আজকের আমেরিকা/লণ্ডন
লণ্ডন
লণ্ডন নগরের নাম কে না জানে? সকলেই লণ্ডন দেখতে চায়, কিন্তু পেরে উঠে না। তাই অনেকেই ভ্রমণ কাহিনী পড়ে মনের পিপাসা মিটায়। যারা লণ্ডনে যায়, তারা সব সময় নগরের সত্য বর্ণনা দিতে পারে না। সেখানে ভালও আছে মন্দও আছে। মন্দের দিকটা সাধারণত চাপা থাকে কারণ অধীন জাতির পক্ষে বৃটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানীর কুৎসা করা অকর্তব্য। যেখানে কথা বলবার ক্ষমতা রয়েছে, লেখবার ক্ষমতা রয়েছে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বর্তমান, সেখানে গিয়ে ভারতবাসী সামান্য দুঃখকষ্টের কথা ভুলে যায়।
দেখবার এবং জানবার প্রবল বাসনা আমার মনকে নাচিয়ে তুলেছিল। লাফালাফি করতে হলে পেট ভরে খেতে হয়, শুতে হয় উত্তম শয্যায়, তবেই চিন্তাধারা ঠিক পথে চলে। এবার আমার খাবারের চিন্তা মোটেই ছিল না, কারণ লণ্ডনের রেস্তোরাঁতে প্রবেশ করতে আমাকে কেউ মানা করছিল না। কিন্তু কোথায় থাকব এই হয়েছিল ভাবনা।
ওয়াটারলু ষ্টেশনে পৌঁছেছিলাম বোধ হয় বারটার সময়। তার পর হতেই ঘরের খোঁজে বাহির হই। যার হাতে টাকা আছে তার ঘর খোঁজার দরকার নাই, যে কোনও হোটেলে গেলেই হয়। কিন্তু অনেক দিনের দরিদ্রতার ফলে একটু বেশী রকম মিতব্যয়িতার জ্ঞান অর্জন করেছিলাম এবং সে জ্ঞান সহজে বর্জন করা আমাদের দ্বারা হয়ে উঠছিল না। ঘরের খোঁজে বার হয়েছি সস্তায় থাকব বলে। ইউস্টন্ স্কোয়ার হতে এলগেট্ পর্যন্ত ঘর খুঁজেছি কিন্তু কোথাও ঘর পাইনি। এই পথটার মাঝে অন্তত দুই শত জায়গায় ঝুলছিল ঘর ভাড়ার বিজ্ঞাপন। কিন্তু ঘরগুলি আমার মত কালো আদমির জন্য নয়, সাদা চামড়ার জন্য। এক স্থানে একজন লোক বেরিয়ে এসে অতি নম্রভাবে বললেন, “এই মাত্র সব ঘরই ভাড়া হয়ে গেছে কি করি বলুন তো?” আমি বললাম, “বিজ্ঞাপনটি উঠিয়ে যদি নিতেন তবে আর আমাকে কষ্ট করতে হত না।” ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ ভদ্রতা করে বিজ্ঞাপনটি উঠিয়ে ঘরে নিয়ে রেখে দিয়ে ফের বাইরে এসে আমাকে বললেন, “এমন করে আপনার ঘর খোঁজা অনর্থক হবে। যে সব পাড়ায় ভারতীয় ছাত্ররা অথবা মজুররা থাকে সেখানে যান সুবিধা হবে―আপনার জন্য কেউ ব্যবসার ক্ষতি কারবে না।” ব্যাপারটা বুঝলাম; আমার কালো মুখই ঘর পাবার প্রতিবন্ধক ছিল। বিলাতফেরত সুধীজন কি এসব কথা দেশে এসে কখনও কারো কাছে বলেছেন? তারা এসব কথা বলতে পারেন না কারণ এসব কথা বললে যে তাদেরই বাহাদুরী চলে যাবে।
ইস্ট ইণ্ডিয়া ডকে যাবার ইচ্ছা ছিল না কারণ এখন আমি ধনী আর যেসকল ভারতবাসী সেখানে থাকে তারা দরিদ্র। কিন্তু এ অভিমান আমার বেশীক্ষণ রইল না। চললাম ডকের দিকে সর্বহারাদের কাছে। তাদের কিছু নাই, তাই অভিমান তাদের কাছে ঘেঁষে না। ভরসা এই তারা আমাকে প্রত্যাখ্যান করবে না। ৯০ হাই ষ্ট্রীটে একটি হিন্দুস্থানী এসোসিয়েসন আছে। ভাবলাম, সেখানে গিয়ে মুসলমানদের সংগেই রাত্রিটা কাটিয়ে আসি। গিয়ে দেখি দরজায় খড়ি দিয়ে লেখা রয়েছে, ‘চাবি উপরে আছে’। আমি উপরে উঠে চাবি নিয়ে এসে দরজা খুলে তিনটা বেন্চ একত্র করে হাতটা বালিশ করে মহানন্দে শুয়ে পড়লাম। পরিশ্রম করলে আপনা হতে ঘুম আসে। ঘুম এসে আমার সকল ব্যথার অবসান করেছিল।
অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম। বোধ হয় রাত্রি তখন এগারটা হবে, একটি মহিলা এসে আমাকে জাগালেন। মহিলার সম্মান রক্ষা করা পুরুষের কর্তব্য। তৎক্ষণাৎ বিছানা ছেড়ে মহিলাকে সম্মান জানালাম। মহিলা আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। এভাবে পরিচয় জিজ্ঞাসা করার নিয়ম যদিও তাদের মাঝে নাই তবুও আমার পরিচয় চেয়েছিলেন এবং আমার পরিচয় পেয়ে মহিলাটি আমাকে বসতে বলেই কাছের বাড়িতে গিয়ে একটি যুবককে ডেকে এনে আমার সংগে তার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। যুবক অল্প সময়ের মধ্যেই আমার সংগে আলাপ করে নিয়ে বললেন, “এই তো মোটে সন্ধ্যা হল, চলুন একটু বেড়িয়ে আসি, আজ রাত্রে আর বাসা ভাড়া হবে না।” উভয়ে কাছের ছোট রেস্তোরাঁ থেকে চা খেয়ে টিউব ষ্টেশনে নেমে পড়লাম এবং ট্রেনে হাইড পার্কের কাছে এসে উঠলাম।
হাইড পার্কে অনেক দিন বেড়িয়েছি। হাইড পার্কের যদি তুলনা দিতে হয়, তবে একমাত্র হাইড পার্কই তার তুলনা। লণ্ডনের হাইড পার্ক স্বাধীনতার কেন্দ্রস্থল। ছোট স্টেণ্ডএর উপর দাঁড়িয়ে যা ইচ্ছা বলে যাও, কেউ কিছু বলবে না। সেখানে যীশু, মোহম্মদ, বুদ্ধ, শঙ্করের যেমন শ্রাদ্ধ হয়, তেমনি হয় চেম্বারলেন, দালাদিয়ের, মুসোলিনী, হিটলার ও স্টালিন প্রভৃতির। শুনতে ভাল লাগে শোন, নতুবা পথ দেখ, কারণ এটা হাইড পার্ক, বাক্-স্বাধীনতার পীঠস্থান। ভারতের সংবাদপত্র ধর্ম নিয়ে কথা বলতেও ভয় পায়। ভয় এই যে, হয়তো গ্রাহক কমে যাবে নয়তো ছোরার আঘাতে সম্পাদকের প্রাণহানি হবে। কিন্তু হাইড পার্কে সে ভয় নাই। যারা স্বাধীনচেতা তারা ছোরা মারে না, তারা নীরবে সবই সহ্য করে যায়।
হাইড পার্কের বিজলি বাতিগুলি যেন সভ্যজগতের কলংকের অন্ধকার সরিয়ে দিয়ে অন্তত একটুখানি জায়গাকে স্বর্গীয় ছটায় আলোকিত করে রেখেছে, যেখানে মানুষ একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারে। হাউড় পার্কের স্নিগ্ধ মৃদুমন্দ বাতাস নরনারীর মনকে উদার ও নির্ভীক করে। হাইড পার্ক আনন্দময়। যুবক যুবতী জোড়া বেঁধে একে অন্যের কাছে আপন আপন সুখ-দুঃখের কথা প্রকাশ করে। একে অন্যের সুবিধার দিকে দৃষ্টি রেখে এবং যতদূর সম্ভব নিজের কাজের জন্য অপরের যাতে কোন ক্ষতি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখে। যেখানে সহিষ্ণুতা বিদ্যমান সেখানেই স্বাধীনতার অংকুর গজায়, সেখানে সুখ এবং শান্তি আপনা হতে এসে দেখা দেয়।
সেই শান্তিময় স্থানে গিয়ে আমি এবং আমার বেকার সাথী একটি গাছের তলে বিশ্রামার্থ শুয়ে পড়লাম। চিন্তা আমাদের আচ্ছন্ন করল। আমার কাছে অর্থ আছে তবুও ঘর পাচ্ছিলাম না, সাথীর শরীরে প্রচুর শক্তি, মুখে যৌবনশ্রী ছিল তবুও তার চাকরি জুটছিল না। এটা কি চিন্তার বিষয় নয়? আমি হাইড পার্ককে কেন স্বর্গ বলতে চেয়েছি তাও জানা উচিত। সেই কারণটি হল হাইড পার্কে বসে বা দাঁড়িয়ে, কলে কৌশলে নয়, সরল এবং স্পষ্ট ভাষায় আপন মনের ভাব প্রকাশ করা যায়। এটা কি কম কথা?
ভারতের বেকারে এবং ইউরোপের বেকারে আকাশ পাতাল প্রভেদ। ভারতের বেকার আপনার কপাল ঠুকে আর বলে, “ভাগ্য মন্দ, তাই খেতে পাচ্ছি না, কাজ পাচ্ছি না।” সেই ভাবকে পোষণ করার জন্য
হলিউড থেকে নূতন ধরনের ছায়াচিত্র ভারতে চালান দেওয়া হয়। হলিউডে ঐ ছবি বিনামূল্যেও কেউ দেখে না। দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন ও প্রসিদ্ধ নট তাতে সাহায্য করে না। ব্রিটেনেও এসব ছায়াচিত্রের স্থান নাই। সময়ের পরিবর্তনের সংগে মজুরদের মনোবৃত্তির পরিবর্তন হচ্ছে। ব্রিটেনের মজুর এখন ভাবে, কাজ করার অধিকার তার আছে, কাজ পাবে না কেন? কে তার অন্তরায়? সাথী নেটিভ আমাকে এ সম্বন্ধে অনেক কথা বলল। আমি মন দিয়ে তা শুনলাম। তারপর মন্তব্য করতে বাধ্য হলাম। আমি তাকে বললাম, “মজুর-জগতে যেরূপ পরিবর্তন দেখা দিয়েছে, আমার মনেও ঠিক সেইরূপ পরিবর্তনের অংকুর অনেক দিন পূর্বে গজিয়ে ছিল; এখন পত্রপুষ্পে শোভিত হয়েছে। পূর্বে আমি ভাবতাম, জীব আপন কর্মফলে কষ্ট পায়, এখন দেখছি, তা সত্য নয়। এখন দেখছি, কতকগুলি বিশেষ লোকের কথায় নরসমাজ অন্ধ হয়ে তাদের উপদেশ মত চলে। আত্মবিস্মৃত হয়ে যারা অপরের চিন্তাধারাকে গ্রহণ করে, তারা নিজেদের সর্বনাশ ত করেই, উপরন্তু তারা নিজের সমাজকেও অপরের পদানত করে।” গভীর রাত্রে আমরা হাইড পার্ক পরিত্যাগ করে ইস্টলণ্ডনের এলগেটের কাছে একটি সেলভেশন আর্মির বাড়িতে শোবার ব্যবস্থা করলাম।সকালে উঠেই নেটিভ সাথীটি আমাকে সেলভেসন আর্মির বাড়ি দেখাতে লাগল। বাড়িটা তিনতলা। সকলের নীচের তলায় রেস্তোরাঁ, বসবার স্থান এবং সর্বহারাদের সামান্য কাপড় চোপড় রাখবার জন্য ‘সেল’ রয়েছে। অনেক সর্বহারা চা খেতে বসেছে। তাদের শরীরের দুর্গন্ধ উল্লেখযোগ্য। সেই সর্বহারাদের এমন পয়সা নাই যে দু’পেনি খরচ করে সপ্তাহে একবার স্নান করতে পারে। মোজাতে ঘাম লেগে যে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয় তার কথা বলতে আমি অক্ষম। এই সর্বহারাদের মোজা পরিবর্তনের ক্ষমতা নাই। অন্য একটি থাকলে তবে তো বদলাবে? দ্বিতীয় মোজা জোড়া কিনার ছ’পেনি পাবে কোথায়? তাদের সংগে বসেই এক পেয়ালা চা খেলাম। চায়ে চিনি অতি অল্পই ছিল। চিনি কেন এত কম দেওয়া হয় জিজ্ঞাসা করলাম। ওয়েটার বলল, “এই ভদ্রলোকেরা গরম জলের বেশী পক্ষপাতী, তাই গরম জল বেশী করে দেওয়া হয়।” মাখনের পরিবর্তে মার্গ্যারিন্ ব্যবহার হয়। মার্গ্যারিন্ চর্বি হতে প্রস্তুত। খেলেই পিত্ত হয়। কিন্তু এই সর্বহারাদের পিত্তের ভয় করতে হয় না, পেটের ক্ষুধায় পিত্ত পর্যন্ত হজম হয়ে যায়। বাড়িটার দুতলা এবং তিনতলা বেড়িয়ে দেখে এলাম। সারি সারি বিছানা সাজান রয়েছে। প্রত্যেক বিছানার নীচে একটি করে পাত্র রয়েছে। সর্বহারাদের ঘুমাবার পোষাক নাই, তাই তারা খালি গায়ে রেস্ট রুমে যেতে পারে না, রাত্রে ঐ পাত্রে মূত্রত্যাগ করে।
ঘরের খোঁজে অনেক সময় কাটালাম। অনেক দরজার সামনে ‘টু লেট’ লেখা রয়েছে। নেটিভ সাথী যখন জিজ্ঞাসা করে ঘর খালি আছে কিনা, তখন ঘরের মালিক বলে, “নিশ্চয়ই খালি আছে।” ঘরের ভাড়া ঠিক হয়, অনেক রকম সুবিধার লোভ দেখান হয় কিন্তু যেই নেটিভ সাথী বলে, ঘর ভাড়া করা হচ্ছে আমার জন্য, তখনই সকল চুক্তির অবসান হয়। এইভাবে অর্ধেক দিন কাটিয়েও যখন ঘর পাওয়া গেল না, তখন আমরা চললাম যথাস্থানে―যেখানে কালো লোকেরা থাকে। মর্নিংটন্ ক্রিসেণ্ট নামক স্থানে যাবার পর ঘরের সুব্যবস্থা হল, রান্নার বন্দোবস্ত হল, জিনিসপত্র আনা হল। দস্তুর মত ছোট একটা সংসার পেতে এবার লণ্ডন দেখার জন্য প্রস্তুত হলাম।
রিজেণ্ট পার্ক হতে আরম্ভ করে ছোট বড় অনেক পার্ক দেখলাম। প্রায় সকল পার্কেই বোমা পড়া এবং গ্যাস হতে রক্ষা পাবার জন্য ছোট ছোট গর্ত খুঁড়ে মাটির নীচে ঘর প্রস্তুত হয়েছে। নেটিভ সাথী আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আগামী যুদ্ধে এইসব ঘর গ্যাসের হাত থেকে তাদের সত্যিই রক্ষা করতে পারবে কি? আমি তার মুখখানা ভাল করে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, “কখনও চেকোশ্লোভাকিয়া গিয়েছেন।” “হ্যাঁ, গিয়েছিলাম” বলে নেটিভ সাথী জবাব দিল। আমি বললাম, “আর আমাকে জবাব দিতে হবে না, নিজেরটা নিজেই বুঝুন।” এ বিষয়ে আমরা আর আলোচনা না করে অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলতে লাগলাম। উপসংহারে গ্যাস সম্বন্ধে আমি যা বলেছিলাম তাতে বলতে বাধ্য হয়েছিলাম যে, সভ্যতার বাইরে যারা আছে, তারাই বাঁচবে আগামী যুদ্ধে, আর সকলেরই একরকম দম বন্ধ হবে যদি গ্যাসের ব্যবহার হয়।
নিউইয়র্ক রওনা হবার পূর্বে লণ্ডনে প্রায় আট সপ্তাহ কাটিয়েছিলাম প্রত্যেক দিন নানারূপ চমকপ্রদ বিষয়ের আলোচনাতেই কাটত। যেখানে কথা বলবার অধিকার আছে অর্থাৎ স্বাধীনভাবে কথা বললে পুলিস এসে দরজায় ধাক্কা দেয় না, সেখানে আলোচনায় সুখ পাওয়া যায়। প্রায়ই নানারূপ লেকচার শুনতাম, আলোচনাতে যোগ দিতাম, এতে মনে বেশ আনন্দ হত। এখানকার লোক মুখ লুকিয়ে মোটেই কোন কথা বলে না। মাঝে মাঝে ভাবতাম আইরিশরা এত গণ্ডগোল করছে, সেজন্য তাদের পক্ষেই সভা হচ্ছে, বিপক্ষের ত কোন কথাই কেউ শুন্ছে না? যা হোক আমার রুমের কাছে একজন আইরিশ থাকত এবং সে এসে নানা কথা বলে বিরক্ত করত। সেজন্য স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। ১৬ নম্বর মর্নিংটন্ ক্রিসেণ্ট হতে ১৮ নম্বর বাড়িতে এই কারণেই সরতে বাধ্য হলাম। এ বাড়িটার সামনেই এক বিরাট কারখানা। সেই কারখানাতে “ক্রাভান এ” নামক সিগারেট তৈরী হয়। আইরিশরা এই কারখানাকে আতংকগ্রস্ত করতে চেয়েছিলেন। যে বাড়িতে এসেছি তার মালিক হলেন একজন স্ত্রীলোক। তাঁর জন্মস্থান বার্মিংহামে, মিঃ চেম্বারলেনের বাড়ির কাছে। এই মহিলার স্বামী একজন চীনা ভদ্রলোক, তাই তাঁর গৃহে আমার স্থান হয়েছিল।
পুলিস কারখানা বাড়িটা বেশ পাহারায় রাখার বন্দোবস্ত করেছিল কিন্তু সেই পুলিস-পাহারার দিকে লক্ষ্য করত না। লোকে কোনরূপ ভয়ও করত না। লোক চলছে নির্বিকার চিত্তে। আইরিশদের কথা কেউ ভুলেও উচ্চারণ করত না। সে ভুল ইচ্ছাকৃত নয়, কারণ সে বিষয়টা তেমন গ্রাহের মধ্যেই নয়। বোমা ফাটছে, লোক মরছে, ঘর ধ্বসে পড়ছে তবুও বিষয়টা গ্রাহের নয়! এই অগ্রাহের ভাব কাদের দ্বারা সম্ভব? লক্ষ লক্ষ আইরিশ লণ্ডনে বাস করছে, তাদের মাঝে এমন কেউ সংবাদপত্র মারফতে দুঃখও প্রকাশ করছে না। তার কারণ কি? কারণ আর কিছুই নয়, শুধু বিষয়টা অগ্রাহ্য। যারা বিপদে পড়লে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে, চিৎকার করতে থাকে, তাদের কাছে বিষয়টার গুরুত্ব আছে। ১২ নম্বর গাওয়ার স্ট্রীটে এবং ভারতীয় সংবাদপত্রে তার প্রচার আছে, কিন্তু লণ্ডনের কোনও ক্লাব তার কথা মোটেই ভাবছে না, সংবাদপত্রগুলিও তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। যারা বীর তারা সামান্য বিষয় নিয়ে হৈচৈ করে না, তারা তৎপর হস্তে বিক্ষোভ দমন করে।
এ অন্চলে অনেক সাইপ্রাসবাসী থাকে। তাদের নাক মুখ এবং শরীরের গঠন দেখবার মতই। একজন সাইপ্রাসবাসীর সংগে ভাব করে তাকে নিজের ঘরে এনে নানারূপ কথা বলেছিলাম। লোকটি রুটি বিক্রি করত। তার চেহারা দেখলে মনে হয় না সে ফরসা। তার ব্যবসা বেশ ভাল, কিন্তু যদি তার চেয়ে ভাল রংএর কোনো কাশ্মীরী ঐ ব্যবসা করতে আরম্ভ করে, তবে তার ব্যবসা চলে না। অনেক কাশ্মীরী যতক্ষণ নিজেকে ইণ্ডিয়ান বলে পরিচয় না দেয়, ততক্ষণ তাদের সকল ব্যবসাই চলে। যেই তার পরিচয় বের হয় অমনি তার কারবার বন্ধ হয়ে যায়।
আমার ইচ্ছা হয়েছিল, একদিন মিঃ চেম্বারলেনের বাড়িটা গিয়ে দেখে আসি। ১০নং ডাউনিং স্ট্রীটের কথা বৃটিশ সাম্রাজ্যের যেখানে সেখানে শোনা যায়। কলোনিয়্যাল অফিস, ইণ্ডিয়া অফিস, এ সবই কাছে কাছে অবস্থিত। তাই সামান্য সময় সেদিকে কাটলে মন্দ হবে না ভেবে ডাউনিং স্ট্রীটে গেলাম। তখন বেলা দশটা। লণ্ডনে কোনদিন আমি এত সকালে ঘুম থেকে উঠিনি। আমার নিয়ম ছিল প্রাতে তিনটায় শোয়া এবং বারটায় শয্যা ত্যাগ করা। কিন্তু সেদিন কি জানি কেন ঘুম ভেংগে গেল, তাই এত সকালে সেখানে যেতে পেরেছিলাম। ভেবেছিলাম ১০নং বাড়ির সামনে অনেক সেপাই থাকবে, ইনফরমার, গুপ্ত পুলিস এ সব তো নিশ্চয়ই থাকবে। কিন্তু গিয়ে দেখি সেই গলিটায় একটা লোকও নাই। সেকেলে ধূসর বর্ণের উচু বাড়িগুলি দাঁড়িয়ে আছে আকাশের দিকে চেয়ে। দেখার মত কিছুই নাই, তাই চলে আসলাম।
বিকালে দশটায় ঘুম থেকে উঠে নেটিভ সাথীটিকে নিয়ে বেড়াতে গেলাম। সর্বপ্রথমই গেলাম একটি চায়ের দোকানে। চা খাওয়া হয়ে গেলে আমরা চললাম টেমস নদীর তীরে। রাত তখন গভীর। পথে লোকজনের চলাচল কম। মাঝে মাঝে দু-একটা মোটরকার একটু বেশী জোরে ছুটে চলেছে। সামনেই টেমস নদী যেন কলকাতার গংগা। নদীর জলে আলো পড়ে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। নদীর জল নীরবে সাগরের দিকে চলেছে। দেখলাম, আমাদের মত আরও অনেকে নদীর সৌন্দর্য দেখতে এসেছে। তাদের অনেকের শরীর শীর্ণ ও জীর্ণ বস্ত্রে আবৃত। শুধু পুরুষ নয় স্ত্রীলোকও আছেন। সবাই নীরবে চলেছে।
পুরুষরা সব সময়েই মেয়েদের সম্মান দেখায় এটা ইউরোপীয় সমাজের একটা সুন্দর রীতি। আমি তার অনুকরণ করতে ভুলিনি। যখনই অসাবধানে কোনও স্ত্রীলোক আমার উপর এসে পড়ছিলেন তখনই আমি ক্ষমা চেয়েছিলাম কিন্তু ফল তাতে সুবিধাজনক হয় নি। রমণীরা ভেবেছিলেন আমার কোনও অসৎ উদ্দেশ্য ছিল। আমি পরাধীন ভারতবাসী কিনা, তাই দু-একবার আমার নেটিভ সাথীটিকে পথচারী মহিলাগণ সাবধান করে বলেছিলেন “এমন লোকের সংগে চলছ কেন?” তা ওদের দোষ নয়; আমাদের দেশের নাবিক, ছাত্র এবং ভদ্রলোক অনেক সময় লণ্ডনে গিয়ে ভুলে যান যে তারা লণ্ডনে কি কলকাতায়। অশিষ্টতায় তারা উন্মত্ত হয়ে উঠেন। টটেনহামকোর্ট রোডে যদি কোনও ইণ্ডিয়ান নাবিক এসে বিকালে দাঁড়ায়, তবে পুলিস অমনি গলাধাক্কা দেয়, কখনও বা ধরেও নিয়ে যায়। সেরূপ নালিশ আমার কাছে অনেকবার অনেকে করেছিলেন। এর প্রতিবাদ করবার জন্য টটেনহামকোর্ট রোডে একদিন গিয়ে দাঁড়াতে সাহস করেছিলাম, কারণ ভাল করেই জানতাম এখানকার পুলিস অমানুষ নয় মানুষ, আমাদের দেশের পুলিসের মতন তারা নয়। টটেনহামকোর্ট রোডে পুলিশ আমাকে পথে দাঁড়াবার জন্য ধরেছিল! যখন আমি এ বিষয়ে তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করেছিলাম তখন পুলিস আমার কাছে ক্ষমাও চেয়েছিল। পুলিস বুঝতে পেরেছিল আমি অসৎ লোক নই।
ইউরোপীয়দের মাঝে চোর লম্পট ডাকাত সবই আছে কিন্তু তাদের মাঝে নারীধর্ষণ কমই হয়। “ওয়ার্ল্ড নিউজ” নামক পত্রিকা ব্রিটিশ জাতির যত দোষ ও নিন্দার বিষয় সর্বদাই প্রকাশ করে। পড়লে দেখা যায় নারীধর্ষণের বিবরণ তাতে অতি অল্পই আছে। আমাদের দেশে নারীধর্ষণ তো সমাজের অংগের ভূষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশী রাত্রি পর্যন্ত আর বাইরে থাকলাম না, কারণ আমার নেটিভ সাথীটি কাল পণ্টনে ভরতি হবে। পেটে কিছু দিতে হলে, মাথা গোঁজবার স্থান পেতে হলে, এ ছাড়া আর উপায় তার ছিল না।
এই জগতে প্রগতিশীল জাতি একটা মাদকতার মাঝেই থাকতে ভালবাসে। জার্মান, ইতালিয়ান, রুশ, জাপানী এই সব জাতির মধ্যে সেই মাদকতা আছে, তাই তারা কষ্টকে কষ্ট বলে মনে করে না। কিন্তু ব্রিটিশ জাতির সে মাদকতা নাই। সেই একঘেঁয়ে রক্ষণশীল দলের একই ধরনের কথা ‘ঐ যায় ঐ ধরি’। আমার ধারণা, বিদ্রোহের ভাব না থাকলে জাতীয়তার অভিব্যক্তি ব্যাহত হয়। যাদের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব আছে পার্লামেণ্টে তাদের দল হালকা। বিদ্রোহের ভাব না থাকলে জাতীয় মানসিকতায় উন্মাদনা আসে না। বিদ্রোহের ভাব জাতীয়তায় ঔদার্যও আনে। সেই কারণে মানুষ দেশের জন্য, জাতির জন্য প্রাণ তো দূরের কথা, তার চেয়েও মূল্যবান জিনিষ যদি কিছু থাকে, তাও দান করবার প্রেরণা পেয়ে থাকে।
রুশিয়ার সংগে প্যাক্ট কর, অতি সত্বর তা কাজে পরিণত হউক, এ কথা সকলের মুখে, সকল সংবাদপত্রে প্রত্যেক দিন লেখা হচ্ছে। মিঃ লয়েড জর্জ থেকে আরম্ভ করে পথের পথিক পর্যন্ত এই মতের পোষক। হাইড পার্কে লাল ঝাণ্ডার নীচে দাঁড়িয়ে কত বক্তা রুশিয়ার সংঙ্গে প্যাক্টের উপকারিতার কথা প্রচার করেচেন তার আর ইয়াত্তা নাই। হাইড পার্কের বক্তৃতা শোনাটা আমার একটা রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনেক গণ্যমাণ্য ভারতবাসী বলে থাকেন হাইড পার্কে নাকি কোনও ইউরোপীয় ভদ্রলোক উপস্থিত থাকেন না। এ সব লোকের কথা মোটেই সত্য নয়। তথাকথিত ভারতীয় ভদ্রলোকেরা তথায় যান না। অন্তত আমি একজন ইণ্ডিয়ানকেও তথায় যেতে দেখিনি। সেদিন এক পার্লামেণ্ট সদস্য বক্তৃতা দিবেন, সেজন্য হাইড পার্কে অনেক লোক একত্রিত হয়েছিল। আমি ভাবছিলাম এই বুঝি ইংলিশ ভদ্রলোকের প্রথম আগমন। তাঁরই বক্তৃতা শুনতে আগ্রহ করে দাঁড়ালাম গিয়ে। তিনি রুশিয়ার সংগে প্যাক্ট করার যুক্তি দেখালেন। তিনি বলেছিলেন, যদি ব্রিটিশ সাম্রাজ্য রক্ষা করতে হয় তবে রুশিয়ার সংগে মিতালি অবশ্য কর্তব্য। প্রশ্ন করার সময় আমি বলেছিলাম, “এ যে আদায় কাঁচকলায় মিলন, এও কি সম্ভব?” তিনি বলেছিলেন―“Pact is adjustable because it is nothing but a pact.” সংগে সংগে এ কথাও বলেছিলেন, “আদা আর কাঁচকলার মিলকেই বলে প্যাক্ট।”
নেটিভ সাথীটি যাবার বেলায় আমার অন্য এক সাথী জুটিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। ইনিও বেকার। এর পণ্টনে ভরতি হবার উপায় ছিল না। জাতিতে ইনি গ্রীক। এখনও তিনি বৃটিশ নাগরীক হতে সক্ষম হননি তাই আমার সংগে বন্ধুত্ব করতে একরকম বাধ্যই হয়েছিলেন। এর মতবাদটাও অন্য রকমের। এর পিতা বাধ্য হয়ে এথেন্স পরিত্যাগ করেছিলেন। এদের মত হল, গৃসে রিপাব্লিক গভর্ণমেণ্ট হওয়া চাই। যেদিন রাজা জর্জ এথেন্স পৌঁছেছিলেন, সেই দিনই মিঃ হরেসিও, এর পিতা, সপরিবারে ইউরোপের নানা দেশ বেড়িয়ে শেষটায় লণ্ডনে এসে পৌঁছেন। ডিমক্র্যাসি আর হিপক্র্যাসি শব্দ দুটো আজকাল লোকের মুখে মুখে শোনা যায়, যেন একটা ফ্যাশন। আমি কিন্তু এ দুটা কথা ব্যবহার করতাম না কারণ যার দেশ স্বাধীন নয় তার কাছে ডিমক্র্যাসি আর হিপক্র্যাসি একই কথা। আমার নবাগত বন্ধু হিপক্র্যাসি শব্দটাই ব্যবহার করতেন বেশী।
নূতন বন্ধু আসার সংগেই নূতন আতংকের সৃষ্টি হল। তিনি বরাবর বলতে লাগলেন, “আপনি আমেরিকা যাবার টিকিট কিনে রাখুন। যদি যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায় তবে মহা বিপদে পড়বেন।” নূতন সাথীটিকে বলেছিলাম, “এ দেশ ছাড়বার আগে একদিন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড দেখতে হবে।” কথাটা তিনি বুঝতে পারেননি, কারণ স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড সাধারণের কাছে শুধু ‘ইয়ার্ড' নামে পরিচিত। অনেক কথার পর যখন বুঝলেন তখন বললেন, “এতে আর কি, গেলেই হল।” এ যেন আমাদের দেশের যাত্রাগানের আসর, কষ্ট করে গেলেই যেখানে হ’ক ঠেসাঠেসি করে বসতে পাওয়া যাবেই। আমি ভাবছিলাম, আবেদন-নিবেদন করব, তারপর পাস আসবে, কত কি হবে, তারপর বলির পাঁঠার মত কাঁপতে কাঁপতে হয়তো মনের বাসনা পুরাতে হবে। নূতন সাথীটি একদিন ঘুম থেকে উঠেই বললেন, চলুন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড দেখতে যাই।
বাসে যাওয়া ঠিক হল। অটোগ্রাফের বইটা সংগে করে নিলাম, উদ্দেশ্য যদি বড় কর্তার দেখা পাই তবে তার অটোগ্রাফ নিয়ে আসব। আমাকে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের বাড়িটা দেখিয়ে দিয়েই আমার নূতন বন্ধু বললেন, “এখানে আপনি একা যান, তাতে ভাল হবে, নেটিভ সংগে থাকলে ওদের সন্দেহ হবে।” হন্হন্ করে একটা অফিসে গিয়ে টোকা দিলাম। প্রবেশের অনুমতি পেলাম। ঢুকে অভিপ্রায় জানাতেই শুনলাম, “আরে না মশায়, এটা নয়, পাশের দরজায় গিয়ে টোকা দিবেন।” একজন ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি বিদেশী। আসার উদ্দেশ্য?”
“আসার উদ্দেশ্য, দেখা, এর বেশী নয়।”
“এটা যে মিউজিয়ম নয় চিড়িয়াখানাও নয়, তা কি মহাশয় জানেন?
“আজ্ঞে হাঁ, তা বেশ জানা আছে। ইংলিশ উপন্যাস পড়লেই স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড-এর কথা পড়তে হয়। আমার ইচ্ছা হয়েছে, একবার স্থানটাকে দেখে আসি, তাতে উপন্যাসের পাতা উলটাতে সুবিধা হবে।”
ভদ্রলোক আমার কথা শুনে সংগে একজন লোক দিলেন, সেই লোকটি আমাকে অন্য এক রুমে রেখে চলে গেল। একে একে সেখানে অনেক অফিসার এলেন। যদিও কেউ কিছু বললেন না তবুও তাদের চাহনি দেখে বুঝলাম সবাই যেন আমাকে প্রশ্ন করতে উৎসুক। কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব না দিতে পেরে একে একে সকলেই চলে গেলেন। অনেকক্ষণ পরে একজন লম্বা এবং গম্ভীর লোক এসে আমায় কাছে বেশ আরাম করে বসে বললেন, “আপনার এখানে আসার উদ্যেশ্য কি?”
“আজ্ঞে সেরূপ কিছু নয়, তবে বাড়িঘরগুলি দেখলে আনন্দিত হব, হয়তো বই লেখার পক্ষে সুবিধা হবে।”
“তবে আপনি লেখক, তা কি দেখবেন চলুন।” এই বলেই তিনি চললেন আমি তাঁর পেছনে চললাম। অনেক দেখলাম কোথাও বিভীষিকা নাই। সর্বত্রই সহজ ও সরল ভাব। ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এখানে থার্ড ডিগ্রি কোথায় দেওয়া হয় সে স্থানটা একটু দেখতে চাই।” ভদ্রলোক বললেন, “থার্ড ডিগ্রির ব্যবস্থা আমাদের শাসিত দেশগুলিতে রয়েছে যেখানে ভয় দেখিয়ে অসভ্যকে সভ্য করতে হয়।” আর দেখতে ভাল লাগল না। বিদায়ের বেলা সেই লম্বা এবং গম্ভীর ভদ্রলোকটির অটোগ্রাফ নিয়ে আসতে ভুলিনি। পথে আসার সময় কেবলই মনে হতে লাগল, সত্যই তো, অসভ্যকে সভ্য করতে হলে ভয় দেখানো দরকার। আমরা কলোনিয়েল দেশের লোক, তবে কি আমরাও অসভ্য?
এবার আমেরিকার টিকিট কেনার পালা। ভেবেছিলাম, টাকা ফেলব আর টিকিট নিব। কিন্তু আমেরিকা কেন, যে কোনও বিশেষ দেশে যেখানে একটু অর্থাগমের পথ খোলা আছে, সেখানকার টিকিট কিনতে ভারতীয়দের বিশেষ কষ্ট পেতে হয়। বাংগালী ও পলাতক জার্মান ইহুদী দ্বারা পরিচালিত একটা নূতন টুরিস্ট কোম্পানীতে টিকিট কিনতে গেলাম। তারা ত আমাকে পেয়েই খুশী। তারা হয়ত জানত না যে ভারতবাসীর পক্ষে আমেরিকার টিকিট কিনা তত সহজ নয় নতুবা এমন অনুগ্রহ এবং আগ্রহ দেখাত না। আমি চুপ করে বসে ওদের চালচলন দেখতে লাগলাম। এদিকে জাহাজ কোম্পানীতে টিকিট কেনার জন্য লোক পাঠান হল। জাহাজের নাম জর্জিক, আটাশ হাজার টন, অল্প ‘রলিং’এ নড়বেও না। কিন্তু টিকিট নিয়ে আসছে না কেন? বেলা তিনটা পর্যন্ত বসে বললাম, “মহাশয়রা টিকিট খানা আসলে রেখে দিবেন, আমি কাল এসে নিয়ে যাব।” এই বলেই চলে আসলাম।
নূতন সাথীটি আমাকে বলতে লাগল, টিকিট বিক্রি না করার কারণ তো আমি খুঁজে পাচ্ছি না, যুদ্ধ তো বাধে নি?” ভারতবাসীকে সাম্রাজ্যবাদীরা কত যে হীন করে রেখেছে, তা সামনে দাঁড়িয়েও ঐ গ্রীক যুবক বুঝতে পারছিল না। ভারতবাসীর দরজা চারিদিক থেকে বন্ধ। যারা লণ্ডনে যায়, তারা একথা হাড়ে হাড়ে বোঝে, কিন্তু সেকথা স্বদেশে এসে বলে না। চড় খেয়ে চড় হজম করে। পরদিন অফিসে গিয়ে দেখলাম তখনও টিকেট আসেনি। অফিসের চাপরাসীকে নিয়ে জর্জিকের অফিসে গেলাম। ম্যানেজার থেকে আরম্ভ করে ছোট কর্মচারী পর্যন্ত বলতে লাগল, ভিসা পেলেই তো হবে না, ফিরে আসার টাকা জমা দেওয়া চাই। এটি না হলে যেন টিকিট বিক্রিই হতে পারে না। তাদের কথা শুনে ব্যাংকের জমা একশত পাউণ্ড-এর একখানা রসিদ দেখালাম জর্জিক জাহাজে প্রচুর স্থান ছিল। জাহাজের মানচিত্র দেখে জাহাজের মধ্যস্থলে আমার ক্যাবিন ঠিক করতে বললাম। অনেক চিন্তা করে আমার প্রার্থনা পূর্ণ করা হল, কারণ তখনও জাহাজে অনেক জায়গা ছিল। স্বর্ণময় চকচকে মুদ্রাকে দক্ষিণ আফ্রিকার জেনারেল ক্রুগার যেমন পদাঘাত করতে পেরেছিলেন, তেমন আর কেউ পারেন নি। লণ্ডনের জাহাজ কোম্পানীও টাকার গোলাম, তারা স্বর্ণমুদ্রাকে মাথায় করার বদলে কি পদাঘাত করতে পারে? অনেক কষ্ট করার পর যখন আমার টিকিট কেনা হল, আমি তখন শান্তিতে নূতন সংগীকে নিয়ে রিজেণ্ট পার্কের দিকে অগ্রসর হলাম। রিজেণ্ট পার্কের ঘাসের উপর বসতে আমি বড়ই ভালবাসতাম। তাই রিজেণ্ট পার্কে গিয়ে তথায় বৃক্ষতলে বসে পবিত্র বায়ুতে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়তে লাগলাম। লণ্ডন নগরের অসংখ্য কলকারখানার চিমনি থেকে কয়লার ধুঁয়া বের হয়, তা নিয়তই শ্বাসপ্রশ্বাসের সংগে মানুষের ফুসফুসে প্রবেশ করে। সেইজন্যে লণ্ডনের অধিবাসীরা দুটি করে রুমাল রাখে। রিজেণ্ট পার্কের বাতাসে সেই কদর্যতা ছিল না, সেখানে বসতে ভাল লাগার সেও একটা মস্ত কারণ।