আকাশ-প্রদীপ/স্কুল-পালানে

স্কুল-পালানে

মাস্টারি শাসন দুর্গে সিঁধকাটা ছেলে
ক্লাসের কর্তব্য ফেলে
জানি না কী টানে
ছুটিতাম অন্দরের উপেক্ষিত নির্জন বাগানে;
পুরোনো আমড়া গাছ হেলে আছে
পাঁচিলের কাছে,
দীর্ঘ আয়ু বহন করিছে তার
পুঞ্জিত নিঃশব্দ স্মৃতি বসন্ত বর্ষার।

লোভ করি নাই তার ফলে,
শুধু তার তলে
সে সঙ্গ-রহস্য আমি করিতাম লাভ,
যার আবির্ভাব
অলক্ষ্যে ব্যাপিয়া আছে সর্ব জলে স্থলে।
পিঠ রাখি কুঞ্চিত বল্কলে
যে পরশ লভিতাম
জানি না তাহার কোনো নাম;
হয়তো সে আদিম প্রাণের
আতিথ্যদানের
নিঃশব্দ আহ্বান,
যে প্রথম প্রাণ
একই বেগ জাগাইছে গোপন সঞ্চারে
রস রক্তধারে
মানব শিরায় আর তরুর তন্তুতে,
একই স্পন্দনের ছন্দ উভয়ের অণুতে অণুতে।
সেই মৌনী বনস্পতি
সুবৃহৎ আলস্যের ছদ্মবেশে অলক্ষিত গতি
সূক্ষ্ম সম্বন্ধের জাল প্রসারিছে নিত্যই আকাশে,
মাটিতে বাতাসে,
লক্ষ লক্ষ পল্লবের পাত্র লয়ে
তেজের ভোজের পানালয়ে।

বিনা কাজে আমিও তেমনি বসে থাকি
ছায়ায় একাকী,
আলস্যের উৎস হতে
চৈতন্যের বিবিধ দিগ্বাহী স্রোতে
আমার সম্বন্ধ চরাচরে
বিস্তারিছে অগোচরে
কল্পনার সূত্রে বোনা জালে
দূর দেশে দূর কালে।
প্রাণে মিলাইতে প্রাণ
সে বয়সে নাহি ছিল ব্যবধান;
নিরুদ্ধ করেনি পথ ভাবনার স্তূপ;
গাছের স্বরূপ
সহজে অন্তর মোর করিত পরশ।
অনাদৃত সে বাগান চায় নাই যশ
উদ্যানের পদবীতে।
তারে চিনাইতে
মালীর নিপুণতার প্রয়োজন কিছু ছিল নাকো।
যেন কী আদিম সাঁকো?
ছিল মোর মনে
বিশ্বের অদৃশ্য পথে যাওয়ার আসার প্রয়োজনে।

কুল গাছ দক্ষিণে কুওর ধারে,
পুবদিকে নারিকেল সারে সারে,



 বাকি সব জঙ্গল আগাছা।
 একটা লাউয়ের মাচা
 কবে যত্নে ছিল কারো, ভাঙা চিহ্ন রেখে গেছে পাছে।
 বিশীর্ণ গোলকচাঁপা গাছে
 পাতাশূন্য ডাল
 অভুগ্নের ক্লিষ্ট ইশারার মতো। বাঁধানো চাতাল;
 ফাটাফুটো মেঝে তার, তারি থেকে
 গরীব লতাটি যেত চোখে-না-পড়ার ফুলে ঢেকে।
 পাঁচিল ছ্যাৎলা-পড়া
 ছেলেমি খেয়ালে যেন রূপকথা গড়া
 কালের লেখনী-টানা নানামতো ছবির ইঙ্গিতে,
 সবুজে পাটলে আঁকা কালো সাদা রেখার ভঙ্গীতে।
 সদ্য ঘুম থেকে জাগা
 প্রতি প্রাতে নূতন করিয়া ভালোলাগা
 ফুরাত না কিছুতেই।
 কিসে যে ভরিত মন সে তো জানা নেই।
 কোকিল দোয়েল টিয়ে এ বাগানে ছিল না কিছুই,
 কেবল চড়ুই,
 আর ছিল কাক।
 তার ডাক
 সময় চলার বোধ
 মনে এনে দিত। দশটা বেলার রোদ

 সে ডাকের সঙ্গে মিশে নারিকেল-ডালে
 দোলা খেত উদাস হাওয়ার তালে তালে।
কালো অঙ্গে চটুলতা, গ্রীবাভঙ্গী, চাতুরী সতর্ক আঁখি কোণে
 পরস্পর ডাকাডাকি ক্ষণে ক্ষণে
 এ রিক্ত বাগানটিরে দিয়েছিল বিশেষ কী দাম।
 দেখিতাম, আবছায়া ভাবনায় ভালবাসিতাম॥


১৪।১০।৩৮