যুগান্তর

শিবনাথবাবুর যুগান্তর উপন্যাসখানি পাঠ করিতে করিতে কর্তব্যক্লান্ত সমালোচকের চিত্ত বহুকাল পরে আনন্দ এবং কৃতজ্ঞতায় উচ্ছ্বসিত হইতেছিল। এমন পর্যবেক্ষণ, এমন চরিত্রসৃজন, এমন সরস হাস্য, এমন সরল সহৃদয়তা বঙ্গসাহিত্যে দুর্লভ। লেখক বিশ্বনাথ তর্কভূষণকে আমাদের নিকট পরমাত্মীয়ের ন্যায় পরিচিত করিয়া দিয়াছেন। এমন সত্য চরিত্র বাংলা উপন্যাসে ইতিপূর্বে কোথাও দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয় না। লেখক তাহাকে সমস্ত তুচ্ছ ঘটনার মধ্যে প্রত্যক্ষবৎ জাজ্বল্যমান দেখিয়াছেন—তাঁহার চরিত্রটিকে প্রতিদিনের হাস্যে এবং অশ্রুজলে, দোষে এবং গুণে অতি সহজেই সজীব করিয়া তুলিয়াছেন। বিরলবসতি বঙ্গসাহিত্যরাজ্যে তর্কভূষণমহাশয় যে একটি জনসংখ্যা বৃদ্ধি করিলেন এবং আমরা যে একটি স্থায়ী বন্ধু লাভ করিলাম সে বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহমাত্র নাই।

 কেবল তর্কভূষণকে কেন, লেখক বঙ্গসাহিত্যে নশিপুর নামক আন্তএকটি গ্রাম বসাইয়া দিয়াছেন। এই গ্রামের ক্রিয়াকর্ম, আমোদ-প্রমোদ, কৌতুক-উপদ্রব, সুজন-দুর্জন সমস্তই পাঠকদের চিরসম্পত্তি হইয়া গিয়াছে। তর্কভূষণের টোল, ‘হাঁসের দল’, চিমু ঘোষ, জহরলালের ইতিহাস নূতনগঠিত সদ্য-পঠিত হইলেও, তাহা আমাদের নিকট যেন অনেক কালের পুরাতন পরিচিত হইয়া উঠিয়াছে। এ দিকে উলোর রামরতন মুখুজ্যের ঘরে তর্কভূষণের কন্যা ভুবনেশ্বরীর ঘরকন্নাও আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ সত্য এবং অত্যন্ত বেদনাজনক হইয়াছে। সংক্ষেপে তর্কভূষণ, তাহার গ্রাম, তাহার পরিবার, তাহার ছাত্রবর্গ, তাহার শক্রমিত্র সকলকে লইয়া একটি গ্রাম্যগ্রহমণ্ডলীর কেন্দ্রবর্তী সূর্যের ন্যায় আমাদের নিকট প্রবল উজ্জ্বল ভাবে প্রকাশিত হইয়াছেন। এমন সময়ে আমাদের পরমদুর্ভাগ্য বশত উপন্যাসটি অকস্মাৎ যুগান্তরে লোকান্তরে আসিয়া উপস্থিত হইল। কোথায় গেল তর্কভূষণ, নশিপুর, হাঁসের দল—কোথা হইতে উপস্থিত নবীনচন্দ্র, হাতিবাগান, নবরত্নসভা। গ্রন্থকারও নৃতন বেশ ধারণ করিলেন। তিনি ছিলেন ঔপন্যাসিক, হইলেন ঐতিহাসিক; ছিলেন ভাবুক, হইলেন নীতিপ্রচারক। আমরা রসসম্ভোগের সত্যযুগ হইতে তর্কবিতর্কের যুগান্তরে আসিয়া অবতীর্ণ হইলাম। গ্রন্থকার পূর্বে যেখানে মানুষ গড়িতেছিলেন এখন সেখানে মত গড়িতে লাগিলেন, পূর্বে যেখানে আনন্দনিকেতন ছিল এখন সেখানে পাঠশালা বসিয়া গেল। এরূপ অঘটন সংঘটন হইল কেন তাহা বলিতে পারি না। তর্কভূষণের বিধবা ভগিনী বিজয়া এবং তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্র হরচন্দ্রের কলিকাতায় আগমনকালটি তাঁহাদের নিজের পক্ষে সুক্ষণ, কিন্তু উপন্যাসের পক্ষে কুক্ষণ; কারণ সেই উপলক্ষটুকু অবলম্বন করিয়া গ্রন্থের শেষার্ধটি প্রথমার্ধের সহিত জুড়িয়া দেওয়া হইয়াছে। পরস্পরের মধ্যে কোনো অবশ্য-যোগ নাই।

 দুইটা মানুষকে এক দড়ি দিয়া বাঁধিলে ঐক্য হিসাবেও তাহাদের বলবৃদ্ধি হয় না এবং দ্বৈত হিসাবেও তাহাদের সুবিধা হয় না। তেমনি দুই স্বতন্ত্র গল্পকে জবরদস্তি করিয়া একত্র বাঁধিয়া দিলে একটা গল্পের হিসাবেও তাহাদের স্বচ্ছন্দ স্বাধীন পরিণতিতে বাধা দেওয়া হয়, দুইটা গল্পের হিসাবেও তাহাদিগকে আড়ষ্ট করিয়া বধ করা হয়। বর্তমান গ্রন্থেও তাহাই হইয়াছে। গ্রন্থকার যদি দুটি গল্পকে বিচ্ছিন্ন আকারে রচনা করিতেন তাহা হইলে সম্ভবত দুটিকেই উৎকৃষ্ট গল্পে পরিণত করিতে পারিতেন।

 দ্বিতীয় গল্পটির কথা বলিতে পারি না। কিন্তু প্রথম গল্পটি যে সাহিত্যের অত্যুচ্চ স্থান অধিকার করিত সে বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নাই।

 আসল কথা, লেখক নিজেই নূতন যুগের মধ্যে বাস করিতেছেন। এমন-কি, নবযুগরথের চালকবর্গ-মধ্যে তিনিও একজন গণ্য ব্যক্তি। তিনি ইহার ঘর্ঘরশব্দ এবং জনতা-কোলাহল হইতে কল্পনাযোগে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করিয়া এত দুরে লইয়া যাইতে পারেন নাই যেখানে শান্তিতে বসিয়া নিপুণ চিত্রকরের ন্যায় ইহাকে চিত্রিত করিতে পারেন। বিচিত্র মতামত এবং তর্কবিতর্কগুলা একেবারে গোটা আসিয়া পড়ে, তাহা রক্তমাংসের মানবাকারে পরিণত হইয়া উঠে না। তাঁহার পঞ্চু, ব্রজরাজ, সুরেন্দ্রগুপ্ত, মথুরেশ, এমন-কি, নবীনও খুব ভালো ছেলে বটে কিন্তু সজীব নহে। তাহারা বীজগণিতের ক খ গ অক্ষরের ন্যায় কেবল কতকগুলি চিহ্নমাত্র।

 সাহিত্যের চিত্রপটে স্থিতি অপেক্ষা গতি আঁকা শক্ত। যাহা পুরাতন, যাহা স্থির, যাহা নানা দিকে নানা ভাবে সমাজের হৃদয় হইতে রসাকর্ষণ করিয়া শ্যামল সতেজ এবং পরিপূর্ণ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে, তাহাকে সত্য এবং সরসভাবে পাঠকের মনে জাজ্বল্যমান করিয়া তোলা অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু যাহা নৃতন উঠিতেছে, যাহা চেষ্টা করিতেছে, যুদ্ধ করিতেছে, পরিবর্তনের মুখে আবর্তিত হইতেছে, যাহা এখনো সর্বাঙ্গীণ পরিণতি লাভ করে নাই, তাহাকে যথাযথভাবে প্রতিফলিত করিতে হইলে বিস্তর সূক্ষ্মবিশ্লেষণ অথবা ঘাতপ্রতিঘাত-ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়া বিচিত্র নাট্যকলা প্রয়োগ আবশ্যক হয়। কিন্তু সেরূপ করিতে হইলে রচনার বিষয় হইতে রচয়িতার নিজেকে বিশ্লিষ্ট করিয়া লইতে হয়। অত্যন্ত কাছে থাকিলে, মণ্ডলীর কেন্দ্রের মধ্যে বাস করিলে সমগ্রের তুলনায় তাহার অংশগুলি, ব্যক্তির তুলনায় তাহার মতগুলি, কার্যপ্রবাহের তুলনায় তাহার উদ্দেশ্যগুলি যেরূপ বেশি করিয়া চোখে পড়ে- তাহাতে রচনা সত্যবৎ হয় না, তাহার পরিমাণ-সামঞ্জস্য নষ্ট হইয়া যায় এবং বাহিরে নির্লিপ্ত পাঠকদের নিকটে কিরূপে বিষয়টিকে সমগ্র এবং সপ্রমাণ করিতে হইবে তাহার ঠাহর থাকে না।

 কিন্তু এই দ্বিতীয় নম্বর গল্পটিতেও লেখক যেখানেই নবযুগের আবর্ত ছাড়িয়া খাঁটি মানুষগুলির কথা বলিয়াছেন সেইখানেই দুই-চারিটি সবল বর্ণনায়, স্বল্প রেখাপাতে, অতি সহজেই চিত্র আঁকিয়াছেন এবং পাঠকের হৃদয়কে রসে অভিষিক্ত করিয়াছেন। একস্থলে গ্রন্থকার প্রসঙ্গক্রমে শ্রীধর ঘোষের সহিত কেবল চকিতের মতো আমাদের পরিচয় করাইয়া তাহাকে অপসৃত করিয়া দিয়াছেন— কিন্তু সেই স্বল্প কালের পরিচয়েই আমাদের মনে একটা আক্ষেপ রাখিয়া দিয়াছেন। আমাদের বিশ্বাস, লেখক মনোযোগ করিলে এই শ্রীধর ঘোষটিকে একটি গ্রন্থের কেন্দ্রস্থলে স্থাপন করিয়া আর-একটি উপন্যাসকে প্রাণদান করিতে পারিতেন। আমরা শ্রীধরের সংক্ষেপ পরিচয়টি এ স্থলে উধৃত করি।—

 ‘এই ঘোষ-পরিবার বৈষ্ণব পরিবার, গোঁসায়ের শিষ্য। শ্রীধর ঘোষ মহাশয় অতি সাত্ত্বিক প্রকৃতির লোক ছিলেন। উদরাম্নের জন্য স্নেচ্ছের অধীনে কাজ করিতেন বটে, কিন্তু নিষ্ঠার কিছুমাত্র ব্যাঘাত হইত না। আপিসে যখন কর্ম করিতেন তখন তাহার নাসাতে তিলক ও সর্বাঙ্গে হরিনামের ছাপ দৃষ্ট হইত।... মানুষটি শ্যামবর্ণ সুস্থ ও সবলদেহ ছিলেন, মুখটি সদ্ভাবে ও ভক্তিতে যেন গদ‍্গদ, সে মুখ দেখিলেই কেমন হৃদয় স্বভাবত তাঁহার দিকে আকৃষ্ট হইত। ঘোষজা মহাশয় আপিসের প্রবেশের দ্বারের পার্শ্বের ঘরেই বসিতেন, এবং যত গাড়ি মাল আমদানি ও রপ্তানি হইত তাহার হিসাব রাখিতেন। সুতরাং তাঁহাকে প্রতিদিন প্রাতঃকালে আপিসে প্রবেশের সময়ে অনেকবার এই প্রশ্ন শুনিতে হইত, কী ঘোষজামশাই, খবর কী? সব কুশল তো? অমনি ঘোষজার উত্তর, আজ্ঞে, গোবিন্দের প্রসাদে সবই কুশল। ঘোষজা দোলের সময় কিছু ব্যয় করিতেন, লোকজনকে শ্রদ্ধাসহকারে আহ্বান করিয়া উত্তমরূপে খাওয়াইতেন। এইজন্য আপিসের লোক মাঘ মাস পড়িলেই জিজ্ঞাসা করিত, “কী ঘোষজামশাই, এবার দোল করবেন তো?” অমনি উত্তর, “আজ্ঞে, কী জানি, যা গোবিন্দের ইচ্ছা।” গোবিন্দের প্রতিনির্ভরের ভাব তাঁহার এমন স্বাভাবিক ছিল যে, আট বৎসর বয়সে ওলাউঠা যোগে তাঁহার দ্বিতীয় পুত্রটির কাল হইলে, তাহারই তিন-চারি দিন পরে আপিসের একজন লোক জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী ঘোমশাই, ছেলে দুটো মানুষ হচ্ছে তো?” ঘোষজা উত্তর করিলেন, “আজ্ঞে, দুটো আর কৈ? —এখন তো একটি, কেবল বড়োটিই আছে।” প্রশ্নকর্তা বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “সে ছেলেটির কী হইল?” ঘোষজা উত্তর করিলেন, “আজ্ঞে, গোবিন্দ সেটিকে নিয়েছেন”।...তিনি সাধ করিয়া নাতি-নাতনীদের নাম রাখিয়াছিলেন। পুত্রের সর্বজ্যেষ্ঠা কন্যা হইলে তাহার নাম রাধারানী রাখিলেন।... সর্বজ্যেষ্ঠা রাধারানী তাহার প্রথম আদরের ধন ছিল। “রাধে। রাজনন্দিনী। গরবিনী। শ্যামযোহাগিনী।” বলিয়া যখন ডাকিতেন, তখন এক বৎসরের বালিকা রাধারানী অচিরোদাগতদন্তাবলী-শোভিত মুখচন্দ্রে একটু হাসিয়া, ঝাঁপাইয়া তাঁহার ক্রোড়ে গিয়া পড়িত। তাহাকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া বলিতেন, “রাখালের সনে প্রেম করিস নে রাই!” অমনি চক্ষে জলধারা বহিত।’

 এ দিকে শিশুকন্যা টিমিমণি, নবীনের সহিত তাঁহার ভ্রাতৃবধূর সম্বন্ধ, নবীনের রাঙা মা— এগুলিও লেখক বড়ো সরল এবং সরস সুমিষ্ট ভাবে ফুটাইয়া তুলিয়াছেন।

 লেখক ধারাবাহিক গল্পের প্রতি বড়ো-একটা দৃষ্টিপাত করেন নাই; আমরাও গল্পের জন্য বিশেষ লালায়িত নহি। আমরা একজন রীতিমত মনুষ্যের আনন্দজনক বিশ্বাসজনক জীবনবৃত্তান্ত চাহি—নশিপুর গ্রামে তর্কভূষণ-পরিবারের আদ্যোপান্ত বিবরণ শুনিয়া যাইতে আমাদের কিছুমাত্র শান্তিবোধ হইত না; কারণ, তর্কভূষণ আমাদের হৃদয় আকর্ষণ করিয়াছেন এবং লেখকও তাঁহার সূক্ষ্মদর্শিনী হাস্যবর্ষিণী কল্পনাশক্তিদ্বারা আমাদের সম্পূর্ণ বিশ্বাস আকর্ষণ করিতে পারিয়াছেন। কিন্তু লেখক দুইখানি বহির পাতা পরম্পর উলটাপালটা করিয়া দিয়া একসঙ্গে বাঁধাইয়া দপ্তরীর অন্ন মারিয়াছেন এবং পাঠকদিগের রসভঙ্গ করিয়াছেন, এ আক্ষেপ আমরা কিছুতেই ভুলিতে পারিব না।

 চৈত্র ১৩০১