আখ্যানমঞ্জরী (দ্বিতীয় ভাগ)/উপকার স্মরণ
উপকার স্মরণ
একদিন, আমেরিকার এক আদিম নিবাসী ইংরেজদের পান্থনিবাসে উপস্থিত হইল, এবং পান্থনিবাসে কর্ত্রীর নিকটে প্রার্থনা করিল, আপনি দয়া করিয়া আমায় কিছু আহার দেন; আমি ক্ষুধায় অতিশয় কাতর হইয়াছি। আপনি যে আহার দিবেন, আজ আমি তাহার মূল্য দিতে পারিব না। অঙ্গীকার করিতেছি, যত শীঘ্র পারি, আপনার এই ঋণের পরিশোধ করিব, কদাচ তাহার অন্যথা হইবে না। পান্থনিবাসের কর্ত্রী তাহার প্রার্থনা শুনিয়া, যথেষ্ট গালি দিলেন, এবং বলিলেন, আমি পরিশ্রম করিয়া যে উপার্জ্জন করি, তোর মত লোককে খাওইয়া তাহা নষ্ট করিতে পাবিব না। তুই, এখনই এখান হইতে চলিয়া যা।
এই কথা শুনি, সে চলিয়া যাইবার উপক্রম করিলে, তথায় উপস্থিত এক ভদ্র ব্যক্তি, তাহার আকার প্রকার দর্শনে, স্পষ্ট বুঝিতে পারিলেন, সে, যথার্থই, ক্ষুধায় অতিশয় কাতর হইযাছে। তখন তিনি পান্থনিবাসের কর্ত্রীকে বলিলেন, এ ব্যক্তির যাহা আবশ্যক হ্য়, দাও, আমি তাহার মূল্য দিব। আহার সমাপ্ত হইলে, আমেরিকার লোকটি, আহারদাতার নিকটে গিয়া, ভক্তিপূর্ব্বক নমস্কার করিয়া, বিনয়নম্র বচনে বলিল, আপনি আমার উপর যে দয়াপ্রকাশ করিলেন, আমি কখনও তাহা বিস্মৃত হইব না। এই বলিযা, সে ব্যক্তি প্রস্থান করিল।
ইংরেজেরা, ইষ্টসিদ্ধির নিমিত্ত আমেরিকার আদিম নিবাসীদের উপর যৎপরোনাস্তি অত্যাচার করিতেন, এজন্য, তাঁহাদের, উপর, তাহাদের ভয়ানক বিদ্বেষ জন্মিয়া ছিল। সুযোগ পাইলে, তাহারা তাঁহাদিগকে যথোচিত শাস্তি দিতে ত্রুটি করিত না। একদা ঐ ভদ্র ব্যক্তি মৃগয়া উপলক্ষে, কোনও অরণ্যে প্রবেশ করিয়াছিলেন। ঘটনাক্রমে, সেই সময়ে, আমেবিকার কতকগুলি আদিমনিবাসী লোক তথায় উপস্থিত হইল, এবং দেখিবামাত্র, তাঁহাকে রুদ্ধ করিয়া, আপনাদের বাসস্থানে লইয়া গেল। কিয়ৎক্ষণ কথোপকথন ও পরামর্শের পর, তাহারা স্থির করিল, এই দণ্ডে ইহার প্রাণদণ্ড করা আবশ্যক। এই ব্যবস্থা শুনিয়া, তথায় উপস্থিত এক বৃদ্ধা স্ত্রীলোক বলিল, অল্পদিন হইল, আমার পুত্ত্রটী, লড়াই কবিতে গিয়া, মারা পড়িয়াছে, অতএব এই লোকটি আমায় দাও, ইহাকে আমি পুত্ত্র করিয়া রাখিব। তদনুসারে, ঐ ব্যক্তি, বৃদ্ধার আলয়ে গিয়া, অবস্থিতি করিতে লাগিলেন।
একদিন, তিনি, বনমধ্যে, একাকী কর্ম্ম করিতেছেন, এমন সমযে, একটি আমেরিকার আদিমনিবাসী লোক তথায় উপস্থিত হইল, এবং অতি বিনীতভাবে তাঁহাকে বলিল, আপনি অনুগ্রহপূর্ব্বক, অমুক দিন অমুক সমযে, অমুক স্থানে গিয়া, আমার সহিত দেখা করিবেন। তিনি সম্মত হইলেন, কিন্তু, এ ব্যক্তি কেন আমায় ঐ স্থানে যাইতে বলিল! হয় ত উহার কোনও দুষ্ট অভিসন্ধি আছে; এই আশঙ্কা করিতে লাগিলেন। ফলতঃ, এ বিষযের যত আন্দোলন করিতে লাগিলেন, ততই তাঁহার ভয় হইতে লাগিল। এজন্য, তিনি, নিয়মিত দিনে তথায়। উপস্থিত হইলেন না।
কিয়ৎদিন পরে ঐ আমেরিকার লোক, পুনর্ব্বার, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিল। তখন তিনি লজ্জিত হইয়া, বলিলেন, আমি নানা কারণে, সে দিন যাইতে পারি নাই, এক্ষণে দিন স্থির করিয়া বল, এবার আমি অবধারিত তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিব। তদনুসারে দিন নির্দ্ধারিত হইল। অনন্তর, তিনি, নির্দ্ধারিত দিনে, নির্দ্ধারিত স্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, সে ব্যক্তি, দুই বন্দুক, দুই বারুদপাত্র, দুই ভোজ্যাধার লইযা, বসিযা আছে। তাঁহাকে দেখিবামাত্র, সে বলিল, আপনি, এই ত্রিবিধ দ্রব্যের এক একটি লইয়া, আমার সঙ্গে আসুন। আপনি ভয় পাইবেন না, আমার দুষ্ট অভিসন্ধি নাই, তাহা থাকিলে, আমি এই দণ্ডে, আপনকার প্রাণসংহার করিতে পারিতাম। তবে, আমি আপনাকে, কিজন্য কোথায় লইয়া যাইতেছি, এখন তাহা ব্যক্ত করিব না। তদীয় ঈদৃশ বাক্য শ্রবণে, সাহসী হইয়া, বন্দুক, বারুদপাত্র ও ভোজ্যাধার লইয়া, তিনি তাঁহার সমভিব্যাহারী হইলেন।
কতিপয় দিনের পর, তাঁহারা এক উচ্চ পাহাড়ের উপর উপস্থিত হইলেন, এবং, কিয়ৎ দূরে কতকগুলি গৃহ দেখিতে পাইলেন। সেখানে কৃষিকর্ম্ম হইয়া থাকে, তাহারও লক্ষণ লক্ষিত হইল। তখন, আমেরিকার আদিমনিবাসী ভাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, যে স্থানে লোকের বসতি দৃষ্ট হইতেছে, আপনি ঐ স্থানের নাম জানেন? তিনি বলিলেন, উহার নাম লিচফিল্ড্, ঐ স্থানে আমার বাস ছিল।
এই কথা শুনিয়া, আমেরিকার আদিম-নিবাসী বলিল, আপনকার স্মরণ হইবে কি না, বলিতে পারি না, কিছু দিন পূর্ব্বে, আমি অতিশয় ক্ষুধার্ত্ত হইয়া, এক পান্থনিবাসে গিযা, সেই পান্থনিবাসের কর্ত্রীর নিকটে আহার-প্রার্থনা করি। তিনি, যথেষ্ট ভৎর্সনা করিয়া, আমায় তাড়াই দেন। আমি নিরাশ হইয়া চলিয়া যাই, এমন সময়ে, আপনি দয়া করিযা, নিজব্যয়ে আহার করাই, আমার প্রাণরক্ষা করিছিলেন। আমি, পান্থনিবাস হইতে, প্রস্থানকালে, আপনাকে বলিয়াছিলাম, আপনি আমার যে উপকার করিলেন, আমি কস্মিনকালেও, তাহা বিস্মৃত হইব না। আমি শুনিতে পাইলাম, আপনি নিরুদ্ধ হইয়া, দাসরূপে অবস্থিতি করিতেছেন। আপনকার দাসত্বমোচনের জন্য, আমি আপনাকে এখানে আনিয়াছি। ঐ আপনকার বাসস্থান, উহা অধিক দূরবর্ত্তীও নহে; আপনি স্বচ্ছন্দে প্রস্থান করুন। আমি আপনকার নিকট বিদায় লইতেছি। এই বলিয়া, সে প্রস্থান করিল। তিনিও তাহার দয়ায়, দাসত্বমুক্ত হইয়া, নির্বিঘ্ন, আপন বাসস্থানে উপস্থিত হইলেন, এবং সেই অসভ্যজাতীয় ব্যক্তির দয়া, সৌজন্য ও সদ্ব্যবহার দর্শনে, নিরতিশয় প্রীত ও চমৎকৃত হইয়া, মুক্তকণ্ঠে তাহার প্রশংসাকীর্ত্তন করিতে লাগিলেন।