আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়)/ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
মৌলিক গবেষণা—গবেষণা বৃত্তি—ভারতীয় রাসায়নিক গোষ্ঠী
(Indian School of Chemistry)
পূর্বেই বলা হইয়াছে যে আমার বৈজ্ঞানিক গবেষণা ক্রমশঃ ভারতের বাহিরে সমাদৃত হইতেছিল। বাংলা গবর্ণমেণ্ট কর্তৃক “গবেষণাবৃত্তি” স্থাপনের ফলে বিজ্ঞান চর্চায় কিয়ৎ পরিমাণে উৎসাহদান করা হইল। কোন ছাত্র যোগ্যতার সহিত এম, এস-সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলে, এবং কোন বিশেষ বিজ্ঞানের চর্চ্চায় অনুরাগ দেখাইলে, —অধ্যাপকের স,পারিশে তিন বৎসরের জন্য একশত টাকার মাসিক বৃত্তি লাভ করিতে পারিত। ১৯০০ সাল হইতে আমার বিভাগে একজন বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র সর্বদাই থাকিত। শিক্ষানবিশীর প্রথম অবস্থায় সে আমার গবেষণাকার্যে সহায়তা করিত, কিন্তু পরে প্রতিভার পরিচয় দিলে, সে নিজের উদ্ভাবিত পন্থায় বিশেষ কোন বিষয়ে মৌলিক গবেষণা করিতে পারিত। এই শ্রেণীর ছাত্রদের মধ্যে অনেকে গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখিয়া “ডক্টর” উপাধি লাভ করিয়াছেন এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সম্মান প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তিও পাইয়াছেন। ইহারা আবার সহজেই শিক্ষাবিভাগে অথবা ইম্পিরিয়াল সার্ভিসের কোন টেকনিক্যাল বিভাগে কাজ পাইতেন। ইহা ছাড়া তাঁহাদের লিখিত গবেষণামূলক প্রবন্ধসমূহ ইংলণ্ড, জার্মানি ও আমেরিকার বৈজ্ঞানিক পত্রিকাসমূহে প্রকাশিত হইত, ইহাও রাসায়নিক গবেষণায় উৎসাহ ও প্রেরণার অন্যতম হেতু ছিল।
আমার নিকটে প্রথম গবেষণাবৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র ছিলেন যতীন্দ্রনাথ সেন। তিনি ‘রায়চাঁদ প্রেমচাঁদ' বৃত্তি লাভ করেন। 'মার্কিউরাস নাইট্রাইটের' গবেষণায় তিনি আমার সহযোগিতা করেন। তিনি পরে পাসার কৃষি ইনষ্টিটিউটে প্রবেশ করেন এবং যথাসময়ে ইম্পিরিয়াল সার্ভিসে স্থান লাভ করেন।
১৯০৫ সালে পঞ্চানন নিয়োগী আমার নিকটে রিসার্চ স্কলার ছিলেন। তাহার কিছু, পরে আসেন আমার সহকারী অধ্যাপক, অতুলচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। অতুলচন্দ্রের শরীর খুব বলিষ্ঠ ছিল এবং তিনি তাঁহার দৈনিক কাজের পরেও কঠোর পরিশ্রম করিতে পারিতেন। তিনি অপরাহ্ণ ৪ই টার সময় আমার সঙ্গে কাজ করিতে আরম্ভ করিতেন এবং সন্ধ্যার পর পর্যন্ত তাহা করিতেন। ছটীর সময়েও তিনি প্রায়ই আমার সঙ্গে থাকিয়া কাজ করিতেন। অতুলচন্দ্র ঘোষ নামে আর একজন যুবক রিসার্চ স্কলাররূপে আমার কাজে সহযোগিতা করিয়াছিলেন। তিনি পরে লাহোরে দয়াল সিং কলেজের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, অতুলচন্দ্র অকালে পরলোকগমন করেন। অধ্যাপক শাস্তিস্বরূপ ভাটনগর “ফিজিক্যাল কেমিষ্ট্রী”তে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। তিনি আমাকে অনেকবার বলিয়াছেন যে অতুলচন্দ্র ঘোষের নিকট তিনি রসায়নশাস্ত্রে শিক্ষালাভ করেন। সতরাং “প্রশিষ্য” বলিয়া দাবী করেন।[১] এইভাবে রাসায়নিক গবেষণার ফল বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। রসায়ন শাস্ত্র সম্বন্ধীয় পত্রিকাসমূহের বিষয়সূচী এবং লেখকদের নাম দেখিলেই তাহা বুঝিতে পারা যাইবে।
১৯০৪ সালে একজন আইরিশ যুবক (কানিংহাম) শিক্ষা বিভাগে প্রবেশ করেন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়নের সহযোগী অধ্যাপক নিযুক্ত হন। তিনি বাংলা দেশে বৈজ্ঞানিক শিক্ষার উন্নতিকল্পে প্রভূত সহায়তা করেন। তিনি উৎসাহী ব্যক্তি ছিলেন এবং তাঁহার মনে কোন ঈর্ষা বা সঙ্কীর্ণতা ছিল না। তিনি প্রায়ই বলিতেন যে তিনি ‘জুনিয়র’ হইয়াও ‘ইণ্ডিয়ান এডুকেশনাল সার্ভিসের’ লোক হিসাবে সিনিয়র বলিয়া গণ্য হইবেন, ইহা খুবই অদ্ভুত কথা। যিনি তাঁহার ‘জুনিয়র’ বলিয়া গণ্য, তাঁহার পদতলে বসিয়া তিনি (কানিংহাম)—শিক্ষালাভ করিতে পারেন। তিনি প্রকাশ্যে এবং কার্যতঃ ভারতবাসীদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতি সহানভূতি প্রদর্শন করিতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নূতন নিয়ম অনুসারে বি, এস-সি এবং এম, এস-সি উপাধি তখন সবে প্রবর্তিত হইয়াছিল এবং তিনি কেবল প্রেসিডেন্সি কলেজে নয়, বাংলার সমগ্র কলেজে লেবরেটরিতে ছাত্রদের শিক্ষাদান প্রণালীর উন্নতি সাধনে যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছিলেন। তিনি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে শিক্ষা বিষয়ে বহু পরামর্শ দিয়া সাহায্য করেন এবং বাংলার বহু শিক্ষক ও রাজনীতিকের সঙ্গে তাঁহার বন্ধুত্ব হয়। বেঙ্গল কেমিক্যাল ও ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কসের কারখানা তখন মানিকতলা মেন রোডে স্থানান্তরিত হইয়াছে এবং উহার নির্মাণকার্য তখনও চলিতেছে। এই প্রতিষ্ঠানটি তাঁহার বিশেষ প্রিয় ছিল। তাঁহার মতে দেশীয়দের প্রতিভা ও কর্মোৎসাহের ইহা জীবন্ত প্রতিমূর্তি। দুর্ভাগ্যক্রমে উৎসাহের আতিশয্য বশতঃ কখন কখন তাঁহার বৃদ্ধির ভুল হইত এবং এই কারণে তিনি শেষে বিপদগ্রস্ত হইলেন।
একবার তিনি বিলাতে তাঁহার বন্ধু জনৈক পার্লামেণ্টের সদস্যকে ব্যক্তিগত ভাবে একখানি পত্র লিখেন। পত্রে পূর্ববঙ্গে, বিশেষ ভাবে গবর্ণর সার ব্যামফিল্ড ফুলারের শাসননীতির বিরুদ্ধে সমালোচনা ছিল। উক্ত বন্ধু বুদ্ধির ভুলে ভারতবাসীদের প্রতি সহানভূতিসম্পন্ন অন্য কয়েকজন পার্লামেণ্টের সদস্যকে ঐ পত্র দেখান, এবং দুর্ভাগ্যক্রমে ইণ্ডিয়া কাউন্সিলের একজন সদস্য (জনৈক অবসরপ্রাপ্ত অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান) উহার একখানি নকল সংগ্রহ করিয়া ভারত-সচিবকে দেখান। ব্যাপারটি যথা সময়ে বাংলার শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর স্যর আর্কডেল আর্লের নিকট আসিল।
স্যর আর্কডেল কানিংহামকে ডাকিয়া পাঠাইলেন এবং শাসনবিধি ভঙ্গের জন্য তাঁহাকে যৎপরোনাস্তি তিরস্কার করিলেন। তাঁহাকে বলা হইল যে তিনি যে কাজ করিয়াছেন, তাহাতে অবিলম্বে তাঁহাকে কার্যচ্যুত করা উচিত এবং তাঁহাকে তাঁহার বর্তমান কর্মক্ষেত্র হইতে অপসারিত করাই সর্বাপেক্ষা লঘু শাস্তি। কানিংহামকে অনুন্নত প্রদেশ ছোটনাগপুর স্কুল ইনস্পেক্টর রূপে বদলী করা হইল। ১৯১১ সালে রাঁচিতে তিনি ম্যালেরিয়া জ্বরে প্রাণত্যাগ করিলেন। বেকার লেবরেটরিতে তাঁহার বন্ধু ও গুণমুগ্ধগণ তাঁহার নামে একটি স্মৃতিফলক প্রতিষ্ঠা করিয়া তাঁহার প্রতি শ্রদ্ধা ও অনুরাগের পরিচর দিয়াছেন।
১৯০৮ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একটি স্মরণীয় অনুষ্ঠান হইল। লর্ড ক্যানিং ১৮৫৮ সালে কলিকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সনন্দ দেন। ১৯০৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চাশৎ বার্ষিক জুবিলী উৎসব মহাসমারোহে সম্পন্ন হইল এবং কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সম্মানসূচক উপাধি প্রদত্ত হইল; ইঁহাদের মধ্যে আমিও ছিলাম।
এই সময়ে আমার মনে হইল যে “হিন্দু রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাসের” প্রতিশ্রুত দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ করা আমার পক্ষে কর্তব্য। তদনুসারে আমি তন্ত্র সম্বন্ধে কতকগুলি নূতন সংগৃহীত পুঁথি পাঠ করিতে লাগিলাম। সৌভাগ্যক্রমে ডাঃ ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের সহযোগিতা লাভেও আমি সমর্থ হইলাম। ডাঃ শীলের জ্ঞান সর্বতোমুখী, তিনি প্রাচীন হিন্দুদের ‘পরমাণু তত্ত্ব’ সম্বন্ধে একটি অধ্যায় লিখিয়া দিলেন। এই অংশ পরে সংশোধিত ও পরিবর্দ্ধিত করিয়া ডাঃ শীল তাঁহার “Positive Sciences of the Ancient Hindus” নামক বিখ্যাত গ্রন্থে প্রকাশ করেন।
দ্বিতীয় খণ্ডের ভূমিকা হইতে নিম্নোদ্ভূত কয়েক পংক্তি পড়িলেই বুঝা যাইবে, আমার এই স্বেচ্ছাকৃত দায়িত্ব ভার হইতে মুক্ত হইয়া আমার মনোভাব কিরূপ হইয়াছিল। বলা বাহুল্য, এই গুরুতর কর্তব্য পালন করিতে যে কঠোর পরিশ্রম করিতে হইয়াছিল, তাহা আমার পক্ষে প্রীতি ও আনন্দপ্রদই ছিল। “গত ১৫ বৎসরেরও অধিককাল ধরিয়া আমি যে কর্তব্য পালনে নিযুক্ত ছিলাম, তাহা হইতে বিদায় গ্রহণ করিবার সময়ে আমার মনে যুগপৎ হর্ষ ও বিষাদ জাগ্রত হইতেছে। রোমক সাম্রাজ্যের ইতিহাসকারের মনে যেরূপ ভাবের উদয় হইয়াছিল, ইহা অনেকটা সেইরূপ। সুতরাং যদি এডমণ্ড গিবনের ভাষায় আমি আমার মনোভাব ব্যক্ত করি পাঠকগণ আমাকে ক্ষমা করিবেন। ‘এই কার্য হইতে অবশেষে মুক্তিলাভ করিয়া আমার মনে যে আনন্দ হইতেছে, তাহা আমি গোপন করিতে চাই না।.......কিন্তু আমার গর্ব শীঘ্রই খর্ব হইল, যে কার্য আমার পুরাতন সঙ্গী ছিল এবং আমাকে দীর্ঘ কাল ধরিয়া আনন্দ দান করিয়াছে, তাহার নিকট হইতে চিরবিদায় গ্রহণ করিতে হইবে, এই ভাবনায় একটা শান্ত বিষাদ আমাকে আচ্ছন্ন করিল।’
“হিন্দুর অতীত গৌরবময়, তাহার অন্তরে বিরাট শক্তির বীজ নিহিত আছে, সতরাং তাহার ভবিষ্যৎ আরও গৌরবময় হইবে, আশা করা যাইতে পারে, এবং যদি এই ইতিহাস পড়িয়া আমার স্বদেশবাসীদের মনে জগৎসভায় তাহাদের অতীত গৌরবের আসন লাভ করিবার ইচ্ছা জাগ্রত হয়, তাহা হইলেই আমার পরিশ্রম সার্থক হইবে।” অধ্যাপক সিল্ভাঁ লেভি ‘হিন্দু রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাসের’ দ্বিতীয় খণ্ড সমালোচনা প্রসঙ্গে বলেন—“তাঁহার গবেষণাগার ভারতের নব্য রাসায়নিকগণের সূতিকা গৃহ। অধ্যাপক রায় সংস্কৃত বিদ্যায় পারদর্শী। ......পাশ্চাত্যের ভাষা সমূহেও তাঁহার দখল আছে,—ল্যাটিন, ইংরাজী, জার্মান ও ফরাসী ভাষায় লিখিত গ্রন্থাবলীর সঙ্গে তাঁহার ঘনিষ্ঠ পরিচয়।”
রসায়ন শাস্ত্রের চর্চায় আমার সমস্ত শক্তি ও সময় নিয়োগ করিবার অবসর আমি পুনর্বার লাভ করিলাম। প্রেসিডেন্সি কলেজ লেবরেটরি হইতে যে সমস্ত মৌলিক গবেষণামমূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছে, তাহার সূচী পড়িলেই যে কেহ দেখিতে পাইবেন, ঐ সময় হইতে কতকগুলি প্রবন্ধ আমার ও আমার সহকর্মী ছাত্রদের যুগ্ম নামে প্রকাশিত হইতে থাকে। পরে এই রীতিই প্রধান হইয়া উঠে। অন্য কাহাকেও সহকর্মী করা হইলে তাঁহার উপরে পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করাই উচিত এবং কার্যের ফলভোগী হইবার সুযোগও তাঁহাকে দেওয়া উচিত। সহকর্মী শীঘ্রই প্রধান কর্মীর সঙ্গে আপনার লক্ষ্যকে একীভূত করিতে শিখেন এবং কাজে সমস্ত মন প্রাণ ঢালিয়া দেন। আরও ভাবিবার কথা আছে। বিষয়টি নানাদিক দিয়া দেখা যাইতে পারে। যিনি অন্যের সাহায্য না লইয়া একাকীই কাজ করেন, এবং অন্যের সঙ্গে পরামর্শ করা বা অন্যের অভিমত গ্রহণ করা প্রয়োজন মনে করেন না, তিনি খামখেয়ালী হইয়া উঠিতে পারেন, কিম্বা কোন একটি বিশেষ ধারণা তাঁহার মনে বদ্ধমূল হইয়া যাইতে পারে। যদি তিনি তাঁহার সহকর্মীদের পরামর্শ গ্রহণ করেন, তাহা হইলে অনেক ভ্রমের হাত হইতে নিস্তার পাইতে পারেন। সহকর্মীও যদি বুঝিতে পারেন যে, প্রভুর তাঁহার প্রতি বিশ্বাস আছে, তাহা হইলে কার্যে তাঁহার দায়িত্ববোধ জন্মে। কেবল মাত্র উপরওয়ালার আদেশ পালন করাই যেখানে রীতি, সেখানে এই দায়িত্ববোধ জন্মিতে পারে না। বস্তুতঃ, সেরূপ স্থলে প্রভু ও সেবকের মধ্যে সম্বন্ধ প্রাণহীন হইয়া উঠে। আমি অবশ্য সাধারণ লোকের কথাই বলিতেছি, অসাধারণ প্রতিভাশালী ব্যক্তিদের কথা বলিতেছি না। বিরাট প্রতিভা অথবা অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে সাধারণ লোকের বুদ্ধি ও মেধা বিকাশ লাভ করিতে পারে না। উপমা দিতে বলা যায়, বহু শাখা বিশিষ্ট বিরাট বটবৃক্ষের ছায়াতলে অন্য কোন গাছপালা বড় হইতে পারে না, বৈষয়িক জগতেও সেই একই নিয়ম খাটে। এবং যাহা বৈষয়িক জগতে ঘটে, মৌলিক গবেষণার ক্ষেত্রেও অল্পবিস্তর তাহাই ঘটে। বিরাট প্রতিভাশালী ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসিয়া কিরূপে বহু বৈজ্ঞানিকের সৃষ্টি হইয়াছে এবং ঐ সমস্ত বৈজ্ঞানিকেরা কিরূপে প্রতিভাশালী ব্যক্তিদের নিকট হইতে প্রেরণা লাভ করিয়াছেন, তৎসম্বন্ধে অনেক কথা লেখা যাইতে পারে। মৎকৃত ‘নব্যরসায়নশাস্ত্রের স্রষ্টাগণ’ (Makers of Modern Chemistry) নামক গ্রন্থ হইতে এই প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত অংশ উদ্ধৃত করা যাইতে পারে।
“গে-লসাকের বন্ধু ও সহকর্মী ছিলেন থেনার্ড। থেনার্ড (১৭৭৭—১৮৫৭) সাধারণ কৃষকের ছেলে। সতর বৎসর বয়সে তিনি চিকিৎসা বিদ্যা অধ্যয়ন করিতে পারিতে আসেন। ছাত্র হিসাবে কোন লেবরেটরিতে প্রবেশ করিবার সঙ্গতি তাঁহার ছিল না, সতরাং ভকেলিনের নিকট কোন লেবরেটরির ভৃত্য হিসাবে থাকিবার জন্য প্রার্থনা করিলেন। “থেনার্ডস্ ব্লু” নামক পরিচিত মিশ্র পদার্থ আবিষ্কার করিয়া থেনার্ড খ্যাতিলাভ করেন। তাঁহার আর একটি আবিষ্কার ‘হাইড্রোজেন পারক্সাইড’। আশী বৎসর বয়সে তাঁহার মৃত্যু হয়। সেই সময়ে তিনি ফ্রান্সের একজন ‘পীয়ার’ এবং পারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হইয়াছিলেন। ভকেলিনের দরিদ্র ছাত্রদের মধ্যে মাইকেল ইউজেন শেভ্রেল (১৭৮৬—১৮৮৯) একজন। তিনি এক শতাব্দীরও অধিক বাঁচিয়া ছিলেন এবং এই হেতু নব্যরসায়নকারগণ এবং সেকালের জৈব রসায়ন শাস্ত্রের প্রতিষ্ঠাতৃগণের মধ্যে তিনি যোগসূত্র স্বরূপ ছিলেন। Fatty Acids অর্থাৎ চর্বি-সম্ভূত অ্যাসিড সম্বন্ধে তাঁহার গবেষণা বিজ্ঞান জগতে সুবিদিত।
অগাষ্ট লরাঁ (১৮০৭—৫৩) একজন সাধারণ কৃষকের ছেলে। ১৮২৬ সালে তিনি খনিবিদ্যালয়ে ‘বাহিরের ছাত্র’ রূপে প্রবেশ লাভ করেন এবং ১৮৩১ খৃষ্টাব্দে Ecole Centrale des Arts et Métiers -এ সহকারীর পদ লাভ করেন। ঐ প্রতিষ্ঠানে ডুমা অধ্যাপক ছিলেন এবং তাঁহারই লেবরেটরিতে লরাঁ তাঁহার প্রথম গবেষণা করেন; ১৮৩৮ সালে লরাঁ বোর্ডোতে বিজ্ঞানের অধ্যাপক হন, ১৮৪৬ সালে তিনি পারিতে ফিরিয়া আসেন এবং টাকশালের ধাতু-পরীক্ষক বা অ্যাসেয়র হন। কিন্তু তাঁহার আর্থিক স্বচ্ছলতা এবং কাজ করিবার সুযোগ খুব সামান্য ছিল এবং সর্বদাই তিনি অর্থকষ্ট ভোগ করিতেন। ১৮৫৩ সালে তিনি যক্ষারোগে প্রাণত্যাগ করেন। তাঁহার জীবনীকার প্রিমো লিখিয়াছেন: “লরাঁ নিঃস্বার্থ ভাবে সত্যের সন্ধানে গবেষণা করিয়া প্রাণপাত করিয়াছেন তবু তিনি বিদ্বেষান্ধ সমালোচকদের কুৎসিত আক্রমণের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পান নাই। সৌভাগ্য, সম্মান কাহাকে বলে, তাহা তিনি জানিতেন না, যে সব তত্ত্ব আবিষ্কারের জন্য তিনি অক্লান্ত ভাবে সংগ্রাম করিয়াছিলেন, সেগুলির সাফল্যও তিনি দেখিয়া যাইতে পারেন নাই।”
প্রতিভাশালী ব্যক্তি অথবা বিশেষজ্ঞের সংস্পর্শে আসিলেই অথবা তাঁহার অধীনে কাজ করিবার সুযোগ পাইলেই যে বৈজ্ঞানিক গড়িয়া উঠে, এমন কথা অবশ্য বলা যায় না। বিদ্যার্থীর মধ্যে অন্তর্নিহিত শক্তি চাই এবং সেই শক্তির বিকাশে সহায়তা করিতে হইবে। গ্রে’র Elegy (বিষাদ-সঙ্গীত) কবিতায় নিম্নলিখিত কয়েক ছত্রে মূল্যবান সত্য আছে: “সমুদ্রের অন্ধকার অতল গর্ভে বহু উজ্জ্বল রত্ন লুকাইয়া আছে। মরুভূমির বুকে বহু ফুল ফাটিয়া লোক-লোচনের অন্তরালে শুকাইয়া ঝরিয়া পড়ে।”
কিন্তু যে যন্ত্র শব্দ-তরঙ্গ ধারণ করিবে তাহারও একই সুরে বাঁধা হওয়া চাই নতুবা সে সাড়া দিতে পারিবে না।
১৯০৯ খৃষ্টাব্দে বাংলার রাসায়নিক গবেষণার ইতিহাসে একটি নূতন অধ্যায় আরম্ভ হইল, ঐ বৎসর কয়েকজন মেধাবী ছাত্র প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রবেশ করেন। তাঁহারা সকলেই পরে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায়, মাণিক লাল দে, সত্যেন্দ্র নাথ বসু এবং পুলিন বিহারী সরকার আই, এস-সি, ক্লাসে ভর্তি হন, রসিক লাল দত্ত এবং নীলরতন ধর বি, এস-সি উপাধির জন্য প্রস্তুত হইতেছিলেন। মেঘনাদ সাহাও ঢাকা কলেজ হইতে আই, এই-সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া এই সময়ে ঘোষ, মখোপাধ্যায় প্রভৃতির সঙ্গে বি, এস-সি ক্লাসে যোগদান করেন। রসিক লাল দত্ত, মাণিক লাল দে এবং সত্যেন্দ্র নাথ বসু কলিকাতাতেই পৈতৃক গৃহে লালিত পালিত। ঘোষ, মখোপাধ্যায়, সরকার, সাহা এবং ধর মফঃস্বল হইতে আসিয়াছিলেন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজের সংলগ্ন ইডেন হিন্দু হোষ্টেলে থাকিতেন। তাঁহাদের মধ্যে এমন প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হইয়াছিল, যাহা সচরাচর দুর্লভ। তাঁহারা পরস্পরের সুখেদুঃখে আপদে বিপদে সঙ্গী ছিলেন। তাঁহাদের চরিত্রে এমনই একটা বৈশিষ্ট্য ছিল যে আমি তাঁহাদের প্রতি আকৃষ্ট হইলাম। আমার সঙ্গে তাঁহাদের একটি সূক্ষ্ম যোগসূত্র স্থাপিত হইল। আমি তাঁহাদের হোষ্টেলে প্রায়ই যাইতাম এবং বিকালে তাঁহারা প্রায়ই আমার সঙ্গে ময়দানে বেড়াইতেন।
ইঁহাদের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ রসিকলাল রসায়নবিজ্ঞানে বিশেষ কৃতিত্ব দেখাইলেন এবং যে সময়ে এম, এস-সি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইতেছিলেন তখন “নাইট্রাইট্স্” সম্বন্ধে গবেষণায় আমার সহায়তা করিয়াছিলেন। কিন্তু শীঘ্রই তিনি স্বতন্ত্র পথ বাছিয়া লইলেন এবং শেষ উপাধি পরীক্ষার জন্য মৌলিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ দাখিল করিলেন। ঐ প্রবন্ধ যথাসময়ে লণ্ডন কেমিক্যাল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হইয়াছিল। ১৯১০ সাল হইতে পর পর কতকগুলি মৌলিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ তিনি প্রকাশ করেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে তিনিই সর্বপ্রথম ‘ডক্টর অব সায়েন্স’ (ডি, এস-সি) উপাধি লাভ করেন।
১৯১০ সালে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে এবং আমি একটি রত্ন লাভ করি। জিতেন্দ্রনাথ রক্ষিত সেণ্ট জেভিয়ার্স কলেজ হইতে বি, এস-সি পরীক্ষা দিয়া অকৃতকার্য হন। তিনি প্রচলিত পরীক্ষাপ্রণালী এবং উপাধিলাভের অবাভাবিক স্পৃহার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হন। তিনি প্রচলিত নিয়ম অনুসারে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংসৃষ্ট কোন কলেজে ছাত্ররূপে প্রবেশ করিতে পারিলেন না, সুতরাং ‘জাতীয় শিক্ষাপরিষদের’ রাসায়নিক লেবরেটরিতে কিছুদিন কাজ করিতে লাগিলেন। ব্যবহারিক রসায়ন বিজ্ঞান তাঁহার বিশেষ প্রিয় ছিল। কয়েকখণ্ড পরিত্যক্ত কাচের নল হইতে তিনি এমন সব যন্ত্র তৈরী করিতে পারিতেন যাহা এতদিন জার্মানি বা ইংলণ্ডের কোন ফার্ম হইতে আনাইতে হইত। জনৈক বন্ধু তাঁহার কৃতিত্ব ও দক্ষতার কথা আমাকে জানান। আমি তাঁহাকে ডাকিয়া পাঠাইলাম এবং শীঘ্রই বুঝিতে পারিলাম তিনি একজন দুর্লভ গুণসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক কর্মী। ‘অ্যামাইন নাইট্রাইট্সের’ সংশ্লেষণ কার্যে তিনি আমার সহায়তা করিয়াছিলেন। তিনি অনেক সময় একাদিক্রমে ৯ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করিতেন। শীতের দেশে ইহা সাধারণ হইলেও এই অসহ্য গ্রীষ্মের দেশে বড়ই কঠিন কাজ। তিনিও শীঘ্রই মৌলিক গবেষণায় যোগ্যতার পরিচয় দিলেন এবং তাহার ফলে সরকারী আফিম বিভাগে বিশ্লেষক রূপে প্রবেশ করিলেন।
১৯১০-১১ সালে আমার একটি অপূর্ব অভিজ্ঞতা হয়। বর্ষার সময়ে বাংলার নিম্নাংশের অনেকখানি বন্যার জলে প্লাবিত হয়। সাধারণতঃ এই বন্যাপ্লাবিত স্থানগুলি ম্যালেরিয়া হইতে মুক্ত থাকে। বস্তুতঃ, এরূপ দেখা গিয়াছে যে, যেস্থানে বেশী বন্যার প্লাবন হয়, সেই স্থানগুলিই ম্যালেরিয়ার আক্রমণ হইতে নিষ্কৃতি পায়। কতকগুলি স্থানে বন্যা হয় না কিন্তু উপযুক্ত জলনিকাশের অভাবে খানা ডোবা খাল পুকুর প্রভৃতিতে রুদ্ধ জল জমিয়া থাকে। বর্ষার শেষে এই সমস্ত রুদ্ধ জলাশয় ম্যালেরিয়াবাহী মশকের জন্মস্থান হইয়া দাঁড়ায়, পচা গাছপালা উদ্ভিজ্জ হইতে একরকম বিষাক্ত গ্যাসও বাহির হইতে থাকে। বরাবর আমার একটা নিয়ম এই ছিল যে, আমি গ্রীষ্মাবকাশের কতকাংশ (মে মাসে) আমার গ্রামে কাটাইতাম। ইহার দ্বারা আমি পল্লীজীবনের আনন্দ উপভোগ করিতে পারিতাম এবং গ্রামবাসী ও কৃষকদের সঙ্গেও আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হইত। ঐ বৎসর (১৯১০-১১) দৈবক্রমে বর্ষা একটু আগেই হইয়াছিল। আমাদের গ্রামের স্কুলের পুরস্কার বিতরণী সভায় যোগদান করিবার জন্য আমি ১৫ই জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করিলাম। পরদিনই আমি কলিকাতা যাত্রা করিলাম এবং কলিকাতা পৌঁছিয়াই ম্যালেরিয়ার পালাজ্বরে আক্রান্ত হইলাম। এক বৎসর এইভাবে কাটিল। চিররুগ্ন ব্যক্তির পক্ষে এইরূপ ম্যালেরিয়া জ্বরের আক্রমণ বেশীদিন সহ্য করা কঠিন। বন্ধুগণ আমার স্বাস্থ্যের জন্য উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন এবং ডাঃ নীলরতন তাঁহার দার্জিলিঙের বাড়ীতে আমাকে পাঠাইলেন, সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যহ তিনবার করিয়া কুইনাইন সেবন করিবার ব্যবস্থাও করিয়াছিলেন। দার্জিলিঙের স্বাস্থ্যকর জলবায়ুতে আমার শরীর ভাল হইল। এই ঘটনাটি আমি প্রায় বিস্মৃত হইয়াছিলাম। কিন্তু বাংলা বৈজ্ঞানিক মাসিক পত্রিকা “প্রকৃতি”তে একখানি পুরাতন পত্র প্রকাশিত হওয়াতে এই ঘটনা আমার মনে পড়িয়াছে। পত্রখানি উদ্ধৃত করিতেছি।
দার্জ্জিলিং, প্লেন ইডেন
১৪।৬।১১
তোমার ১২ই তারিখের পত্র পাইয়া আনন্দিত হইলাম। আমিই তোমার কাজ সম্বন্ধে জানিবার জন্য তোমাকে পত্র লিখিব বলিয়া মনে করিতেছিলাম। হেমেন্দ্রকে তুমি বলিতে পার যে, ‘মেখিল ইথর’ সম্বন্ধে তাহার গবেষণা যোগ্য সমাদর লাভ করিবে।
আহত সেনাপতি দূর হইতে যেমন দেখেন ভীষণ যুদ্ধ হইতেছে এবং তাঁহার বিজয়ী সৈন্যগণ অভিযান করিতেছে, আমার মনের ভাবও কতকটা সেইরূপ। ভগবানের কৃপায় আমার রোগের বৎসরে বহু অপ্রত্যাশিত এবং গৌরবময় সাফল্যলাভ হইয়াছে। তোমরা এইভাবে ভারতীয় প্রতিভার জীবন্ত শক্তির নিদর্শন জগতের নিকট প্রদর্শন করিতে থাকিবে।
রসিকের কার্যও যে অগ্রসর হইতেছে, ইহা জানিয়া আমি সুখী হইলাম। আশা করি আমি শীঘ্রই তাহার নিকট হইতে তাহার গবেষণার ফলাফল জানিতে পারিব।
গত শুক্রবার ও শনিবার আবহাওয়া বেশ রৌদ্রোজ্জ্বল ছিল। কিন্তু তারপর তিন দিন ক্রমাগত বৃষ্টি হইয়াছে। গত কল্য হইতে আকাশ আবার পরিষ্কার হইয়াছে।
আমি ভাল আছি। ধীরেন্দ্র জার্মানি হইতে আমাকে পত্র লিখিয়াছে। সে পি-এইচ, ডি উপাধির জন্য তাহার মৌলিক প্রবন্ধ দাখিল করিবার অনুমতি পাইয়া আনন্দিত হইয়াছে। কিন্তু আমি আশা করি, তুমি, হেমেন্দ্র ও রসিক কার্যতঃ প্রমাণ করিতে পারিবে যে, এদেশে থাকিয়াও অনুরূপ উচ্চাঙ্গের গবেষণা করা যাইতে পারে।
ভবদীয়
(স্বাঃ) পি, সি, রায়
জিতেন্দ্রনাথ রক্ষিত,
বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যাণ্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস্
৯১, আপার সার্কুলার রোড, কলিকাতা।
আমাকে স্বীকার করিতে হইতেছে যে, এই পত্রে কি লিখিয়াছিলাম তাহা আমার আদৌ স্মরণ ছিল না। ভারতীয় রসায়ন গোষ্ঠী ধীরে ধীরে কিভাবে গড়িয়া উঠিয়াছে, এই পত্র হইতে তাহারও যোগসূত্রের সন্ধান পাইয়াছি।
এই সময়ে আর একজন যুবক আমার প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি সিটি কলেজ হইতে বি, এ পাশ করেন, রসায়নবিদ্যা তাঁহার অন্যতম পাঠ্যবিষয় ছিল। উহার প্রতি অনুরাগ বশতঃ তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়নশাস্ত্রে এম, এ পড়িতে লাগিলেন। তাঁহার বিমল বুদ্ধি ছিল এবং রসায়ন শাস্ত্রে শীঘ্রই প্রবেশলাভ করিলেন। তাঁহার আর একটি যোগ্যতা ছিল যাহা আমাদের বিজ্ঞানের গ্রাজুয়েটদের মধ্যে বড় একটা দেখা যায় না। বাংলা ও ইংরাজী সাহিত্যে তাঁহার দখল ছিল এবং টেষ্ট টিউবের মত লেখনী ধারণেও তিনি সুপটু ছিলেন। এই কারণে আমার সাহিত্য চর্চায় তিনি অনেক সময়ে সহায়তা করিতে পারিয়াছিলেন। ইনি হেমেন্দ্রকুমার সেন। Tetramethylammonium hyponitrite সম্বন্ধে গবেষণায় তিনি আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংসৃষ্ট ছিলেন এবং তাঁহার যোগ্যতার বিশেষ পরিচয় দেন। পূর্বোক্ত পদার্থের বিশ্লেষণ করিবার জন্য তিনি নিজে একটি প্রণালী উদ্ভাবন করেন। সেনের আর একটি কৃতিত্বের পরিচয় এই যে, তিনি জীবিকার জন্য ছাত্র পড়াইতেন এবং পরে সিটি কলেজে আংশিকভাবে অধ্যাপকের কাজও করিতেন। তাঁহার ছাত্রজীবন গৌরবময় ছিল। এম, এ পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন এবং প্রেমচাঁদ বৃত্তিও পান। ইহার ফলে তিনি লণ্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজ অব সায়েন্সে রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যয়ন সম্পূর্ণ করিবার সুযোগ প্রাপ্ত হন। ঐ কলেজেও তিনি বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন এবং অধ্যাপকেরা তাঁহার উচ্চ প্রশংসা করেন। লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডক্টর’ উপাধির জন্য তিনি যে মৌলিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ দাখিল করেন, তাহা খুব উচ্চাঙ্গের। পরে উহা ‘কেমিক্যাল সোসাইটি’র জার্নালে প্রকাশিত হইয়াছিল।
হেমেন্দ্র কুমারের সহপাঠী আর একজন যুবক বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তিনি স্বল্পভাষী, গম্ভীরপ্রকৃতি ছিলেন। চলিত কথায় বলে, “স্থির জলের গভীরতা বেশী—” তিনি তাহার দৃষ্টান্ত স্বরূপ ছিলেন। তিনি এম, এস-সি পরীক্ষায় উচ্চ স্থান অধিকার করেন এবং সেনের সঙ্গে একযোগে কিছু গবেষণাও করেন। কিন্তু তাঁহার বিশেষ যোগ্যতার পরিচয় পরে পাওয়া যায়। ইঁহার নাম বিমানবিহারী দে। দে এবং সেনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধত্ব দেখিয়া আমি মুগ্ধ হইতাম এবং অনেক সময় তাঁহাদিগকে রহস্য করিয়া “হ্যামলেট ও হোরাশিও” অথবা “ডেভিড ও জোনাথান” বলিতাম। দে সেনের দুই বৎসর পূর্বে ইংলণ্ডে গমন করেন এবং ‘ইম্পিরিয়াল কলেজ অব সায়েন্সে’ জৈব রসায়ন সম্বন্ধে গবেষণা করিয়া যথা সময়ে ‘ডক্টর’ উপাধি পান।
এই সময়ে নীলরতন ধর “ফিজিক্যাল কেমিষ্ট্রী” সম্বন্ধে মৌলিক প্রবন্ধ লিখিয়া এম, এস-সি ডিগ্রী পান। তিনি যে পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন, তাহা বলা বাহুল্য।
যদিও অজৈব রসায়ন শাস্ত্রেই আমি অধ্যাপনা করিতাম, তথাপি এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় হইতে ‘ডক্টর’ উপাধি লাভ করিবার পর হইতেই, আমি জৈব রসায়নে যে সব নূতন নূতন সত্য আবিষ্কৃত হইতেছিল, সেগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ রাখিতে চেষ্টা করিতাম। ১৯১০ সালের পর হইতে জৈব রসায়ন সম্বন্ধে উচ্চ শ্রেণীর ছাত্রদের আমি অধ্যাপনা করিতাম। বিশেষ ভাবে ইহার ঐতিহাসিক বিকাশই আমার আলোচ্য বিষয় ছিল। রসায়ন শাস্ত্রের এত দ্রুত উন্নতি হইতেছিল এবং ইহার নানা বিভাগ এত জটিল হইয়া উঠিতেছিল যে, একজন লোকের পক্ষে তাহার দুই একটি বিভাগেও অধিকার লাভ করা কঠিন হইয়া পড়িতেছিল।
দৃষ্টান্তস্বরূপ ‘স্পেকট্রাম’ বিশ্লেষণের কথাই ধরা যাক। বুনসেন এবং কার্চ্চফের পর আংষ্ট্রম এবং থেলেন, ক্রুক্ক্স এবং হার্টলী প্রভৃতি তাঁহাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ অংশ এই কার্যে ব্যয় করিয়াছেন। কুরী দম্পতি কর্তৃক রেডিয়ম আবিষ্কারের পর হইতে রসায়নশাস্ত্রের একটি নূতন শাখার উৎপত্তি হইল। বহু বৈজ্ঞানিক এই নূতন বিষয়ের গবেষণায় আত্মনিয়োগ করিয়াছেন এবং এ সম্বন্ধে বিপুল সাহিত্য গড়িয়া উঠিয়াছে। আমি যখন এডিনবার্গে ছাত্র ছিলাম, তখন ফিজিক্যাল কেমিষ্ট্রীর ভ্রণাবস্থা বলিতে হইবে। কিন্তু অষ্টোয়াল্ড, ভ্যাণ্ট হফ এবং আরেনিয়াসের অক্লান্ত পরিশ্রম ও গবেষণার ফলে এই বিজ্ঞান বিরাট আকার ধারণ করিয়াছে। এবং ইহারই এক প্রশাখা Colloid Chemistry অষ্টোয়াল্ড, সিগমণ্ডি এবং জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়[২] প্রভৃতির ন্যায় বৈজ্ঞানিকদের হাতে অদ্ভুত উন্নতি সাধন করিয়াছে।
আমি যখন এডিনবার্গে ছাত্র ছিলাম, তখন ফিজিক্যাল কেমিষ্ট্রী কেবল গড়িয়া উঠিতেছিল। এই সময়ে এই বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা আরেনিয়াস ষ্টকহলম শহরে গবেষণা করিতেছিলেন। আমার বেশ মনে আছে যে, ঐ সময়ে এই সুইডিশ বৈজ্ঞানিককে গোঁড়া প্রাচীন পন্থী বৈজ্ঞানিকেরা কিভাবে বিদ্রূপ ও উপহাস করিতেন। যথা সময়ে আরেনিয়াসের বৈজ্ঞানিক তথ্য জগতে স্বীকৃত ও গৃহীত হইল। তাঁহার বিদ্রূপকারীরাই তাঁহার প্রধান অনুরাগী হইয়া উঠিলেন। আমি তখন স্বপ্নেও ভাবি নাই যে ২৫ বৎসর পরে আমারই প্রিয় ছাত্র জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ এই বিজ্ঞানের বহুল উন্নতি করিবেন, এমনকি আরেনিয়াসের আবিষ্কৃত নিয়মও কিয়ৎ পরিমাণে পরিবর্তিত করিবেন।
১৯১০ সালে ‘ফিজিক্যাল কেমিষ্ট্রী’ বৈজ্ঞানিক জগতে স্থায়ী আসন লাভ করিল। কিন্তু ১৯০০ সাল পর্যন্ত ইংলণ্ডেও এই বিজ্ঞানের জন্য কোন স্বতন্ত্র অধ্যাপক ছিল না। ভারতে এই বিজ্ঞানের অনুশীলন ও অধ্যাপনার প্রবর্তক হিসাবে নীলরতন ধরই গৌরবের অধিকারী। তিনি কেবল নিজেই এই বিজ্ঞানের গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন নাই, জে, সি, ঘোষ, জে, এন, মুখার্জী এবং আরও কয়েক জনকে তিনি ইহার জন্য অনুপ্রাণিত করেন। নীলরতন সরকারী বৃত্তি লাভ করিয়া ইউরোপে যান এবং ইম্পিরিয়াল কলেজ অব সায়েন্সে ও সোরবোনে শিক্ষালাভ করেন। তিনি উচ্চাঙ্গের মৌলিক প্রবন্ধ লিখিয়া লণ্ডন ও পারি এই উভয় বিশ্ববিদ্যালয় হইতেই ডক্টর উপাধি লাভ করেন।
১৯১২ সালে লণ্ডনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিণ্ডিকেট আমাকে এবং দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারীকে এই কংগ্রেসে প্রতিনিধি করেন।
লণ্ডনে থাকিবার সময় আমি অ্যামোনিয়ম নাইট্রাইট সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ পাঠ করি। তাহাতে রসায়নজগতে একটু চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ইংলণ্ডে আসিবার পূর্বে কলিকাতায় থাকিতেই এ বিষয়ে গবেষণা করিয়া আমি সাফল্যলাভ করি। সৌভাগ্যক্রমে নীলরতন ধর আমার সহযোগিতা করেন এবং তিনকড়ি দে নামক আর একটি যুবকও আমার সঙ্গে ছিলেন। এই গবেষণায় প্রায় দুইমাস সময় লাগিয়াছিল, কোন কোন সময়ে একাদিক্রমে ১০।১২ ঘণ্টা পরীক্ষাকার্যে ব্যাপৃত থাকিতে হইত। কিন্তু বিষয়টি এমনই কৌতূহলপ্রদ যে কাজ করিতে করিতে আমাদের সময়ের জ্ঞান থাকিত না। প্রত্যহ পরীক্ষাকার্যের পর নীলরতন ধর যখন ফলাফল হিসাব করিতেন, তখন আমি অধীর আনন্দে প্রতীক্ষা করিতাম।
লণ্ডনে আমি কেমিক্যাল সোসাইটির সভায় এই প্রবন্ধ পাঠ করি। সভায় বহু সদস্য উপস্থিত ছিলেন। প্রবন্ধটি রাসায়নিকদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করিয়াছিল। স্যার উইলিয়াম র্যামজে আমাকে সানন্দে অভিনন্দিত করেন। ডাঃ ভেলী তাঁহার বক্তৃতায় উচ্চপ্রশংসা করেন।
“ডাঃ ভি, এইচ, ভেলী অধ্যাপক রায়কে সাদর অভ্যর্থনা করিয়া বলেন ‘তিনি (অধ্যাপক রায়) সেই আর্যজাতির খ্যাতনামা প্রতিনিধি—যে জাতি সভ্যতার উচ্চস্তরে আরোহণ করতঃ এমন এক যুগে বহু রাসায়নিক সত্যের আবিষ্কার করিয়াছিলেন, যখন এদেশ (ইংলণ্ড) অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। অধ্যাপক রায় অ্যামোনিয়ম নাইট্রাইট সম্বন্ধে যে সত্য প্রমাণ করিয়াছেন, তাহা প্রচলিত মতবাদের বিরোধী।’ উপসংহারে ডাঃ ভেলী ডাঃ রায় এবং তাঁহার ছাত্রগণকে অ্যামোনিয়ম নাইট্রাইট সম্বন্ধে মূল্যবান গবেষণার জন্য ভূয়সী প্রশংসা করেন। সভাপতিও ডাঃ ভেলীর উক্তি সমর্থন করিয়া ডাঃ রায় এবং তাঁহার ছাত্রগণকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন।”—The Chemist and Druggist.
এই সময়ে রস্কোর বয়স ৮০ বৎসর হইয়াছিল, তিনি কোন সভা সমিতিতে যাইতেন না। কিন্তু তিনি যখন এই গবেষণার ফল শুনিলেন, তখন বলিলেন “বেশ হইয়াছে!”
বিশ্ববিদ্যালয় কংগ্রেস লর্ড রোজবেরী কর্তৃক উদ্বোধিত হয় এবং স্যার জোসেফ টমসন প্রথমদিনের আলোচনা আরম্ভ করেন। কয়েকজন প্রসিদ্ধ বক্তা তাহার পর আলোচনায় যোগদান করেন। সর্বাধিকারী আমার পার্শ্বে বসিয়াছিলেন, তিনি আমাকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ হইতে কিছু বলিবার জন্য অনুরোধ করিতে লাগিলেন। আমি ইতস্ততঃ করিতে লাগিলাম এবং বলিলাম যে বৃহৎ সভায় বক্তৃতা করিতে উঠিলে আমি সঙ্কুচিত হইয়া পড়ি। তাঁহার (সর্বাধিকারীর) বাগ্মিতা আছে, সুতরাং তিনিই বক্তৃতা দিবার ভার গ্রহণ করুন, আমি নীরব হইয়াই থাকিব।
সর্বাধিকারী অটল-সঙ্কল্প। তিনি বলিলেন যে আলোচ্য বিষয়ে বক্তৃতা করিবার যোগ্যতা আমারই আছে এবং আমার সম্মতির অপেক্ষা না করিয়াই তিনি একটুকরা কাগজে আমার নাম লিখিয়া সভাপতির নিকট দিলেন। আমাকে বক্তৃতা করিতে আহ্বান করা হইলে, আমি সভাপতির আদেশ পালন করিতে বাধ্য হইলাম এবং যথাসাধ্য বক্তৃতা করিলাম। আমি মাত্র ৫ মিনিট বক্তৃতা করিয়াছিলাম এবং আমার সেই বক্তৃতা সভার কার্যবিবরণী হইতে নিম্নে উদ্ধৃত হইল,—
“মাননীয় সভাপতি মহাশয়, উপনিবেশ হইতে আগত প্রতিনিধিগণ অধ্যাপক এইচ, বি, অ্যালেন (মেলবোর্ণ) এবং অধ্যাপক ফ্র্যাঙ্ক অ্যালেন (মানিটোবা) যে সব মন্তব্য প্রকাশ করিলেন, তাহা আমি সমর্থন করিতেছি।
“ভারতীয় গ্রাজয়েট ও ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষ্ট-গ্রাজুয়েট অবস্থায় অধ্যয়ন ও গবেষণা করিতে আসিলে নানা অসুবিধা ভোগ করিয়া থাকেন। ভারতীয় গ্রাজুয়েটের যোগ্যতা অধিকতর উদারতার সহিত স্বীকার করা হইবে, ইহাই আমি প্রার্থনা করি। আমার আশঙ্কা হয়, কেবলমাত্র ভারতীয় ছাত্র বলিয়াই তাহাকে নিকৃষ্ট বলিয়া গণ্য করা হয়। রসায়ন-বিজ্ঞান সম্বন্ধে কথা বলিবার আমার কিছু অধিকার আছে। সম্প্রতি কলিকাতায় বহু প্রতিভাবান ছাত্র রসায়নশাস্ত্র সম্বন্ধে পোষ্ট-গ্রাজুয়েট অধ্যয়ন অবস্থায়ও গবেষণা করিতেছেন। তাঁহাদের লিখিত মৌলিক প্রবন্ধ ব্রিটিশ জার্নালসমূহে স্থান পাইয়া থাকে। সুতরাং তাঁহাদের কিছু যোগ্যতা আছে ধরিয়া লওয়া যাইতে পারে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ঐ সমস্ত গবেষণাকারী ছাত্র যখন ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ও উপাধিলাভের জন্য আসে, তখন তাহাদিগকে সেই পুরাতন রীতি অনুসারে প্রাথমিক পরীক্ষা দিতে বাধ্য করা হয়। ইহার ফলে আমাদের যুবকদের মনে উৎসাহ হ্রাস পায়। পূর্ববর্তী জনৈক বক্তা প্রস্তাব করিয়াছেন যে, এইরূপ ছাত্রকে নিজের নির্বাচিত কোন অধ্যাপকের অধীনে শিক্ষানবীশ থাকিতে হইবে এবং উক্ত অধ্যাপক তাহার কার্যে সন্তুষ্ট হইলে, তাহার মৌলিক প্রবন্ধ বিচার করিয়া তাহাকে সর্বোচ্চ উপাধি দেওয়া হইবে। আমি এই প্রস্তাব সমর্থন করি।
“স্যার জোসেফ টমসন বলিয়াছেন যে পোষ্ট-গ্রাজুয়েট ছাত্রকে উৎসাহ দিবার জন্য যোগ্য বৃত্তি প্রভৃতি দানের ব্যবস্থা করিতে হইবে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এইরূপে কতকগুলি ইতিমধ্যেই স্থাপন করিয়াছেন এবং ভবিষ্যতে আরও কয়েকটি করিবেন, আশা করা যায়। কিন্তু আমি ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাগত প্রতিনিধিদিগকে স্মরণ করাইয়া দিতে চাই যে, ভারতে আমরা স্মরণাতীত যুগ হইতে উচ্চ চিন্তা ও সরল অনাড়ম্বর জীবন যাপনের আদর্শ গ্রহণ করিয়া আসিয়াছি এবং অপেক্ষাকৃত সামান্য বৃত্তি ও দানের সাহায্যেই আমরা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় যথেষ্ট উন্নতির আশা করিতে পারি।
“মাননীয় সভাপতি মহাশয়, ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে যেরূপ শিক্ষা দেওয়া হয়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত শিক্ষাও সেইরূপ উচ্চশ্রেণীর একথা আমি বলিতে চাই না, বস্তুতঃ আমরা আপনাদের নিকট অনেক বিষয় শিখিতে পারি; কিন্তু যথেষ্ট ত্রুটীবিচ্যুতি ও অভাব সত্ত্বেও ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এমন অনেক লোককে গড়িয়া তুলিয়াছে, যাহারা দেশের গৌরব ও অলঙ্কারস্বরপ। কলিকাতার সর্বপ্রধান আইনজ্ঞ,—যাঁহার আইনজ্ঞানের গভীরতা ভারতের সর্বত্র প্রসিদ্ধ—কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট। কলিকাতার তিনজন প্রসিদ্ধ চিকিৎসক—যাঁহারা ব্যবসায়ে অসামান্য সাফল্য অর্জন করিয়াছেন—কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভাইস-চ্যান্সেলর—যিনি উপর্যুপরি বড়লাট কর্তৃক ভাইস-চ্যান্সেলর মনোনীত হইয়াছেন—সেই স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট।
“মাননীয় সভাপতি মহাশয়, আমি আসন গ্রহণ করিবার পূর্বে পুনর্বার আমাদের দেশের কলেজসমূহে যে শিক্ষা দেওয়া হয়, আপনাদিগকে তাহার অধিকতর সমাদর করিতে অনুরোধ করিতেছি।”
আমার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় সুফল হইয়াছিল, মনে হয়। অধিবেশন শেষ হইলে, মাষ্টার অব্ ট্রিনিটি ডাঃ বাটলার সর্বাধিকারী ও আমার সঙ্গে পরিচয় করিলেন এবং বলিলেন, কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করিবার সময় আমরা যেন তাঁহার অতিথি হই।
আমি প্রথমেই এই ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয় (কেম্ব্রিজ) দেখিতে গেলাম। সর্বাধিকারী আমার একদিন পূর্বে গিয়াছিলেন। আমি কেম্ব্রিজে পৌছিলে, সর্বাধিকারীকে সঙ্গে করিয়া মাষ্টার অব ট্রিনিটি ষ্টেশনে আসিলেন এবং আমাকে গাড়ীতে করিয়া তাঁহার বাড়ীতে লইয়া গেলেন। কিছু জলযোগের পর তিনি আমাদিগকে ট্রিনিটি কলেজের একটি ছোট ঘরে লইয়া গেলেন। ঘরটি একটি ছোটখাট মিউজিয়মের মত, বহু প্রাচীন ও মূল্যবান নিদর্শন সেখানে রক্ষিত আছে। আমার যতদূর মনে হয়, ‘লালে গ্রো’র (L’ Allegro) পাণ্ডুলিপির কয়েকপাতা আমি সেখানে দেখিয়াছি। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক নিউটন যে সমস্ত যন্ত্রপাতি লইয়া জ্যোতিষ ইত্যাদি সম্বন্ধে গবেষণা করিয়াছিলেন, তাহাও একটি মানমন্দির বা গবেষণাগারে রক্ষিত আছে।
ডাঃ বাটলার প্রাচীন সাহিত্যে সুপণ্ডিত, মধুর প্রকৃতির লোক। তাঁহাকে দেখিয়া আমাদের দেশের প্রাচীন পণ্ডিতদের কথা আমার মনে পড়িল। তিনি গল্প করিলেন, সেকালে জজেরা যখন কেম্ব্রিজে আদালত বসাইতেন, তাঁহাদের দলবল ট্রিনিটি কলেজের রসুইখানা ইত্যাদি দখল করিয়া লইত। আমার বিশ্বাস, এখনও ঐ প্রাচীন প্রথা আছে। ইংলণ্ডের রাজা এখনও প্রতি বৎসর যখন কেম্ব্রিজে ‘রিভিউ’ দেখিতে আসেন, তখন তিনি ট্রিনিটি কলেজের অতিথি হন। মাষ্টার আমাদের থাকিবার জন্য ঘর ঠিক করিয়াছিলেন এবং সেই সময়ে দেখাইলেন, পাশের একটি ঘর রাজার অভ্যর্থনার জন্য সাজানো হইতেছে।
বাহির হইতে কংগ্রেসে আগত প্রতিনিধিগণ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করিবার জন্য বাছিয়া লইতে পারেন এবং ঐ সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁহারা অতিথিরূপে গণ্য হন। আমি উত্তর ইংলণ্ডের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় দেখিব ঠিক করিলাম। উহার মধ্যে শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয় একটি। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি অপেক্ষাকৃত নূতন এবং অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ বা এডিনবার্গের মত ইহার তেমন প্রাচীনতার খ্যাতিও নাই। সেজন্য ইহা দেখিবার জন্য কম প্রতিনিধিই যাইতেন। আমার বাল্যকালে শেফিল্ড রজার্সের ছুরি, কাঁচি, ক্ষুর প্রভৃতির কারখানার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল, ঐগুলি বাংলাদেশে সে সময়ে খুব ব্যবহৃত হইত। শেফিল্ড এখন খুব বড় শহর হইয়া উঠিয়াছে, অসংখ্য কলকারখানা এখানে গড়িয়া উঠিয়াছে। সুপ্রসিদ্ধ ভিকার্স ম্যাক্সিন এণ্ড কোম্পানির কারখানা এখানে। শেফিল্ড অতিথিগণের অভ্যর্থনার জন্য বিপুল আয়োজন করিয়াছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে ঐ দিন সকাল বেলায় একমাত্র অতিথি গিয়াছিলাম আমি। একটা কৌতুককর ঘটনা এখনও আমার মনে আছে। ষ্টেশনে নামিলে, পোর্টার আমার মালপত্র একটা টানাগাড়ীতে তুলিয়া লইল এবং বলিল যে কোন ট্যাক্সি ভাড়া করিবার দরকার নাই, কেননা নিকটেই অনেকগুলি হোটেল আছে। আমি কোন্ হোটেলে যাইতে চাই, তাহাও সে জিজ্ঞাসা করিল। আমি কোন হোটেলের নাম করিতে পারিলাম না,—কেবল সম্মুখের ছোট হোটেল দেখাইয়া দিলাম। পোর্টার গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল—“ও হোটেল আপনার যোগ্য নয়।” আমি তাহার উপরই ভার দিলাম এবং সে আমাকে নিকটবর্তী একটি ফ্যাশনেবল হোটেলে লইয়া গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের আফিসে আমার আগমন সংবাদ দিলে,—সকলেই আমার অভ্যর্থনার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক হিক্স্ এবং সমস্ত অধ্যাপক আমাকে লইয়া গিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ দেখাইলেন। যে হোটেলে আমি ছিলাম, সেখানেই তাঁহারা আমার সম্মানার্থ লাঞ্চের আয়োজন করিলেন। সন্ধ্যার পর একটি চমৎকার অনুষ্ঠান হইল। টাউন হলে বিরাট ভোজের আয়োজন হইল এবং ‘মাষ্টার কাটলার’ আমার এবং কানাডার একজন প্রতিনিধির সম্বর্ধনার প্রস্তাব করিলেন। কানাডার প্রতিনিধিটি অপরাহ্ণের দিকে শেফিল্ডে পৌঁছিয়াছিলেন। সুতরাং সমস্তদিন অতিথিরূপে একমাত্র আমিই রাজোচিত আদর অভ্যর্থনা পাইয়াছিলাম। এই জন্যই বলিয়াছি যে ‘দুর্ভাগ্যক্রমে অতিথিরূপে একমাত্র আমি সকালবেলা শেফিল্ডে গিয়াছিলাম।’ উৎসব অনুষ্ঠান প্রভৃতিতে যোগ দিতে আমার স্বভাবতঃই সঙ্কোচ হয়।
লণ্ডনে “ওয়ারশিপফুল ফিসমঙ্গার্স কোম্পানি” (মৎস্য ব্যবসায়ী) অতিথিদের অভ্যর্থনার জন্য একটি ভোজ দিয়াছিলেন। এই ফিসমঙ্গার্স কোম্পানি এবং ভিণ্টার্স কোম্পানি, মার্চেণ্ট টেলার্স কোম্পানি প্রভৃতি প্রভূত ঐশ্বর্যশালী এবং বহু পুরাতন। এই সব ভোজ এত ব্যয়বহুল যে, ভারতবাসীদের নিকট তাহা রূপকথার মত বোধ হয়। ফিসমঙ্গার্স কোম্পানির একটি ভোজ সভা প্রসঙ্গে মেকলে লিখিয়াছেন—“একবার তাহাদের ভোজে জন প্রতি প্রায় দশ গিনি (১৫০৲ টাকা) ব্যয় হইয়াছিল।” (মেকলের জীবনী, প্রথম খণ্ড, ৩৩৭ পৃঃ)। আর একস্থানে তিনি লিখিয়াছেন, “ভোজের সম্বন্ধে এই কোম্পানিই পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।” (জীবনী, ৩৩৬ পৃঃ)। এই সব কোম্পানির শহরে এবং অন্যান্য স্থানে ভূসম্পত্তি আছে, উহার মূল্য বর্তমানকালে প্রায় সহস্রগুণ বাড়িয়া গিয়াছে। ভোজের খাদ্যদ্রব্যের তালিকায় এগারটি পদ ছিল, প্রথমে ‘সুপ’ এবং প্রত্যেক পদের শেষে উৎকৃষ্ট মদ্য। এইসব মদ্য প্রায় অর্ধশতাব্দী বা তার বেশী মাটীর নীচে পাত্রে রক্ষিত এবং ভোজের সময়ে খোলা হইয়াছিল। এই সব অনুষ্ঠানে বহু প্রাচীন প্রথা অনুষ্ঠিত হয়, যথা “কাপ অব লভের” অনুষ্ঠান। সেকালে এই অনুষ্ঠানের সময়, অতিথিরা অতিরিক্ত মদ্য পান করিয়া পরস্পরের সঙ্গে কলহ করিত। এমনকি পরস্পরকে অস্ত্রদ্বারা আহতও করিত। কাপটি বৃহদাকার, ধাতুনির্মিত। ইহা মদ্যপূর্ণ করা হইত এবং প্রত্যেক অতিথি উহা হইতে একটু মদ্য আস্বাদ করিয়া, তাহার পাশের লোকের হাতে দিত। ইহা শান্তি ও সদিচ্ছার প্রতীক স্বরূপ। আমি মদ্যপান করিনা, সুতরাং কেবল মুখের নিকট তুলিয়া ধরিয়া অন্যের হাতে দিলাম।
কংগ্রেসের অধেবেশনের সমকালে রয়েল সোসাইটির ২৫০তম বার্ষিক উৎসবও হইতেছিল। আমি এই উৎসবেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ হইতে প্রতিনিধিরূপে আসিয়াছিলাম। সুতরাং ইহার কয়েকটি অনুষ্ঠানে আমি যোগ দিয়াছিলাম। লণ্ডনের লর্ড মেয়র রয়্যাল সোসাইটির সদস্যগণ এবং কংগ্রেসের প্রতিনিধিগণকে গিল্ড হলে এই স্মরণীয় ঘটনা উপলক্ষে একটি বিরাট ভোজ দিবার আয়োজন করিলেন। আমিও ঐ ভোজে লর্ড মেয়রের অতিথিরূপে যোগ দিলাম। রাজাও উইণ্ডসর প্রাসাদে অতিথিদের সম্বর্ধনা করিলেন। বহু-বিস্তৃত সবুজ তৃণমণ্ডিত মাঠ এবং বৃক্ষের সারি আমার নিকট বড় মনোরম বোধ হইল।
ডাঃ বিমানবিহারী প্রেসিডেন্সি কলেজ হইতে এম, এস-সি উপাধি লাভ করিয়া এই সময়ে লণ্ডনে ‘ডক্টর’ উপাধির জন্য অধ্যয়ন করিতেছিলেন। আমার লণ্ডন বাস কালে তিনি আমাকে যথেষ্ট সহায়তা করিয়াছিলেন। এই সময়ে পরলোকগত আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নিকট হইতে আমি একখানি পত্র পাইলাম। এই পত্র ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ এবং ভবিষ্যতের পক্ষে বিপুল আশাসূচক, কেননা ইউনিভারসিটি কলেজ অব সায়েন্স (বিজ্ঞান কলেজ) প্রতিষ্ঠার পূর্বাভাষ এই পত্রে ছিল। নিম্নে পত্রখানির অনুবাদ উধৃত হইল:—
সিনেট হাউস, কলিকাতা
২৫শে জুন, ১৯১২
আপনার স্মরণ থাকিতে পারে যে, গত ২৪শে জানুয়ারী তারিখে সিনেটের সম্মুখে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদের প্রশ্ন উপস্থিত হয়, তখন আপনি দুঃখ করিয়া বলিয়াছিলেন যে, বিজ্ঞানের অধ্যাপকের জন্য কোন ব্যবস্থা করা হয় নাই। তখন আমি আপনাকে আশ্বাস দিয়াছিলাম যে,—শীঘ্রই হয়ত বিজ্ঞানের অধ্যাপকের জন্য ব্যবস্থাও হইবে। আপনি শুনিয়া সুখী হইবেন যে, আমার ভবিষ্যৎ বাণী সফল হইয়াছে এবং আপনার ও আমার উচ্চাশা পূর্ণ হইয়াছে। আমরা একটি পদার্থবিদ্যার, ও আর একটি রসায়নশাস্ত্রের— দুইটি অধ্যাপক পদের প্রতিষ্ঠা করিয়াছি। আমরা অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় সংসৃষ্ট একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার স্থাপনের সঙ্কল্পও করিয়াছি। মিঃ পালিতের মহৎ দান এবং তাহার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজার্ভ ফণ্ড হইতে আরও আড়াই লক্ষ টাকা দিয়া, আমরা এই সব ব্যবস্থা করিতে সক্ষম হইয়াছি। গত শনিবার আমি সিনেটের সম্মুখে যে বিবৃতি দিয়াছি, তাহাতে এইসব বিষয় পরিষ্কাররূপে বলা হইয়াছে। উহার একখানি নকল আপনাকে পাঠাইলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রসায়নাধ্যাপকের পদ গ্রহণ করিবার জন্য আমি আপনাকে এখন মহানন্দে আহ্বান করিতেছি। আমার বিশ্বাস আছে যে আপনি এই পদ গ্রহণ করিবেন। বলা বাহুল্য, আমি এরূপ ব্যবস্থা করিব যাহাতে আর্থিক দিক হইতে আপনার কোন ক্ষতি না হয়। আপনি ফিরিয়া আসিলেই, আপনার সহায়তায় আমরা প্রস্তাবিত গবেষণাগারের পরিকল্পনা গঠন করিব এবং যতশীঘ্র সম্ভব উহা কার্যে পরিণত করার চেষ্টা করিব। আপনি যদি ফিরিবার পূর্বে গ্রেট ব্রিটেন ও ইউরোপের কতকগুলি উৎকৃষ্ট গবেষণাগার দেখিয়া আসেন, তবে কাজের সুবিধা হইবে।
আপনাকে “সি, আই, ই” উপাধি দেওয়া হইয়াছে দেখিয়া আমি সুখী হইয়াছি, কিন্তু আমি মনে করি যে, ইহা দশ বৎসর পূর্বেই দেওয়া উচিত ছিল।
আশাকরি আপনি ভাল আছেন এবং ইংলণ্ড ভ্রমণে আপনার উপকার হইয়াছে।
ভবদীয়
আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
আমি যে উত্তর দিয়াছিলাম, তাহার নকল আমি রাখি নাই। কিন্তু যতদূর স্মরণ হয় তাহাতে নিম্নলিখিত মর্মে আমি উত্তর দিয়াছিলাম:—“প্রস্তাবিত বিজ্ঞান কলেজের দ্বারা আমার জীবনের স্বপ্ন সফল হইবে বলিয়া আমি মনে করি এবং এই কলেজে যোগ দেওয়া এবং ইহার সেবা করা আমার কেবল কর্তব্য নয়, ইহাতে আমার পরম আনন্দও ইইবে।”
কলিকাতায় ফিরিয়া আমি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলাম এবং তাঁহার বিজ্ঞান কলেজের স্কীম সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করিব, এই প্রতিশ্রুতি দিলাম। কলেজ খোলা হইলেই আমি তাহাতে অধ্যাপকরূপে যোগদান করিব, ইহাও বলিলাম। ইতিমধ্যে ডাঃ প্রফুল্লচন্দ্র মিত্রকে ভারতের অন্যান্য স্থানে প্রধান প্রধান লেবরেটরি দেখিয়া একটি লেবরেটরির প্ল্যান প্রস্তুত করিবার জন্য নিয়োগ করা হইল। তিনি আমার একজন ভূতপূর্ব ছাত্র এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে রসায়ন শাস্ত্রে সর্বোচ্চ উপাধি লইয়া তিনি বার্লিন বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিতে গিয়াছিলেন। সেখানকার ‘ডক্টর’ উপাধি লইয়া তিনি সবে ফিরিয়া আসিয়াছিলেন।
১৯১২ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয় কংগ্রেস হইতে ফিরিবার পর, আমার সহকর্মী ও ছাত্রেরা আমাকে একটি প্রীতি-সম্মেলনে সম্বর্ধনা করেন। মিঃ জেমস সেই সম্মেলনে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন:—
“বৈজ্ঞানিক হিসাবে ডাঃ রায়ের কার্যাবলী বর্ণনার স্থল ও সময় এ নহে। তাঁহার কার্যাবলী সহজেই চার ভাগে বিভক্ত করা যাইতে পারে। প্রথমতঃ, ডাঃ রায়ের রাসায়নিক আবিষ্কার, যে সমস্ত মৌলিক গবেষণার দ্বারা তিনি জগতের রসায়নবিদদের মধ্যে সম্মানের আসন লাভ করিয়াছেন। দ্বিতীয়তঃ, তাঁহার হিন্দু রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাস। এ বিষয়ে ইহা প্রামাণিক গ্রন্থ, প্রাচীন ভারত রসায়ন বিদ্যায় কতদূর উন্নতি লাভ করিয়াছিল, এই গ্রন্থ বিজ্ঞান-জগতের নিকট তাহার পরিচয় দিয়াছে। তাঁহার আর একটি বিশেষ কৃতিত্ব, বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যাণ্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কসের প্রতিষ্ঠা, ইহা একটি প্রধান শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং সফলতার সঙ্গে পরিচালিত হইতেছে। বর্তমান যুগে বাংলার তথা ভারতের একটা প্রয়োজনীয় বিষয় যে শিল্প বাণিজ্যের উন্নতি, তাহা সকলেই স্বীকার করেন। ডাঃ পি, সি, রায় ব্যবসায়ী নহেন, তিনি বৈজ্ঞানিক। কিন্তু ব্যবসায়ী বা ব্যবসায়ীরা যে স্থলে ব্যর্থকাম, সে স্থলে তিনি একটি বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিয়াছেন। তাঁহার রাসায়নিক জ্ঞান ও প্রতিভা এই প্রতিষ্ঠানের সেবায় নিয়োজিত করিয়া তিনি ইহাকে ব্যবসায়ের দিক দিয়া সফল করিয়া তুলিয়াছেন এবং অংশীদার রূপে অন্য লোকে এখন ইহার লভ্যাংশ ভোগ করিতেছে। তাঁহার আর একদিকে কৃতিত্ব—এবং আমার মতে ইহাই তাঁহার শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব—ডাঃ রায় আমাদের এই লেবরেটরিতে একদল যুবক রসায়নবিদকে গড়িয়া তুলিয়াছেন, তাঁহার আরব্ধ কার্য এই সমস্ত শিষ্যপ্রশিষ্যেরাই চালাইবে। এই জন্যই একজন বিখ্যাত ফরাসী অধ্যাপক এই লেবরেটরি সম্বন্ধে বলিয়াছেন—ইহা বিজ্ঞানের স্মৃতিকাগার, এখান হইতে নব্য ভারতের রসায়নবিদ্যা জন্মলাভ করিতেছে।” (প্রেসিডেন্সি কলেজ ম্যাগাজিন।)
এই সমস্ত উচ্চ প্রশংসাপূর্ণ কথা নিয়া আমি সত্যই সংকোচ বোধ করিতেছিলাম। এই সমস্ত কথা আমি উদ্ধৃত করিলাম ইহাই দেখাইবার জন্য যে মিঃ জেমস সাহিত্যসেবী হইলেও বিজ্ঞান বিভাগে যে সমস্ত কাজ হইতেছিল, তাহার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তিনি সম্যক অনুভব করিতে পারিতেন।
- ↑ অধ্যাপক ভাটনগর তাঁহার অননুকরণীয় সরস ভাষার বলেন,—
“আমি একটা গুরুতর অপরাধ করিয়াছি যে স্যর পি, সি, রায়ের ছাত্র হইতে পারি নাই। স্যর পি, সি, রায় সেজন্য নিশ্চয়ই আমাকে ক্ষমা করেন নাই। কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থনার্থ আমি বলিতে পারি যে আমি অনেক পরে এ পৃথিবীতে আসিয়াছি, সুতরাং আমি তাঁহার রাসায়নিক “প্রশিষ্য” হইয়াছি। সার পি, সি, রায়ের ভূতপূর্ব ছাত্র মিঃ অতুলচন্দ্র ঘোষের নিকট আমি রসায়নশাস্ত্রে শিক্ষালাভ করিয়াছি।” (১৯২৮ সনে জানুয়ারীতে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের রসায়ন শাখার প্রদত্ত সভাপতির অভিভাষণ) - ↑ ১৯২০ সালের ৪ঠা নবেম্বরের ‘নেচার’ (৩২৭-২৮ পঃ) লিখিয়াছেন— ফ্যারাডে এবং ফিজিক্যাল সোসাইটির যুক্ত অধিবেশনে কোলয়েড সম্বন্ধে যে সব প্রবন্ধ পঠিত হইয়াছিল, তাহার মধ্যে মিঃ জে, এন, মুখার্জীর প্রকল্পই প্রধান, কেননা ইহাতে বহু নূতন তত্ত্বের উল্লেখ ছিল।”