আনন্দীবাঈ ইত্যাদি গল্প/বটেশ্বরের অবদান

বটেশ্বরের অবদান

টেশ্বর সিকদার একজন প্রখ্যাত গ্রন্থকার এবং বাণীর একনিষ্ঠ সাধক, অর্থাৎ পেশাদার লেখক। যাঁদের লেখা ছাড়া অন্য কর্ম নেই তাঁদের প্রায় অর্থাভাব দেখা যায়, কিন্তু বটেশ্বর ধনী লোক। এই ব্যতিক্রমের কারণ— তিনি প্রথম শ্রেণীর সাহিত্যিক, শুধু বড় বড় উপন্যাস লেখেন, দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর লেখকদের মতন ছোট গল্প প্রবন্ধ কবিতা রম্যরচনা ভ্রম্যরচনা ইত্যাদি লিখে প্রতিভার অপচয় করেন না। তাঁর কোনও উপন্যাস সাত শ পৃষ্ঠার কম নয় এবং প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা দেশের বুভুক্ষু পাঠক-পাঠিকারা তা গোগ্রাসে পড়ে ফেলেন এবং পরবর্তী রচনার জন্য ব্যগ্র হয়ে প্রতীক্ষা করেন। সম্প্রতি তাঁর পঁয়ষট্টিতম জন্মদিনের উৎসব খুব ঘটা করে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

 সকালবেলা বটেশ্বর তাঁর সাধনকক্ষে বসে লিখছেন এবং মাঝে মাঝে একটি বড় টিপট থেকে চা ঢেলে খাচ্ছেন, এমন সময় একটি অচেনা যুবক ঘরে এসে ঝুঁকে নমস্কার করে বলল, আমার নাম প্রিয়ব্রত রায়, পাঁচ মিনিট সময় দিতে পারবেন কি?

 আগন্তুকের বয়স প্রায় ত্রিশ, সুশ্রী চেহারা, সজ্জায় দারিদ্র্যের লক্ষণ নেই, পারিপাট্যও নেই। বটেশ্বর একটা চেয়ার দেখিয়ে বললেন, ব’স। নতুন পত্রিকা বার করছ, তার জন্যে আমার লেখা চাও, এই তো? আগেই বলে দিচ্ছি, আমি কল্পতরু নই, যে চাইবে তাকেই লেখা দিতে পারি না। একটা আশীর্বাণী যদি চাও তো দিতে পারি, দশ টাকা লাগবে।

 প্রিয়ব্রত বলল, আজ্ঞে, লেখার জন্যে আপনাকে বিরক্ত করতে আসি নি, শুধু একটি কথা জানতে এসেছি। ‘প্রগামিণী’ পত্রিকায় ‘কে থাকে কে যায়’ নামে আপনার যে গল্পটি বার হচ্ছে তা শেষ হতে আর ক মাস লাগবে দয়া করে বলবেন কি?

 —আরও ছ-সাত মাস লাগবে। কেন বল তো? কেমন লাগছে লেখাটা?

 —অতি চমৎকার, সব চরিত্র যেন জীবন্ত। বড্ড কৌতূহল হচ্ছে তাই জানতে এসেছি —গল্পের নায়িকা ওই অলকা মেয়েটি যে টি-বি স্যানিটেরিয়মে আছে, সে সেরে উঠবে তো?

 প্রিয়ব্রতর আগ্রহ দেখে বটেশ্বর খুশী হলেন। একটু হেসে বললেন, তা তোমাকে বলব কেন? প্লট আগেই ফাঁস করে দিলে রচনার রসভঙ্গ হয়।

 হাত জোড় করে প্রিয়ব্রত বলল, সার, দয়া করে অলকাকে বাঁচিয়ে দেবেন।

 —তোমার তো বড় অদ্ভুত আবদার হে! গল্পের নায়িকার জন্যে এত ভাবনা কেন? লোকে মিলনান্ত বিয়োগান্ত দু রকম গল্পই চায়, তোমার ফরমাশ মতন আমি লিখতে পারি না। মিলনান্ত চাও তো আমার ‘কাড়াকাড়ি’, ‘তেটানা’ এই সব পড়তে পার।

 প্রিয়ব্রত করুণ স্বরে বলল, দয়া করুন সার।

 —তুমি একটি আস্ত পাগল। এখন যাও, আমার ঢের কাজ। অলকার জন্যে মাথা খারাপ না করে নিজের চিকিৎসা করাও গে, নিশ্চয় তোমার মনের রোগ আছে।

 প্রিয়ব্রত বিষণ্ণমুখে মাথা নীচু করে আস্তে আস্তে ঘর থেকে চলে গেল।

রাত সাড়ে নটার সময় বটেশ্বর খেতে যাচ্ছেন এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার ধরে বললেন, কাকে চান?... হাঁ, আমিই বটেশ্বর। আপনি কে?

 উত্তর এল— নমস্কার। আমি ডাক্তার সঞ্জীব চাটুজ্যে, আপনার কাছে একটু বিশেষ দরকার আছে। কাল সকালে আটটার সময় যদি যাই আপনার অসুবিধা হবে না তো?

 বটেশ্বর বললেন, না না, আপনি আসতে পারেন। কি দরকার বলুন তো?

 —সাক্ষাতেই সব বলব সার। আচ্ছা, নমস্কার।

 ডাক্তার সঞ্জীব চাটুজ্যের নাম বটেশ্বর শুনেছেন। বছর দুই হল বিলাত থেকে ফিরেছেন, বয়স বেশী নয়, খুব নাকি ভাল সার্জন, বেশ পসার হয়েছে।

 পরদিন সকালে সঞ্জীব ডাক্তার এসে বললেন, গুড মর্নিং সার, আপনার মহামূল্য সময় আমি নষ্ট করব না, দশ মিনিটের মধ্যেই বক্তব্য শেষ করব। ওঃ কি আশ্চর্য আপনার ক্ষমতা! ‘প্রগামিণী’ পত্রিকায় ‘কে থাকে কে যায়’ নামে যে গল্পটি লিখছেন তার তুলনা নেই, দেশ সুদ্ধ লোক মুগ্ধ হয়ে গেছে। শরৎ চাটুজ্যে তারাশংকর বনফুল প্রবোধ সাণ্ডেল সবাইকে কাত করে দিয়েছেন মশাই।

 বটেশ্বর সহাস্যে বললেন, আপনার তো খুব প্র্যাকটিস শুনতে পাই, আমার লেখা পড়বার সময় পান কি করে?

 —সময় করে নিতে হয় সার, না পড়লে যে চলে না। সর্বত্র এই গল্পটির কথা শুনি, আমাদের মেডিক্যাল ক্লাবে পর্যন্ত। সেদিন একটি বৃদ্ধ লোকের হার্নিয়া অপারেশন করছি, অ্যানিসথেটিকের ঝোঁকে তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন— কি খাসা মেয়ে অলকা, জিতা রহো অলকা! আমার আত্মীয়স্বজন বন্ধুর দল তো আপনার অলকার জন্যে খেপে উঠেছে। ধন্য আপনি! সকলেই বলে, এখনকার সাহিত্যসম্রাট হচ্ছেন শ্রীবটেশ্বর সিকদার, তাঁর কাছে দামোদর নশকর গল্পসরস্বতী দাঁড়াতেই পারেন না। এখন আমার নিবেদনটি জানাই। আমার বন্ধুবর্গের তরফ থেকে অনুরোধ করতে এসেছি—অলকা মেয়েটিকে চটপট সারিয়ে দিন, সবাই তার জন্য চিন্তিত হয়ে উঠেছে। স্যানিটেরিয়ম থেকে বেশ সুস্থ করে ফিরিয়ে আনুন। একবারে থরো কিওর চাই, বুঝলেন? তার স্বামী হেমন্তর অবস্থা তো বেশ ভালই, অলকাকে নিয়ে সে সিমলা কি উটকামণ্ড চলে যাক, সেখানে তিনটি মাস কাটিয়ে বেশ মোটাসোটা করে ঘরে নিয়ে আসুক।

 বটেশ্বর কুণ্ঠিত হয়ে বললেন, তা তো হবার জো নেই ডাক্তার চ্যাটার্জি, আমার এই রচনাটি যে ট্রাজেডি। অলকা বাঁচবে না।

 —বলেন কি মশাই, আলবত বাঁচবে। আধুনিক চিকিৎসায় টি-বি রোগী শতকরা নব্বইজন সেরে ওঠে। অলকার ভাল ট্রিটমেণ্ট করান, পি-এ-এস, আইসোনায়াজাইড, স্ট্রেপ্টোমাইসিন এই সব ওষুধ দিন। বলেন তো আমার বন্ধু ডাক্তার বড়ালের সঙ্গে একটা কনসলটেশনের ব্যবস্থা করি।

 বটেশ্বর বিব্রত হয়ে পড়লেন। কাল এক পাগল এসেছিল, আজ আর এক বড় পাগলের কবলে তিনি পড়েছেন। কিন্তু এই সঞ্জীব ডাক্তার গুণগ্রাহী লোক, এঁকে ধমক দিয়ে হাঁকিয়ে দেওয়া চলে না। এঁর উচ্ছসিত প্রশংসা আর নিরর্থক উপদেশ থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য বটেশ্বর মনে করলেন, গল্পের পরিণামটা জানিয়ে দেওয়াই ভাল। বললেন, আপনি ভুলে যাচ্ছেন ডাক্তার চ্যাটার্জি, অলকা সত্যিকারের মানুষ নয়, আমার উপন্যাসের নায়িকা। তাকে বাঁচালে আমার প্লটটি মাটি হবে। অলকা মরবে, তার দু বছর পরে তার স্বামী হেমন্তর সঙ্গে শর্বরীর বিয়ে হবে, ওই যে মেয়েটি পাঁচটি বৎসর হেমন্তর জন্য প্রতীক্ষা করেছে।

 টেবিলে কিল মেরে সঞ্জীব ডাক্তার বললেন, অ্যাবসর্ড, তা হতেই পারে না। অলকার স্বামী হল তার হকের ধন, অন্য মেয়ে তাকে কেড়ে নেবে কেন?

 —শর্বরীর কথাটাও ভেবে দেখুন ডাক্তার চ্যাটার্জি। রূপে গুণে বিদ্যায় স্বাস্থ্যে সে অলকার চাইতে ভাল। এত বৎসর প্রতীক্ষার পর হেমন্তকে না পেলে তার বুক যে ফেটে যাবে!

 —ফাটলেই হল! বুক অত সহজে ফাটে না মশাই, খুব শক্ত টিশুতে তৈরী। হার্ট খারাপ হয় তো চিকিৎসা করাবেন, ডিজিটালিস অ্যামিনোফাইলিন খেলিন এই সব দেবেন। বুকে বোরিক কমপ্রেস, তিসির পুলটিস আর আইসব্যাগ লাগাবেন। শর্বরীর বিয়ে নাই বা দিলেন, তাকে রাজকুমারী অমৃত কাউরের কাছে পাঠিয়ে দিন, তিনি তাকে নর্সিং শেখাবার ব্যবস্থা করবেন।

 —আপনি আমার লেখা পড়ে উত্তেজিত হয়েছেন, কাল্পনিক পাত্রপাত্রীদের জীবন্ত মনে করেছেন, এ আমার পক্ষে গৌরবের বিষয়। কিন্তু একটু স্থির হয়ে লেখকের দিকটাও বিবেচনা করুন। মিলনান্ত বিয়োগান্ত দু রকম গল্পই আমাদের লিখতে হয়। ভগবান সুখ দেন, দুঃখ দেন, মানুষকে রক্ষা করেন, আবার মারেনও। তিনি মিলন-বিরহ দিয়ে সংসার সৃষ্টি করেছেন। আমরা লেখকরা ভগবানেরই অনুসরণ করি। লোকে নিজে শোক পেতে চায় না, কিন্তু ট্রাজেডি বেশ উপভোগ করে। সেই জন্যেই তো মহাকবিরা সীতা, অজমহিষী ইন্দুমতী, ওফেলিয়া, ডেসডিমোনা ইত্যাদির সৃষ্টি করেছেন। ভগবান সব সময় দয়া করেন না, আমরাও করি না।

 —কি বলছেন মশাই, ভগবানের নকল করবেন এতদূর আম্পর্ধা! ভগবান নাচার, সব সময় দয়া করলে তাঁর চলে না, তা বোঝেন? ইঁদুরকে যদি দয়া করেন তো বেড়াল উপোস করবে। মাছ মুরগি পাঁঠা ভেড়াকে দয়া করলে আপনার আমার পেটই ভরবে না। তিনি যখন মানুষকে দয়া করেন তখন মাইক্রোব ধ্বংস হয়, আবার মাইক্রোবকে দয়া করলে মানুষ মরে। নিজের হাত-পা বাঁধা বলেই ভগবান মানুষ সৃষ্টি করেছেন, বলেছেন —আমার হয়ে তোরাই যতটা পারিস দয়া করবি, মনে রাখিস অহিংসাই পরম ধর্ম। গল্প লিখছেন বলেই আপনি মানুষ খুন করবেন এ কি রকম কথা! সেকালে বাল্মীকি কালিদাস শেকস্পীয়ার কি লিখেছিলেন তা ভুলে যান। এটা হল গান্ধীজীর যুগ, বিয়োগান্ত রচনা একদম চলবে না। যারা ট্রাজেডি লেখে আর তা পড়তে ভালবাসে তারা মরবিড, প্রচ্ছন্ন নিষ্ঠুর। মানুষের তো দুঃখের অভাব নেই, তার ওপর আবার মনগড়া-দুঃখের কাহিনী চাপাবেন কেন? আনন্দের গল্প লিখুন, মানষকে আর কাঁদাবেন না, শুধু হাসাবেন। আপনাদের ভাবনা কি, কলমের আঁচড়েই তো সৃষ্টি স্থিতি লয় করতে পারেন। অলকাকে বাঁচাতেই হবে, বুঝলেন সিকদার মশাই? শারলক হোম্‌সকে কোনান ডয়েল মেরে ফেলেছিলেন, কিন্তু পাঠকদের ধমক খেয়ে আবার বাঁচিয়ে দিলেন। আপনিই বা বাঁচাবেন না কেন?

 উত্যক্ত হয়ে বটেশ্বর বললেন, মাপ করবেন ডাক্তার চ্যাটার্জি, আপনার সঙ্গে আমার মতের মিল হবে না। আমরা লে-ম্যান লেখকরা তো আপনাদের চিকিৎসায় হস্তক্ষেপ করি না, আপনারাই বা লেখকদের হুকুম করবেন কেন? অনধিকারচর্চা কোনও পক্ষেই ভাল নয়।

 সঞ্জীব ডাক্তার দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, আমি অনধিকারচর্চা করি না, ডাক্তারের কাজ প্রাণরক্ষা, আপনি খুন করতে যাচ্ছেন তাতে আপত্তি জানানো আমার কর্তব্য। বেশ, যা খুশি করুন, আপনার পরম ভক্ত দু লাখ পাঠক আর চার লাখ পাঠিকা চটে গিয়ে আপনাকে শাপ দেবে, আপনার এই কুকর্মের ফল পরলোকে ভুগতে হবে। একটু সাবধানে থাকবেন মশাই, এখনকার ছোকরারা ভাল নয়। আচ্ছা, চললুম। যদি হাড়টাড় ভাঙে তো খবর দেবেন। নমস্কার।

 সঞ্জীব ডাক্তার বটেশ্বরের মন খারাপ করে দিয়ে চলে গেলেন। গতকাল সকালে যে ছোকরা এসেছিল—প্রিয়ব্রত রায়—সে পাগল হলেও শান্তশিষ্ট। কিন্তু এই সঞ্জীব ডাক্তার দুর্দান্ত উন্মাদ। শুধু উন্মাদ নয়, মনে হয় ফাজিল বকাটে আর মাতালও বটে। এমন লোকের চিকিৎসায় পসার হল কি করে? যাই হ’ক, পাগলদের কথায় বটেশ্বর কর্ণপাত করবেন না, তাঁর সংকল্পিত প্লট কিছুতেই বদলাবেন না। কিন্তু সঞ্জীব ডাক্তার ভয় দেখিয়ে গেছে, সাবধানে থাকতে হবে।


তিন দিন পরের কথা। বিকালবেলা দোতলার বারান্দায় বসে বটেশ্বর চুরট টানছেন। তাঁর বাতের বেদনাটা বেড়ে উঠেছে, সিঁড়ি দিয়ে নামাওঠায় কষ্ট হয়। ছেলেমেয়েদের নিয়ে গৃহিণী কাশীপরে তাঁর ছোট বোনের বাড়ি বেড়াতে গেছেন। বটেশ্বরের কোথাও যাবার জো নেই, কথা কইবার লোকও নেই। তাঁর অনুরক্ত বন্ধুদের কেউ যদি এখন এসে পড়েন তো তিনি খুশী হন।

 চাকর এসে খবর দিল, একজন মহিলা দেখা করতে এসেছেন। বটেশ্বর বললেন, এখানে নিয়ে আয়।

 একটি সুবেশা চব্বিশ-পঁচিশ বছরের মেয়ে তাঁর কাছে এল, একটু মোটা হলেও বেশ সুন্দরী বটে। সে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে পায়ে হাত দিলে। বটেশ্বর বললেন, থাক থাক, ওই হয়েছে। কোথা থেকে আসা হচ্ছে?

 —চিনতে পারছেন না? আমি কদম্বানিলা চ্যাটার্জি, সিনেমার ছবিতে আমাকে দেখেন নি? মধ্যগগনের তারকা না হলেও আমাকে সবাই উদীয়মানা মনে করে।

 —বেশ বেশ। সিনেমা বড় একটা দেখি না, খবরও বিশেষ রাখি না। আপনি দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন ওই চেয়ারটায়।

 —আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না সার।

 কদম্বানিলা পান চিবুতে চিবুতে কথা বলছিল, সেই বেআদবি দেখে বটেশ্বর একটু অপ্রসন্ন হয়েছিলেন। কিন্তু মেয়েটির নম্র ব্যবহারে তাঁর বিরাগ কেটে গেল, ভাবলেন, আমার সামনে সিগারেট ফুঁকছে না এই ঢের। প্রশ্ন করলেন, কদম্বানিলা তো ছদ্মনাম, তোমার আসল নামটি কি?

 —তা যে বলতে নেই সার। সন্ন্যাসী আর সিনেমা-তারার পূর্বনাম জানানো বারণ, গুরুর নিষেধ থাকে কি না। কদম্বানিলা বলতে যদি অসুবিধে হয় তো আপনি কদু বলবেন৷

 —উঁহু, কদু চলবে না, পুরো নামটাই বলব। এখন কি দরকারে এসেছ তা বল।

 মাথা পিছনে হেলিয়ে চোখ আধবোজা করে গদ্‌গদস্বরে কদম্বানিলা বলল, উঃ কি আশ্চর্য গল্প আপনি লিখেছেন দাদু, ওই ‘প্রগামিণী’ পত্রিকায় যেটি ক্রমশ বেরুচ্ছে! সবাই ধন্য ধন্য করছে, বলছে এত বড় সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যে এ পর্যন্ত আর হয় নি। আমি একটি প্রস্তাব এনেছি, বিজনেস প্রোপোজাল। এই গল্পটির ছবি অতি চমৎকার হবে। লালা নেবুচাঁদ নাজার দশ লাখ পর্যন্ত খরচ করতে প্রস্তুত আছেন। আপনার নায়িকা অলকার পার্ট আমিই নেব। দেবকী বোস কি অন্য কোনও উপযুক্ত লোককে ডিরেকশনের ভার দেওয়া হবে। তা হাজার দশ টাকা কি আরও বেশী লালাজী আপনাকে দেবেন, আমাকেও মন্দ দেবেন না। এখন আপনি রাজী হলেই হয়।

 খুশী হয়ে বটেশ্বর বললেন, তা আমার আর আপত্তি কি, তুমি নায়িকা সাজলে খুব ভালই হবে। কিন্তু গল্পটি শেষ হতে এখনও তো ছ-সাত মাস লাগবে।

 —তার জন্যে ভাববেন না দাদু। আমারও এখন অনেক এনগেজমেণ্ট, সাত মাস আমি বোম্বাইএ ব্যস্ত থাকব, নেবুচাঁদজীও থাকবেন। তিনি এখন শুধু আপনার মতটি জানতে চান, পাকা কথাবার্তা সাত মাস পরেই হবে। কিন্তু এর মধ্যে আপনি আর কাউকে কথা দিয়ে ফেলবেন না যেন।

 —না, না, তা কেন দেব।

 —আপনি দেখে নেবেন, আমার অভিনয় কি ওআণ্ডারফুল হবে, আপনার ওই অলকাকে আমার খুব ভাল লেগেছে কিনা। উঃ, ছবির শেষে অলকা যখন বেশ মোটাসোটা হয়ে তার তিন মাসের খোকাটিকে কোলে নিয়ে পর্দায় দেখা দেবে তখন হাততালিতে হাউস একেবারে ফেটে পড়বে, আর আপনি উপস্থিত থাকলে লোকে আপনাকে কাঁধে তুলে নাচবে।

 বটেশ্বর ত্রস্ত হয়ে বললেন, এই মাটি করলে, সব শেয়ালের এক রা! আমাকে পাগল না করে তোমরা ছাড়বে না দেখছি। শোন কদম্বানিলা, আমার গল্পটি বিয়োগান্ত, অলকা মরবে, দু বছর পরে তার স্বামী হেমন্তর সঙ্গে শর্বরীর বিয়ে হবে।

 চমকে উঠে চোখ কপালে তুলে কদম্বানিলা বলল, অ্যাঁ, অলকাকে মারবেন! তবে আমি ওতে নেই, ও আমি পারব না।

 —নিশ্চয় পারবে, ট্রাজেডির নায়িকা সেজেও তো চমৎকার অভিনয় করা যায়।

 —তা হতেই পারে না, মরতে আমি মোটেই রাজী নই, অলকা সেজেও নয়। আপনি সব মাটি করে দিলেন দাদু, মিছেই এখানে এসে আপনাকে বিরক্ত করলুম। তা হলে চললুম, গল্পসরস্বতী দামোদর নশকরের সঙ্গেই কথা বলি গিয়ে। তাঁর ‘মানস-মরালী’ উপন্যাসটি অপূর্ব হয়েছে, তার নায়িকা মঞ্জুলার পার্টটিও আমার বেশ পছন্দ।

 বটেশ্বর চঞ্চল হয়ে উঠলেন। দিন কতক আগে ‘দুন্দুভি’ পত্রিকায় একটা গণ্ডমূর্খ সমালোচক লিখেছিল— দামোদর নশকরের গল্প যুগচেতনা সমাজচেতনা যৌনচেতনায় পরিপূর্ণ, বটেশ্বর সিকদারের রচনা একেবারে অচেতন, শুধু চর্বিতচর্বণ। এই সমালোচনা পড়ার পর থেকে দামোদরের নাম শুনলে বটেশ্বর খেপে ওঠেন। উত্তেজিত হয়ে হাত নেড়ে বললেন, খবরদার ওটার কাছে যেয়ো না। অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন, দু দিন সময় আমাকে দাও, ভেবে দেখি অলকাকে বাঁচিয়ে গল্পটি মিলনান্ত করা চলে কিনা।

 —ভাবনার যে সময় নেই দাদু। কালই আমি বোম্বাই চলে যাচ্ছি, আজকের মধ্যেই একটা হেস্তনেস্ত করে নেবুচাঁদজীকে জানাতে হবে।

 গালে হাত দিয়ে একটু ভেবে বটেশ্বর বললেন, আচ্ছা আচ্ছা, অলকাকে বাঁচিয়েই রাখব, শর্বরীই না হয় মরবে। অন্য কারও কাছে তোমাকে যেতে হবে না। জান কদম্বানিলা, আমরা গল্পলিখিয়েরা হচ্ছি সর্বশক্তিমান, কলমের খোঁচায় সৃষ্টি স্থিতি লয় করতে পারি।

 কদম্বানিলা উৎফুল্ল হয়ে বলল, থ্যাংক ইউ দাদু এই তো লক্ষ্মী ছেলের মতন কথা। দিন পায়ের ধূলো। গল্পটি কিন্তু বেশ ভাল করে শেষ করতে হবে, শেষ দৃশ্যে ছেলে কোলে করে অলকার আসা চাই। এখন চললুম, নেবুচাঁদজীকে সুখবরটা দিইগে।

টেশ্বর সিকদার প্রতিশ্রুতি পালন করলেন, তাঁর গল্প ‘কে থাকে কে যায়’ মিলনান্তরূপেই সমাপ্ত হল। কিন্তু আট মাস হতে চলল, কদম্বানিলার দেখা নেই কেন? তার ঠিকানাটাও জানেন না যে চিঠি লিখে খবর দেবেন।

 সকাল বেলা বটেশ্বর তাঁর নীচের ঘরে বসে নিবিষ্ট হয়ে একটি নূতন গল্প লিখছেন—‘মন নিয়ে ছিনিমিনি।’ সহসা একটা চেনা গলার আওয়াজ তাঁর কানে এল—আসতে পারি সিকদার মশাই?

 ডাক্তার সঞ্জীব চাটুজ্যে ঘরে প্রবেশ করলেন, তাঁর পিছনে প্রিয়ব্রত রায় এবং একটি অচেনা মেয়ে। সঞ্জীব ডাক্তার বললেন, গুড মর্নিং সার। ওঃ আপনার সেই গল্পটিকে একেবারে মহত্তম অবদান বানিয়েছেন মশাই! একে নিশ্চয় চিনতে পেরেছেন— প্রিয়ব্রত রায়, যাকে আপনি পাগল বলে হাঁকিয়ে দিয়েছিলেন। আর এই দেখুন আপনার অলকা, আপনি যার প্রাণরক্ষা করেছেন।

 বটেশ্বরকে প্রণাম করে তাঁর পায়ের কাছে অলকা একটি পাতলা কাগজে মোড়া বড় কৌটো রাখল। সঞ্জীব ডাক্তার বললেন, আপনার জন্যে অলকা নিজের হাতে ছানার মালপো করে এনেছে, খাবেন সার।

 হতভম্ব হয়ে বটেশ্বর বললেন, কিছুই তো বুঝতে পারছি না!

 —এটা হল আপনার গল্পের সত্যিকার উপসংহার। বুঝিয়ে দিচ্ছি শুনুন।—এই অলকা হচ্ছে প্রিয়ব্রতর স্ত্রী, আমার শালী—মানে আমার স্ত্রীর মাসতুতো বোন। অলকা বছর খানিক স্যানিটেরিয়মে ছিল, বেশ সেরেও উঠেছিল, কুক্ষণে এর হাতে এল প্রগামিণী পত্রিকা। আপনার গল্প পড়তে পড়তে এর মাথায় এক বেয়াড়া ধারণা এল— গল্পের অলকা যদি বাঁচে তবেই আমি বাঁচব, সে যদি মরে তবে আমিও মরব। আমরা অনেক বোঝালুম, ওসব রাবিশ গল্প পড়ে মাথা খারাপ ক’রো না, তুমি তো সেরেই উঠছ। কিন্তু অলকার বদখেয়াল কিছুতেই দূর হল না, রেগুলার অবসেশন। অগত্যা ওর স্বামী এই প্রিয়ব্রত আপনার দ্বারস্থ হল, আপনি ওকে পাগল বলে হাঁকিয়ে দিলেন। তার পর আমি এসে আপনাকে একটি সারগর্ভ লেকচার দিলাম, আপনি তো চটেই উঠলেন। তখন আমার স্ত্রী বলল, তোমাদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না, যত সব অকম্মার ধাড়ী, আমিই যাচ্ছি, দেখি বুড়োকে বাগ মানাতে পারি কিনা। সে আপনার সঙ্গে দেখা করে পাঁচ মিনিটের মধ্যে কাজ হাসিল করল। আপনি গল্পের প্লট বদলালেন, অলকাও চটপট সেরে উঠল। এখন কি রকম মুটিয়েছে দেখুন।

 বটেশ্বর বললেন, কিন্তু আমার কাছে যিনি এসেছিলেন তিনি তো সিনেমা-অভিনেত্রী, কদম্বানিলা চ্যাটার্জি।

 —ওর চোদ্দপুরুষ কখনও সিনেমায় নামে নি। ও হল আমার স্ত্রী অনিলা, নাম ভাঁড়িয়ে কদম্বানিলা সেজে আপনাকে ঠকিয়ে গেছে। অতি ধড়িবাজ মহিলা মশাই। যাক, এখন আপনি এই আসল অলকাকে ভাল করে আশীর্বাদ করুন দেখি।

 —হাঁ হাঁ, নিশ্চয় করব। মা অলকা, চিরায়ুষ্মতী হও, সুখে থাক, স্বামীর সোহাগিনী হও, সুন্তানের জননী হও, লক্ষ্মী তোমার ঘরে অচলা হয়ে থাকুন। আচ্ছা ডাক্তার, সব তো বুঝলুম, কিন্তু আপনার স্ত্রী অনিলা না কদম্বানিলা এলেন না কেন?

 —আসবে কি করে মশাই! সে আছে মেটার্নিটি হোমে, তার একটা খোকা হয়েছে, পাক্কা দশ পাউণ্ড ওজন। অনিলা চাঙ্গা হয়ে উঠুক, তার পর আপনার কাছে এসে ধাপ্পাবাজির জন্যে মাপ চাইবে।

১৮৭৮