতে (রেকর্ডিং রুমে) তাঁকে লিখে উত্তর দিতে দিইনি। উত্তর দিতে হয়েছিল মুখে মুখে। আমার তরফ থেকে প্রশ্ন করার জন্যে হাজির করেছিলাম চিত্র-সাংবাদিক কল্যাণ চক্রবর্তী, প্রকাশক ময়ূখ বসু ও একাধারে চ্যাটার্ড ইঞ্জিনিয়ার ও প্রকাশক রঞ্জন সেনগুপ্তকে।
কল্যাণ প্রশ্ন করেছিলেন, “আমার সঙ্গের ক্যামেরাটার ক’টা ছবি তোলা হয়েছে।”
—“১৬ থেকে ১৭টা।” পাগলাবাবা বলেছিলেন।
ক্যামেরা ইণ্ডিকেটারে দেখা গেল ছবি তোলা হয়েছে ৩০টা।
ময়ূখ জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমার মানিব্যাগে কত টাকা আছে?”
—“৭৭টাকা।”
ব্যাগ খুলে দেখা গেল ২৭০টাকা।
রঞ্জন জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমার সিগারেটের প্যাকেটে ক’টা সিগারেট আছে।”
—“৭টা।”
সিগারেটের প্যাকেট খুলে দেখা গেল ৯টা সিগারেট রয়েছে।
‘অতীন্দ্রিয় দৃষ্টির অধিকারী’ তিনবারে তিনবারই ফেল করলেন। কেন বলুন তো? কারণ ওই একটিই, তাঁকে লিখে উত্তর দিতে দিইনি।
লিখে উত্তর দেওয়ার সময় সম্ভাব্য সব উত্তর লিখে রেখে তারপর প্রশ্নকর্তার কাছ থেকে উত্তরটা জেনে নিয়ে কাগজ ভাঁজ করে আঙুলের কারসাজিতে আসল উত্তরটি ছাড়া বাকি সব উত্তরই ঢেকে দেওয়া হয়। ফলে প্রশ্নকর্তা দেখতে পান খাতাতে সঠিক উত্তরই লিখে রেখেছেন অতীন্দ্রিয় দৃষ্টির অধিকারী সাধকবাবাজি।
লিখে উত্তর দেওয়ার বিষয় নিয়ে আগেই দীর্ঘ আলোচনা করেছি। তাই এখানে সংক্ষেপে সারলাম। এই খেলাই ঠিকমতো দেখাতে পারলে যাঁরা দেখেন তাঁরা প্রত্যেকেই অবাক হয়ে যান। এই বিস্ময় আমি দেখেছি প্রতিষ্ঠিত চোখেই। যাঁদের দেখিয়ে অবাক করেছিলাম তাদের মধ্যে রয়েছেন, কলকাতা পুলিশের ডি. সি. হেডকোয়ার্টার সুবিমল দাশগুপ্ত, ডাঃ আবীরলাল মুখোপাধ্যায়, ডাঃ ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, কার্ডিওলজিস্ট ডাঃ রণধীর বসু, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্যামসুন্দর দে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিসিনের দুই অধ্যাপক ডাঃ জ্ঞানব্রত শীল ও ডাঃ সুখময় ভট্টাচার্য, আকাশবাণী কলকাতার বিজ্ঞান বিভাগের ডঃ অমিত চক্রবর্তী ও ডঃ সুভাষ সান্যাল, প্রাইস ওয়াটার-এর চার্টার্ড অ্যাকাউনটেণ্ট কামাখ্যাপ্রসাদ সেনগুপ্ত, কবি সাধনা মুখোপাধ্যায়, সাহিত্যিক শেখর বসু, রঞ্জন ভাদুড়ী, শ্যামলকান্তি দাশ এবং আরও অনেকেই। সুতরাং এই জাদু-কা-খেল ঠিক মতো পরিবেশে দেখিয়ে এই সব অতীন্দ্রিয়বাবারা যে বিখ্যাত বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিকদের সার্টিফিকেট পাবেন তাতে আর আশ্চর্যের কী!
ইউরি গেলারের ‘থট রিডিং’-এর অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা
ইউরি গেলারের গডফাদার পুহারিক প্রথম ইউরির যে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, সেটি ছিল থট রিডিং। পুহারিক-কে ইউরি ১ থেকে ১০-এর মধ্যে যে কোনও একটি সংখ্যা ভাবতে বলেছিলেন। পুহারিক ভেবেছিলেন। ইউরি একটা রাইটিং-প্যাডে একটা সংখ্যা লিখে কলমটি নামিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “বলো, কত ভেবেছ?”
পূহারিক উত্তর দিতেই তাঁর চোখের সামনে রাইটিং-প্যাডটা মেলে ধরেছিলেন ইউরি। সেই সংখ্যাটিতেই লেখা রয়েছে।
ঠিক এই খেলাই আগরতলার প্রেস কনফারেন্সে (২৮.২.৮৬) দেখাই সংখ্যাটা ভাবতে বলেছিলাম ১ থেকে ১০-র মধ্যে।
ইউরি গেলারের অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি
অতীন্দ্রিয় দৃষ্টির জন্য বিশ্বের সবচেয়ে নামি-দামি ব্যক্তিটি হলেন ইউরি গেলার। গেলার হলেন পরামনোবিজ্ঞানীদের মাথার মণি। গেলারের গডফাদার ডক্টর অ্যানড্রিজা পুহারিক-এর ব্যবস্থাপনায় অনেক আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সম্মেলনে গেলার তাঁর এই ক্লেয়ারভয়ান্স বা অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি প্রমাণ করেছেন। একটা মোটা খামের ভেতরে একটা ছবি রেখে খামটা সীল বন্ধ করে গেলারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। দেখা গেছে গেলার প্রতিবারই ভেতরের ছবির সঠিক বর্ণনা দিয়েছেন।
খামে হাত না ছুঁয়েই ভিতরে কি আছে, বলে দিচ্ছে লেখক
খামটিকে এমন পুরু রাখা হয়েছিল যাতে তীব্র আলোর সামনে খামটিকে ধরলেও ছবিটা ফুটে না ওঠে।
গেলারের পদ্ধতিতেই আমি একইভাবে আমার অতীন্দ্রিয় দৃষ্টির (?) প্রমাণ রাখতে পেরেছি একাধিকবার। চমকে যাওয়ার মতোই ঘটনা। সবিনয়ে স্বীকার করছি আমার কোনও অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা নেই, কারণ যে জিনিসের অস্তিত্বই নেই, তা আমারই বা থাকবে কী করে? আমি যে অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি দেখাই তার পেছনে অবশ্যই রয়েছে কৌশল। দর্শকদের দৃষ্টির আড়ালে সীল করা খামটা ডুবিয়ে নিই অ্যাবসলিউট অ্যালকোহল বা রিফাইণ্ড স্পিরিটে। সামান্য সময়ের জন্য খামটা স্বচ্ছ হয়ে যায়, অতএব ভেতরের ছবিটা একটুক্ষণের জন্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দর্শকদের চোখের আড়ালে চোখ বুলিয়ে নিই খামের ওপরে। তারপর একটু সময় কাটিয়ে যখন ছবির বর্ণনা দিই তখন অ্যাবসলিউট অ্যালকোহল বা রিফাইণ্ড স্পিরিট উবে গিয়ে খাম আবার অস্বচ্ছ হয়ে যায়।