মতিলালের বালীতে আগমন ও তথায় লীলাখেলা

পরে ইংরাজী শিক্ষার্থে বহুবাজারে অবস্থিতি।


 রবিবারে কুঠীওয়ালারা বড়ো ঢিলে দেন—হচ্ছে হবে—খাচ্চি খাব—বলিয়া অনেক বেলায় স্নান আহার করেন—তাহার পরে কেহ বা বড়ে টেপেন—কেহ বা তাস পেটেন—কেহ বা মাছ ধরেন—কেহ বা তবলায় চাঁটি দেন— কেহ বা সেতার লইয়া পিড়িং২ করেন— কেহ বা শয়নে পদ্মনাভ ভালো বুঝেন—কেহ বা বেড়াতে যান—কেহ বা বহি পড়েন। কিন্তু পড়া শুনা অথবা সৎ কথার আলোচনা অতি অল্প হইয়া থাকে। হয় তো মিথ্যা গালগল্প কিংবা দলাদলির ঘোঁট, কি শম্ভু তিনটা কাঁঠাল খাইয়াছে এই প্রকার কথাতেই কাল ক্ষেপণ হয়। বালীর বেণী বাবুর অন্য প্রকার বিবেচনা ছিল। এদেশের লোকদিগের সংস্কার এই যে স্কুলে পড়া শেষ হইলে লেখাপড়ার শেষ হইল। কিন্তু এ বড় ভ্রম, আজন্ম মরণ পর্য্যন্ত সাধনা করিলেও বিদ্যার কূল পাওয়া যায় না, বিদ্যার চর্চ্চা যত হয় ততই জ্ঞান বৃদ্ধি হইতে পারে। বেণী বাবু এ বিষয় ভালো বুঝিতেন এবং তদনুসারে চলিতেন। তিনি প্রাতঃকালে উঠিয়া আপনার গৃহকর্ম্ম সকল দেখিয়া পুস্তক লইয়া বিদ্যানুশীলন করিতেছিলেন। ইতিমধ্যে চৌদ্দ বৎসরের একটি বালক—গলায় মাদুলি—কানে মাকড়ি, হাতে বালা ও বাজু, সম্মুখে আসিয়া ঢিপ করিয়া একটি গড় করিল। বেণী বাবু এক মনে পুস্তক দেখিতেছিলেন বালকের জুতার শব্দে চম্‌কিয়া উঠিয়া দেখিয়া বলিলেন, “এসো বাবা মতিলাল এসো—বাটীর সব ভাল তো?” মতিলাল বসিয়া সকল কুশল সমাচার বলিল। বেণী বাবু কহিলেন অদ্য রাত্রে এখানে থাক কল্য প্রাতে তোমাকে কলিকাতায় লইয়া স্কুলে ভর্ত্তি করিয়া দিব। ক্ষণেক কাল পরে মতিলাল জলযোগ করিয়া দেখিল অনেক বেলা আছে। চঞ্চল স্বভাব—এক স্থানে কিছু কাল বসিতে দারুন ক্লেশ বোধ হয়—এজন্য আস্তে২ উঠিয়া বাটীর চতুর্দ্দিগে দাঁদুড়ে বেড়াইতে লাগিল— কখন ঢেঁস্কেলের ঢেঁকিতে পা দিতেছে—কখন বা ছাতের উপর গিয়া দুপ২ করিতেছে—কখন বা পথিকদিগকে ইট পাটকেল মারিয়া পিট্টান দিতেছে। এইরূপে দুপদাপ করিয়া বালী প্রদক্ষিণ করিতে লাগিল—কাহারো বাগানে ফুল ছেঁড়ে—কাহারো গাছের ফল পাড়ে —কাহারো মট্‌কার উপর উঠিয়া লাফায়—কাহারো জলের কলসী ভাঙ্গিয়া দেয়।

 বালীর সকল লোকেই ত্যক্ত হইয়া বলাবলি করিতে লাগিল—এ ছোঁড়া কে রে? যেমন ঘরপোড়া দ্বারা লঙ্কা ছারখার হইয়াছিল আমাদিগের গ্রামটা সেইরূপ তচ্‌নচ্‌ হবে না কি? কেহ২ ঐ বালকের পিতার নাম শুনিয়া বলিল—আহা বাবুরাম বাবুর এপুত্র—না হবে কেন? “পুত্রে যশসি তোয়ে চ নরাণাং পুণ্য লক্ষণম্‌।”

 সন্ধ্যা হইল—শৃগালদিগের হোয়া২ ও ঝিঁ২ পোকার ঝিঁ২ শব্দে গ্রাম শব্দায়মান হইতে লাগিল। বলীতে অনেক ভদ্র লোকের বসতি—প্রায় অনেকের বাটীতে শালগ্রাম আছেন এজন্য শঙ্খ-ঘণ্টা ধ্বনির ন্যূনতা ছিল না। বেণী বাবু অধ্যয়নান্তর গামোড়া দিয়া তামাক খাইতেছেন ইত্যবসরে একটা গোল উপস্থিত হইল। পাঁচ-সাত জন লোক নিকটে আসিয়া বলিল—মশাইগো! বৈদ্যবাটীর জমিদারের ছেলে আমাদের উপর ইঁট মারিয়াছে—কেহ বলিল—আমার ঝাঁকা ফেলিয়া দিয়াছে—কেহ বলিল আমাকে ঠেলে ফেলেদিয়াছে—কেহ বলিল আমার মুখে থুতু দিয়াছে—কেহ বলিল আমার ঘিয়ের হাঁড়ি ভাঙ্গিয়াছে। বেণী বাবু পরদুঃখে কাতর—সকলকে তুষেতেষে ও কিছু কিছু দিয়া বিদায় করিয়া দিলেন পরে ভাবিলেন এ ছেলের তো বিদ্যা নগদ হইবে—এক বেলাতেই গ্রাম কাঁপিয়া দিয়াছে—এক্ষণে এখান হইতে প্রস্থান করিলে আমার হাড় জুড়ায়।

 গ্রামের প্রাণকৃষ্ণ খুড়া, ভগবতী ঠাকুরদাদা ও ফচ্‌কে রাজকৃষ্ণ আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন বেণী বাবু এ ছেলেটি কে? —আমরা আহার করিয়া নিদ্রা যাইতেছিলাম—গোলের দাপটে উঠে পড়েছিলাম—কাঁচা ঘুম ভাঙ্গাতে শরীরটা মাটি২ করিতেছে। বেণী বাবু কহিলেন—আর ও কথা কেনে বল? একটা ভারি কর্ম্মভোগে পড়িয়াছি—আমার একটি জমিদার ষণ্ডা কুটুম্ব আছে—তাহার হ্রস্ব দীর্ঘ কিছুই জ্ঞান নাই—কেবল কতকগুলো টাকা আছে। ছেলেটিকে স্কুলে ভর্ত্তি করাইবার জন্য আমার নিকট পাঠাইয়াছেন—কিন্তু এর মধ্যেই হাড় কালি হইল—এমন ছেলেকে তিনদিন রাখিলেই বাটীতে ঘুঘু চরিবে। এইরূপ কথোপকথন হইতেছে—জন কয়েক চেংড়া পশ্চাতে মতিলাল “ভজ নর শম্ভুসুতেরে” বলিয়া চিৎকার করিতে করিতে আসিল। বেণী বাবু বলিলেন—ঐ আস্‌ছে রে বাবু—চুপ কর—আবার দুই-এক ঘা বসিয়ে দেবে নাকি? পাপকে বিদায় পারিলে বাঁচি। মতিলাল বেণীবাবুকে দেখিয়া দাঁত বাহির করিয়া ঈষদ্ধাস্য করত কিঞ্চিৎ সস্কুচিত হইল। বেণী বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন—বাবু কোথায় গিয়েছিলে? মতিলাল বলিল মহাশয়দের গ্রামটা কত বড় তাই দেখে এলাম।

 পরে বাটীর ভিতর যাইয়া মতিলাল রাম চাকরকে তামাক আনিতে বলিল। অম্বুরি অথবা ভেলসায় সানে না—কড়া তামাকের উপর কড়া তামাক খাইতে লাগিল। রাম তামাক যোগাইয়া উঠিতে পারে না—এই আনে—এই নাই। এইরূপ মুহুর্মুহু তামাক দেওয়াতে রাম অন্য কোনো কর্ম্ম করিতে পারিল না। বেণী বাবু রোয়াকে বসিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিলেন ও এক২ বার পিছন ফিরিয়া মিট২ট করিয়া উঁকি মারিয়া দেখিতে লাগিলেন।

 আহারের সময় উপস্থিত হইল। বেণী বাবু অন্তঃপুরে মতিলালকে লইয়া উত্তম অন্ন ব্যঞ্জন ও নানা প্রকার চর্ব্ব চোষ্য লেহ্য পেয় দ্বারা পরিতোষ করাইয়া তাম্বুল গ্রহণান্তর আপনি শয়ন করিতে গেলেন। মতিলাল শয়নগারে গিয়া পান-তামাক খাইয় বিছেনার ভিতর ঢুকিল। কিছু কাল এপাশ ওপাশ করিয়া ধড়মড়িয়া উঠিয়া এক২ বার পায়চারি করিতে লাগিল ও এক২ বার নীলুঠাকুরের সখীসংবাদ অথবা রাম বসুর বিরহ গাইতে লাগিল। গানের চোটে বাটীর সকলের নিদ্রা ছুটে পালাইল।

 চণ্ডীমণ্ডবে রাম ও কাশীজোড়া নিবাসী পেলারাম মালি শয়ন করিয়াছিল। দিবসে পরিশ্রম করিলে নিদ্রাটি বড় আরামে হয়, কিন্তু ব্যঘাত হইলে অত্যন্ত বিরক্তি জন্মে। গানের চীৎকারে চাকরের ও মালীর নিদ্রা ভাঙ্গিয়া গেল।

 পেলারাম। অহে বাপা রাম! এ সড়ার চিড়কারে মোর লিদ্রা হতেছে না—উঠে বগানে বীজ গুঁড়া কি পেড়াইব?

 রাম। (গা মোড়া দিয়া) আরে রাত ঝাঁ২ কচ্চে—এখন কেন উঠ্‌বি? বাবু ভাল নালা কেটে জল এনেছে এ ছোঁড়া কান ঝালাপালা কল্লে—গেলে বাঁচি।

 পরদিন প্রভাতে বেণীবাবু মতিলালকে লইয়া বৌবাজারের বেচারাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাটীতে উপস্থিত হইলেন। বেচারামবাবু কেনারামবাবুর পুত্র—বুনিয়াদী বড় মানুষ—সন্তানাদি কিছুই নাই—সাদাসিদে লোক কিন্তু জন্মাবধি গঁর্ণাখাঁদা—অল্প২ পিট্‌পিটে ও চিড়্‌চিড়ে। বেণীবাবুকে দেখিয়া স্বাভাবিক নাকিস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন “আরে কও কি মনে করে”?

 বেণী বাবু। মতিলাল মহাশয়ের বাটীতে থাকিয়া স্কুলে পড়বে—শনিবার শনিবার ছুটি পাইলে বৈদ্যবাটী যাইবে। বাবুরাম বাবুর কলিকাতায় আপনার মত আত্মীয় আর নাই এজন্য এই অনুরোধ করিতে আসিয়াছি।

 বেচারাম। তার আটক কি —এও ঘর সেও ঘর। আমার ছেলেপুলে নাই— কেবল দুই ভাগিনেয় আছে—মতিলাল স্বচ্ছন্দে থাকুক।

 বেচারাম বাবুর নাকি স্বরের কথা শুনিয়া মতিলাল খিল২ করিয়া হাসিতে লাগিল। অমনি বেণী বাবু উহুঁ২ করত চোক টিপ্তে লাগিলেন ও মনে করিলেন এমন ছেলে সঙ্গে থাকিলে কোথাও সুখ নাই। বেচারাম বাবু মতিলালের হাসি শুনিয়া বলিলেন—বেণী ভায়া! ছেলেটি কিছু বেদ্‌ড়া দেখতে পাই যে? বোধ হয় বালককালাবধি বিশেষ নাই পাইয়া থাকিবে। বেণী বাবু অতি অনুসন্ধনী—পূর্ব্বকথা সকলি জানেন, আপনিও ভুগেছেন—কিন্তু নিজ গুণে সকল ঢেকে ঢুকে লইলেন—গুপ্ত কথা ব্যক্ত করিলে মতিলাল মারা যায়—তাহার কলিকাতায় থাকাও হয় না ও স্কুলে পড়াও হয় না। বেণী বাবুর নিতান্ত বাসনা সে কিছু লেখাপড়া শিখিয়া কোন প্রকার মানুষ হয়।

 অনন্তর অন্যান্য প্রকার অনেক আলাপ করিয়া বেচারাম বাবুর নিকট হইতে বিদায় হইয়া বেণী বাবু মতিলালকে সঙ্গে করিয়া শরবোণর সাহেবের স্কুলে আসিলেন। হিন্দু কালেজ হওয়াতে শরবোণর সাহেবের স্কুল কিঞ্চিৎ মেড়ে পড়িয়াছিল এজন্য সাহেব দিন রাত্রি উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছিলেন—তাঁহার শরীর মোটা—ভুরুতে রোঁ ভরা—গালে সর্ব্বদা পান—বেত হাতে—এক২ বার ক্লাশে২ বেড়াইতেন ও এক২ বার চৌকিতে বসিয়া গুড়গুড়ি টানিতেন। বেণী বাবু তাঁহার স্কুলে মতিলালকে ভর্ত্তি করিয়া দিয়া বালীতে প্রত্যাগমন করিলেন।