১৮ মতিলালের দলবল সুদ্ধ বুড়া মজুমদারের

সহিত সাক্ষাৎ ও তাহার প্রমূখাৎ বাবুরাম বাবুর

দ্বিতীয় বিবহের বিবরণ ও তদ্বিষয়ে কবিতা।


 সূর্য্য অস্ত হইতেছে— পশ্চিমদিকে আকাশ নানা রঙ্গে শোভিত। জলে স্থলে দিবাকরের চঞ্চল আভা মৃদু মৃদু হাসিতেছে,— বায়ু মন্দ২ বহিতেছে। এমত সময়ে বাহিরে যাইতে কাহার্ না ইচ্ছা হয়? বৈদ্যবাটীর সরে রাস্তায় কয়েকজন বাবু ভেয়ে হো২ মার২ ধর২ শব্দে চলিয়াছে— কেহ কাহার ঘাড়ের উপর পড়িতেছে—কেহ কাহার ভার ভাঙ্গিয়া দিতেছে—কেহ কাহাকে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিতেছে— কেহ কাহার ঝাঁকা ফেলিয়া দিতেছে— কেহ কাহার খাদ্যদ্রব্য কাড়িয়া লইতেছে— কেহবা লম্বা সুরে গান হাঁকিয়া দিতেছে— কেহবা কুকুর ডাক ডাকিতেছে। রাস্তার দোধারি লোক পালাই পালাই ত্রাহি২ করিতেছে— সকলেই ভয়ে জড়সড় ও কেঁচো— মনে করিতেছে আজ্ বাঁচ্‌লে অনেকদিন বাঁচ্‌বো। যেমন ঝড় চারি দিগে তোল্‌পাড় করিয়া হু২ শব্দে বেগে বয়, নব বাবুদিগের দঙ্গল সেই মত চলিয়াছে। এ গুণ পুরুষেরা কে? আর কে! এঁরা সেই সকল পুণ্যশ্লোক—এঁরা মতিলাল, হলধর, গদাধর, রামগোবিন্দ, দোলগোবিন্দ, মানগোবিন্দ ও অন্যান্য দ্বিতীয় নলরাজা ও যুধিষ্ঠির। কোনো দিকে দৃক্‌পাত নেই—একেবারে ফুল্লারবিন্দ—মত্ততায় মাথা ভারি—গুমরে যেন গড়িয়া পড়েন। সকলে আপন মনেই চলিয়াছেন—এমন সময় গ্রামের বুড় মুজমদার, মাথায় শিক্কা ফর২ করিয়া উড়িতেছে, একহাতে লাঠি ও আর একহাতে গোটাদুই বেগুন লইয়া ঠকর্‌২ করিয়া সম্মুখে উপস্থিত হইল, অমনি সকলে তাহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া রং জুড়ে দিল। মজুমদার কিছু কানে খাট—তাহারা জিজ্ঞাসা করিল—আরে কও তোমার স্ত্রী কেমন আছেন? মজুমদার উত্তর করিলেন—পুড়িয়ে খেতে হবে—অমনি তাহারা হাহা২ হো২, লিক২ ফিক২, হাসিয়া গর্রায় ছেয়ে ফেলিল। মজুমদার মোহাড়া কাটাইয়া চম্পট দিতে চান কিন্তু তাঁহার ছাড়ান নাই। নব বাবুরা তাঁহাকে ধরিয়া লইয়া গঙ্গার ঘাটের নিকট বসাইল। এক ছিলিম গুড়ুক খাওয়াইয়া বলিল—মজুমদার। কর্ত্তার বের নাকালটা বিস্তারিত করিয়া বল দেখি—তুমি কবি—তোমার মুখের কথা বড়ো মিষ্ট লাগে, না বল্‌লে ছেড়ে দিব না এবং তোমার স্ত্রীর কাছে এক্‌খুনি গিয়া বলিব তোমার অপঘাত মৃত্যু হইয়াছে। মজুমদার দেখিল বিষম প্রমাদ, না বলিলে ছাড়ান নাই—লাচারে লাঠি ও বেগুন রাখিয়া কথা আরম্ভ করিল।

 দুঃখের কথা আর কি বল্‌ব? কর্ত্তার সঙ্গে গিয়ে ভালো আক্কেল পাইয়াছি। সন্ধ্যা হয়২ এমত সময়ে বলাগড়ের ঘাটে নৌকা লাগলো। কতক গুলিন স্ত্রীলোক জল আনিতে আসিয়াছিল, কর্ত্তাকে দেখিয়া তাহারা একটু ঘোমটা টানিয়া দিয়া ঈষৎ হাস্য করিতে২ পরস্পর বলাবলি কর্‌তে লাগ্‌লো—আ মরি! কি চমৎকার বর! যার কপালে ইনি পড়্‌বেন সে একেবারে এঁকে চাঁপা ফুল করে খোঁপাতে রাখ্‌বে। তাহাদিগের মধ্যে একজন বলিল—বুড়ো হউক ছুড় হউক তবু একে মেয়েমানুষটা চক্ষে দেখ্‌তে পাবেতো? সেও তো অনেক ভাল। আমার যেমন পোড়া কপাল এমন যেনো আর কারো হয় না, ছয় বৎসরের সময় বে হয় কিন্তু স্বামী কেমন চক্ষে দেখনু না—শুনেছি তাঁর পঞ্চাশ-ষাটটি বিয়ে, বয়সে আশি বচ্চরের উপর—থুরথুরে বুড় কিন্তু টাকা পেলে বে করতে আলেন না। বড়ো অধর্ম্ম না হলে আর মেয়ে মানুষের কুলীনের ঘরে জন্ম হয় না। আর একজন বলিল—ওগো জল তোলা হয়্যে থাকে তো চলে চল—ঘাটে এসে আর বাক্‌চাতুরীতে কাজ নাই—তোর তবু স্বামী বেঁচে আছে, আমার যার সঙ্গে বে হয় তাঁর তখন অন্তর্জ্জলী হচ্ছিল। কুলীন বামুনদের কি ধর্ম্ম আছে না কর্ম্ম আছে—এ সব কথা বল্‌লে কি হবে? পেটের কথা পেটে রাখাই ভালো। মেয়ে গুলার কথোপকথন শুনে আমার কিছু দুঃখ উপস্থিত হইল ও যাওন কালীন বেণী বাবুর কথা স্মরণ হইতে লাগিল। পরে বলাগড়ে উঠিয়া সওয়ারির অনেক চেষ্টা করা গেল কিন্তু একজন কাহারও পাওয়া গেল না। লগ্ন ভ্রষ্ট হয় এজন্য সকলকে চলিয়া যাইতে হইল। কাদাতে হেঁকোচ হোঁকোচ করিয়া কন্যা কর্ত্তার বাটীতে উপস্থিত হওয়া গেল। দঁকে পড়িয়া আমাদিগের কর্ত্তার যে বেশ হইয়াছিল তাহা কি বল্‌ব? একটা এঁড়ে গোরুর উপর বসাইলেই সাক্ষাৎ মহাদেব হইতেন আর ঠকচাচা ও বক্রেশ্বরকে নন্দী ভৃঙ্গীর ন্যায় দেখাইত। শুনিয়াছিলাম যে দানসামগ্রী অনেক দিবে, দালানে উঠিয়া দেখিলাম সে গুড়ে বালি পড়িয়াছে। আশা ভগ্ন হওয়াতে ঠকচাচা এদিক ওদিক চান—গুম্‌রে২ বেড়ান—আমি মুচ্‌কে২ হাসি ও এক একবার ভাবি এস্থলে সাটে হেঁ হুঁ দেওয়া ভাল। বর স্ত্রীআচার কর্‌তে গেল, ছোট বড় অনেক মেয়ে ঝুনুর২ করিয়া চারিদিকে আসিয়া বর দেখিয়া আঁত্‌কে পড়িল, যখন চারি চক্ষে চাওয়া চায়ি হয় তখন কর্ত্তাকে চস্‌মা নাকে দিতে হইয়াছিল—মেয়েগুলা খিল্‌২ করিয়া হাসিয়া ঠাট্টা জুড়ে দিল—কর্ত্তা ক্ষেপে উঠে ঠকচাচা২ বলিয়া ডাকেন—ঠকচাচা বাটীর ভিতর দৌড়ে যাইতে উদ্যত হন—অমনি কন্যাকর্ত্তার লোকেরা তাহাকে আচ্ছা করে আল্‌গা২ রকমে সেখানে শুইয়ে দেয়—বাঞ্ছারাম বাবু তেরিয়া হইয়া উঠেন তাঁরও উত্তম মধ্যম হয়—বক্রেশ্বরও অর্দ্ধচন্দ্রের দাপটে গলাফুলা পায়রা হন। এই সকল গোলযোগ দেখিয়া আমি বরযাত্রিদিগকে ছাড়িয়া কন্যাযাত্রিদিগের পালে মিশিয়া গেলুম,তার পরে কে কোথায় গেল তাহা কিছুই বলিতে পারি না কিন্তু ঠকচাচাকে ডুলি করিয়া আসিতে হইয়াছিল।—কথাই কাছে লোভে পাপ—পাপে মৃত্যু। এক্ষণে যে কবিতা করিয়াছি তাহা শুন।

ঠকচাচা মহাশয়, সদা করি মহাশয়,
বাবুরামে দেন কাণে মন্ত্র।
বাবুরাম অঘা অতি, হইয়াছে ভীমরথী,
ঠকবাক্য শ্রুতি স্মৃতি তন্ত্র।
ধনাশয়ে সদোন্মত্ত, ধর্ম্মাধর্ম্ম নাহি তত্ত্ব,
অর্থ কিসে থাকিবে বাড়িবে।
সদা এই আন্দোলন, সৎকর্ম্মে নাহি মন,
মন হৈল করিবেন বিয়ে।
সবে বলে ছিছি ছিছি, এবয়সে মিছা মিছি,
নালা কেটে কেন আন জল।
জাজ্জ্বল্য যে পরিবার, পৌত্র হইবে আবার,
অভাব তোমার কিসে বল।
কোন কথা নাহি শোনে, স্থির করে মনে মনে,
ভারি দাঁও মারিব বিয়েতে।
করিলেন নৌকা ভাড়া, চলিলেন খাড়া খাড়া,
স্বজন ও লোক জন সাতে।
বেণী বাবু মানা করে, কে তাঁহার কথা ধরে,
ঘরে গিয়া ভাত তিনি খান।
বেচারাম সদা চটা, ঠকে বলে ঠেঁটা বেটা,
দূঁর দূঁর করে তিনি যান।

গণ্ড গ্রাম বলাগোড়, রামা সবে পেতে গড়,
ইঙ্গিতে ভঙ্গিতে করে ঠাট্টা।
বাবুরাম ছট্‌ফট্‌, দেখে বড় সুসঙ্কট,
ভয় পান পাছে লাগে বাঁট্টা!
দর্পণ সম্মুখে লয়ে, মুখ দেখে ভয়ে ভয়ে,
রামা সবে কেন দেয় বাধা।
চুল গুলি ঘন বাঁধে, হাত দিয়া ঠক কাঁধে,
হৃষ্ট মনে চলয়ে তাগাদা।
পিছলেতে লণ্ডভণ্ড, গড়ায় যেন কুষ্মাণ্ড,
উৎসাহে আহ্বাদে মন ভরা।
পরিজন লােক জন, দেখে শমন ভবন,
কাদা চেহলায় আদ মরা।
যেমন বর পৌঁছিল, হাড়কাটে গলা দিল,
ঠক আশা আসা হল সার।
কোথার বা রূপা সােণা, সােণা মাত্র হল শােনা,
কোথায় বা মুকতার হার।
ঠক করে তেরি মেরি, দন্দ্বোজ বাধায় ভারি,
মনে রাগ মনে সবে মারে।
স্ত্রী আচারে বর যায়, ঝুনু ঝুনু রামা ধায়,
বর দেখে হাক থুতে সারে।
ছি ছি ছি, এই ঢোষ্কা কি ঐ মেয়েটির বর লাে। 
পেট্টা লেও, ফোগ্লারাম, ঠিক আহ্লাদের বুড় গো। 
চুল গুলি কিবা কাল, মুখখানি তোবড়া ভাল, নাকেতে 
চস্‌মা দিয়া, সাজলাে জুজুবুড় গাে।
মেয়েটি সােণার লতা, হায় কি হল বিধাতা, কুলীনের 
কর্ম্ম কাণ্ডে, ধিক ধিক ধিক লাে।
বুড় বর জ্বরজ্বর, থর্‌থর্‌ কাঁপিছে।
চক্ষুকট্‌মট্‌ সট্‌সট্‌ করিছে।

নাহি কথা ঊর্দ্ধ মাথা পেয়ে ব্যথা ডাকিছে।
ঠকচাচা একি ঢাঁচা মোকে বাঁচা বলিছে।
লম্ফঝম্প ভূমিকম্প ঠক লম্ফ দিতেছে।
দয়োয়ান হান্‌হান্ সান্‌সান্ ধরিছে।
ভূমে পড়ি গড়াগড়ি গোঁপ দাড়ি ঢাকিছে।
নাথি কীল যেন শিল পিল্‌পিল্ পড়িছে।
এইপর্ব্ব দেখে সর্ব্ব হয়ে খর্ব্ব ভাগিছে।
নমস্কার এ ব্যাপার বাঁচা ভার হইছে।
মজুমদার দেখে দ্বার আত্মসার করিছে।
মার্‌মার্ ঘের্‌ঘার্ ধর্‌ধর্ বাড়িছে।