আনন্দীবাঈ ইত্যাদি গল্প/যযাতির জরা

যযাতির জরা

হারাজ যযাতি তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র পুরুকে বললেন, বৎস, পঁচিশ বৎসর আমি তোমার প্রদত্ত যৌবন উপভোগ করেছি, তুমি তার পরিবর্তে আমার জরার গুরু ভার বহন করেছ। আমার আর ভোগবিলাসে রুচি নেই। এখন বুঝেছি, কাম্য বস্তুর উপভোগে কামনা শান্ত হয় না, ঘৃতসংযোগে অগ্নির ন্যায় আরও বৃদ্ধি পায়, অতএব বিষয়তৃষ্ণা ত্যাগ করাই উচিত। আমার পাঁচ পুত্রের মধ্যে তুমি কনিষ্ঠ হলেও গুণে শ্রেষ্ঠ। তোমার ভ্রাতারা সকলেই স্বার্থপর, কেউ আমার অনুরোধ রাখে নি, কিন্তু তুমি দ্বিরুক্তি না করে তোমার নবীন যৌবন আমাকে দিয়েছিলে এবং তার পরিবর্তে আমার পলিত কেশ গলিত দন্ত লোল চর্ম আর দুর্বল ইন্দ্রিয়গ্রাম নিয়েছিলে। পুত্র, এখন জরা ফিরিয়ে দিয়ে তোমার যৌবন নাও, আমার রাজ্যও নাও। তুমি মনোমত সুন্দরী কন্যা বিবাহ কর, সুদীর্ঘ কাল জীবিত থেকে ঐশ্বর্য ভোগ কর। আমি সংসার ত্যাগ করে বনগমন করব।

 এইখানে একটু পূর্বকথা বলা দরকার। যযাতির প্রথমা পত্নী দেবযানী শুক্রাচার্যের কন্যা। তাঁর দুই পত্র হয়েছিল। দ্বিতীয়া পত্নী শার্মষ্ঠা, দৈত্যরাজ বৃষপর্বার কন্যা। তাঁর তিন পুত্র, পুরু কনিষ্ঠ। শর্মিষ্ঠাকে যযাতি লুকিয়ে বিবাহ করেছিলেন, তা জানতে পেরে দেবযানী ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর পিতার আশ্রমে চলে যান। শুক্রাচার্যের শাপে যযাতি অকালেই ষাট বৎসরের বৃদ্ধের তুল্য জরাগ্রস্ত হয়েছিলেন।

 যযাতির বাক্য শনে পুরু যুক্তকরে সবিনয়ে বললেন, পিতা, আমাকে ক্ষমা করুন। একবার আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য করেছিলাম, কিন্তু আপনার এই নূতন আজ্ঞা পালনের অভিরুচি আমার নেই, আপনি কৃপা করে প্রত্যাহার করুন। আমি যৌবন ফিরে চাই না, আপনিই তা ভোগ করতে থাকুন, আমি জরাতেই তুষ্ট।

 যযাতি বললেন, পুত্র, তুমি আমাকে অবাক করলে। আমার অনুরোধে তুমি জরা নিয়েছিলে, কালক্রমে সেই জরা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন তা থেকে মুক্ত হতে কেন চাও না তা আমি বুঝতে পারছি না।

 পুরু বললেন, পিতা, আমাদের দুজনের বর্তমান অবস্থাটা বিচার করে দেখুন। যখন আপনি আমার যৌবন নিয়ে আপনার জরা আমাকে দিয়েছিলেন তখন আমার বয়স ছিল বিশ, আর আপনার ছিল ষাট। তার পর পঁচিশ বৎসর কেটে গেছে। এখন আপনি পঁয়তাল্লিশ বৎসরের প্রৌঢ়, আর আমি পঁচাশি বৎসরের স্থবির। আপনার প্রৌঢ়তার প্রতি আমার কিছুমাত্র লোভ নেই। জরাগ্রস্ত হবার পর থেকে আমি শাস্ত্রপাঠ যোগচর্চা আর অধ্যাত্মচিন্তায় নিরত আছি, ইন্দ্রিয়ভোগে আমার আসক্তি নেই, সর্ববিধ বিষয়তৃষ্ণা লোপ পেয়েছে। আমি দারপরিগ্রহ করি নি, পরমা সুন্দরী রমণী দেখলেও আমার চিত্তচাঞ্চল্য হয় না, অতি সুস্বাদ মাংস বা মিষ্টান্নেও আমার রুচি নেই। এই শান্তিময় অবস্থার আমি পরিবর্তন করতে চাই না। এখন আমি মোক্ষলাভের জন্য তপস্যা করছি, আপনার সঙ্গে বয়স বিনিময় করলে আমার পঁচিশ বৎসরের সাধনা পণ্ড হবে।

 যযাতি এখন স্বাস্থ্যবান সবল মধ্যবয়স্ক, তাঁর চুল আর গোঁফে মোটেই পাক ধরে নি, দেখলে ত্রিশ বৎসরের যুবা বলেই মনে হয়। তাঁর পুত্র পুরু পচাশি বৎসরের বৃদ্ধ, মাথায় এখনও কিছু পাকা চুল অবশিষ্ট আছে, মুখে প্রকাণ্ড সাদা দাড়ি-গোঁফ। প্রৌঢ় যযাতি তাঁর মহাস্থবির পুত্রকে কিঞ্চিৎ ভয় করেন, লজ্জাও করেন। পুরুর কথা শুনে বললেন, পুত্র, আমি তোমার তপশ্চর্যার হানি করতে চাই না, কিন্তু আমার গতি কি হবে? এই যৌবনতুল্য দুর্মদ প্রৌঢ়ত্ব আর যে সহ্য হচ্ছে না।

 পুরু বললেন, পিতা, কোনও স্থবির সদ্‌বিপ্র বা সৎক্ষত্রিয়কে আপনার প্রৌঢ়ি দান করুন, তার পরিবর্তে তাঁর জরা গ্রহণ করুন। আপনি মন্ত্রীকে আদেশ দিলে তিনি রাজ্যের সর্বত্র ঢক্কা বাজিয়ে ঘোষণা করবেন, প্রার্থীর অভাব হবে না, যোগ্যতমের সঙ্গেই আপনি বয়স বিনিময় করবেন। এখন আমাকে গমনের অনুমতি দিন, আমি অগ্নিষ্টোম যজ্ঞের সংকল্প করেছি, তারই আয়োজন করতে হবে।


পুরু চলে গেলে পঞ্চাশ জন রাজভার্যা অন্তঃপুর থেকে এসে ব্যাকুল হয়ে যযাতিকে বেষ্টন করলেন। প্রথমা মহিষী দেবযানী সেই যে রাগ করে পিত্রালয়ে চলে গিয়েছিলেন তার পরে আর ফিরে আসেন নি। দ্বিতীয়া মহিষী শর্মিষ্ঠার বয়স এখন ষাট। তিনি কারও সঙ্গে মেশেন না, অন্তরালে থেকে ধর্মকর্মে কালযাপন করেন। পুনর্যৌবন লাভের পর যযাতি ক্রমে ক্রমে পঞ্চাশটি বিবাহ করেছেন। এই সকল পত্নীদের বয়স এখন চল্লিশ থেকে পঁচিশ। এদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে প্রবীণা সেই পৃথলাঙ্গী সপত্নীদের মুখপাত্রী হয়ে যযাতিকে বললেন, আর্য পুত্র, এ কিরকম কথা শুনছি? আপনি নাকি আপনার যৌবন পুরুকে ফিরিয়ে দিয়ে তাঁর পঁচাশি বৎসরের জরা নেবেন?—

 যযাতি বললেন, সেই রকমই তো ইচ্ছা। যৌবন আর আমার ভাল লাগে না, এখন বৈরাগ্য অবলম্বন করব। কিন্তু পুরু বেঁকে দাঁড়িয়েছে, সে আর আগেকার মতন পিতৃভক্ত আজ্ঞাপালক পুত্র নয়, তার জরা ছাড়তে চায় না, যেন কতই দুর্লভ সামগ্রী। যদি নিতান্তই তাকে বশে আনতে না পারি তবে কোনও স্থবির ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়কে আমার বয়স দিয়ে তাঁর জরা নেব।

 রাজপত্নীদের মধ্যে যিনি কনিষ্ঠা সেই করঞ্জাক্ষী বললেন, মহারাজ, এই যদি আপনার অভিপ্রায় ছিল তবে আমাদের পাণিগ্রহণ করেছিলেন কেন? আপনি বহু পত্নীর স্বামী, নিজের যৌবন ভোগ করার পর আবার পুত্রের যৌবন ভোগ করেছেন। আপনার যৌবনে অরুচি হতে পারে, কিন্তু আমাদের তো হয় নি। আমাদের অনাথা করে যদি জরা গ্রহণ করেন তবে আপনার মহাপাপ হবে।

 যযাতি বললেন, আমি মন স্থির করে ফেলেছি, আমার সংকল্প বদলাতে পারি না। তোমাদের সকলকেই আমি পত্নীত্ব থেকে মুক্তি দিলাম, প্রচুর অর্থও রাজকোষ থেকে পাবে। ইচ্ছা করলে আবার বিবাহ করতে পার।

 করঞ্জাক্ষী তীক্ষ্ণকণ্ঠে বললেন, মহারাজ, আপনার কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছে। আমরা সকলেই সন্তানবতী, কে আমাদের পত্নীত্বে বরণ করবে? সবৎসা ধেনুর যে মূল্য সবৎসা নারীর তা নেই।

 যযাতি বললেন, আচ্ছা আচ্ছা, তোমাদের জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করা হবে। নূতন পতি যদি নাও জোটে তথাপি সুখে থাকতে পারবে। এখন যাও, আমার বিস্তর কাজ।


পুত্রের মত পরিবর্তনের জন্য যযাতি অনেক চেষ্টা করলেন কিন্তু কোনও ফল হল না। তখন তাঁর আজ্ঞানুসারে রাজমন্ত্রী এই ঘোষণা করলেন।—ভো ভো বিদ্যাবিনয়সম্পন্ন সদ্‌বংশজাত স্থবির ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণ, অবধান করুন। কুরুরাজ যযাতির আর যৌবনভোগের ইচ্ছা নেই, কোনও জরাগ্রস্ত সৎপাত্রের সঙ্গে তাঁর বয়স বিনিময় করতে চান। শ্রীযযাতির বর্তমান বয়স পঁয়তাল্লিশ, পূর্ণ যৌবনেরই তুল্য। প্রার্থী স্থবিরগণ আগামী অমাবস্যায় পূর্বাহ্ণে হস্তিনাপুরে রাজভবনের চত্বরে উপস্থিত হবেন। মহারাজ স্বয়ং নির্বাচন করবেন, যাঁকে যোগ্যতম মনে করবেন তাঁর সঙ্গেই বয়স বিনিময় করবেন। তাঁর সিদ্ধান্তের কোনও প্রতিবাদ গ্রাহ্য হবে না।

 নির্দিষ্ট দিনে প্রায় এক হাজার জরাগ্রস্ত ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় হস্তিনাপুরে এলেন। এঁদের বয়স এক শ থেকে ষাট। কেউ কুঁজো হয়ে পড়েছেন, লাঠিতে ভর দিয়ে চলেন। কেউ দৃষ্টিহীন, অপরের হাত ধরে এসেছেন। কেউ চলতেই পারেন না, ডুলিতে চড়ে এসেছেন। যযাতির সংকল্পের সংবাদ পেয়ে দেবলোক থেকে দুই অশ্বিনীকুমার আর দেবর্ষি নারদও কৌতূহলবশে উপস্থিত হলেন, কিন্তু আত্মপ্রকাশ না করে অগোচরে রইলেন।

 সমবেত প্রার্থিগণকে স্বাগত জানিয়ে যযাতি তাঁদের পরীক্ষা করতে যাচ্ছেন এমন সময় একদল বৃদ্ধা ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন। তাঁদের নেত্রী একজন বর্ষীয়সী ব্রাহ্মণী। তাঁর মস্তক প্রায় কেশশূন্য, ললাটে বৈধব্যের প্রতিষেধক একটি প্রকাণ্ড সিন্দূরের ফোঁটা, পরিধানে রক্তবর্ণ পট্টবাস। ইনি কম্পিত কণ্ঠে বললেন, কুরুরাজ যযাতি, শাস্ত্রে আছে যৌবন ধনসম্পত্তি প্রভুত্ব আর অবিবেকিতা, এর প্রত্যেকটি অনর্থকর, দুর্দৈবক্রমে আপনাতে চারটিই একত্র হয়েছে। এক যৌবনেই রক্ষা নেই, আপনি দুই যৌবন ভোগ করেছেন, সুতরাং যৌবনাক্রান্ত ধেড়ে-রোগগ্রস্ত বৃদ্ধ কি প্রকার জীব তা ভালই জানেন। যে বৃদ্ধের সঙ্গে আপনি বয়স বিনিময় করবেন সে নিশ্চয় যুবতী ভার্যা ঘরে আনবে। তখন তার বৃদ্ধা পত্নীর কি দশা হবে ভেবে দেখেছেন কি?

 যযাতি কুণ্ঠিত হয়ে বললেন, হুঁ, আপনার আশঙ্কা যথার্থ। ওহে মন্ত্রী, এখনই ঘোষণা করে দাও—যাঁদের পত্নী জীবিত আছেন তাঁদের সঙ্গে আমি বয়স বিনিময় করব না। একটি করে স্বর্ণমুদ্রা প্রণামী স্বরূপ দিয়ে তাঁদের বিদায় কর।

 যাঁদের বাদ দেওয়া হল তাঁরা প্রণামী নিলেন, কিন্তু কেউ চলে গেলেন না, রাজা কাকে মনোনীত করেন দেখবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

 যে পঙ্গু ব্রাহ্মণ ডুলিতে এসেছিলেন তিনি রাজার সম্মুখে এসে ডুলিতে বসেই বললেন, মহারাজের জয় হক। আমি মহাকুলীন বিপ্র কুলীরক, বয়স শত বর্ষ, সর্বশাস্ত্রজ্ঞ, আমার পাঁচ পত্নীই একে একে গত হয়েছেন। আমার তুল্য যোগ্যপাত্র কোথাও পাবেন না, অতএব আমার সঙ্গেই বয়স বিনিময় করুন।

 নমস্কার করে যযাতি বললেন, দ্বিজোত্তম কুলীরক, আমি জরা কামনা করি, কিন্তু পঙ্গুত্ব চাই না। মন্ত্রী, একে পাঁচ স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে বিদায় কর।

 তার পর এক বক্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধ তাঁর দুই পৌত্রের হাত ধরে যযাতির কাছে এসে বললেন, মহারাজ, আমার নাম কিঞ্চুলুক, কার্তবীর্যার্জুনের বংশধর, বয়স আশি। চোখে ভাল দেখতে পাই না, অগাধ বিদ্যাবুদ্ধির জন্য লোকে আমাকে প্রজ্ঞাচক্ষু বলে। বহু পুত্র পৌত্র সত্ত্বেও আমি অসুখী, সকলেই আমাকে অবহেলা করে, সম্পত্তির লোভে আমার মৃত্যুকামনা করে। আপনার পরিপক্ক যৌবন পেলে আমি পুনর্বার দারপরিগ্রহ করে সুখী হতে পারব।

 যযাতি বললেন, মহামতি কিঞ্চুলুক, আমি জরা চাই, কিন্তু আপনার প্রজ্ঞাচক্ষুতে আমার কাজ চলবে না। মন্ত্রী, পঞ্চ স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে এঁকে বিদায় কর।

 বহু প্রার্থী একে একে এসে রাজসম্মুখে নিজের নিজের গুণাবলী বিবৃত করলেন, কিন্তু যযাতি কাকেও তাঁর মহৎ দানের যোগ্য পাত্র মনে করলেন না। সহসা একটা গুঞ্জন উঠল, জনতা সসম্ভ্রমে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পথ ছেড়ে দিল। দুজন পক্ককেশ পক্কশ্মশ্রু বৃদ্ধ একটি অপূর্ব রূপলাবণ্যবতী ললনার হাত ধরে রাজার সম্মুখে এলেন।

 যযাতি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কে আপনারা দ্বিজদ্বয়? এই বরবর্ণিনী সুন্দরী যাঁর আগমনে সভা উদ্‌ভাসিত হয়েছে ইনিই বা কে?

 দুই বৃদ্ধের মধ্যে যিনি বয়সে বড় তিনি বললেন, মহারাজ, আমরা বিন্ধ্যপাদস্থ তপোবন বিল্বাশ্রম থেকে আসছি। মহাতপা ভল্লাতক ঋষির নাম শুনে থাকবেন, আমি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র বিভীতক, আর কনিষ্ঠ এই হরীতক। এই রূপবতী কুমারী হচ্ছেন সুবর্তরাজ মিত্রসেনের কন্যা মনোহরা। প্রৌঢ় বয়সে মিত্রসেনের পত্নীবিয়োগ হলে তিনি বানপ্রস্থ গ্রহণের সংকল্প করলেন এবং পুত্রকে রাজপদে অভিষিক্ত করে একমাত্র কন্যার বিবাহের জন্য উদ্‌যোগী হলেন। কিন্তু এই মনোহরা বললেন, পিতা, বিবাহ থাকুক, আমিও বনে যাব, নইলে আপনার সেবা করবে কে? কন্যার অত্যন্ত আগ্রহ দেখে মিত্রসেন সম্মত হলেন এবং তাঁর কুলগুরু আমাদের পিতা ভল্লাতকের আশ্রমের নিকটে কুটীর নির্মাণ করে সেখানে বাস করতে লাগলেন। আমাদের পিতার অনেক বয়স হয়েছিল, কিছুকাল পরে তিনি স্বর্গে গেলেন। সম্প্রতি রাজা বসুমিত্রও পনরো বৎসর অরণ্যবাসের পর দেহত্যাগ করেছেন। মৃত্যুকালে তিনি বললেন, হা, কন্যাকে অনূঢ়া রেখেই আমাকে যেতে হচ্ছে! গুরুপুত্র বিভীতক ও হরীতক, এর ভার তোমরা নাও, কালবিলম্ব না করে এর বিবাহ দিও, কিন্তু বৃদ্ধের সঙ্গে কদাচ নয়, বৃদ্ধপতিতে আমার কন্যার রুচি নেই। রাজার মৃত্যুর পর আমরা মহা সমস্যায় পড়লাম। আমরা দুজনেই বৃদ্ধ, সে কারণে মনোহরার মনোমত পাত্র নই। এমন সময় ভাগ্যক্রমে আপনার ঘোষণা শুনলাম, তাই সত্বর এখানে এসেছি। মহারাজ, সকল বিষয়েই আমি এই কন্যার যোগ্য পাত্র, আমার সঙ্গেই আপনার বয়স বিনিময় করুন, তা হলে আমাদের বিবাহে কোনও বাধা থাকবে না।

 হরীতক উত্তেজিত হয়ে বললেন, মহারাজ, আমার দাদার প্রস্তাব মোটেই ন্যায়সংগত নয়। আমি ওঁর চাইতে রূপবান ও বিদ্বান, মনোহরার সঙ্গে আমার বয়সের ব্যবধানও কম, ওঁর ত্রিশ, আমার ষাট, আর দাদার পঁয়ষট্টি। আমি এখনই যোগ্যতর পাত্র, মহারাজের যৌবন পেলে তো কথাই নেই।

 বিভীতক ধমক দিয়ে বললেন, তুই চুপ কর মূর্খ। জ্যেষ্ঠের পূর্বে কনিষ্ঠের বিবাহ হতেই পারে না।

 যযাতি বললেন, রাজকন্যা, তোমার অভিমত কি? তুমি যাকে চাও তাকেই আমার যৌবন দেব। এই দুই ভ্রাতার মধ্যে কাকে যোগ্যতর মনে কর?

 মনোহরা বললেন, দুজনেই সমান।

 যযাতি বললেন, সুন্দরী, তুমি আমাকে বড়ই সমস্যায় ফেললে, এই বিভীতক আর হরীতকের মধ্যে আমিও কোনও ইতরবিশেষ দেখছি না। আচ্ছা, এক কাজ করলে হয় না? আমার দিকে একবার দৃষ্টিপাত কর।

 নিজের কুচকুচে কালো বাবরি চুলে হাত বুলিয়ে আর রাজকীয় মোটা গোঁফে চাড়া দিয়ে যযাতি বললেন, যৌবন তো আমার রয়েইছে, বেশ পরিপুষ্ট যৌবন, তা যদি দান না করে রেখেই দিই? আমিই যদি তোমাকে বিবাহ করি তা হলে কেমন হয় মনোহরা?

 বিভীতক আর হরীতক ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, এ কি রকম কথা মহারাজ! আপনি ঢাক পিটিয়ে ঘোষণা করেছেন যে আপনার যৌবন অন্যকে দান করবেন, এখন বিপরীত কথা বলছেন কেন? সমবেত বৃদ্ধদের কয়েক জন চিৎকার করে হাত নেড়ে বললেন, মহারাজ, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে আপনি রৌরব নরকে যাবেন। আমাদের ডেকে এনে বঞ্চনা করবেন এত দূর আস্পর্ধা! জনতা থেকে নিনাদ উঠল—চলবে না, চলবে না।


ব্যাপার গুরুতর হচ্ছে দেখে নারদ আর অশ্বিনীকুমারদ্বয় আত্মপ্রকাশ করলেন। যযাতি সসম্ভ্রমে তাঁদের পাদ্য-অর্ঘ্যাদি দিতে গেলেন, কিন্তু নারদ বললেন, মহারাজ, ব্যস্ত হয়ো না, উপস্থিত সংকট থেকে আগে মুক্ত হও।

 যযাতি বললেন, দেবর্ষি, আমার মাথা গুলিয়ে গেছে, আপনিই বলুন এখন আমার কর্তব্য কি।

 নারদ বললেন, তুমি সত্যভ্রষ্ট হয়েছ। পুরুকে ডাক, সেই তোমার প্রতিশ্রুতি রক্ষার ব্যবস্থা করবে।

 যযাতির আহ্বানে পুরু জনসভায় এলেন। পূজনীয়গণকে বন্দনা করে বললেন, পিতা, আমাকে আবার এর মধ্যে জড়াতে চান কেন? আমার যজ্ঞীয় অনুষ্ঠান এখনও সমাপ্ত হয় নি, যজ্ঞান্ত স্নান না করেই আপনার আদেশে এসেছি। বলুন কি করতে হবে।

 যযাতি নীরবে রইলেন। নারদ বললেন, রাজপুত্র, তোমার পিতার কিঞ্চিৎ চিত্তবিকার হয়েছে, তাঁর সংকল্প সিদ্ধির ব্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে। এই সভায় উপস্থিত বৃদ্ধগণের মধ্যে কে যোগ্যতম, কার সঙ্গে যযাতি বয়স বিনিময় করবেন তা তুমিই স্থির কর।

 পুরু প্রশ্ন করলেন, ওই বিদ্যুদ্‌বল্লরী তুল্য ললনা যাঁর দুটি হাত দুই বৃদ্ধ ধরে আছেন, উনি কে?

 নারদ বললেন, উনি স্বর্গত সুবর্তরাজ মিত্রসেনের কন্যা মনোহরা। ওই দুই বৃদ্ধ ওঁর পিতার গুরুপুত্র, বিভীতক ও হরীতক। ওঁরা দুজনেই মনোহরার পাণিপ্রার্থী, যযাতির যৌবনও ওঁরা চান। কিন্তু তোমার পিতা বড় সমস্যায় পড়েছেন, কার সঙ্গে বয়স বিনিময় করবেন তা স্থির করতে পারছেন না।

 পুরু বললেন, সমস্যা তো কিছুই দেখছি না, আমি এখনই মীমাংসা করে দিচ্ছি। রাজকন্যা, ওই দুই বৃদ্ধের মধ্যে কাকে যোগ্যতর মনে কর?

 মনোহরা বললেন, দুজনেই সমান।

 একটু চিন্তা করে পুরু বললেন, বরবর্ণিনী মনোহরা, তোমার সহিত নিভৃতে কিছু পরামর্শ করতে চাই। ওই অশোক তরুর ছায়ায় চল।


 অশোকতরুতলে কিছুক্ষণ আলাপের পর পুরু সকলের সমক্ষে এসে বললেন, পরমারাধ্য পিতৃদেব, ত্রিলোকপূজ্য দেবর্ষি, দেববৈদ্য অশ্বিদ্বয়, এবং সমবেত ভদ্রগণ, অবধান করুন। আজ সহসা আমার উপলব্ধি হয়েছে, পিতার আজ্ঞা পালন না করে আমি অপরাধী হয়েছি। এখন উনি আমাকে ক্ষমা করুন, ওঁর যৌবনের পরিবর্তে আমার জরা গ্রহণ করুন। এই রাজকুমারী মনোহরা আমাকেই পতিত্বে বরণ করবেন।

 নারদ আর দুই অশ্বিনীকুমার বললেন, সাধু সাধু! জনতা থেকে ধ্বনি উঠল, রাজা যযাতির জয়, যুবরাজ পুরুর জয়! বিভীতক আর হরীতক বিরস বদনে নিঃশব্দে প্রস্থান করলেন।

 যযাতি মৃদুস্বরে আপন মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, ছি ছি ছি, এই যদি করবি তবে সেদিন অমন তেজ দেখিয়ে আমার কথায় ‘না’ বললি কেন? এত লোকের সামনে ধাষ্টামো করবার কি দরকার ছিল?

 দুই অশ্বিনীকুমার বললেন, মহারাজ যযাতি, রাজপুত্র পুরু, আমরা এখনই অস্ত্রোপচার করে তোমাদের জরা-যৌবন পরিবর্তিত করে দিচ্ছি, অস্ত্রভাণ্ড আমাদের সঙ্গেই আছে।

 নারদ বললেন, তোমাদের কিছুই করতে হবে না, পিতা-পুত্রের পুণ্যবলে বিনা অস্ত্রেই পরিবর্তন ঘটবে।

 পুরু তাঁর পিতার চরণ স্পর্শ করলেন। পুরুর মস্তকে করার্পণ করে যযাতি বললেন, পুত্র, আমার যৌবন তোমাতে সংক্রমিত হক, তোমার জরা আমাতে প্রবেশ করুক।

 তৎক্ষণাৎ বিনিময় হয়ে গেল।

১৮৭৯