বংশীধরের নতুন আবদার শুনে হংসেশ্বর বললেন, আবার চাকরির শখ হল কেন? আমার বুকে বাঁশ দিয়ে তো যত পেরেছ বাগিয়ে নিয়েছ।

 বংশীধর বলল, আজ্ঞে, একটা ভাল পোস্ট না পেলে যে আমার সেল্‌ফ-রেস্‌পেক্ট থাকবে না। লোকে বলবে, ব্যাটা শ্বশুরের বিষয় পেয়ে নবাবি করছে।

(একটি ইংরেজী গল্পের প্লটের অনুসরণে। লেখকের নাম মনে নেই।)

১৮৭৯

নবজাতক

সোমনাথের বউ উমা আসন্নপ্রসবা। পাশের ঘরে ডাক্তার নর্স ধাই মোতায়েন আছে। বাইরের বসবার ঘরে শুভাকাঙ্ক্ষী স্বজনবর্গ অপেক্ষা করছে, উমা আর সোমনাথ দুজনেরই ইচ্ছে সন্তান ভূমিষ্ঠ হবামাত্র যেন সকলের আশীর্বাদ পায়। সোমনাথ অস্থির হয়ে এ ঘর ও ঘর করে বেড়াচ্ছে। ডাক্তার বার বার তাকে বোঝাচ্ছেন, অত উতলা হচ্ছেন কেন, হলেনই বা প্রথম পোয়াতী, আপনার স্ত্রীর স্বাস্থ্য তো বেশ ভালই, কিছুমাত্র চিন্তার কারণ নেই।

 সন্ধ্যা সাড়ে সাত। উদীয়মান জ্যোতিঃসম্রাট তারক সান্যাল তার হাতঘড়ি দেখে বলল, রেডিওর সঙ্গে মিলিয়ে রেখেছি, করেক্ট টাইম। যদি ঠিক আটটা পাঁচ মিনিটে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় তবে সে রাজচক্রবর্তী হবে। ডাক্তারের উচিত ততক্ষণ ছেলেকে ঠেকিয়ে রাখা।

 নাস্তিক ভুজঙ্গ ভঞ্জ বলল, যত সব গাঁজা। তোমাদের জ্যোতিষ তো আগাগোড়া ভুল, জন্মক্ষণ ঠিক করেই বা কি হবে? যে আসছে সে তোমার কথা শুনবে না, ডাক্তারের বাধাও মানবে না, নিজের মর্জিতে যথাকালে বেরিয়ে আসবে। আর, ছেলে হবে তাই বা ধরে নিচ্ছ কেন?

 —নির্ঘাত ছেলে হবে। আমি সোমনাথের বউএর কররেখা দেখেছি, তা ছাড়া খনার ফরমুলা কষে ভাগশেষ এক পেয়েছি—একে সূত দুইএ সূতা, তিন হইলে গর্ভ মিথ্যা।

 সোমনাথ হঠাৎ ছুটে এসে মাথার চুল টেনে বলল, ওঃ, আর তো যন্ত্রণা দেখতে পারি না। কি পাপই করেছি, আমার জন্যেই এত কষ্ট পাচ্ছে।

 সোমনাথের ভাগিনীপতি পাঁচুবাবু বললেন, তোমার মুণ্ডু। পাপ কিচ্ছু কর নি, মানবধর্ম পালন করেছ, বউকে শ্রেষ্ঠ উপহার দিয়েছ। না হলে চিরকাল গঞ্জনা খেতে। তবে হা ঁযদি তাকে তিন বারের বেশি আঁতুড় ঘরে পাঠাও তবে তোমাকে বর্বর স্বার্থপর সমাজদ্রোহী বলব। কুইন ভিক্টোরিয়ার যুগ আর নেই, গণ্ডা গণ্ডা সন্তানের জন্ম দিলে দেশের লোক কৃতার্থ হবে না।

 পণ্ডিত হরিবষ্ণু সত্যার্থি বললেন, ওহে সোমনাথ, বউমাকে জম্ভলার নাম নিতে বল। আস্ত গোদাবরীতনরে জম্ভলা নাম রাক্ষসী, তস্যাঃ স্মরণমাত্রেণ গাভী বিশল্যা ভবেৎ। অর্থাৎ গোদাবরীর তরে জম্ভলা রাক্ষসী থাকে, তার নাম স্মরণ করলেই গর্ভণীর যন্তণা দূর হয়ে সুপ্রসব হয়।

 তারক জ্যোতিষী বলল, এখন নয়, আটটা বেজে তিন মিনিটের সময় জম্ভলার নাম নিতে বলবেন। কাল সকালেই আমি কোষ্ঠী গণনায় লেগে যাব, প্রাচ্য আর পাশ্চাত্ত্য সিদ্ধান্ত, ভৃগু আর জ্যাডকিল,দুটোরই সমন্বয় করব, প্রাচীন নবগ্রহ আর আধুনিক ইউরেনস নেপচুন প্লুটো কিছুই বাদ দেব না। দেখে নেবেন আমার ভবিষ্যৎ গণনা কীরকম নির্ভুল হবে।

 পাঁচুবাব বললেন, ভবিষ্যৎ তো পরের কথা, সন্তানের বর্তমান হালচাল কিছু বলতে পার?

 —না, বর্তমান আমার গণ্ডির বাইরে, আমার কারবার শুধু ভবিষ্যৎ নিয়ে।

 হরিবিষ্ণু সত্যার্থা বললেন, গীতায় আছে, জীবের শুধু মধ্য অবস্থা অর্থাৎ জীবিতাবস্থাই আমরা জানতে পারি, তার পূর্বে কি ছিল এবং মরণের পরে কি হবে তা অব্যক্ত। সোমনাথের সন্তান এখন অতীত আর বর্তমানের সন্ধিক্ষণে রয়েছে। এ সম্বন্ধে আমাদের শাস্ত্রে যা আছে বলছি শুনুন। পরলোকবাসী মানবাত্বার পাপপুণ্যের ফলভোগ যখন সমাপ্ত হয় তখন সে মর্ত্যলোকে পতিত হয় এবং মেঘে প্রবেশ করে জলময় রূপ পায়। সেই জল বৃষ্টি রূপে পত্র পুষ্প ফল মূল ঔষধ বনস্পতিতে সঞ্চারিত হয় এবং তা ভক্ষণের ফলে নরনারীর দেহে শুক্র ও শোণিত উৎপন্ন হয়। গর্ভধানকালে শুক্রের আধিক্যে পুরুষ, শোণিতের আধিক্যে স্ত্রী, এবং উভয়ের সমতায় ক্লীবের সৃষ্টি হয়। জরায়ুমধ্যস্থ ভ্রুণ প্রথম দিনে পঙ্কতুল্য, পাঁচ দিনে বুদবুদ, সাত দিনে পেশী, এক পক্ষে অর্বুদ, পঁচিশ দিনে ঘন, এবং এক মাসে কঠিন আকার পায়। দুই মাসে মস্তক, তিন মাসে গ্রীবা, চার মাসে ত্বক, পাঁচ মাসে নখ ও রোম, ছ মাসে চক্ষু কর্ণ নাসা আর মুখের সৃষ্টি হয়। সপ্তম মাসে ভ্রুণ স্পন্দিত হয়, অষ্টম মাসে বুদ্ধি যোগ হয়, এবং নবম মাসে সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পূর্ণতা পায়। জন্মের পরেই শিশুর অনুভূতি হয়। তার পর সে বৃদ্ধি পায়, প্রান্তন কর্ম অনুসারে সংসারে সুখদুঃখ ভোগ করে, এবং মৃত্যুর পরে পুনর্বার দেহান্তর পায়।

 পাঁচুবাবু বললেন, ওহে প্রফেসর অনদি, তোমাদের শাস্ত্রে কি বলে?

 বায়োলাজিস্ট অনাদি রায় বললেন, সত্যার্থি মশায় নেহাত মন্দ বলেন নি। আমরা যা জানি তা বলছি শুনুন। প্রথমে দুটি অতি ক্ষুদ্র কোষের সংযোগ, তা থেকে ক্রমশ অসংখ্য কোষের উৎপত্তি, তারই পরিণাম এই মানবদেহ। প্রথম কয়েক মাস ভ্রুণকে মানুষ বলে চেনা যায় না, মনে হয় মাছ টিকটিকি বা বেরাল-ছানা। কোটি কোটি বৎসরে মানুষের যে ক্রমিক রূপান্তর হয়েছে, জরায়ুস্থ ভ্রুণ যেন তারই সে হাত-পা নাড়ে, মাঝে মাঝে মাথা দিয়ে গর্ভধারণীকে গুতো মারে, হয়তো আঙুলও চোষে। গর্ভবাসকালে সে শ্বাস নেয় না, কিন্তু দেড় মাসের হলেই ভ্রূণের বুক ধুকধুক করতে থাকে। পুষ্টির জন্যে যা দরকার সবই তার মায়ের রক্ত থেকে ফুল বা প্লাসেণ্টার মধ্যে ফিলটার হয়ে গর্ভনাড়ী দিয়ে ভ্রূণের দেহে প্রবেশ করে। জরায়ুস্থ তরল পদার্থের মধ্যে সে যেন জলচর প্রাণী রূপে বাস করাছল, ভূমিষ্ঠ হয়েই সে হঠাৎ স্থলচর হয়ে যায়। দু-এক মিনিটের মধ্যেই সে শ্বাস নেবার চেস্টা করে, খাবি খেয়ে কেঁদে ওঠে, নাক মুখ দিয়ে লালা বার করে ফেলে। নবজাত মনুষ্যশাবক লম্বায় এক হাতের কম, ওজনে প্রায় সাড়ে তিন সের, মাথা বড়, পেট লম্বা, হাত-পা ছোট ছোট। মা বাপ ভাই বোনের সঙ্গে তার চেহারার যতই মিল থাকুক, সে একজন স্বতন্ত্র অদ্বিতীয় মানুষ। প্রথম কয়েক মাস সে সমবয়সী ছাগল-ছানার চাইতেও অসহায়, কিন্তু তার পর তার শক্তি আর বুদ্ধি ক্রমশ বাড়তে থাকে।

 হরিবিষ্ণু সত্যার্থী বললেন, অনাদিবাবু শুধু স্থূল দেহের উৎপত্তির বিবরণ দিলেন, কিন্তু মন বুদ্ধি চিত্ত অহংকার আর আত্মার কথা তো বললেন না।

 অনাদি রায় বললেন, ও সব কিছুই জানি না সত্যার্থী মশায়, বলব কি করে?

সোমনাথ কান খাড়া করে ছিল, হঠাৎ একটা অস্ফুট আর্তনাদ শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল। তারক সান্যাল তার হাতঘড়িতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রইল। আর সকলে নীরবে অপেক্ষা করতে লাগলেন। তার পর হঠাৎ আওয়াজ এল—ওয়াঁ ওয়াঁ।

 তারক জ্যোতিষী বলল, আটটা বেজে তিন মিনিট, আহাহা, আর দু মানট পরে হলেই খাসা হত। যাই হক, আমার গণনায় ভুল হয় নি, পুত্র সন্তানই হয়েছে।

 ভুজঙ্গ ভঞ্জ বলল, তা তুমি জানলে কি করে?

 —ওই যে, হুলো বেরালের মতন ডেকে উঠল। মেয়ে হলে উয়াঁ উয়াঁ করত।

 কবি শ্রীকণ্ঠ নন্দী এতক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন। এখন বললেন, তারকবাবুর কথা ঠিক। কৃত্তিবাস তাঁর রামায়ণে লিখেছেন, জনক রাজা লাঙল চালাতে চালাতে হঠাৎ দেখলেন, মাটির ডেলা থেকে ছোট্র একটি মেয়ে বেরিয়েছে, ‘উঙা উঙা করি কাঁদে যেন সৌদামিনী।’

 ভুজঙ্গ ভঞ্জ বলল, তারকের মতন গুনে বলতে সবাই পারে। হয় ছেলে না হয় মেয়ে, এই দুটোর মধ্যে একটা যদি বাই চান্স মিলে যায় তাতে বাহাদুরিটা কি?

 সোমনাথের ভাগনী তোতা শাঁখ বাজাতে বাজাতে এসে বলল, মামীর খোকা হয়েছে, এই আ্যাত্তো বড়, গোলাপ ফলের মতন লাল টুকটুকে।

 পাঁচুবাবু বললেন, লাল টুকটুকে রঙ এক মাসের মধ্যেই নবঘনশ্যাম হয়ে যাবে। তোর মামা কি করছে রে?

 —নর্স বলছে চলে যেতে, কিন্তু মামা ঘর থেকে নড়বে না, খালি খালি ছেলের দিকে চেয়ে আছে।

 —হুঁ। প্রথম যখন ছেলে হল ভাবলুম বাহা বাহা রে। সোমনাথের সেই দশা হয়েছে। আর দেরি করে কি হবে, আমাদের আশীর্বাদটা এখনই সেরে ফেলা যাক। সোমনাথকে ডাকবার দরকার নেই, পরে জানিয়ে দিলেই চলবে। সে এখন পুত্রের চন্দ্রমুখ নিরীক্ষণ করতে থাকুক। সত্যার্থী মশায়, আপনিই আরম্ভ করুন।

গলায় খাঁকারি দিয়ে হরিবিষ্ণু সত্যার্থী সুর করে বলতে লাগলেন—

কুলং পবিত্রং জননী কৃতার্থা
বসুন্ধরা পুণ্যবতী চ তেন।
অপারসংবিৎসুখসাগরেঽস্মিন্‌
লীনং পরে ব্রহ্মণি যস্য চেতঃ॥

 এই নবকুমার স্বাস্থ্যবান, বিদ্যাবান ধর্মপ্রাণ হয়ে বেঁচে থাকুক, পরম জ্ঞান লাভ করুক, পরব্রহ্ম রূপ অপারসংবিৎসুখসাগরে তার চিত্ত লীন হক, তাতেই তার কুল পবিত্র হবে, জননী কৃতার্থা হবেন, বসুন্ধরা পুণ্যবতী হবেন। এর চাইতে বড় আশীর্বাদ আমার জানা নেই।

 পাঁচুবাবু হাত নেড়ে বললেন, এ কি রকম বেয়াড়া আশীর্বাদ করলেন সত্যার্থী মশায়! সোমনাথের ছেলের চিত্ত যদি পরব্রহ্মে লীন হয়ে যায় তবে তার আর রইল কি? ওর বাপ মা আত্মীয় স্বজন যে মহা ফেসাদে পড়বে।

 হরিবিষ্ণু সত্যার্থী বললেন, বেশ তো, আপানি নিজের মনের মতন একটি আশীর্বাদ করুন না।

 পাঁচুবাবু বললেন, শুনুন, আশীর্বাদ করি, এই ছেলে সুস্থ দেহে দিন দিন বাড়তে থাকুক, বেশী অসুখে ভুগে যেন বাপ-মাকে না জ্বালায়। সুন্দর সবল খোকা হয়ে বালগোপালের মতন উপদ্রব করুক, যথাকালে লেখাপড়া শিখুক, ভাল রোজগার করুক, প্রেমে পড়ে বিয়ে করুক কিংবা বিয়ে করে প্রেমে পড়ুক। সে তৈজস্বী বীরপুরুষ হক। গুণ্ডা হতে বলছি না, কিন্তু এক চড়ের বদলে তিন চড় যেন ফিরিয়ে দিতে পারে। দরকার হলে সে যেন দেশের জন্যে লড়তে পারে, উড়তে পারে, জাহাজ চালাতে পারে। সে যেন অলস বিলাসী হুজুগে না হয়, নাচ গান আর সিনেমা নিয়ে না মাতে, চোর ঘুষখোর মাতাল লম্পট না হয়। বহু লোককে সে প্রতইপালন করুক, প্রচুর উপার্জন করে জনহিতার্থে ব্যয় করুক, কিন্তু বেশী টাকা জমিয়ে রেখে যেন বংশধরদের মাথা না খায়। তার অসংখ্য বন্ধু হক, গোটা কতক শত্রুও হক, নইলে সে আত্মগর্বী হয়ে পড়বে। সে সাহিত্য বিজ্ঞান দর্শন কর্মযোগ জ্ঞানযোগ ভক্তিযোগ যত খুশি চর্চা করুক, কিন্তু যেন বুদ্ধ যিশু শংকর আর শ্রীচৈতন্যের মতন সংসারত্যাগী না হয়। তার মহা-পুরুষ পরমপুরুষ বা অবতার হবার কিছুমাত্র দরকার নেই। তবে হাঁ, বঙ্কিমচন্দ্র কাটছাঁট করে যে রকম bowdlerized নির্দোষ সর্ব-গুণান্বিত আদর্শ পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ খাড়া করেছেন সে রকম যদি হতে পারে তাতে আমাদের আপত্তি নেই। মোট কথা, আমরা চাই সোমনাথের ব্যাটা একজন মান্য গণ্য স্বনামধন্য চৌকশ পরিপূর্ণ পুংপুরুষ হয়ে উঠুক, যাকে বলে hundred percent he-man.

 ভুজঙ্গ ভঞ্জ বলল, পাঁচু-দা ভালই বলেছেন, তবে ওঁর আশীর্বাদে বুর্জোআ ভাব প্রকট হয়েছে। প্রজার ভাগ্য আর রাষ্ট্রের ভাগ্য এক সঙ্গে জড়িত, রাষ্ট্রের সংস্কার না হলে প্রজার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল হতে পারে না। অতএব রাষ্ট্র আর প্রজা দুইএরই মঙ্গলকামনায় আমি বলছি—এই সদ্যোজাত ভারতসন্তান যেন এমন শাসনতন্ত্রের আশ্রয় পায় যা তাকে সর্বাত্মক শিক্ষা দেবে, তার সামর্থের উপযুক্ত কর্ম দেবে, তার প্রয়োজনের উপযুক্ত জীবিকার ব্যবস্থা করবে, সে যেন কায়মনোবাক্যে রাষ্ট্রবিধির বশবর্তী হয়, তার চিত্ত পরব্রহ্মে লীন না হয়ে যেন রাষ্ট্রেই লীন হয়। সে যেন বোঝে, সে রাষ্ট্রেরই একটি অবয়ব, হাত পা প্রভৃতির মতন সেও এক বিরাট মস্তিষ্কের অধীন, তার স্বাতন্ত্র্য নেই।

 পাঁচুবাবু বললেন, তুমি বলতে চাও এই শিশু রাষ্ট্রদাস হয়ে জন্মেছে, চিরকাল রাষ্ট্রদাস হয়েই থাকবে। তার নিজের মতে চলবার বা আপত্তি জানাবার অধিকার নেই, যত অধিকার শুধু রাষ্ট্রের বিরাট মস্তিষ্ক অর্থাৎ চাঁইদেরই আছে। ও সব চলবে না বাপ, সোমনাথের অপত্য কর্তাভজা হয়ে কলের পুতুলের মতন হাত পা নাড়বে কিংবা পিঁপড়ে মৌমাছির মতন বাঁধাধরা সংস্কারের বশ একঘেয়ে জীবনযাত্রা নির্বাহ করবে তা আমরা চাই না। ওহে শ্রীকণ্ঠ কবি, তোমার কণ্ঠ নীরব কেন? তুমিও একটি আশীর্বাণী বল।

 শ্রীকণ্ঠ নন্দী বললেন, বলবার অবসর পাচ্ছি কই? স্বর্গ থেকে একটি শিশু অবতীর্ণ হয়েছে, তাকে আদর করে ঘরে তুলবেন, তা নয়, শুধু বায়োলজি ব্রহ্মনির্বাণ সমাজতত্ত্ব আর রাজনীতির কচকচি। আসুন, আমরা নবজাতককে অভিনন্দন জানাই, মহাত্মা কবীর যেমন তাঁর পুত্র কমালকে পেয়ে বলেছিলেন তেমনি সোমনাথের হয়ে আমরাও বলি—

অজব মুসাফির ঘর মে আয়া ধরো মংগল থাল,
উজ্জর বংস কবীর কা উপজে পুত কমাল।

 —আশ্চর্য পথিক ঘরে এসেছে, মঙ্গল থাল ধরে তাকে বরণ কর; কবীরের বংশ উজ্জ্বল হল, পুত্র কমাল জন্মেছে। অথবা টেনিসনের মতন উদাত্ত কণ্ঠে সম্ভাষণ করুন—

Out of the deep, my child, out of the deep,
From that great deep, before our world begins,
Whereon the spirit of God moves as he will ...
From that true world within the world we see,
Whereof our world is but the bounding shore ...
With this ninth moon, that sends the hidden sun
Down yon dark sea, thou comest, darling boy.

 কিংবা রবীন্দ্রনাথের মতন বলুন—

সব দেবতার আদরের ধন,
নিত্য কালের তুই পুরাতন,
তুই প্রভাতের আলোর সমবয়সী।
তুই জগতের স্বপ্ন হতে
এসেছিস আনন্দস্রোতে—

 গরুচোরের মতন সলজ্জ মুখে সোমনাথ ঘরে এসে বলল, চা করতে বলি? তার সঙ্গে কচুরি আর রসগোল্লা?

 পাঁচুবাবু বললেন, রাম বল। তোমার তো এখন জাতাশৌচ, এ বাড়ির কোনও জিনিস আমাদের খাওয়া চলবে না, কি বলেন সত্যার্থী মশায়? এক মাস কাটুক, তোমার বউ চাঙ্গা হয়ে উঠুক, তার পর খোকাকে কোলে নিয়ে আমাদের যত ইচ্ছে হয় পরিবেশন করবে।

 তোতা বলল, বা রে, খোকাকে কোলে নিয়ে বুঝি পরিবেশন করা যায়!

 —আচ্ছা আচ্ছা, খোকা না হয় তোর মামার কোলে থাকবে।

 —আর যদি মামার—

 —তা হলে তোর মামার চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার হয়ে যাবে।

১৮৭৯