অলৌকিক নয়, লৌকিক (প্রথম খণ্ড)/ভূমিকা


ভূমিকা


বিজ্ঞানকে এবং বিজ্ঞানের দৌলতে পাওয়া কৃতকৌশল প্রযুক্তিবিদ্যাকে জীবনের সর্বস্তরে ব্যবহার করেও আমরা অনেকেই বিজ্ঞান-বিরোধী। বিজ্ঞান বিরোধিতার স্থূল ও সূক্ষ্ম চেষ্টা অনেকদিন ধরেই চলছে। কোপারনিকাস, ডারউইন, ফ্রেজার, মার্কস, এঙ্গেলস, ফ্রয়েড, পাভলভের বই লক্ষ লক্ষ বিক্রি হয়েছে। সব দেশেই ম্যাক্রো-ওয়ার্ল্ড, মাইক্রো-ওয়ার্ল্ড, মহাকাশবিদ্যা সম্পর্কিত জ্ঞান ও গবেষণা বৃদ্ধির ব্যাপক চেষ্টা চলছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে ধারণা আমাদের ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আসছে। বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ মন্ত্রতন্ত্র ছেড়ে যন্ত্র ও প্রযুক্তিবিদ্যার আরাধনায় রত হয়েছে। তবু কেন মানুষের বিজ্ঞানমনস্কতা বাড়ছে না? কেন এখনও বেশির ভাগ দেশের সংস্কৃতির ও ধর্মের মধ্যে অতিপ্রাকৃত, অস্বাভাবিক, অলৌকিক ঘটনার সমাবেশ? এবং প্রাচীন ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে সেইসব ঘটনায় গুরুত্ব আরোপ এবং অলৌকিক ঐশীমহিমা প্রচারে ধর্মীয় সংস্থার ও সাধুসন্তদের পরিকল্পিত প্রচার ও প্রচেষ্টা? অলৌকিক অবৈজ্ঞানিক রহস্যময়তার প্রতি মানুষের দুর্বলতা না থাকলে প্রচার সংস্থাগুলি এসব নিয়ে সক্রিয় থাকত না। অতিপ্রাকৃত ঘটনার প্রতি এই দুর্বলতা অনেকের মানসিকতার বৈশিষ্ট্য হলেও আমরা একে স্বভাবগত বলতে পারি না। অনেককিছু প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যা না জানার জন্যে আদিম যুগের মানুষের ভয়ই যে কাল্পনিক ভূত ও ভগবানে রূপান্তরিত হয়েছে, একথা অনেকে লিখছেন, কাজেই অনেকেই পড়েছেন। কিন্তু পুরনো শর্তাধীনতা (conditioning) থেকে মুক্ত হয়েছেন ক’জন? না হবার কারণ বুঝতে না পারলে অলৌকিক ঘটনার জাদু জানলেও মানুষের আদিম সংস্কার দূর হবে না। বৈজ্ঞানিক কি সব ব্যাখ্যা করতে পারে? বৈজ্ঞানিক কি বন্যা, অনাবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস, ঝঞ্ঝা, ভূমিকম্পকে প্রতিরোধ করতে পারে? বৈজ্ঞানিক কি মৃতকে জীবন্ত করতে পারে? ঠিক কি ভাবে ব্রহ্মাণ্ড তৈরি হল, প্রাণের উদ্ভব হল—এর উত্তর কি দিতে পারে আধুনিক বিজ্ঞান?

 সৎ বিজ্ঞানী মাত্রেই বলবেন,—না জানি না, পারি না। কিন্তু মাত্র কয়েক হাজার বছরের চেষ্টায় আমরা কি প্রকৃতির অনেক রহস্য জানতে পারিনি? প্রকৃতির অনেক ক্রিয়াকলাপের অনুকরণে বা অনুসরণে প্রকৃতিকে কিছুটা বশীভূত করে মানবসমাজের কল্যাণে নিয়োগ করিনি? বিজ্ঞান সৃষ্টির ও মানবধর্মের আদি ও অনন্ত সম্পর্কে এখনও অনেকখানি অজ্ঞ থাকা সত্ত্বেও মানুষের জীবনকে অনেক উন্নত করেনি কি? মানুষের ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানকে গড়ে তুলতে সময় দিন।

 বিজ্ঞান অনেক কিছু করেছে ও আরও কিছু করতে পারে, এ নিয়ে কেউ কোমর বেঁধে তর্কে নামবেন না জানি; কিন্তু বিজ্ঞানকে মানুষের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার স্বাধীনতা কোনো দেশের রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত শাসকশ্রেণি, পূজিত নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা—(বিজ্ঞানীরা ও নামি-দামী বিজ্ঞানীরাও এর মধ্যে আছেন) দেবেন না। সেই পুরনো কথাই তুলবেন। বিজ্ঞান বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ ও সমাজকে দেখতে চায় ও তাদের সম্পর্ক নিরূপণ করতে চায় এবং সৎ বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানসম্মত শোষণহীন সমাজ সংগঠিত করতে চায়। অধিকাংশ দেশের শাসকশ্রেণি তাদের স্বার্থরক্ষক সমাজ সংগঠনের পরিবর্তন চায় না। কাজেই আমরা সব পণ্ডিতদের মুখ ও কলম থেকেই এই একই প্রচার শুনছি গত তিন চার দশক ধরে। বিজ্ঞান মানুষের জৈবিক সমস্যা হয়তো নিরসন করতে পারে, কিন্তু আত্মিক ঐশ্বর্য থেকে বঞ্চিত করে মানুষকে অমানুষ করে তুলছে। যে বিজ্ঞানের মধ্যে নীতিবোধ, সৌন্দর্যবোধ ও দর্শনচিন্তা নেই—সেই বিজ্ঞান চাঁদে পাড়ি দিতে পারলেও মূল্যবোধ বাড়াতে পারে না, মনুষ্যত্ব উন্মেষে অক্ষম। ভারতের দেশে উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিজ্ঞান-বিশারদরা বিজ্ঞানের প্রযুক্তিবিদ্যা ও প্রাচীন ব্রহ্মবিদ্যার কুশলী মিশ্রণের ফর্মুলা আবিষ্কারের জন্য আলোচনা ও চর্চায় রত। এদেশের শাসক মনে করে শুধু ভাত রুটির জোগান দিলে মানুষ গড়া যাবে না! মনুষ্যত্বের উন্মেষে প্রয়োজন বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের নির্যাসের সঠিক পরিমাণে সংযোজন।

 বিজ্ঞান বিরোধিতায় তাই স্থূল চেষ্টা এখন আর আগের মতো নজরে পড়ে না। অলৌকিকতার ও রহস্যময়তার ধাঁধার সৃষ্টি করে কিছু বিজ্ঞানী সাধুসন্তদের বিজ্ঞান বিরোধিতায় মদত জোগাচ্ছেন। আজ যোগবলে অলৌকিক শক্তির অধিকারী হয়েছেন কোনও স্বামীজি বা বাবাজি—এই প্রচার বা এই ধরনের প্রদর্শনী আগের মতো বিস্ময় উৎপাদন করে না। আজকের রকেট—কম্পিউটার যুগের মানুষ আর আগের মতো প্রয়াত আত্মার বাক্যালাপ শুনে শিহরিত হয় না। আজ বিজ্ঞানের মর্যাদা পাবার জন্য উৎসুক পরাসনোবিদ্যা, জ্যোতিষ ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির মধ্যে আসতে চায়। ভারতীয় যোগী থেকে ইউরি গেলারেরা মাঝে মাঝে মিডিয়া মারফত নিজেদের জাহির করার চেষ্টা করলেও অলৌকিককে বিজ্ঞানীদের রবার স্ট্যাম্পে লৌকিক করে তুলতে পারেননি। যদি কোনোদিন ল্যাবরেটরিতে পদার্থকণার বিশেষ কোনও শক্তি আবিষ্কৃত হয় যা টেলিপ্যাথি বা ক্লেয়ারোভয়েনসের রহস্যভেদে সক্ষম, তাহলেও ESP-র মর্যাদা বৃদ্ধি হবে না। আধুনিক বিজ্ঞানের মতে বস্তুকণা ও শক্তির অভিব্যক্তি অজস্রভাবে ঘটতে পারে—সপক্ষে আর একটি তথ্য সংযোজিত হবে। সঙ্গে সঙ্গে এও প্রমাণিত হবে যে, এই বস্তুকণা তথাকথিত অলৌকিক শক্তি বিজ্ঞানীর পঞ্চেন্দ্রিয়ের কোন একটির কাছেই অভিব্যক্ত হয়েছে প্রকৃতিবিজ্ঞানের মেথডোলজির মাধ্যমেই।

 ঐশীশক্তি, অলৌকিক শক্তি, অতিপ্রাকৃত শক্তি—প্রভৃতি কথাগুলো পরিহার করলেও প্রেতলোকের অস্তিত্ব, জন্মান্তরের রহস্য, পীরের সমাধির (মাজার) অলৌকিকত্ব, ব্যক্তিবিশেষের সমাধি-মাধ্যমে ভগবদ্দর্শন—ইত্যাদিকে বিজ্ঞানগ্রাহ্য করার চেষ্টা সফল হবার কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

 প্রবীর ঘোষ দীর্ঘকালের পরিশ্রমলব্ধ গবেষণায় ও অসাধারণ মননশীলতায় পৃথিবীর বিভিন্ন রহস্যাবৃত অলৌকিক ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণের কাজে হাত দিয়েছেন। বইটি একাধিক খণ্ডে প্রকাশিত হবে। এটি প্রথম খণ্ড। এই খণ্ডে পরাবিদ্যার উপর গুরুত্ব আরোপ করে বইটির গুরুত্ব বাড়িয়েছেন, বেশি উপভোগ্য করেছেন; আমাদের ধন্যভাজন হয়েছেন। কারণ, ভারতীয় কোনও ভাষায় অথবা ভারত থেকে প্রকাশিত কোনও গ্রন্থে পরাবিদ্যার ওপর এত বিস্তৃত আলোচনা ইতিপূর্বে হয়েছে বলে আমার জানা নেই। বিষয়টা অ্যাকাডেমিক হলেও লেখার সহজবোধ্যতা ও সাবলীলতার দরুণ সাধারণের পক্ষে সহজবোধ্য হয়েছে।

 প্রবীর সাধুসন্তদের ঘটানো অনেক ঘটনাই আমাদের লৌকিক কৌশলে ঘটিয়ে দেখিয়েছেন। প্রবীর পৃথিবীর সমস্ত অলৌকিক ক্ষমতাধর এবং জ্যোতিষীদের বুজরুকির বিরুদ্ধে এক অসাধারণ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। ঘোষণা করেছেন—বিশ্বের যে কেউ অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ রাখলে বা কোনও জ্যোতিষী অভ্রান্ত গণনার পরিচয় দিলে দেবেন ৫০ হাজার ভারতীয় টাকা। লেখক চান, এই চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে আরও কিছু মানুষ বুঝতে শিখুন, বাস্তবে অলৌকিক বলে কিছু নেই, অলৌকিকের অস্তিত্ব আছে শুধু পত্র-পত্রিকা, ধর্মগ্রন্থ, বইয়ের পাতায় এবং অতিরঞ্জিত গল্প বলিয়েদের গল্পে।

 ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রবীর ঘোষের নির্ভিক যুক্তিবাদী সংগ্রাম নিশ্চয়ই সমাজ ও ব্যক্তির কল্যাণ করবে। প্রথম খণ্ডের আলোচ্য বিষয়গুলোর ওপর বিস্তৃত আলোচনা আমাকে মুগ্ধ করেছে। পরবর্তী খণ্ডের জন্য তীব্র আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় রইলাম।

ডিরেক্টর
পাভলভ ইনস্টিটিউট অ্যাণ্ড হসপিটাল
১৩২/১ এ, বিধান সরণি
কলকাতা-৪

ডাঃ ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়
১অক্টোবর, ১৯৮৯