আজাদ হিন্দ ফৌজ (দ্বিতীয় খণ্ড)/স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর অধিনায়কগণ
স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর অধিনায়কগণ
শ্রীযুত রাসবিহারী বসু
ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের প্রথম প্রেসিডেণ্ট ও আজাদ হিন্দ গবর্ণমেণ্টের প্রধান পরামর্শদাতা শ্রীযুত রাসবিহারী বসু কয়েক মাস আগে টোকিওতে মারা গিয়াছেন।
পূর্ব্ব এশিয়ায় ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন সংগঠনে তিনি প্রধান অংশ গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং প্রথম অবস্থায় তিনিই এ আন্দোলন পরিচালনা করিয়াছিলেন।
বাংলার বিপ্লববাদ যখন পাঞ্জাবকে রঙীন করিয়আ তুলিয়াছিল সেই সময় দেরাদুন বনবিভাগের হেডক্লার্ক রাসবিহারী বসু পাঞ্জাবের ষড়যন্ত্রে যোগদান করেন ও তাহাদের নেতৃস্থানীয় হইয়া উঠেন। ১৯১৪ সালের ২৭শে ডিসেম্বব লর্ড হার্ডিংজ্ যখন দিল্লী নগরীতে শোভাযাত্রা করিয়া প্রবেশ করিতেছিলেন তখন তাঁহারই নেতৃত্বে যে বোম। নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল তাহাতে বড়লাট ও তাঁহার পত্নী আহত হন এবং কয়েকজন মৃত্যু মুখে পতিত হন। লেডী হার্ডিংজ্ বোমার শব্দে এমনি আঘাত পান যে, তিনি আর ভাল করিয়া সারিতে পারিলেন না এবং উহাই তাঁহার মৃত্যুর শেষ কারণ বলিয়া জানা যায়। এই ঘটনার পর বহু ষড়যন্ত্র ও বোমা-নিক্ষেপের ব্যাপারে রাসবিহারী সংশ্লিষ্ট ছিলেন।
১৯১৪ সালে কলিকাতা রাজাবাজার বোমার আখড়া আবিষ্কারের ফলে সেখানকার কাগজপত্রে সরকার উপলব্ধি করিলেন যে, দিল্লীর এই ঘটনা রাসবিহারী ও তাঁহার দলবলেরই কীর্ত্তি। ১৯১৪ সালে সরকার এই সব নথিপত্র হইতে সংগৃহীত তথ্যাবলীর দ্বারা দিল্লী ষড়যন্ত্রের মামলা খাড়া করিলেন। ইহাতে তাঁহার সহকর্মীদের অনেকে ধরা পড়িল এবং অনেকের ফাঁসি হইল। রাসবিহারীকে গ্রেপ্তারের জন্য বারো হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয় এবং হিন্দুস্থানের সর্ব্বত্র তাঁহার ছবি প্রচার করা হয়। এত চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি পুলিস ও গোয়েন্দাদের চক্ষে ধূলি দিয়া বাংলার ও পাঞ্জারের মধ্যে বিপ্লবসূত্র গ্রথিত করিবার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন।
১৯১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বিষ্ণুগণেশ পিংলে নামক জনৈক মারাঠা যুবক অনেকদিন আমেরিকায় বাস করিয়া স্বদেশে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন। তিনি আমেরিকায় ‘গদর’ ও অন্যান্য বিপ্লব-প্রতিষ্ঠানের সহিত বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ভারতে বিপ্লব জাগরণে সহায়তা করিবার নিমিত্তই আসিয়াছিলেন এবং বাঙ্গালী বিপ্লবীদের সহিত মিলিত হন। রাসবিহারীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া বিপ্লব-ভাবাপন্ন লোকদের একত্র করিয়া দেশকে কি প্রকারে স্বাধীন করা যায় সে সম্বন্ধে নানা পরামর্শ করিলেন। রাসবিহারীর অত্যদ্ভূত সংগঠন শক্তি ছিল। তিনি পিংলে, মোহন সিং, কর্তার সিং, শচীন্দ্রনাথ প্রভৃতি বিপ্লবীগণের সাহায্যে দেশীয় সৈনিকদের মধ্যে বিদ্রোহ সৃষ্টি করিবার আয়োজন করিলেন, কয়েকটি স্থানের সৈনিকেরা রাজী হইল। স্থির হইল ১৯১৫ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী বিদ্রোহ হইবে। কিন্তু ইতিমধ্যে কৃপাল সিং নামক একজন বিশ্বাসঘাতক পুলিসের নিকট সমস্ত বলিয়া দেয়। সরকার তখনই ব্রিটিশ সৈন্য আনাইয়া বারুদঘরে ও তোপখানায় বিশেষ পাহারার ব্যবস্থা করিয়া সতর্ক হইলেন। সরকারের ভাবগতিক ও আয়োজন দেখিয়া সৈনিকেরা ভয় পাইল।
চারি দিকে খানাতল্লাস ধরপাকড় চলিল। রাসবিহারীর এক বাসায় অনেক রিভলবার, গুলী, বোমা প্রভৃতি আবিষ্কৃত হইল, কিন্তু সে-বারও পুলিস রাসবিহারীকে ধরিতে পারিল না। কয়েকদিন পরে মিরাটের এক কেল্লার মধ্যে পিংলে কতকগুলি বোমা সমেত ধরা পড়েন। সরকারী মতে বোমাগুলি এমন উপাদানে গঠিত যে, সেগুলি অনায়াসে অর্ধেক রেজিমেণ্ট উড়াইয়া দিতে পারিত। বিচারে পিংলের ফাঁসী হইল। ইহার পর ব্যাপক ভাবে খানাতল্লাস করিয়া সরকার পক্ষ লাহোর ষড়যন্ত্রের মামলা আরম্ভ করিলেন। এই সময় ভারতীয় বিপ্লববাদীদের বিপ্লবের ঐকান্তিক চেষ্টার ইতিহাস প্রকাশিত হইয়া পড়িল।
ইহাদের সহিত আমেরিকাবাসী গদরের ঘনিষ্ঠ যোগ, আমেরিকার জার্মাণ কন্সাল ও গুপ্তচরদের নিকট হইতে সাহায্য গ্রহণের আয়োজন, বাংলার বিপ্লবীদের সহিত যুক্ত হইয়া সেখান হইতে বোমা ও অন্যান্য বিস্ফোরক আমদানী, ডাকাতি ও হত্যা প্রভৃতি ভীষণ কার্য্য জনসাধারণ জানিতে পারিল। বিচারে কয়েকজনের ফাঁসী ও কয়েকজন মুক্তি পাইলেন, অবশিষ্ট কর্ম্মীদের কারাদণ্ড হইল। কয়েক জনের দ্বীপান্তরও হইয়াছিল; তন্মধ্যে ভাই পরমানন্দের নাম উল্লেখযোগ্য। ইহার পর সরকার ভারতরক্ষা আইনের সাহায্যে ১৬৮ জন পাঞ্জাবীকে বিপ্লবী সন্দেহে, ও Ingress Ordinance বিধি অনুসারে ৩৩১ জন লোককে আবদ্ধ কবিয়া রাখিলেন। প্রত্যাগত শিখদের মধ্যে ২,৫৭৬ জনকে নিজ নিজ গ্রামে নজরবন্দী রাখা হইল।
লাহোর ষড়যন্ত্রে অনেক উচ্চ শিক্ষিত লোক ছিলেন। তাঁহারা সকলেই মৃত্যু বরণ করিলেন অথবা কারাপ্রাচীরের অন্তরালে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় দিন গণনা করিতে লাগিলেন। এই ঘটনার পর সশস্ত্র বিপ্লবের শেষ আশা নষ্ট হইল। এই সকল রাজনৈতিক বিপ্লব দমনকল্পে শিখ সর্দ্দারগণ, পাঞ্জাবী জমিদার ও প্রধান ব্যক্তিগণ সরকারকে বিশেষভাবে সাহায্য করিয়াছিলেন। তাঁহাদের সাহায্য ব্যতীত কেবল পুলিসের পক্ষে এরূপ ভাবে কাজ করা সম্ভব হইত কি না সন্দেহ।
রাসবিহারী লাহোরে বিদ্রোহ জাগরণে অসমর্থ হইয়া ১৯১৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসেই ছদ্মবেশে দেশত্যাগী হইলেন। রাসবিহারীর নামে গ্রেপ্তারের পরোয়ানা ছিল। তথাচ সমস্ত বাধা অতিক্রম করিয়া তিনি পুলিসকে ফাঁকি দিলেন। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ জাপান যাইতেছেন। রাসবিহারী P.N. Tagore নাম লইয়া ও রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় বলিয়া নিজের পরিচয় দিয়া, তাঁহার পূর্বে জাপানে গিয়া ব্যবস্থাদি করিতে হইবে এই অজুহাতে ছাড়পত্র প্রভৃতি লইয়া চিরকালের জন্য দেশত্যাগী হইলেন। রাসবিহারীর জাপান পৌঁছাইবার এক মাস পরে বৃটিশ সরকার যখন বুঝিলেন তিনি জাপানে আছেন, তখন জাপান সরকারকে বৃটিশ সরকার তাঁহাকে ভারতে পাঠাইয়া দিবার অনুরোধ করেন। জাপান সরকারও ইহাতে রাজী হন।
সেই সময় একদিন রাসবিহারী জাপানী পোষাক পরিয়া ছদ্মবেশে রাস্তায় বাহির হন। সেই রাত্রে বেশ তুষারপাত হইয়াছিল। পথগুলি তখনও বরফে আবৃত ছিল। রাসবিহারী গলিপথ ধরিয়া তদানীন্তন এক মামুলী মন্ত্রীর গৃহে উপস্থিত হন। মন্ত্রিকন্যা তাঁহাকে সাদর সম্ভাষণ করেন। তিনি মন্ত্রিকন্যার সহিত যখন চা-পান করিতেছিলেন তখন জানিতে পারিলেন যে, দরজায় পুলিস দাঁড়াইয়া আছে। রাসবিহারী বুঝিলেন, এবার তাঁহাকে বুঝিয়া কাজ করিতে হইবে। তিনি ভাল করিয়াই জানিতেন, যদি তিনি ধৃত হন তবে মৃত্যু সুনিশ্চিত।
পিছন দরজা দিয়া তিনি মন্ত্রিকন্যার সহিত নিকটস্থ ঘেইসা বালিকাদের আড্ডায় গিয়া তাহাদের পোষাক পরিধান করিয়া এবং পরচুল লাগাইয়া ঘেইসা বেশে থাকিতে লাগিলেন। তাঁহাকে ছয় মাস কাল জাপানী পুলিস খুঁজিয়া পায় নাই। অবশেয়ে তিনি ব্লেক-ড্রেগনদের সাহায্যে জাপানী প্রজা হইতে সক্ষম হন। ইহারা জাপান সরকারের বিরুদ্ধবাদী দল।
তিনি ঐ অঞ্চলের বিপ্লবীদের সংঘবদ্ধ করিলেন এবং চীনদেশস্থ জার্ন্মাণদিগকে তাঁহার অভিপ্রায় জ্ঞাপন করিলেন। সাংহাই-এর জার্ম্মাণ কন্সালের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া ভারতীয় বিপ্লবীদের কর্তব্য সম্বন্ধে অনেক পরামর্শ করিলেন। ১৯১৫ সালের অক্টোবর মাসে সাংহাইতে একজন চীনার দ্বারা অনেকগুলি পিস্তল ও টোটা ভারতের বিপ্লবে সহায়তার জন্য প্রেরণ করেন। কিন্তু বৃটিশ পুলিস সন্ধান পাইয়া উহা বাজেয়াপ্ত করে। বৃটিশ সরকারের অনুরোধক্রমে জাপ সরকার তাঁহাকে পাঁচদিনের মধ্যে সাংহাই ত্যাগ করিতে বাধ্য করেন। অতঃপর তিনি আট বৎসর আত্মগোপন করিয়া ছিলেন।
ইহার পর তিনি জাপানে “ভারতীয় স্বাধীনতা লীগ” প্রতিষ্ঠা করিয়া উহা পরিচালনা করেন। ভারতবর্ষ সম্বন্ধে তিনি জাপানী ভাষায় পাঁচখানা গ্রন্থ লিখিয়াছেন এবং ডাঃ সাণ্ডারল্যাণ্ড লিখিত “ইণ্ডিয়া ইন বণ্ডেজ” পুস্তক জাপভাষায় অনুবাদ করিয়াছেন। জাপ-ভাষায় তিনি একখানা সংবাদপত্র পরিচালনা করেন। উক্ত সংবাদপত্রে ভারত সম্পর্কে জাপ সংবাদপত্রসমূহেও বহু প্রবন্ধ লিখিয়াছেন এবং জাপানীদের নিকট বহু বক্তৃতাও করিয়াছেন। মহাযুদ্ধ আরম্ভ হইবার পূর্ব্বে টোকিওতে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি অর্থসংগ্রহের কাজে লাগিয়া যান।
১৯৪২ সালের ১৫ই ফেব্রুযাবী সিঙ্গাপুরের পতন হয়। বৃটিশ সৈন্যগণ পূর্ব্বাহ্ণেই পলায়ন করেন, কিন্তু ভারতীয় সৈন্যদলকে কিছু না জানাইয়া তাঁহাদের অনিশ্চিত ভাগ্যের উপর ফেলিয়া রাখা হয়। ব্রিটিশ সমর-অধিনায়কগণের আদেশে সিঙ্গাপুরের সমস্ত ভারতীয় সৈন্য বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেন।
এই সকল ভারতীয় সৈন্য ও প্রবাসী ভারতীয়গণকে যাহাতে জাপানীদের পক্ষে যুদ্ধে লাগাইতে পাবেন সেই হিসাবে মেজর ফুজিয়াবা ইঁহাদের নেতৃবৃন্দকে একটি সংঘ গঠন করিতে বলেন। ইঁহারা ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতাকে মূলমন্ত্ররূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং জাপানের তাঁবেদার হিসাবে গণ্য হইতে অস্বীকার করেন। ইহার পর মার্চ্চ মাসের শেষে রাসবিহারীর সভাপতিত্বে টোকিওতে এক সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনে কয়েকটি প্রস্তাবের মধ্যে একটিতে বলা হয়—পূর্ব্ব-এশিয়াপ্রবাসী ভারতীয়গণের পক্ষে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইহাই প্রকৃষ্ট সময়। এতদ্বারা গঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজ কেবল সামরিক প্রয়োজনে জাপানের নিকট হইতে নৌবল ও বিমানবল প্রভৃতি চাহিতে পারিবে। ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র রচনা করিবার অধিকার একমাত্র ভারতীয় নেতৃবৃন্দেরই থাকিবে এবং ভারতের জাতীয় কংগ্রেসই সেই অধিকারের মালিক।
জুন মাসে ব্যাঙ্ককেও একটি প্রতিনিধি সম্মেলনে আজাদ হিন্দ আন্দোলনের মূল নীতি নির্ধারিত হয়। এই সম্মেলন হইতে গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে আজাদ হিন্দ সংঘ গঠিত হয়। ইহার সভাপতি হন রাসবিহারী বসু। ভারতীয়গণের এই স্বাধীন প্রচেষ্টা জাপান কিছুতেই প্রীতির চক্ষে দেখিতে পারে নাই। বরঞ্চ সাম্রাজ্যবাদী জাপানের মনেও ভীতি ও আতঙ্কের সৃষ্টি হইয়াছিল। পাছে সম্রাজ্যবাদের ক্ষতি হয় এই জন্য জাপান অচিরেই এই সংঘ-গঠিত সৈন্যবাহিনী ভাঙ্গিয়া দেয়।
১৯৪৩ সালের ২রা জুলাই সুভাষ চন্দ্র সিঙ্গাপুর পৌঁছেন। পুনরায় তিনি ২নং আজাদ হিন্দ ফৌজ সংগঠন করিবার নিমিত্ত ৪ঠা জুলাই এক সম্মেলন আহ্বান করেন। তাহাতে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন এবং সকল আন্দোলনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সংঘ গঠিত পরিষদে রাসবিহারী বসু তাঁহার প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন।
“রাজদ্রোহ কমিটি” সুপারিশ করিয়াছিলেন যে, শ্রীযুত বসু ভারতে প্রত্যাবর্ত্তন করামাত্র তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিতে হইবে। তিনি বাস্তবিক নির্ব্বাসিতের জীবন যাপন করিতেছিলেন। তাঁহার মৃত্যুতে একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বিপ্লবীর জীবনের অবসান ঘটিয়াছে।
রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ
রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ সুরসানের রাজা বাহাদুর ঘনশ্যাম সিংহের পুত্র। ১৮৮৬ সালে তাঁহার জন্ম হয়। রাজা ঘনশ্যাম সিংহের নিকট-আত্মীয় হাথরাসের রাজা হরনারায়ণ সিংহের কোন পুত্র ছিল না। এইজন্য ঘনশ্যাম সিংহ হাথরাসের রাজা হরনারায়ণ সিংহের নিকট মহেন্দ্র প্রতাপকে আড়াই বৎসর বয়সের সময় পোষ্যরূপে দান করেন এবং হরনারায়ণও আনন্দের সহিত মহেন্দ্র প্রতাপকে দত্তকপুত্ররূপে গ্রহণ করেন।
হাথরাসের রাজা নিজ রাজ্য হাথরাস ছাড়িয়া বৃন্দাবনধামে বাস করিতেই ভালবাসিতেন। তিনি বৃন্দাবনে যমুনার তীরে কেলীঘাট নামক স্থানে এক বিরাট প্রাসাদ নির্মাণ করেন। রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ পিতার সহিত এই বৃন্দাবনেই খেলা করিতেন, বেড়াইতেন, যমুনার নীল জলে সাঁতার কাটিতেন। পরবর্তী জীবনে তিনি ভাল সাঁতার কাটিতে পারিতেন বলিয়া খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন। উপযুক্ত গৃহশিক্ষকদের উপর তাঁহার বিদ্যাশিক্ষার ভার পড়ে। বাড়ীতে যখন পড়িতেন, তখন তিনি বীরপুরুষদের সম্বন্ধেই বেশী করিয়া পড়িতেন। খেলাধুলার মধ্যেও তাঁহার বীরত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁহার খেলার সাথী ছিল অনেক। তিনি ছিলেন তাহাদের নায়ক। শৈশবে খেলার ছলে তিনি সাজিতেন নেপোলিয়ান আর সবাই সৈন্য সাজিয়া তাঁহার হুকুম তামিল করিত। হুকুম চালাইবার এবং সেই হুকুমকে কার্য্যে পরিণত করিবার অসাধারণ ক্ষমতা তিনি বাল্যকালেই লাভ করিয়াছিলেন।
মহেন্দ্র প্রতাপের বয়স যখন সাড়ে নয় বৎসর তখন তাঁহার পিতার মৃত্যু হয়। পিতার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত রাজ্য এবং তাঁহার ভার কোর্ট অব ওয়ার্ডসের হাতে চলিয়া যায়। তিনি হাইস্কুলে পড়িতে আরম্ভ করেন এবং ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। পরে আলিগড় কলেজ হইতে এফ, এ, পাশ করিয়া তিনি বি, এ, শ্রেণীতে ভর্তি হন। এই সময় কলেজের ইংরাজ প্রিন্সিপ্যালের কোন অন্যায় কার্য্যের জন্য কলেজের সমস্ত ছেলেরা ধর্মঘট করে, তাহাদের মধ্যে রাজা মহেন্দ্র প্রতাপও ছিলেন। তিনি ছিলেন ইহাদের অন্যতম নায়ক। কলেজের ধর্মঘটের অবসান হইল। কিন্তু মহেন্দ্র প্রতাপ আর কলেজে গেলেন না। কলেজের পড়া সেই হইতেই শেষ হইল।
বিবাহ ও ইউরোপ ভ্রমণ
রাজা মহেন্দ্র প্রতাপের বয়স যখন সবেমাত্র ষোল বৎসর, তখন প্রসিদ্ধ ঝিন্ধ রাজ্যের তৎকালীন রাজার ছোট ভগ্নীর সহিত তাঁহার বিবাহ হয়। বিবাহের দুই বৎসর পর তাঁহার ইউরোপ ভ্রমণের ইচ্ছা হয়। পূর্ব-পশ্চিমের জ্ঞানবিজ্ঞানের একটা সমন্বয় তৃষ্ণা তাঁহার প্রাণকে উতল করিয়া তুলিয়াছিল। পশ্চিমের যাহা কিছু ভাল, তাহা গ্রহণ করিতে এবং ভারতের সনাতন সত্যের প্রচার করিতেই তিনি বাহির হইয়াছিলেন। এইজন্য তিনি ১৮ বৎসর বয়সে স্ত্রীকে সঙ্গে লইয়া য়ূরোপ ভ্রমণে বাহির হন।
য়ূরোপে নানা দেশ ভ্রমণ করিবার সময় তিনি নানাপ্রকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। সেখানে তিনি দেখিলেন যে, যাহারা স্কুল-কলেজে পড়ে তাহাদের সে পড়া ব্যর্থ হয় না। য়ূরোপের শিক্ষার সুন্দর ব্যবস্থা দেখিয়া তাঁহার মনে হইল দেশে গিয়া সেই আদর্শে বিদ্যালয় স্থাপন করিবেন এবং সেখানে পুঁথিগত ও কারিগরী শিক্ষার ব্যবস্থা। তাঁহার এই প্রেরণার ফলেই বৃন্দাবনের প্রেমমহা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত। তাঁহার পত্নীর নাম প্রেমমহা। তাঁহারই নামানুসারে এই বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়।
১৯০৯ সালের মে মাসে তিনি তাঁহার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য প্রভৃতি দেশের বরেণ্য জননায়কবর্গকে আমন্ত্রণ করিয়া এক সভার অনুষ্ঠান করেন। সভার সভাপতি ছিলেন পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য। সভায় তিনি বলেন যে, তাঁহার একটি পুত্র হইয়াছে এবং সেই পুত্র হইল এই বিদ্যালয়। তিনি এই বিদ্যালয়ের জন্য তাঁহার সমস্ত সম্পত্তি দান করিতে চাহেন। তাঁহার সমস্ত সম্পত্তি দান করিতে সকলে তাঁহাকে নিষেধ করিলেন। অবশেষে তিনি তাঁহার সমস্ত সম্পত্তি দান না করিয়া প্রায় দশ লাখ টাকা মূল্যের পাঁচখানা গ্রাম বিদ্যালয়কে দান করেন। সঙ্গে সঙ্গে বৃন্দাবনের রাজপ্রাসাদও বিদ্যালয়কে দিয়া দিলেন। পরে নানা বাধাবিঘ্ন আসিতে পারে—এইজন্য যাহা দান করিলেন, তাহা বিদ্যালয়ের নামে রেজিষ্টারী করিয়া দিলেন। ইহাই প্রেমমহা বিদ্যালয় স্থাপনের ইতিহাস।
বিদ্যালয় স্থাপন হইতেই তিনি বিদ্যালয়ের কর্ণধার ছিলেন এবং অবৈতনিকভাবে শিক্ষকতাও করিয়াছেন। শিশুশিক্ষার প্রতি তাঁহার খুব দৃষ্টি ছিল। তখন এদেশে বর্তমান পদ্ধতির শিশুশিক্ষা আরম্ভ হয় নাই। তবু বহু পুরাতন কিণ্ডারগার্টেন পদ্ধতি দ্বারা তিনি শিশুদিগের মন গড়িয়া তুলিলেন। ছেলেদের লইয়াই তিনি বেশী সময় অতিবাহিত করিতেন। তারপর তাঁহার অবশিষ্ট সম্পত্তির আয় হইতেও গুপ্তভাবে তিনি বিদ্যালয়কে সাহায্য করিতেন এবং গরীব বিদ্যার্থীকে সাহায্য করিতেন। তিনি সাধারণ শিক্ষকের মত শিক্ষকতা করিতেন। ছেলেদের মনে উৎসাহ দিবার জন্য প্রাণে নূতন ভাব সৃষ্টি কবিবার জন্য তিনি নানা স্থানে ছেলেদের লইয়া যাইতেন। স্থানে স্থানে বনে জঙ্গলে পাহাড়ে গিয়া তাঁবু পাতিয়া ছেলেদিগকে প্রকৃতির সহিত পরিচয় করাইতেন এবং তাহার সমস্ত খরচ নিজেই বহন করিতেন।
১৯২১ সালের প্রারম্ভে ভারতে যে অসহযোগের বিরাট আন্দোলন আরম্ভ হয় এবং মহাত্মা গান্ধী যাহার নায়ক, সেই অসহযোগের কথা রাজা মহেন্দ্র প্রতাপের হৃদয়ে প্রায় ৩৬/৩৭ বৎসর পূর্বে প্রথম স্থান পাইয়াছিল। তিনি তাঁহার সমস্ত অস্ত্রশস্থ সরকারকে ফিরাইয়া দিয়াছিলেন। ডাক্তারী প্রভৃতি বিদেশী ঔষধ ব্যবহারের তিনি পক্ষপাতী ছিলেন না। আয়ুর্ব্বেদকে তিনি খুব উচ্চ স্থান দিতেন। সরকারের সহিত সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করিয়া তিনি তাঁহার নিজের আদর্শ অনুসারে—জাতির আদর্শ অনুসারে চলিয়াছিলেন।
দাতা হিসাবে রাজা মহেন্দ্র প্রতাপের স্থান অনেক উচ্চে। তাঁহার ছোট ছোট দানের অন্ত ছিল না। অনেকে জানিতেই পারিত না—কে তাহাকে দান করিলেন, এমন ছিল তাঁহার দানের রীতি।
এক সময় যুক্তপ্রদেশের আর্য্যসমাজের গুরুকুল ফরক্কাবাদে ছিল। কিন্তু সবার ইচ্ছা ছিল উহা বৃন্দাবনে তুলিয়া আনা হউক। বৃন্দাবনে কেহ আর্য্যসমাজীদের জমি দিতে স্বীকার করিল না। তখন তিনি বিনাসর্তে বৃন্দাবন সহরের বাহিরের কয়েকটি বাগান ও জমি দান করিলেন। ঐ জমির মূল্য হইবে ১৫০০০৲ টাকা।
বর্তমানে হিন্দু সমাজে যে সব কুসংস্কার আছে, রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ তাহা দূর করিবার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করিয়াছেন। কেবল বক্তৃতাতেই অস্পৃশ্যতা বর্জন হয় না, তাই তিনি মেথরদের সহিত একত্র বসিয়া আহার করেন।
বহু সাম্যবাদীর সহিত তাঁহার আলাপ-আলোচনা হয়। তবে তাঁহারা বর্তমান যুগের সাম্যবাদী নহেন। তাঁহাদের সহিত আলাপ-আলোচনার পর কেবলই ভাবিতেন, ভারতের মুক্তি কোন্ পথে?
১৯১২ সালে তিনি পুনরায় ইউরোপ ভ্রমণ করিয়া ফিরিয়া আসিয়া প্রেমমহা বিদ্যালয়ের ভিতর দিয়া সংগঠনকার্য্য আরম্ভ করেন। তিনি বুঝিয়াছিলেন, ভারতের স্বাধীনতা লাভ করিতে হইলে জনগণকে জাগাইয়া তুলিতে হইবে। কিছু কাল দেশে থাকিবার পর যখন তিনি জানিতে পারিলেন যে, ইউরোপে যুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছে সেই দিনই তিনি য়ুরোপ যাত্রার জন্য তৈয়ার হইলেন। ইহা তাঁহার তৃতীয়বার য়ুরোপ যাত্রা।
মহেন্দ্র প্রতাপ যুদ্ধের সময় নানাদেশ ঘুরিয়া নানাদেশের সহায়তা লইতে চেষ্টা করিতেছিলেন; এই জন্য জার্ম্মাণীর কাইজারের নিকট হইতে চিঠি লইয়া তুরস্ক হইয়া আফগানিস্থানে আসেন এবং আমীরের সহিত আলোচনা করেন। পরে আবার জার্ম্মাণীতে ফিরিয়া যান।
সেই হইতে ভারত সরকার অন্যান্য বহু লোকের সহিত মহেন্দ্র প্রতাপের ভারত আগমন বন্ধ করিয়া দেন। তিনি আফগানিস্থানের নাগরিক অধিকার লাভ করিয়াছিলেন। আফগানিস্থানের আমীর তাঁহাকে খুব ভালবাসিতেন। আমীর আমানুরা তাঁহার বন্ধু ছিলেন। আফগানিস্থানের এজেণ্ট হিসাবে তিনি পৃথিবীর নানাদেশ পর্যটন করিয়াছিলেন।
বার্লিনে অবস্থানকালে “World Federation” নামক একখানা ইংরেজী কাগজ তিনি সম্পাদনা করিতেন।
তিনি ভারতের নানা ইংরেজী কাগজে প্রবন্ধ লিখিতেন। মহাত্মা গান্ধীর সহিত তাঁহার রীতিমত পত্র ব্যবহার হইত। “Young India” পত্রেও তিনি অনেক প্রবন্ধ লিখিয়াছেন।
তাঁহার যে রাজনৈতিক মত তাহা তিনি তাঁহার এক বন্ধুর পত্রের জবাবে “World Federation” পত্রে ব্যক্ত করিয়া জানাইয়াছিলেন যে, প্রত্যেক ভারতবাসীরই কংগ্রেসে যোগদান করা উচিত এবং কংগ্রেসের আদর্শ অনুসারে উহার অনুজ্ঞা পালন করা উচিত।
প্রেমমহা বিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশ করিয়া তিনি লিখিয়াছিলেন, “আমার ধর্ম্ম প্রেমধর্ম্ম, যদি আমি হিন্দু হই—তবে আমি মুসলমান, বৌদ্ধ ও খৃষ্টান।”
বহুদিন তাঁহার বিশেষ কোনও সংবাদ পাওয়া যায় নাই। মস্কো, কাবুল প্রভৃতি স্থানে তিনি আছেন বলিয়া শুনা যাইত। পরে সংবাদ পাওয়া যায় যে, জাপানে আছেন। টোকিও এবং কোবেস্থিত বৃটিশ বাণিজ্য দূতাবাসের কর্ম্মচারিগণ যখন তাঁহার কার্য্যকলাপ সম্পর্কে ঔৎসুক্য প্রকাশ করিতে আরম্ভ করেন, তখন তিনি তাহার প্রতিবাদ করিয়া বলেন যে, তিনি আফগানিস্থানের প্রজা।
অতঃপর হনোলুলুতে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করিয়া তিনি পৃথিবীর সমস্ত জাতিকে লইয়া একটি রাষ্ট্র-সমবায় গঠনের উদ্দেশ্যে একটি নূতন কার্য্যে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁহার এই নূতন পরিকল্পনা সম্পর্কে বহু পুস্তক-পুস্তিকা প্রকাশিত হয় এইং এ সম্পর্কে নানারূপ মন্তব্য করা হয়। আর্য্যবাহিনী নামে পরিচিত ভারতীয়গণের সভাপতিরূপেই তাঁহাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
জেনারেল ম্যাক আর্থার যে ৩৯ জন লোককে গ্রেপ্তার করিবার আদেশ দিয়াছেন রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ তাঁহাদের অন্যতম। যুদ্ধবন্দী হিসাবে তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিবার আদেশ দেওয়া হয়। সম্প্রতি তিনি মুক্তিলাভ করিয়াছেন। তাঁহাকে ভারতে ফিরাইয়া আনার প্রচেষ্টা হইতেছে।
দীর্ঘ এবং শীর্ণকায় রাজা মহেন্দ্র প্রতাপের মুখমণ্ডল গুম্ফ এবং শ্মশ্রুমণ্ডিত। তিনি চশমা পরিয়া থাকেন। বর্ত্তমানে তাঁহার বয়স ৬০ বৎসর হইবে।
কর্ণেল জগন্নাথ রাও ভোঁসলে
যে বংশে ইতিহাস বিখ্যাত মহারাষ্ট্রনায়ক বীরশ্রেষ্ঠ শিবাজী জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, কর্ণেল জগন্নাথরাও সেই গৌরবদীপ্ত ভোঁসলে কুলোদ্ভব। মহারাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে ‘শান্তবাদীর’র নিকটবর্তী তিরোদ গ্রামে তিনি ১৯০৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন।
‘শান্তবাদী’তে মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণের পর জগন্নাথরাও দেরাদুনের প্রিন্স অফ ওয়েলস সামরিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। দেরাদুনের শিক্ষা সমাপনান্তে তিনি ১৯২৭ সালে ইংলণ্ডের ‘স্যাণ্ডহার্ষ্ট’ সামরিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। সর্ববিষয়ে পারদর্শিতার জন্য তিনি সকলেরই প্রশংসা ভাজন হন। ১৯২৮ সালে ভোঁস্লেজী কোয়েটাতে অবস্থিত ল্যাঙ্কাশায়ার’ রেজিমেণ্টে যোগদান করেন। এক বৎসর পর তাঁহাকে রাজকীয় মারহাট্টা পদাতিক দলে বদলি করা হয়।
১৯৩০ সালে জগন্নাথরাও লেফটেন্যাণ্ট এডজাটাণ্টের পদে উন্নীত হন এবং কনৌরে অবস্থান করিতে থাকেন। এইখানেই তিনি সমুদ্রে নিমগ্নপ্রায় দুইটি উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ কর্মচারীকে মৃত্যুর কবল হইতে রক্ষা করেন। তাঁহার এই বীরত্বের জন্য তিনি অকুণ্ঠ প্রশংসার অধিকারী হন এবং সম্রাট তাঁহাকে একটি পদকে ভূষিত করেন।
১৯৩৪ সালে ভোঁস্লে কাপ্টেন হন এবং সম্রাটের মুকুটোৎসবে যোগদানের দুষ্প্রাপ্য সুযোগ পান। ইংলণ্ড হইতে প্রত্যাবর্তন করিবার পর তিনি সৈন্যাপত্য শিক্ষাকার্য্যের জন্য নির্বাচিত হন। এই স্থলে উল্লেখযোগ্য যে, ভারতবাসীদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম এই মনোনয়ন লাভ করিতে সমর্থ হন। এই শিক্ষা শেষ হইলে ভোঁস্লেকে বেরিলীতে সেনাধিনায়ক মণ্ডলীর অন্তর্গত পদবিশেষে নিযুক্ত করা হয়। অতঃপর তাঁহাকে লেফটেন্যাণ্ট কর্ণেলরূপে সিঙ্গাপুরে পাঠান হয়।
বিবরণে প্রকাশ, সিঙ্গাপুরের দূরবস্থার পর ভোঁস্লে আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগদান করেন এবং সৈন্যাধ্যক্ষরূপে সর্বোচ্চ পদে তিনি অভিষিক্ত হন। তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের জন্য সহস্র সহস্র অফিসারকে শিক্ষিত করিয়া তোলেন। তাঁহাকে ব্যাঙ্ককে গ্রেপ্তার করা হয় এবং সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, তাহাকে দিল্লীর ‘লালকেল্লায়’ বন্দী জীবন কাটাইতেছেন।
জগন্নাথরাও ঐতিহাসিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিজাত সর্দার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। গত মহাযুদ্ধে এবং এই মহাযুদ্ধেও তাঁহার অনেক আত্মীয় সাহস ও বিক্রমের পরিচয় দিয়াছেন। তাঁহার একটি আত্মীয় গোয়ালিয়র রাজ্যের উচ্চপদস্থ সামরিক আফিসারের পদে অধিষ্ঠিত আছেন। কাপ্টেন ভোঁস্লে সিন্ধিয়ার বর্তমান শাসকেরও আত্মীয়।
তাঁহার পত্নী চাঁদকিনোবাঈও অভিজাত পরিবার সম্ভূত। বরোদা, কোলাপুর, শান্তবাদী, প্রভৃতি কয়েকটি দেশীয় রাজ্যের নৃপতির সহিত তাঁহার আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। জগন্নাথরাওএর তিনটী কন্যা বর্তমান—জ্যেষ্ঠের বয়স ১১ বৎসর। তাঁহার স্ত্রী ও কন্যারা বর্তমানে বরোদাতে বাস করিতেছেন।
জগন্নাথরাওয়ের পেশীবহুল বলিষ্ঠকায় আকৃতি সৈন্যোপজীবিকার পক্ষে বিশেষ উপযোগী। মহৎ-চরিত্র ও সরল ব্যবহারের গুণে তিনি সকলেরই প্রিয়। মহারাষ্ট্র ভাষা ছাড়া উর্দু ও ইংরাজী ভাষার উপবও তাঁহার বেশ অধিকার আছে। তিনি একজন বিশিষ্ট ক্রীড়ামোদী। সৈনিক জীবনে তিনি খেলা-ধূলায় পারদর্শিতা দেখাইয়া বহু পদক লাভ করিয়াছিলেন। ক্রিকেট তাঁহার প্রিয় খেলা।
জগন্নাথরাওএর ৮৫ বৎসর বয়স্কা বৃদ্ধা মাতা গঙ্গাবাঈ তাঁহার বীর সন্তানের সহিত মিলিত হইবার জন্য গৃহদেবী ভবানীর নিকট প্রার্থনা করিয়া শান্তবাদীতে কালাতিপাত করিতেছেন। বৃদ্ধা মাতার এই আকুল কামনা কি পূর্ণ হইবে না?
লেঃ কর্ণেল ডাঃ লক্ষ্মী স্বামীনাথন
ডাঃ লক্ষ্মী স্বামীনাথন ১৯৩৭ সালে মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজ হইতে ভৈষজ্য ও শল্য শাস্ত্রে ডিগ্রী লাভ করেন। অতঃপর ১৯৪২ সালে তিনি সিঙ্গাপুর গমন করেন। তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগদান করিয়া উহার অন্তর্ভুক্ত নারীবাহিনী গঠন করেন। তিনি লেঃ কর্ণেল পদে উন্নীত হইয়া “ঝাঁসীর রাণী” বাহিনীর অধিনায়কত্ব করেন। সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম নেত্রী ঝাঁসীর রাণীর নামানুসারে উক্ত বাহিনীর নামকরণ করা হয় এবং মালয়ে অবস্থিত ভারতীয় পরিবার হইতে উক্ত বাহিনীর জন্য নারীদের সংগ্রহ করা হয়। তাহারা অস্ত্র প্রয়োগের কৌশল ও যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা করে। ব্রহ্মে জাপানীদের পতনের পর এই নারী বাহিনীর অস্তিত্ব লোপ পায়। অতঃপর শ্রীমতী লক্ষ্মী কিছুকাল কালেওয়ায় এবং পরে রেঙ্গুনে ইউনাইটেড ফার্ম্মেসীতে আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্যদের মধ্যে চিকিৎসক হিসাবে কাজ করেন। তিনি বৃটিশ কর্তৃপক্ষের নিকট পরে আত্মসমর্পণ করেন। ঝাঁসীর রাণী বাহিনীর অধিনায়িকা লেঃ কর্ণেল লক্ষ্মী স্বামীনাথনের বয়স ৩২ বৎসর। তাঁহার পিতা একজন বিখ্যাত ব্যারিষ্টার ছিলেন এবং তাঁহার মাতা শ্রীযুক্তা আম্মু স্বামীনাথন ভারতবর্ষে সুপরিচিত। এই বীরাঙ্গনা বাল্যে ঐশ্বর্য্যের ক্রোড়ে লালিতপালিত হইলেও নানারূপ বিদ্যার ও কলার্চ্চার প্রতি তাঁহার অনুরাগ ছিল এবং তিনি বেশভূষা হইতে আরম্ভ করিয়া, এমন কি কথাকলি নৃত্যের আঙ্গিক পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করিতে পারিতেন। তিনি ক্রীড়ামোদী ছিলেন এবং টেনিস ও পিংপং খেলিতে ভালবাসিতেন। মোডিক্যাল কলেজ হইতে ডাক্তারী পাশ করিবার পর তিনি মাদ্রাজ ফ্লাইং ক্লাবের শিক্ষক বাঙ্গালোর নিবাসী বিমানচালক জনৈক ব্রাহ্মণযুবকের সহিত পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হইতে মনস্থ করেন। কিন্তু শীঘ্রই গতানুগতিক গার্হস্থ্য-জীবনের আকর্ষণ তাঁহার কাছে নিষ্প্রভ হইয়া যায়। তিনি নিস্তরঙ্গ ও নিরাপদ জীবন যাপনের মোহ কাটাইয়া বিপদসঙ্কুল বৃহত্তম জীবনের সহিত পরিচিত হইবাব জন্য বাহির হইয়া পড়েন এবং ১৯৪০ সালে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা ব্যবসায় আরম্ভ করেন।
বহুগুণবিভূষিতা শ্রীমতী লক্ষ্মী মাদ্রাজে তাঁহার প্রোজ্জ্বল দেশপ্রেমের জন্য খ্যাত ছিলেন। তাঁহার কংগ্রেসানুরাগ সুবিদিত ছিল। কংগ্রেস নির্ধারিত দিবসগুলি তিনি নিষ্ঠার সহিত পালন করিতেন এবং ত্রিবর্ণ রঞ্জিত জাতীয় পতাকা তাঁহার গৃহে উত্তোলন করিতেন। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু কয়েকবার শ্রীমতী লক্ষ্মীর বাসায় বেড়াইতে গিয়াছিলেন এবং গৃহস্থ অধিবাসীদের নৈষ্টিক দেশপ্রেম দর্শনে তিনি মুগ্ধ হইয়াছিলেন। জাপান কর্তৃক সিঙ্গাপুর অধিকৃত হইবার প্রাক্কালে শ্রীমতী লক্ষ্মীকে স্থান ত্যাগ করিতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তিনি ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ইহার পর কিছুদিন আর তাঁহার সম্পর্কে কোন সংবাদ পাওয়া যায় না।
অতঃপর একদিন সাইগল রেডিও হইতে বিজ্ঞাপিত হয় যে, শ্রীমতী লক্ষ্মী মালয়ে যে অস্থায়ী গবর্ণমেণ্ট প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে সেই গবর্ণমেণ্টের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছেন। অতঃপর তাঁহার নেতৃত্বে “ঝাঁসীর রাণী” এই নামে নারী যোদ্ধৃ বাহিনী গঠিত হয়।
১৯৪৫ সালের অক্টোবর মাসে শান ষ্টেটে কালওয়া নামক স্থানে বার্মা রক্ষা আইনে তাঁহাকে অন্তরীণ করা হয়। ১৯৪৬ সালে ৩রা মার্চ্চ বর্ম্মা হইতে দমদম বিমান ঘাঁটিতে আনার পর মুক্তি দেওয়া হয়। অপূর্ব বীরত্ব ও দুঃসাহসিক প্রচেষ্টার জন্য লেঃ কর্ণেল লক্ষ্মীর নাম পৃথিবীর মুক্তিলিপ্সু বীরাঙ্গনাদের তালিকায় চিরউজ্জ্বল থাকিবে।
মেজর জেনারেল শাহ নওয়াজ
মেজর জেনারেল শাহ নাওয়াজ রাওয়ালপিণ্ডীর বিখ্যাত জানজুয়া রাজপুত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতা জানজুয়া সম্প্রদায়ের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন; তিনি ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে দীর্ঘ ত্রিশ বৎসরকাল কার্য্য করিয়াছিলেন।
প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে শাহ নওয়াজের পরিবারস্থ প্রত্যেক সক্ষম ব্যক্তিই সৈন্যবাহিতে যোগদান করিয়াছিলেন, এবং তাঁহাদের পরিবারভুক্ত স্বজনগণের মধ্যে ন্যূনকল্পে আশীজন ব্যক্তি বর্তমানে ভারতীয় সামরিক বিভাগের অফিসাররূপে কার্য্য করিতেছেন। এক কথায় বলিতে গেলে একটি সুবিদিত রাজভক্ত পরিবারে শাহ নওয়াজের জন্ম। তিনি রয়েল ইণ্ডিয়ান মিলিটারী কলেজে অধ্যয়ন করিতেন। ১৯৩১ খৃষ্টাব্দে তিনি আই, এম, এস, পরীক্ষায় সগৌরবে উত্তীর্ণ হইয়া বিশেষ বিশেষ বৃত্তি লাভ করেন ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে চতুর্দ্দশ পাঞ্জাবে রেজিমেণ্টের প্রথম বাহিনীতে নিযুক্ত হন।
১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে ফিরোজপুর শিক্ষা কেন্দ্র ত্যাগ করিয়া তিনি মালয়ের একটি সৈন্যবাহিনীতে যোগদানের জন্য আদিষ্ট হন, উক্ত সৈন্যবাহিনীর সহিত ১৯৪২ খৃঃ ২৯শে জানুয়ারী তিনি সিঙ্গাপুর উপনীত হন। কিন্তু সিঙ্গাপুর যুদ্ধের অবস্থা তখন চরমে পৌঁছিয়াছে। শাহ নওয়াজ স্বভাবতঃ এত নির্ভীক ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে তিনি সেই চরম অবস্থা বিপর্য্যয়ের মধ্যেও জাপানের বিরুদ্ধে সমানভাবে যুদ্ধ চালাইয়া যাইবেন স্থির করিয়াছিলেন; পশ্চাৎ অপসরণের কল্পনাও করেন নাই। অথচ তাঁহার দক্ষিণ ও বাম পার্শ্বস্থ সৈন্যবাহিনীর ব্রিটিশ অধিনায়কগণ সঙ্কট উপলব্ধি করিয়া তৎপরতার সহিত পূর্ব্বেই পলায়ন করেন।
১৯৪২ খৃঃ ১৬ই ফেব্রুয়ারী সকালে জাপ অধিনায়ক মেজর ফুজিয়ারার নিকট তাঁহাদের বাহিনী আত্মসমর্পণ করেন। পরে মেজর ফুজিয়ারা এই ভারতীয় বাহিনীর সর্ব্ববিধ দায়িত্ব সর্ব্বাধিনায়ক মোহন সিংএর হস্তে সমর্পণ করেন। ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের সহিত শাহ্ নওয়াজের সাক্ষাৎ হয়। মেজর জেনারেল শাহ্ নওয়াজ তাঁহার কর্ম্মজীবনের বিবৃতি প্রসঙ্গে বলিয়াছেন যে নেতাজীয় সহিত আমার সাক্ষাৎএর পূর্ব্বে আমি কেবল সামরিক শিক্ষাই লাভ করিয়াছিলাম; রাজনীতি বা অন্যান্য বিষয়ে আমার বিশেষ কোন জ্ঞান ছিল না। শৈশব হইতে যে পারিপার্শ্বিক আবেষ্টনের মধ্যে আমি প্রতিপালিত হইয়াছিলাম তাহাতে আমার মানসিক বৃত্তিগুলি একজন তরুণ ইংরাজ অফিসারের মতই গঠিয়াছিল এবং আমি ভারতবর্ষকে ইংরাজের দৃষ্টি লইয়াই দেখিতে শিখিয়াছিলাম, কিন্তু নেতাজীর সংস্পর্শে আসিয়া আমার দৃষ্টিপথ হইতে সে স্বপ্নের কাজল মুছিয়া গেল। দাসত্বের মোহমুক্ত দৃষ্টি মেলিয়া আমি প্রথম আমার জন্মভূমিকে ভারতবাসীর দৃষ্টি লইয়া দেখিলাম।”
দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্ত্তনের সঙ্গে সঙ্গে মেজর জেনারেল শাহ্ নওয়াজের জীবনে এক অভূতপূর্ব্ব পরিবর্ত্তন ঘটিল। জন্মভূমির দাসত্ব শৃঙ্খল এবং ৪০ কোটি ভারত বাসীর পরাধীনতার বন্ধন মুক্ত করিবার জন্য তিনি ভারতের জাতীয় বাহিনী আজাদ হিন্দ ফৌজের একটি দায়িত্বপূর্ণ কার্যভার গ্রহণ করেন। ১৯৪৪ খৃঃ ইম্ফল অভিযান কালে তিনি ‘বসু’ বিগ্রেডের অধিনায়করূপে ইংরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। জন্মভূমির স্বাধীনতা অর্জ্জনে তিনি এতদূর দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হইয়াছিলেন যে এই যুদ্ধে তিনি তাঁহার সহোদর ভ্রাতার বিরুদ্ধেও অস্ত্রধারণ করিতে কুণ্ঠিত হন নাই। আজাদ হিন্দ ফৌজে তিনি মেজর জেনারেলের পদে উন্নীত হন; এবং জাতীয় বাহিনীর বিজয় গৌরবের কীর্ত্তি স্বরূপ তিনিই প্রথম বৃটিশ শাসিত মণিপুর, কোহিমা, প্রভৃতি প্রদেশে জাতীয় পতাকা উড্ডীন করেন।
কর্ণেল পি কে সেহ্গল
আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগদানের পূর্ব্বে ক্যাপ্টেন পি কে সেহ্গল বৃটিশ ভারতীয় বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত পঞ্চম বেলুচ রেজিমেণ্টের অফিসার ছিলেন। তিনি লাহোর হাইকোর্টের বিচারপতি মিঃ অচ্ছুরামের পুত্র।
১৯৪০ সালের অক্টোবর মাসে উক্ত রেজিমেণ্টের ২য় ব্যাটেলিয়নের নায়ক পদ গ্রহণ করিয়া সিঙ্গাপুরে গমন করেন। ১১ই নভেম্বর কর্ণেল সেহ্গল সিঙ্গাপুরে উপনীত হন। এক পক্ষকাল পরে কেলানটান ষ্টেটের অন্তর্গত কোটা বারু সমুদ্রাঞ্চল রক্ষা করিবার নিমিত্ত প্রেরিত হন। মালয়ের উত্তরাঞ্চলের সৈন্যাধ্যক্ষ মেজর জেনারেল মারে, ভারতীয় নবম ডিভিসনের মেজর জেনারেল বার্ষ্টো প্রভৃতি কর্ণেল সেহ্গলের রেজিমেণ্ট পরিদর্শন করিয়া তাঁহার ভূয়সী প্রশংসা করেন।
মালয় অভিযানের সময় তিনি জাপানীগণকে কয়েকটি যুদ্ধে বিশেষভাবে পরাজিত করেন। একবার কর্ণেল সেহ্গল তাঁহার সৈন্যগণের সাহায্যে ৫০০ শত জাপানী সৈন্যের সম্পূর্ণ বিলোপ সাধন করিয়া বহু অস্ত্র শস্ত্র সংগ্রহ করেন।
১৯৪২ সালে ৩১শে জানুয়ারী ভোর রাত্রে তিনি তাঁহার সৈন্যদল সমেত জোহর বারু অতিক্রম করিয়া সিঙ্গাপুরে উপস্থিত হন। সিঙ্গাপুরে যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর এই সৈন্যদল অক্লান্তভাবে দিবারাত্র জাপানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। জাপানীগণ ৮ই ফেব্রুয়ারী সিঙ্গাপুরে অবতরণ করে এবং ১০ই ফেব্রুয়ারী কর্ণেল সেহগল প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করিয়া জাপানীগণকে সমুদ্রাভিমুখে উড্ল্যাণ্ড অঞ্চলে বিতাড়িত করেন। কিন্তু পরদিবস মাণ্ডাই পর্ব্বত অঞ্চল হইতে অস্ট্রেলিয়ান সৈন্যদের স্থান গ্রহণের জন্য কর্ণেল সেহ্গল আদেশ প্রাপ্ত হন। মাণ্ডাই পর্ব্বত অঞ্চলে যাইবার পথে তাঁহারা জাপানীগণ কর্ত্তৃক আক্রান্ত হন। ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়ান সৈন্যদল কর্ণেল সেহ্গলের সৈন্যদল পৌঁছিবার পূর্ব্বেই পলায়ন করেন। জাপানীগণ উক্ত পর্ব্বত অধিকার করায় এই সৈন্যদল মূল বাহিনী হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়। ঐ দিবস অপরাহ্নে তিনি তাঁহার মূল সেনাদলের সহিত পুনরায় যোগসূত্র স্থাপন করেন। এই সময় জাপানীগণ প্রবলভাবে আক্রমণ করিলে তিনি তাঁহার সৈন্যদলের সাহায্যে সে আক্রমণ প্রতিহত করিয়া তিনটি জাপানী ট্যাঙ্ক অধিকার করেন। ১৩ই ফেব্রুয়ারী ব্রিটিশ কর্ত্তৃপক্ষের আদেশ অনুযায়ী কর্ণেল সেহ্গল জাপানীদের নিকট আত্মসমর্পণ করেন।
শৃঙ্খলিতা ভারত জননীর মুক্তি সাধনের জন্য ১৯৪২ সালে সেপ্টেম্বর মাসে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগদান করেন, এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসারদের শিক্ষার ভার গ্রহণ করেন।
কর্ণেল গুরুবক্স সিং ধীলন
আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্যতম অভিযুক্ত আসামী কর্ণেল গুরুবক্স সিং ধীলন। তিনি জাতিতে শিখ, দেখিতে গৌরবণ মধ্যমাকৃতি। তিনি যে পরিবারসম্ভূত, সে পরিবারের অনেকেই বহুদিন যাবৎ সেনাবাহিনীতে কাজ করিয়াছেন। তিনি ১৯১৬ সালে লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া তিনি সৈন্যবাহিনীতে সিপাহী হিসাবে যোগদান করেন। তিনি দেরাদুন ও নবাবগঞ্জ সামরিক বিদ্যালয় হইতে সম্মানের সহিত উত্তীর্ণ হইয়া গুরুবক্স ১।১৪ পাঞ্জাব রেজিমেণ্টের অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৩৯ সালে যুদ্ধ বাধিলে তাঁহাকে এবং তাঁহার রেজিমেণ্টকে মালয়ে পাঠান হয়। মালয়ে কিছুকাল অবস্থান করিবার পর পুণায় আরও অধিক ব্যবহারিক সামরিক শিক্ষালাভের জন্য তিনি ভারতবর্ষে প্রত্যাবর্তন করেন। এখানেও তিনি সসম্মানে উত্তীর্ণ হন এবং তাঁহার রেজিমেণ্টে যোগদানের জন্য পুনরায় মালয় যাত্রা করেন। এই সময় তাঁহাদের রেজিমেণ্টটি উত্তর মালয়ের জঙ্গলে অবস্থান করিতেছিল। বিপদের সময় তাঁহার মধ্যে আজীবন নেতার সমস্ত গুণপনাই তাঁহার মধ্যে পরিলক্ষিত হইয়াছে।
কর্ণেল ধীলন ৫ই ডিসেম্বর (১৯৪১) জিব্রাতে তাঁহার সৈন্যবাহিনীর সহিত মিলিত হন। চাংলুন রণাঙ্গনে জাপানীদের সহিত যুদ্ধে তিনি তাঁহার সৈন্য ও অফিসারগণসহ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়েন। ১৬ই ডিসেম্বর পেনাং হইতে ২৬ মাইল দূরে নিবং টাইবলে তাঁহারা উপস্থিত হন। এইস্থানে কর্ণেল ধীলন ও হাবিবকে দুইটি সেতুমুখ রক্ষার ভার দেওয়া হয়। ১৯শে ডিসেম্বর ব্রিটিশ কর্ত্তৃপক্ষের আদেশ অনুযায়ী পশ্চাৎ অপসরণ করা হয়। ৮ই ডিসেম্বর জাপানীগণের যুদ্ধ ঘোষণার পর কর্ণেল ধীলন অক্লান্তভাবে জাপানীদের বিরুদ্ধে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এই সময় তিনি সারাদিনের মধ্যে একবারের জন্যও পূর্ণ খাদ্য গ্রহণ করিবার সময় পাইতেন না। এই সময় যখন তিনি জ্বরে আক্রান্ত হইয়া হাসপাতালে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তখন ভারতীয় সেনাদের মধ্যে বৈষম্যমূলক ব্যবহারের জন্য তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। তৎপর তিনি ভারতীয় উইং কমাণ্ডার ও অ্যাডজুটাণ্ট পদে বৃত হন ও ভারতীয় সৈনিকগণকে শান্ত করেন।
যুদ্ধের সময় একবার যখন জাপানীরা অধিকসংখ্যক সৈন্য ও বিমান বাহিনী লইয়া বৃটিশ ও ভারতীয় সৈন্যদিগকে নির্মমভাবে আক্রমণ করিতেছিল, তখন তিনি অনেকের জীবন বাঁচাইতে সক্ষম হইয়াছিলেন। তাঁহাদের পলায়নের রাস্তা বিচ্ছিন্ন হইয়া গেলে তাঁহারা অস্ত্র ত্যাগ করিতে বাধ্য হন এবং তাঁহাদের দলটিকে জাপানী সামরিক বন্দীনিবাসে লইয়া যাওয়া হয়। ক্যাপ্টেন গুরুবক্স ধীলন অতঃপর ব্যাংককে অধিষ্ঠিত পূর্ব এশিয়ার ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সম্মেলনে যোগদানের জন্য আমন্ত্রিত হন।
এই সময় তিনি মেজর মোহন সিং কর্তৃক গঠিত ভারতীয় জাতীয় বাহিনীতে যোগদান করেন। কর্ণেল ধীলন তিন হাজার আজাদী সৈন্য লইয়া গঠিত “নেহেরু ব্রিগেড” ইম্ফল রণাঙ্গনে পরিচালিত করেন। ১৭ই মে পেগু রণাঙ্গনে বৃটিশ বাহিনী কর্তৃক ধৃত হইয়া পেগু জেলে নীত হন। ১৯৪৫ সালের জুন মাসের শেষভাগে তাঁহাকে ভারতবর্ষে আনিয়া কলিকাতাতে অবস্থিত বৃটিশ মিলিটারী হাজতে আটক রাখা হয়। ১৯৪৫ সালের ৫ই জুলাই তিনি দিল্লী পৌঁছেন। ৫ই জুলাই হইতে ১১ই আগষ্ট পর্যন্ত তিনি কোথায় আছেন, এ সম্পর্কে কোন খবরই পাওয়া যায় না। ১১ই জুলাই ভারত গবর্নমেণ্টের য়্যাডজুট্যাণ্ট জেনারেলের নিকট হইতে প্রাপ্ত একটি পত্র হইতেই তাঁহার সম্পর্কে তাঁহার পরিবারবর্গ প্রথম খবর পান। পত্রে উল্লিখিত হয় যে, ক্যাপ্টেন গুরুবক্স সিংকে খুঁজিয়া পাওয়া গিয়াছে এবং তাঁহাকে প্রশ্ন করা ও তাঁহার অনুসন্ধানাদির কাজ কয়েক সপ্তাহব্যাপী চলিবে। ঐ সময়ের মধ্যে তাঁহার সম্পর্কে কোনরূপ অনুসন্ধান বা তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ ইত্যাদি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ হয়। সেপ্টেম্বর মাসে তাঁহার পিতা গুরুবক্স সিংয়ের নিকট হইতে এই মর্মে একটি ‘তার’ পান—‘দয়া করিয়া সত্বর দিল্লী লালকেল্লায়’ আমার সহিত সাক্ষাৎ করুন। ভালই আছি। মাতাঠাকুরাণীকে আমার ভালবাসা জানাইবেন।
ক্যাপ্টেন ধীলন বিবাহিত, কিন্তু তাঁহার কোন সন্তানাদি নাই। তাঁহার পিতা পশু-চিকিৎসক হিসাবে সেনাবাহিনীতে ২২ বৎসর কাজ করিবার পর বর্তমানে অবসর গ্রহণ করিয়াছেন। তিনি এখন লাহোরের আলগাঁওতে বিশ্রাম-জীবন যাপন করিতেছেন। তাঁহার আরও দুই ভাই সেনাবাহিনীতে কাজ করিতেছেন এবং চতুর্থ ভ্রাতা ডেপুটি-ফরেষ্ট রেঞ্জারের পদে নিযুক্ত আছেন।