২৯ বৈদ্যবাটির বাটী দখল লওন —বাঞ্ছারামের কুব্যব-

হার —পরিবারদিগের দুঃখ ও বাটী হইতে বহিষ্কৃত হওন—

বরদাবাবুর দয়া।


 বাঞ্ছারাম বাবুর ক্ষুধা কিছুতেই নিবৃ হয় না —সর্ব্বক্ষণ কেবল দাঁও মারিবার ফিকির দেখেন এবং কিরূপ পাকচক্র করিলে আপনার ইষ্ট সিদ্ধ হইতে পারে তাহাই সর্ব্বদা মনের মধ্যে তোলাপাড়া করেন। এইরূপ করাতে তাঁহার ধূর্ত্ত বুদ্ধি ক্রমে প্রখর হইয়া উঠিল। বাবুরাম ঘটিত ব্যাপারে সকল উল্টে পাল্টে দেখতে্‌২ হঠাৎ এক সুন্দর উপায় বাহির হইল। তিনি তাকিয়া ঠেসান দিয়া বসিয়া ভাবিতে২ অনেকক্ষণ পরে আপনার উরূর উপর করাঘাত করিয়া আপনা আপনি বলিলেন —এই তো দিব্য রোজগারের পথ দেখিতেছি —বাবুরামের চিনেবাজারের জায়গা ও ভদ্রাসন বাটী বন্ধক আছে, তাহার মেয়াদ শেষ হইয়াছে —হেরম্ব বাবুকে বলিয়া আদালতে একটা নালিশ উপস্থিত করাই, তাহা হইলেই কিছুদিনের জন্যে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি হইতে পারিবে, এই বলিয়া চাদরখানা কাঁধে দিলেন এবং গঙ্গা দর্শন করিয়া আসি বলিয়া জুতা ফটাস্‌ ফটাস্‌ করিয়া মন্ত্রের সাধন কি শরীর পতন, এইরূপ স্থির ভাবে হেরম্ববাবুর বাটীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। দ্বারে প্রবেশ করিয়াই চাকরকে জিজ্ঞাসা করিলেন —কর্ত্তা কোথা রে! বাঞ্ছারামের স্বর শুনিয়া হেরম্ব বাবু অম্‌নি নামিয়া আসিলেন —হেরম্ব বাবু— সাদা সিদে লোক —সকল কথাতেই “হ্যাঁ” বলিয়া উত্তর দেন। বাঞ্ছারাম তাঁহার হাত ধরিয়া অতিশয় প্রণয়ভাবে বলিলেন —চৌধুরী মহাশয়! বাবুরামকে আপনি আমার কথায় টাকা কর্জ্জ দেন —তাহার সংসার ও বিষয় আশয় ছারখার হইয়া গেল —মান সম্ভ্রমও তাহার সঙ্গে গিয়াছে —বড় ছেলেটা বানর—ছোটটা পাগল, দুটই নিরুদ্দেশ হইয়াছে, এক্ষণে দেনা অনেক —অন্যান্য পাওনাওয়ালারা নালিশ করিতে উদ্যত —পরে নানা উৎপাত বাধিতে পারে অতএব আপনাকে আর আমি চুপ করিয়া থাকিতে বলিতে পারি না —আপনি মারগেজি কাগজগুলা দিউন —কালিই আমাদের আফিসে নালিসটি দাগিয়া দিতে হইবেক —আপনি কেবল একখানা ওকালতনামা সহি করিয়া দিবেন। পাছে টাকা ডুবে এই ভয় এ অবস্থায় সকলেরই হইয়া থাকে —হেরম্ব বাবু খল কপট নহেন, সুতরাং বাঞ্ছারামের উক্ত কথা তাঁহার মনে একেবারে চৌচাপটে লেগে গেল, অম্‌নি “হ্যাঁ” বলিয়া কাগজপত্র তাঁহার হস্তে সমর্পণ করিলেন। হনূমান যেমন রাবণের মৃত্যুবাণ পাইয়া আহ্লাদে লঙ্কা হইতে মহাবেগে আসিয়াছিল, বাঞ্ছারামও ঐ সকল কাগজপত্র ইষ্ট কবচের ন্যায় বগলে করিয়া সেইরূপ ত্বরায় সহর্ষে বাটী আসিলেন।

 প্রায় সম্বৎসর হয় —বৈদ্যবাটীর সদর দরওয়াজা বন্ধ —ছাত দেয়াল ও প্রাচীর শেওলায় মলিন হইল —চারিদিকে অসঙ্খ্য বন —কাঁটানটে ও শেয়ালকাঁটায় ভরিয়া গেল। বাটীর ভিতরে মতিলালের বিমাতা ও স্ত্রী এই দুইটি অবলামাত্র বাস করেন, তাঁহারা আবশ্যকমতে খিড়কি দিয়া বাহির হয়েন। অতি কষ্টে তাঁহাদের দিনপাত হয় —অঙ্গে মলিন বস্ত্র—মাসের মধ্যে পোনের দিন অনাহারে যায় —বেণী বাবুর দ্বারা যে টাকা পাইয়াছিলেন তাহা দেনা পরিশোধ ও কয়েক মাসের খরচেই ফুরাইয়া গিয়াছে সুতরাং এক্ষণে যৎপরোনাস্তি ক্লেশ পাইতেছেন ও নিরুপায় হইয়া ভাবিতেছেন।

 মতিলালের স্ত্রী বলিতেছেন —ঠাক্‌রুন! আমরা আর জন্মে কতই পাপ করেছিলাম তাহা বলিতে পারি না —বিবাহ হইয়াছে বটে কিন্তু স্বামীর মুখ কখন দেখিলাম না—স্বামী এক বারও ফিরে দেখেন না —বেঁচে আছি কি মরেছি তাহাও একবার জিজ্ঞাসা করেন না। স্বামী মন্দ হইলেও তাঁহার নিন্দা করা স্ত্রীলোকের কর্ত্তব্য নহে —আমি স্বামীর নিন্দা করি না —আমার কপাল পোড়া, তাঁহার দোষ কি? কেবল এই মাত্র বলি এক্ষণে যে ক্লেশ পাইতেছি স্বামী নিকটে থাকিলে এ ক্লেশ ক্লেশ বোধ হইত না। মতিলালের বিমাতা বলিলেন —মা! আমাদের মত দুঃখিনী আর নাই —দুঃখের কথা বল্‌তে গেলে বুক ফেটে যায় —দীন-হীনদের দীননাথ বিনা আর গতি নাই।

 লোকের যাবৎ অর্থ থাকে তাবৎ চাকর দাসী নিকটে থাকে, ঐ দুই অবলার ঐরূপ অবস্থা হইলে সকলেই চলিয়া গিয়াছিল, মমতা বশতঃ একজন প্রাচীনা দাসী নিকটে থাকিত —সে আপনি ভিক্ষাশিক্ষা করিয়া দিনপাত করিত। শাশুড়ী বৌয়ে ঐরূপ কথাবার্ত্তা হইতেছে এমত সময়ে ঐ দাসী থর্‌২ করে কাঁপ্‌তে২ আসিয়া বলিল —অগো মাঠাক্‌রুনরা! জানালা দিয়া দেখ—বাঞ্ছারামবাবু সার্‌জন ও পেয়াদা সঙ্গে করিয়া বাড়ি ঘিরে ফেলেছেন —আমাকে দেখে বললেন —মেয়েদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বল্‌। আমি বললুম —মোশাই! তাঁরা কোথায় যাবেন? অমনি চোক লাল করে আমার উপর হুম্‌কে বল্‌লেন —তারা জানে না এ বাড়ি বন্ধক আছে —পাওনাওয়ালা কি আপনার টাকা গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে? ভালো চায় তো এই বেলা বেরুক তা না হলে গলাটিপি দিয়া বার করে দিব? এই কথা শুনিবা মাত্র শাশুড়ী বৌয়ে ভয়ে ঠক্‌২ করিয়া কাঁপিতে লাগিলেন। এদিকে সদর দরওয়াজা ভাঙ্গিবার শব্দে বাড়ি পরিপূর্ণ হইল, রাস্তায় লোকারণ্য, বাঞ্ছারাম আস্ফালন করিয়া “ভাং ডাল২” হুকুম দিতেছেন ও হাত নেড়ে বলতেছেন —কার সাধ্য দখল লওয়া বন্ধ করিতে পারে —এ কি ছেলের হাতের পিটে? কোর্টের হুকুম এখনি বাড়ি ভেঙ্গে দখল লব —ভালমানুষ টাকা কর্জ্জ দিয়া কি চোর? এ কি অন্যায়? পরিবারেরা এখনি বেরিয়ে যাউক। অনেক লোক জমা হইয়াছিল। তাহাদের মধ্যে দুই ব্যক্তি অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বলিল —ওরে বাঞ্ছারাম! তোর বাড়া নরাধম আর নাই —তোর মন্ত্রণায় এ ঘরটা গেল —চিরকালটা জুয়াচুরি করে এ সংসার থেকে রাশ২ টাকা লয়েছিস —এক্ষণে পরিবারগুলাকে আবার পথে বসাইতে বসেছিস —তোর মুখ দেখ্‌লে চান্দ্রায়ণ করিতে হয় —তোর নরকেও ঠাঁই হবে না। বাঞ্ছারাম এ সব কথায় কাণ না দিয়া দরওয়াজা ভাঙ্গিয়া সার্‌জন সহিত বাড়ির ভিতর হুড়্‌মুড়্ করিয়া প্রবেশ করত অন্তঃপুরে গমন করেন —এমন সময়ে মতিলালের বিমাতা ও স্ত্রী দুইজনে ঐ প্রাচীনা দাসীর দুই হাত ধরিয়া হে পরমেশ্বর! অবলা দুঃখিনী নারীদের রক্ষা কর, এই বলিতে২ চক্ষের জল পুঁচিতে২ খিড়্‌কি দিয়া বাহির হইয়া আসিলেন। মতিলালের স্ত্রী বলিলেন —মাগো! আমরা কুলের কামিনী —কিছুই জানি না —কোথায় যাইব? পিতা সবংশে গিয়াছেন —ভাই নাই —বোন নাই —কুটুম্ব নাই —আমাদের কে রক্ষা করিবে? হে পরমেশ্বর! এখন আমাদের ধর্ম্ম ও জীবন তোমার হাতে —অনাহারে মরি সেও ভালো, যেন ধর্ম্ম নষ্ট হয় না। অনন্তর পাঁচ-সাত পা গিয়া একটি বৃক্ষের তলায় দাঁড়াইয়া ভাবিতেছেন, ইতিমধ্যে একখানা ডুলি সঙ্গে বরদাপ্রসাদ বাবু ঘাড় নত করিয়া ম্লানবদনে সম্মুখে আসিয়া বলিলেন —ওগো! তোমরা কাতর হইও না, আমাকে সন্তানস্বরূপ দেখ —তোমাদের নিকট আমার ভিক্ষা যে ত্বরায় এই ডুলিতে উঠিয়া আমার বাটীতে চল —তোমাদিগের নিমিত্তে আমি স্বতন্ত্র ঘর প্রস্তত করিয়াছি —সেখানে কিছুদিন অবস্থিতি কর, পরে উপায় করা যাইবে। বরদা বাবুর এই কথা শুনিয়া মতিলালের স্ত্রী ও বিমাতা যেন সমুদ্রে পড়িয়া কূল পাইলেন। কৃতজ্ঞতায় মগ্ন হইয়া বলিলেন, —বাবা! আমাদিগের ইচ্ছা হয় তোমার পদতলে পড়িয়া থাকি —এ সময় এমত কথা কে বলে? বোধ হয় তুমি আর জন্মে আমাদিগের পিতা ছিলে। বরদা বাবু তাঁহাদিগকে ত্বরায় সোয়ারিতে উঠাইয়া আপন গৃহে পাঠাইয়া দিলেন। অন্যের সহিত দেখা হইলে তাহারা পাছে একথা জিজ্ঞসা করে এজন্য গলি ঘুঁজি দিয়া আপনি শীঘ্র বাটী আইলেন।