চিনি-দিদি ব্যস্ত হয়ে চারি দিকে ঘুরছেন— খাতির যত্ন ক'রে; আর তাঁর ছেলেটিও মায়ের সঙ্গে ঘুরঘুর করছেন আর মাঝে মাঝে মায়ের দু-একটা ইংরিজি উচ্চারণের আর আদব-কায়দার ভুল হলেই চমকে তাকে কানে কানে ধমকাচ্ছেন। ছেলেটি বিলেতে ভাসাতত্ত্ব পড়তে গিয়েছিলেন কিন্তু সাতার মোটেই না জানায় তিন-তিনবার প্লাকট হয়ে এসেছেন।

 সোনালী-আঁচল উড়িয়ে বনমুরগি সোনালি যখন হেঁসেলবাড়ির খিড়কির কাছটায় পৌছল, তখন রাজ্যের পাখি সেখানে জুটে কিচমিচ লাগিয়েছে; চিনি-দিদির মজলিসটা খুজে নিতে সোনালির আর একটুও কষ্ট পেতে হল না।

 সোনালিয়াকে দেখেই চিনি-দিদি খাতির ক’রে কুলতলায় ফাকায় নিয়ে বসিয়ে ওদিকে চলে গেলেন। সোনালি শুনতে লাগল বোলতারা সব ফলন্ত গাছকে ঘিরে ঘিরে মোচং বাজিয়ে গাইছে, সোনা-ফলের গান, হুল রাগে।

গান


মন ভুলে গুঞ্জরি— মুঞ্জরি মুঞ্জরি।
ফুলে বউল গোছা গোছা,
ফলে মউল গাছে গাছে,
আমরা বলি গুঞ্জরিয়া—
শেষ সবারই আছে আছে।
সবজে পাতার কলি, সোনালী ফুলের মধু
 বঁধু ওগো বঁধু—
ফুলের মঞ্জরি! আমরা গুঞ্জরি।
ফুল ঝরে, ফল ঝরে, কুঁড়ি ঝরে, কলি ঝরে, মন ঝুরে
গুঞ্জরি— মঞ্জরি মঞ্জরি।


শুধু যে বোলতারাই গাইছিল তা নয়; ভোমরা, মৌমাছি, গঙ্গাফড়িং সবাই দলে দলে বাছি আর গান জুড়ে দিলে। চিনি-দিদি গড়ের মাঠের বাছি যত দল, তা ছাড়া কালোয়াতি কীর্তন বাউল সব রকম জোগাড়ই করেছিলেন। কেবল চুনোগলির ব্যাঙটা তিনি জোগাড় করতে পারেন নি। আর সেইজন্যে তিনি সবার কাছে বার-বার দুঃখু জানাতে লাগলেন। কালোকোট সাদা-কামিজে ফিটফাট কাক দরজায় দাড়িয়ে মোড়লি ক’রে এর-ওর-তার আলাপ-পরিচয় ক’রে বেড়াচ্ছেন– ইনি রাজহংস, ইনি হংসেশ্বরী, তুরস্কের পেরু, ও-পাড়ার চটসাই চড়াইমশায় ইনি আমাদের। সোনালি চড়াইকে ধুলোমাখা, কেমন হতভাগা-গোছের চেহারায় আসছে দেখে শুধলেন, “কোনো অমুখ হয় নি তো।” চড়াই সোনালিকে ফুলের টবের ইতিহাস বলতে সোনালি হেসেই অস্থির। সোনালি আর চড়ায়ে কথা হচ্ছে, এমন সময় আরো পাখি আসতে লাগল। ভিড় দেখে সোনালি চড়াইকে নিয়ে একটা জলের বোমার আড়ালে সরে দাড়ালেন। সেই সময় জিম্ম কাছেই একটা ভাঙা ঠেলাগাড়িতে লাফিয়ে বসল, সোনালি তাকে দেখে একবার ঘাড় হেলিয়ে নমস্কার করলেন, দূর থেকেই।

 জিম্মার চেহারাটা কেমন রাগি-রাগি বোধ হল। ঘোটের খবর যেমন শোনা অমনি সে কুঁকড়োকে বিপদ থেকে বাচাতে শিকলিটা ছিড়ে টানতে টানতে এসে উপস্থিত কুলতলায়। চড়াইকে বোমার পিছনে দেখে জিম্মী রাগে গো-গো করতে লাগল। ভয় পেয়ে চড়ায়ের লেজ কাপতে লেগেছে, এমন সময় ফড়িংদের স্ট্রিংব্যাণ্ড শুরু হল, সেইসঙ্গে গঙ্গা-মৃত্তিকার অলকা-তিলকা দিয়ে ছাপমারা গঙ্গাফড়িং কীর্তন ধরলেন– তুড়ি রাগিণীতে খোল বাজিয়ে সূর্যের রূপবর্ণনা –

কনক বরন, কিয়ে দরশন
নিছনি দিয়ে যে তার।
কপালে ললিত চাদ শোভিত
সিন্দুর অরুণ আর
আহা কিবা সে মধুর রূপ।

দু-একজন বিলেত-ফেরত মোরগ, খোল শুনে দশা পেলেন।

 তার পর মৌমাছি গাইতে লাগল দলে দলে ‘মধুর গান—

আলোতে চলি সবাই গুনগুনিয়ে,
আলোতে ফুল ফুটেছে তাই শুনিয়ে,
গুন-গুনিয়ে।

বাহিরে সোনার আলো,
ভিতরে সোনার রেণু,
বাহিরে বাজল বীণা,
ভিতরে বাজল বেণু,
সকালের আলো আলো গুন-গুনিয়ে।

 ফুলের স্ববাস, সোনার রেণু, পদ্মের মধু রোদ-বাতাস সব যেন একসঙ্গে এসে উপস্থিত হল। মধুকরের দল চারি দিকে স্বরের মধু-বিষ্টি করে দিলে। বাহবা বাহবা পড়ে গেল। চিনি-দিদি কিন্তু গানও বুঝছেন না, স্বরও শুনছেন না। তিনি কেবল কারা কারা তার পার্টিতে এসেছে তারি হিসেব সবাইকে দিচ্ছেন, “বোঝা থেকে শাকের আঁটিটি পর্যন্ত কেউ আর আসতে বাকি নেই, দেখেছ ভাই?” একটা শু্যামা পাখি পেয়ারা গাছে বসে শিস দিলে, অমনি চিনিদিদি বললেন, “ওই শ্যামদাসী এলেন। ওই বুঝি কাছিমুদি? না না কাছিম বুড়ে তো নয়। এ তবে কে। সবাইকে তো চিনি নে ভাই, তেনার সব পুরোনো বন্ধু।” একটা ভীমরুল বোঁ-বোঁ করে চারি দিকে ঘুরে বেড়াতে লাগল, চিনি-দিদি তার পিছনে “ভালো আছ? ভালো আছ?” বলতে বলতে ছুটলেন।

 চড়াই সোনালিকে বললে, “চিনি-দিদি একেবারে খেপে গেছেন।” সোনালি মজা দেখবার জন্তে আড়াল থেকে বেরিয়ে দাড়ালেন। চিনি-দিদি ভীমরুলের সঙ্গে খানিক ছুটে একটা গাছের তলায় দাড়িয়ে একটু কপি পাতা খাচ্ছেন এমন সময় হাওয়াতে টুপ টাপ ক’রে পাতার শিশিরের সঙ্গে একটি শিউলি ফুল ঝরে পড়ল। চিনি-দিদি অমনি বলে উঠলেন, “অ শিউলি, অ শিশির, এতক্ষণে বুঝি আসতে হয়?” এই সময় একটু হাওয়া উঠল আর টুপ করে একটি কুল চিনি-দিদির ঠিক নাকের উপরে পড়ে গেল, চিনি-দিদি চমকে উঠে বললেন, “এই যে বাতাসি-দিদিও এসেছ। তবু ভালো যে মনে পড়েছে।” বলে কতকগুলো গিনিপিগ নিয়ে চিনি-দিদি খাওয়াতে চললেন। “কে যে চিনি-দিদির চেনা নয়, তা জানি নে।” ব’লে চড়াই এদিক-ওদিক ভালো করে দেখে পা টিপে টিপে বেরাল যেখানে আতা গাছের ডালে গুড়ি মেরে বসে এদিক-ওদিক দেখছিল, সেইখানে গিয়ে বললে, “সব ঠিক তো বন্দোবস্ত?” বেরাল একবার ওই ওদিকটায় ঘাড় তুলে দেখে বললে, “সব ঠিক। আসছে তারা।” এদিকে চিনি-দিদি সোনালিকে নতুন বিলিতি কলে-দিয়ে-ফোটানে দুটি মুরগির ছানার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, এমন সময় দূরে ময়ুর গলা-খাকানি দিলেন, “কেও, চিনি নাকি।” ময়ুর এসে বুক ফুলিয়ে দাড়ালেন; মুরগি, হাস, তিতির, বটের সব অমনি তাকে ঘিরে যেন রথ দেখবার ভিড় করলে। ময়ুর সবাইকে জাকালো পোশাক আর হীরে জহরতের ভাউ বাংলাতে লাগলেন, খুব বুদ্ধিমানের মতো গম্ভীর মুখ ক’রে। জিন্ম কুত্তানি কিন্তু ময়ূরকে দেখে মনেমনে বললে, “এটার মতো দেমাকে অদ্ভূত জানোয়ার আর ত্বটি দেখা যায় না।’ এমন সময় কাক দরজা থেকে ফোকরালেন, “চাটগাঁই মোরগ।” চিনি-দিদি এ-নাম কখনো শোনেন নি; বুঝি-বা ভুল করেছে কাকট ভেবে সেদিকে যাবেন, এমন সময় সত্যিই সাদা জোববী-খাববী, কালে চাপদাড়ি মোড়াসা-মাথায় চাটগাই এসে সেলাম করলেন। চিনি-দিদির মুখে আর কথা সরল না। তার পর কাক একে একে সব অদ্ভুত মোরগের নাম ফোকরাতে থাকল, “সিংগালি, বোগদাদি, জাপানি।” সবাই বলে উঠল, “একি ব্যাপার।” চিনি-দিদি বেড়ার ফাক দিয়ে দেখলেন দলে দলে অদ্ভূত মোরগ সব আরো আসছে, “সেলেম সাহি, খ খাননি, তখতে তাউস, কান্দাহারি, কাবুলী, জবরদস্ত ঝোঁটনদার, চম্পাধাড়ি, কুলকুটি, খুঞ্চেপোষ, ডেগচি, মোগলাই, জবড়জঙ্গ, ইয়াহুদি, চাল বাহাদুর, খেতাববক্স, মেজাজি, পরন্থস্বা, মুলুকচাদি, বাজখাই, শির-ই-ফরহাদ, গোলগুম্বজ, কাবাবি।”

 চিনি-দিদি দেখে শুনে অবাক, কেবল লেজ দোলাচ্ছেন আর বলছেন, “ওমা কোথায় যাব। ওলো দেখ, কী হবে গো, এমন তো কখনো দেখি নি।”

 নবাবী আমলের মোরগ সব একে একে এলেন। এবার পাটনাই মোরগ সব আসছেন, “তিলকধারী ভোজপুরি, রামদুলালি।”

 “ওমা কোথায় যাব।” বলে চিনি-দিদি সবাইকে খাতির করতে ছুটলেন।

 এবার গৌড়িয়া মোরগ সব আসছেন, “গোবরগণেশ, চালপিটুলি, মোহনভোগ, বামুনমারি, কানাইচুড়ে, চৌগোপলা, টেকুচকুচ, ঢাক-পিটুনে, ফিকুরে গোসাই, বেঁটেবঙ্কট, কয়লাধাম, রাজকুমড়ো, থুতি নাতি।”  কুলতলাটা কুটিতে, পালকে,চাপদাড়ি, গোঁপ, টিকি আর পোষা-পালাবড়ে বড়ো খেতাবজাইগীর শিরপেচওয়াল মোরগের ভিড়ে সরগরম হয়ে উঠল, যেন পালকের গদী। কারুলেজের পালক, মেপে সাতগজ। কারু গলায় যেন উলের গলাবন্ধ জড়ানো রয়েছে। একজনের কুটির কেতা যেন রামছাগলের শিং। কারু মাথায় জরির তাজ, কারু এক চোখে চশমা, অন্ত চোখটা টুপিতে ঢাকা; কারু বুকে ফুলের তোড়ার মতো খানিক পালক, কারু অঞ্জল দস্তানায়মোড়, কারু-বা আণ্ডল এত লম্বা যে কিছুই ধরতে পারে না। কেউ বাকড় চুলের উপরে আবারটিকি রেখেছে, আর কারু-বা মাথায় চুলও নেই, টিকিও নেই, কিছুই নেই। ঘাড়ে-গর্দানে-সমান এই শেষের মোরগট হচ্ছে সেই নামজাদা লড়ায়ে মোরগ, যে বিলেত পর্যন্ত মেরে এসেছে। এরি ছুপায়ে ইস্পাতের র্কাট-মারা ভয়ংকর ঘটে কাতান মানুষ শখ করে বেঁধে দিয়েছে, অন্য মোরগকে লড়ায়ে খুন ক’রে বাজি জেতবার আর মজা দেখবার জন্যে। ঘোড়দৌড়ের খেলায় যেমন, তেমনি এই মোরগের লড়াই দেখতে আর বাজি লাগাতে লোকে টিকিট পায় না, এত ভিড় হয়।

 বেরাল চড়াইকে গাছের উপর থেকে এই মোরগটাকে দেখিয়ে বললে, “এই সেই বাজখাই গুণ্ডা বা লড়ায়ে মোরগ বা নবাব বাজেখার বাবুর্জিখানার শেষ-পোষা পাখি। পুরুষানুক্রমে এদের ঘাড় এমন শক্ত যে মোটেই নোয় না, ইনি খালি দিল্লীর লাড্ডু খেয়ে লড়েন।”

 এইবার সব বিলেত-ফেরত মোরগ এলেন, “মিস্টার চচ্চড়ি, মিঃ ভাজি,মিঃ ঘণ্ট, মিঃ আবার খাব, মিঃ চাপাটি,মিঃবে-হোস।” চিনি-দিদি ভাবছেন এই-সব মোরগের মুরগিদের নিয়ে আসছেবারে তিনি একটা পর্দাপার্টি দেবেন। দাড়কাকতখনো হাপাতে হাপাতে ফুকরোচ্ছে, “রামধনুস, রঙবেরঙ, বুঁদেলা মল, রণছোড় ভাগি, ধান ভগৎজিউ.” যত মাড়োয়ার দেশের মোরগ, সিন্দি কচ্ছি, অরোদ-বরোদ সবাই এলে পর দাড়কাক মুখ ফিরিয়ে দেখলে— কুঁকড়ো। সে তার পদবী উপাধি ফুকরোতে যাবে, কুঁকড়ো বললেন, “কিছু দরকার নেই। শুধু জানিয়ে দাও আমি কুঁকড়ো এলেম।” দাড়কাক তার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে মুখটা বেঁকিয়ে জোরে হাক দিলে, “কুঁকড়ো -ও-ও।” কুঁকড়ো অতি শাস্ত ভালোমানুষটির মতো চিনি-দিদিকে নমস্কার করে বললেন, “আমাকে মাপ করতে হবে, আমার সাজসজ্জা পদবী উপাধি কিছুই নেই,আমার ঠিক যতগুলো আঙুল হওয়া উচিত তাই আছে, আর মাথার এই লাল একটিমাত্র টুপি, জন্মাবধি এইটেই পরে বেড়াচ্ছি, সে কথাটা লুকিয়ে লাভ নেই। আর আমার এই গায়ের কাপড়— এটা প’রে এখানে আসাটা বাস্তবিক অন্যায় হয়েছে; দেখো-না রঙচঙ বেশি নেই, কেবল একটু কচিপাতার সবুজ আর পাকা ধানের সোনালী। মাফ করে, আমি নেহাতই একটা সাধারণ কুঁকড়ো যাকে দেখা যায় ধানের গোলায়, চালের মটকায়, গির্জার চুড়োয়, সোনায় মোড়া ছেলেদের হাতে টিনের বাঁশির আগায় রঙ-কর, জলেস্থলে সর্বত্র। কেবল কোনো চিড়িয়াখানায় আর জাদুঘরে আমার দেখা পাওয়া যাবে না।”

 চিনি-দিদি বললেন, “তা হোক। তোমার কাজের সাজে এসেছ তাতে কী দোষ। তোমার সময় কোথা যে, সেজে বেড়াবে? কাজের পাখি তোমার সব দোষ মাপ। কিন্তু যারা বিয়েতে যায়, কেরানীর কিম্বা উকিল ব্যারিস্টার মোক্তারের সাজ পরে, কিম্বা বুট হ্যাট পরে যায় বউভাতের ভোজে, তাদের আমি কিছুতে মাপ করি নে।”

 দাঁড়কাক ফোকরাল, “জুড়ি লোটন পায়রা।” কুঁকড়ো ভাবলেন বুঝি তাঁর বন্ধু কবুদ আর কবুদনী। কিন্তু ফিরে দেখলেন সাদা দুটি গুজরাট, পায়রা কি— কী, বোঝবার জো নেই, ডিগবাজি খেতে খেতে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল। তার পর দাড়কাক ফুকরলে, “ব্রহ্লাওভাণ্ডোদর রাজহংস স্বামিজী।” কুঁকড়ো পদ্মবনের মরাল আসছেন ভেবে আনন্দে দরজার দিকে চেয়ে রইলেন, অনেকক্ষণ পরে পাখির মতো পাখি আসছে ভেবে; কিন্তু হেলতে ফুলতে সাদা মরাল না এসে, নেংচাতে নেংচাতে এলেন এক পাখি, দেখতে মরালের মতো কতকটা, কিন্তু মোটেই সাদা নয়, সিধেও নয়, কালো ঝুল। কুঁকড়ো নিশ্বেস ছেড়ে বললেন, “মরাল না এসে এল কিনা মরালের একটা বিকট কালো ছায়া।” বলে কুঁকড়ো একটা দোলার উপরে দাড়িয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলেন, দূরে সবুজ মাঠ, তারি উপরে ধেনু চরছে, বাছুরগুলো ছুটোছুটি করছে; কোথায় আমলকী গাছের ছায়ায় বঁশি বাজছে তারি শব্দ। পৃথিবীর সবই এখনো এইসব হরেক রকম পোষা পাখিগুলোর মতো টেরে বেঁকে অদ্ভুত রকম হয়ে ওঠে নি; সাদাসিদে গোলগাল যেমন ছিল তেমনিটি আছে। ঘাসের রঙ সবুজই রয়েছে,আকাশনীল, জল পরিষ্কার, পাখিরা উড়ছে ডানা ছড়িয়ে, গোরু হঁটিছে চার পায়ে, মানুষ চলেছে ছপায়ে। কুঁকড়ো আনন্দে এই-সব দেখছেন আর সোনালি আস্তে আস্তে তাঁর কাছে এসে দাড়িয়ে বলছে, “এই-সব চিড়িয়াখানার উপযুক্ত অদ্ভুত সঙগুলোকে আমার ভারি খারাপ লাগছে, আর একদণ্ড এখানে থাকা নয়, চলে আমরা স্থজনে সেই বনে চলে যাই; সেখানে আলো আর ফুল আর তোমার আমার ভালোবাসা।” কুঁকড়ো ঘাড় নেড়ে বললেন, “না সোনালি, সে হতে পারে না। বিধাতা যেখানে রেখেছেন সেইখেনেই আমাকে থাকতে হবে। আমি জানি এই আবাদটুকুর মধ্যে করবার মতো কাজ আমাদের অনেক রয়েছে, আর, সবার ভালোবাসাও এখানে পাচ্ছি তো।”

 সোনালির মনে পড়ল রাত্রের ঘুটের কথা; কিন্তু ওদের ভালোবাসা যে মোসলমানের মুরগি-পোষার মতে, সেটা বলে কুঁকড়োকে দুঃখ দেওয়া কেন। সে বার বার বলতে লাগল, “না না, চলো দুজনে চলে যাই, আহ সেই বনে যেখানে বসন্ত-বাউর কেবলি বলছে, বউ কথা কও; আর পাতায় পাতায় সোনার অক্ষরে ভালোবাসার গান সব লেখা হচ্ছে সকাল থেকে সন্ধে।”

 এই সময় ওধারটায় কিচিরমিচির শব্দ উঠল, সব পাখিরা ময়ূরকে পাখম ছড়াবার জন্মে পেড়াপিড়ি করছে। চিড়িয়াখানার সব মোরগগুলো তাদের সম্পর্কে পাখমদাদা ময়ূরের চারিদিকে ঘিরে দাড়িয়েছে। অনেক বলা-কওয়াতে ময়ুর পাখম খুলে দেখালেন। পাতিহাস র্হ করে চেয়ে রইল। ময়ূরের কাছে কোটের কাটকুট নমুনো ফ্যাশান চাইতে লেগে মোরগদের মধ্যে হট্টগোল বেধে গেল। সবাই ময়ূরকে আপনার আপনার সাজগোজ দেখিয়ে পাস হতে চাচ্ছে, এক মোরগ অন্তকে ঠেস দিয়েবলছে, “তোমায় দেখতে হয়েছে ওই কাপড়ে,যেন মুড়ঙ্গে স্বপুরি গাছটি” সে আবার তাকে এক ধাক্কা দিয়ে বলছে, “আর তোমারই সাজাটা কী দেখতে হয়েছে? যেনমগের মুল্লুকের আটচালাখানি, শিং বের-করা ছুচোলো।” সবাই যখন সাজসজ্জা দেখাতে মারামারি বাধিয়েছে তখন কুঁকড়ো গলা চাড়িয়ে বলে উঠল,“তাকাও,তাকাও, ওদিকে তাকাও।” কুঁকড়োর কথামত সব মোরগ মায় ময়ুর হাস আর যত দেমাকে পোশাকী পাখি সবাই সেই কাপড়-ঝোলানো খড়ের কুশে-পুতুলটার দিকে চেয়ে দেখলে, হাওয়াতে সেইখড়ের কাঠামোর কামিজের হাতাটা লটপট ক’রে যেন তাদেরই দেখিয়ে কী বলতে যাচ্ছে। ভয়ে সব পোশাকী পুস্তি পাখিদের মুখ চুন হয়ে গেল। কুঁকড়ো হেঁকে বললেন, “তাকাও, তাকাও, উনি তোমাদের আশীর্বাদ করছেন।” মোরগগুলো কুঁকড়োর দিকেই চেয়ে রইল, তখন কুঁকড়ো বললেন, “ওই যে কাঠামোটার পায়ে পেণ্টালুন লটপট করছে, ওটা কী বলছে জানো? আমার এই ছককাটা ছিট একদিন ফ্যাশান ছিল, উনোপঞ্চাশ টাকা গজ দরে আমি বিকিয়েছি, এক কালে। আর ওই যে ভাঙা তোবড়ানো সোলার টুপি ওটার মাথায় চড়ানো দেখছ, ওটাই-বা কী বলছে — আমিও একদিন ফ্যাশান ছিলুম, আশি টাকা দিয়ে লোকে আমায় কিনেছিল,এখন মেথরও আমাকে মাথায় দিতে লজ্জা পায়। আর ওই দেখো কোট, তার এখনো ভুল ভাঙে নি, সে এখনো দেখো, চলতি বাতাসে উড়ে উড়ে আকাশে ফ্যাশান হাতড়ে বেড়াচ্ছে। চলতি বাতাস চলে গেল আর ওই দেখে ফ্যাশান-ধরা নিষ্কর্ম কোটের হাতত্বটো নিরাশ হয়ে ঝুলে পড়ল।” এই কথা কুঁকড়ে যেমন বলেছেন আর সত্যি সত্যি বাতাস বন্ধ হল, সব পাখির দেখলে তুই হাত মাটির দিকে ঝুলিয়ে কুশে-পুতুলট স্থির হয়ে দাড়াল। তারা সব সেইদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে এমন সময় ময়ুর বললে, “রাখে, ওটা কি কথা বলতে পারে যে এ-সব বলবে। তুমিও যেমন।”

 কুঁকড়ো ময়ুরকে বললেন, “তুমি যা বললে ওটাকে, মানুষেরা ঠিক ওই কথাই তোমাকে বলছে ইস্ত-না-গা-দ।”

 ময়ুর তার কাছের এক পাখিকে চুপি চুপি বললে যে, এই-সব জাকালো জাদরেল পোষা মোরগকে সোনালির সামনে হাজির করাতেই কুঁকড়োটা তার উপর খাপ্পা হয়েছে। তার পর ময়ুর কুঁকড়োকে বললে, “আচ্ছা, এই যে সব জাদরেল মোরগ এসেছেন, এঁদের তুমি ঠাউরেছ কী শুনি?”

 বুক ফুলিয়ে কুঁকড়ো উত্তর দিলেন, “দর্জির হাতে সেলাই করা, কলে কাটা, কাচি দিয়ে ছাটা নকল ছাড়া এরা আর কিছুই নয়। সবটাই এদের জোড়াতাড়া দেখছি, ওর ডানা তার ঝুটি, এমনি সব টুকিটাকি দিয়ে গড়া এদের চেহারাগুলো কাসারিপাড়ার সঙের বিজ্ঞাপনে লাগতে পারে; আর-কোথাও এমন-কি, এই সামান্ত গোলাবাড়িতেও, এদের দরকার মোটেই নেই। এদের চলন, বলন, গড়ন সবই বেস্বরে, বেয়াড়, বেখাপ্পা। ডিমের সুন্দর ডোলটি নিয়ে সব পাখিই বেরিয়ে আসে জগতে, কিন্তু ডিম ফাটিয়ে এরা যে বেরিয়েছে তার কোনো লক্ষণ তো এদের শরীরে দেখছি নে ৷”  কুঁকড়োর কথা শুনে একটা পোশাক মোরগ রেগে বলে উঠল, “বাড়াবাড়ি কোরে না।” কুঁকড়ো সে কথায় কান না দিয়ে বলে চললেন, সূর্যের দিকে চেয়ে, “এর কি সত্যিকার মোরগ। কখনোই নয়। কোথায় এদের মধ্যে সেই সকালের আলো, সেই রক্তের মতো রাঙা মুর। সূর্য তুমি সাক্ষী, এরা দেখতে হরেক রকমের বটে, কিন্তু মিথ্যে ছায়া-বাজি বৈ সত্যি নয় সত্যি নয়। আর ছায়াবাজিরই মতো এরা তামাশা দেখিয়ে কোথায় মেলাবে তার ঠিক নেই। এদের কেউ বেঁচে থাকবে না, হ-রে-ক-র-ক-ম-বা-জি-বা-হ-বা” বলে কুঁকড়ো একটু থামলেন। ময়ুর শোধালে, “কাকে তুমি সত্যিকার মোরগ বল শুনি।”

 “সত্যিকার মোরগ তাকেই বলি যার একমাত্র ধ্যান হল”, ব’লে কুঁকড়ো চুপ করলেন। সব পাখিই আমনি শুধোলে, “কী কী? ধ্যান হল কী?”

 কুঁকড়ো বুক-ফুলিয়ে বললেন, “আলোর ফুলকি— ই-ই—।”

 সব পোশাকী মোরগ অমনি বাজখাই গলায় বলে উঠল, “কা-লো-কু-ল-চু-র। ই, হঁ। এই তে চোখ বুজলেই আমরা সরষে-ফুলের মতো গুড়ে গুড়ো কী যেন দেখতে পাচ্ছি। বাঃ এ তো সবাই ধ্যান করে, নতুনটা কী হল?” ব’লে মোরগগুলো কুঁকড়োকে প্রশ্ন করতে লাগল, তিনি ওড়বে না খাড়বে না নাদে গলা সাধেন? তিনি দক্ষিণী চালে গান করেন না হনুমানের মতে। কোন রাগে তার দখল বেশি।

 কুঁকড়ো সংগীতশাস্ত্র, স্বরলিপি এ-সবের ধার দিয়েও যান নি; তিনি প্রশ্ন শুনে অবাক হলেন। কুঁকড়ো গাইবে কুঁকড়োর মতে, হনুমানের মতে কেন যে হনুমান ছাড়া আর কেউ গাইতে যাবে কুঁকড়ে তা বুঝে উঠতে পারলেন না। এক মোরগ বললে, “রোসে, তালটা ঠিক করে নেওয়া যাক, ‘কা-আ-আ-লো-ও-ও-ও’• • •নাঃ মিলল না তো, ফাঁকের বেলায়ও সোম পড়ছে, সোমের বেলাতেও তাই, ফাক মোটেই নেই।” ফাক আওয়াজের জন্তে কেন যে এ পাখিটা এত ব্যস্ত তা কুঁকড়ো বুঝলেন না। এক মোরগ মুখে মুখে স্বরলিপি করে যাচ্ছিল, সে বললে, “প্রথম লাগল মধ্যম আ-মা; তার পর লো, রি-র-গা-র-গ। এই হল মা-রি-গা।”

 আর-একজন বললে, “মা-রি-গ। তো নয়, ধ-পা-স।”  কুঁকড়োর মনে হল, ঠিক সবাই পাগল হয়ে গেছে। এ-সব কী খেয়াল। তিনি সাফ জৰাব দিলেন, তিনি কোনো গানের ইস্কুলে গান শেখেন নি, শাস্তর-মাস্তর তিনি জানেনও না মানেনও না, গোলাপ যেমন ফুল ফুটিয়ে চলেছে, তিনি তেমনি গান গেয়ে চলেছেন, এইটুকুই তিনি জানেন।

 কুঁকড়ো শাস্ত্রের কিছুই জানেন না দেখে অন্য মোরগগুলো তর্ক ছাড়লে। কিন্তু গোলাপের শোভা কি কুঁড়িতে কি ফোটা অবস্থায় ময়ুরটার অসহ ছিল, দেখলেই সে ঠোকর দিতে ছাড়ত না; কুঁকড়ে গোলাপের নাম করতেই ময়ুরট অমনি বলে উঠল, “গোলাপ আবার একটা ফুলের মধ্যে নাকি?” -

 কুঁকড়ো গোলাপের নিন্দে শুনে রেগেই লাল; তিনি সব মোরগকে শুনিয়ে বললেন, “কুঁকড়ে কিম্বা মোরগ হয়ে গোলাপের নিন্দে যে সয় সে নরাধম কুলাঙ্গার...।”

 “হেঃ তে-রি-গো-ল-প” বলে বাজখাই মোরগ তাল ঠুকে উপস্থিত, “আওতে, কুঁকড়ে দেখে” বলে।

 “আও।” বলেই কুঁকড়ো বুক-ফুলিয়ে এগিয়ে এসে বললেন, “তোকেই খুঁজছিলেম ঝুটিকাট কাকাতুয়া।”

 বাজখাঁই কেওমেও করে বলে উঠল, “ক্যা বোলা? এ কেস বাত হুয়া?—কা-কা-তু-য়তুয়া কাকা।” w

 কুঁকড়ো ঠিক তেমনি স্বরে বলে উঠলেন, “ক্যা বোলা কা-কা-তুয়া।”

 খানিক দুজনে চোখ পাকিয়ে পালক ফুলিয়ে এ-ওর দিকে চাওয়াচায়ি হল। তার পর বাজখাঁই বললে, “তুমসে কুস্তিগীর পাহালোয়ান জাহানদার জবরদস্ত দশ জোয়ানকো সাথ বেলায়েৎমে ময় লড়া হু, আউর জিতা হু, দো দশকে ঘয়েল ভি কিয়া।”

 কুঁকড়োর কাজ খুন নয়— ভয় যারা পায় তাদের অভয় আর আলো দেওয়া। তিনি কিন্তু তাই বলে কাপুরুষ ভীরু ছিলেন না, এগিয়ে এসে বললেন, “তবে লড়ায়ের আগে একবার আলাপ-পরিচয়টা হয়ে যাক ৷”

 বাজখাঁই চেচিয়ে বললে, “মের নাম ফতে-জঙ্গ তাগবাহাদুর মালিকিময়দান।”  কুঁকড়ো হেসে বললেন, “আর আমার নাম কুঁকড়ো।”

 লড়াই বাধে দেখে সোনালি ভয় পেয়ে জিম্মার কাছে ছুটে গেল। কুঁকড়ো বললেন, “জিন্ম, খবরদার, তুমি এতে কোনো কথা বলতে পাবে না, তুমি নড়তে পাবে না, যেখানে আছ সেখান থেকেই শেষ পর্যন্ত দেখো।*

 সোনালি বললে, “একটা গোলাপ ফুলের জন্যে প্রাণ দিতে যাবে?”  কুঁকড়ো গম্ভীর স্বরে বললেন, “ফুলের অপমানে সূর্যের অপমান, তা জান?”   সোনালি চড়াইয়ের কাছে ছুটে গিয়ে বললে, “তুমি যে বলেছিলে সব মিটিয়ে নেবে?”   চড়াই গম্ভীর হয়ে উত্তর করলে, “সব মেটে কিন্তু জ্ঞাতির ঝগড়া মেটে না গো মেটে না।”  চিনি-দিদি বুক চাপড়াতে লেগেছেন আর বলছেন, “এ কী গো। লোকের বাড়ি নেমস্তম্নে এসে খুনোখুনি।” এই বলছেন আর কুঁকড়োর লড়াই দেখবার জন্তে সবাইকে বসাচ্ছেন—ফুলের টবে, লাউকুমড়োর মাচায়। দেখতে দেখতে সব পাখি দুই পালোয়ানকে ঘিরে বসে গেল কুস্তি দেখতে। সবপ্রথমে মুরগিরা গোল হয়ে বসেছে, ছানাপোনা কোলে, তার পর হাস ইত্যাদি, শেষে যত পোশাকী মোরগ, ময়ুর এর।

 জিম্মা কুঁকড়োকে ডেকে বললে, “জেতা চাই, পাহাড়তলির নাম রেখো।”

 কুঁকড়ো একবার চারি দিক চেয়ে দেখলেন, সবাই আজ তাকে যেন মরতে দেখতে ঘাড়গুলো বাড়িয়ে বসে আছে মনে হল। কোথাও একটু ভালোবাসা নেই– হিংসে আর খুনের নেশায় সবার মুখ বিকট দেখাচ্ছে। কুঁকড়ো একটি নিশ্বেস ফেললেন।

 সোনালি চোখের জল মুছে বললে, “আহ, কাচ্ছাবাচ্ছাগুলির কী হবে গে।”

  কিন্তু কুঁকড়োর প্রাণে কোনো দুঃখু নেই, তিনি বুঝলেন যে, তাকে মরতেই হবে। তবে মরবার পুর্বে কেন না তিনি সবার কাছে প্রচার করবেন, যা এতদিন কাউকে বলা হয় নি। এই তো ঠিক সময়। তবে আর কেন গোপন রাখা তার মহামন্ত্র। কুঁকড়ো সবাইকে বললেন, “শোনো তোমরা আমার গোপন কথা, মহামন্ত্র, যা এতদিন বলি নি, আজ বলে যাব।” .

 সবাই যেটা জানতে ব্যস্ত, সেটা আজ কুঁকড়ো প্রচার করবেন, মুরগিদের আনন্দ আর ধরে না। কুঁকড়ো বাঁচুক মরুক তাতে কী। মন্তরটা শুনতে পেলেই হল। তারা সবার আগেই

 গলা বাড়িয়ে বসল। কুঁকড়ো সেটা দেখলেন। হায়দ্রাবাদিটা কেবল তাল ঠুকছিল, তার আর তর সয় না। কুঁকড়ো তাকে বললেন, “ভয় নেই, পালাব না, একটু সবুর করে।” তার পর সবার দিকে চেয়ে বললেন, “কথাটা শুনে তোমাদের যদি খুব হাসি পায় তো খুবই হেসে; তামাশা টিটকিরি দিতে চাও তাও দিয়ে, আমি তাই দেখেই সুখে মরব।” সোনালি চেচিয়ে বললে, “ছিং, ও কী কথা।” জিন্ম বুঝেছিল, কুঁকড়োর মনের কথাটা কী; তাই সে বললে, “বেন বনে মুক্ত ছড়িয়ে কী লাভ হবে বন্ধু।” কিন্তু কুঁকড়ো যখন বলেছেন তখন তিনি আর সে কথা নড়চড় হতে দেবেন না। র্তার মুখ দেখে জিম্মা আর সোনালি দুজনেই চুপ হয়ে গেল। কুঁকড়ো চারি দিকে দেখে বললেন, “নিশাচরদের বন্ধু, অন্ধকারের পাখি সব। তবে শোনে, আর শুনে আমায় পাগল ব’লে খুব হাসে। আজ আমার কাছে তোমাদের কিছুই লুকোনো রইল না, কে আমার আপনার, কেবা পর সব চেনা গেল, ধরা পড়ল। তবে আজ আমিই-বা লুকিয়ে থাকি কেন আপনাকে না জানিয়ে।” বলে কুঁকড়ো আর-একবার চারি দিক দেখে বললেন, “আলোর ফুলকি, আলোর ফুল আকাশে ফোটে কেন তা জানো? আমি গান গাই ব’লে।” প্রথমটা সবাই থ হয়ে গেল, তার পর একেবারে হাসির হুল্লোড় উঠল, “পাগল! পাগল।”

 কুঁকড়ো বলে উঠলেন,“সবাই হাসছতে৷” বলেই হাক দিলেন, “সামাল জোয়ানসামাল।”

 লড়াই শুরু হয়ে গেল। তখনো সবাই হাসছে, কী মজা, উনি গান গেয়ে আকাশে আলো জ্বালান, কী আপদ-।

 কুঁকড়ো বাজখাঁই মোরগের এক প্যাঁচ সামলে বললেন, “হাঁ আমিই সূর্যের রথ রোজকে রোজ টেনে আনি।” তার পরেই কুঁকড়োকে বাজখাই এক ঘা বসালে; তার পর আরএক ঘ, আর-এক ঘা। সবাই চারি দিক থেকে চীৎকার করতে লাগল, “বাহবা বাজখাঁ, চালাও, জোরসে ভাই।” কুঁকড়োর মুখে চোখে ঘা পড়ছে আর সবাই চেঁচাচ্ছে, “খুব হুয়া, বহুত আচ্ছা, জেসাকে তেস, ইয়েঃ মারা।” ওদিকে কুঁকড়োও ব’লে চলেছেন, “আমিই আলে। আনি, সকাল আনি, আলো, আলো, আলো” কুকুর চেঁচাচ্ছে, “হঁ। হাঁ।” সোনালি কাঁদছে চোখ ঢেকে, আর সব পাখি তারা বলে চলেছে হাততালি দিয়ে, “চালাও বাজখাই চোঁচ, আওর এক লাথ তুগুমে, বাহবা বাজখ, খুব লড়ত, ইয়েঃ এক ঘা, উয়োঃ দো ঘাও, মারা মারা।” রাজ্যের পাখির গালাগালি হাসি টিটকিরির মধ্যে কুঁকড়ো এক-এক পা করে ক্রমে মরবার দিকে এগিয়ে চলেছেন। তার বুক বেয়ে রক্ত পড়ছে, গায়ের পালক সব ছিড়েখুড়ে চারি দিকে উড়ছে, চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে, মনে হচ্ছে পৃথিবী যেন ঘুরছে কিন্তু তবু তিনি যুঝছেন। কিন্তু শক্তি ক্রমেই কমছে। এই সময় তার মোরগ-ফুলের উপরে বাজখ। এমন এক ঘা বসিয়ে দিলে যে কুঁকড়ো অসান হয়ে বসে পড়লেন। অমনি চারি দিকে সবাই চেচিয়ে উঠল, “বাহবা কী বাহবা। ঘায়েল হুয়া, ঘায়েল হুয়া।”

 জিন্ম রাগে ফুলতে লাগল আর তার দুই চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়তে লাগল। কুঁকড়োর হুকুম, তার নড়বার জো নেই। কিন্তু সে তার বন্ধুর দুর্দশা আর দেখতে পারে না। সে ধমকে উঠল, “তোরা সব পাখি না মানুষ?” জিম্মা বলতে চায় যে মানুষ ছাড়া এমন নির্দয় আর কে হতে পারে। কিন্তু তার কথা জোগাল না; সে কেবল বলতে লাগলে, “ওরে, এরা পাখি, না মানুষ?” কুঁকড়ো যখন সান পেয়ে আবার চোখ মেললেন, তখন সব চুপচাপ রয়েছে, হায়দারি মোরগ বেড়ায় ঠেস দিয়ে হাপাচ্ছে, জিন্ম কেবল কাছে দাড়িয়ে; আর দূরে, সব পাখির দলের থেকে দূরে, ডানায় মুখ ঢেকে রয়েছে সোনালিয়া।

 কুঁকড়ো জিম্মাকে বলছেন, “এই শেষ, নাযন্ত্রণার আরো কিছু রেখেছে পোশাকী পাখি আর তাদের দলবলের” এমন সময় দেখা গেল, সব পাখি পা টিপে টিপে কুঁকড়ো যেখানে পড়ে রয়েছে সেই দিকে দল বেঁধে এগিয়ে আসছে; সবার মুখ শুকনো, যেন কী-একটা ভয়ে সবাই জড়োসড়ো, কেউ আর হাসছে না।

 কুঁকড়ো বললেন, “আ:জিন্ম, দেখো দেখে ওরা আমায় ভালোবাসে কি না দেখো। আহ সবার মুখ শুকিয়ে গেছে। এরা যদি শক্র তবে আর মিত্র কে। আজ আমার ভুল ভাঙল, এখন সবাই আমায় ভালোবাসে জেনে সুখে মরতে পারব।”

 জিন্মাও একটু অবাক হয়ে গেল, এই যারা ‘মার মার' ক'রে কুঁকড়োকে গাল পাড়ছিল, তারাই আবার হঠাৎ বন্ধু হয়ে উঠল এমন যে কেঁদেই অস্থির। কুকুর ঘাড় নেড়ে ভালো ক’রে পাখিদের দিকে চাইলে; দেখলে, সবাই ভয়ে ভ.জিাকাশের দিকে এক-একবার চাচ্ছে আর কুঁকড়োর কাছে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। পাখিরা কখন কিভাবে থাকে জিম্মার বেশ জানা ছিল, সে কুঁকড়োকে চুপি চুপি বললে, “আমার তো বোধ হয় না ওরা তোমার প্রাণের জন্যে ভয় পেয়েছে একটুও। ভয় ওইদিক থেকে আসছে শিকরে রাজ হয়ে, আর সেটা এসে ঘাড়ে পড়বার আগে সব পাখিরা চিরকাল যা করে থাকে, আজও ঠিক তাই করছে।”

 কুঁকড়ো দেখলেন আকাশের অনেক উপরে থেকে সত্যিই বাজপাখি ঘুরে ঘুরে নামছে। তার কালো ছায়াটা যেন কালো হাতের মতো একবার খানিকক্ষণ ধ’রে সব পাখিদের উপর দিয়ে যেন তাদের এক-একে গুনতে গুনতে এক পাক ঘুরে গেল; আমনি সব পাখি ভয়ে জড়োসড়ো, আর-এক পা কুঁকড়োর দিকে এগিয়ে এল। বিপদের সময় কুঁকড়োর আশ্রয় তারা চিরকাল না চেয়েও যে পেয়েছে, বাজ অনেক বার পড়ে পড়ো হয়েছে, আর অনেকবারই কুঁকড়ো সেটাকে সরিয়ে দিয়েছেন, এবারও তা হবে না কেন। কুঁকড়ো সেই রক্তমাখা বুক ফুলিয়ে সত্যিই সোজা হয়ে দাড়ালেন, তার পর ঘাড় তুলে হুকুম হাকলেন, “আয় তোরা আয়, কাছে আয়, বুকে আয়, ভয় নেই,ভয় নেই।” আমনি বাচ্ছাগুলোকে ডানার মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে সবাই কে কার ঘাড়ে পড়ে, ছুটে এসে কুঁকড়োর গা ঘেঁষে দাড়াল কাতারে কাতারে সব পাখি। পোশাকী মোরগগুলোর কাছে কেউ গেলও না, তাদের আশ্রয়ও কেউ চাইলে না। কেননা পোশাকী তারা নিজেরাই ভয়ে কঁপিছিল এ-ওকে জাপটে ধ’রে। বাজের ছায়া আবার সবার উপর দিয়ে ঘুরে চলল, এবারে আরো কালো, আরো বড়ো; আর সবাই এমন-কি পালোয়ান হায়দারি পর্যন্ত ভয়ে গুটিয়ে যেন পালকের পুটলিটি। কেবল সবার উপরে মাথার মোরগফুল লাল নিশেনের মতো উচু ক'রে দাড়িয়ে রয়েছেন কুঁকড়ো, রক্তমাখা বুক ফুলিয়ে। বাজপাখি আর-এক পাক ঘুরে এল, এবার সে একেবারে কাছে এসেছে, কালবোশেখের মেঘের মতো কালো হয়ে উঠেছে তার ভয়ংকর কালো ছায়া; সমস্ত যেন অন্ধকার করে আসছে সেটা আস্তে আস্তে। ভয়ে মায়ের বুকের মধ্যে বাচ্ছাগুলো পর্যন্ত কাঁদতে থাকল। সেই সময় কুঁকড়োর সাড়া আকাশ ভেদ করে উঠল, “অবতক হাম জিন্দা হ্যায়,অবতক হাম দেখতা হ্যায়, অব তক্‌ হাম মালেক হ্যায়...।”

 অমনি দেখতে দেখতে বাজের ছায় ফিকে হতে হতে কোথায় মিশিয়ে গেল। আকাশ যে পরিষ্কার সেই পরিষ্কার নীল ঝকঝক করছে। আহলাদে পাখিরা সব আবার গা ঝাড়া দিয়ে যে যার জায়গায় উঠে বসে বললে, “এইবার আবার কুস্তি চলুক।” জিম্মা অবাক হয়ে গেল; কুঁকড়োর মুখে কথা সরল না, সোনালি বললে, “তুমি ওদের বাচালে আর ওরা তার পুরস্কার দেবে না? বাজ দেখালে ভয়, তার শোধ তুলবে ওরা তোমায় মেরে”  কিন্তু কুঁকড়ো জানেন আর তাঁর মরণ নেই; যে-পাখিকে সবাই ভয় করে, সেই বাজের কালো ছায়া তিনবার তাঁর মাথার উপর দিয়ে ঘুরে গেছে, ভয় থেকে তিনি সবাইকে বাচিয়েছেন, এখন নিজে তিনি নির্ভয়ে যুদ্ধের জন্যে এগিয়ে এসে হায়দারিকে এক গোত্ত বসিয়ে বললেন, “আও।” গোত্তা খেয়ে হায়দারি ঠিকরে বেড়ার উপর গিয়ে পড়ল। এবার ইস্পাতের পেরেকআঁটা কাতান কুঁকড়োর উপর চালারার মতলব ক’রে সে ছপায়ে বাঁধা ছোরাছটোয় শান দিয়ে নিতে লাগল। বেরাল গাছের উপর থেকে হায়দারিকে বললে, “কেঁও মিঁয়া।”

 চড়াই বললে, “কাতানি কাটকাটানি।”

 জিন্ম বললে, “চালাক দেখি, ও কাতান, ওর টুঁটি ছিঁড়ব না।”

  আবার কুস্তি চলল। জিন্মা দেখছে হায়দারিটা ছোরা না চালায়, এমন সময় হঠাৎ হায়দারি সঁ। ক’রে ছোরা উচিয়ে ‘লেও ব’লেই যেমন কুঁকড়োকে কাতান বসাবে, অমনি কুঁকড়ো এক প্যাচ দিয়ে তাকে উলটে ফেললেন। হায়দারির নিজের কাটা তার নিজেরই বুকে কেটে বসল। হায়দারি পড়লেন। তার বন্ধুরা তাকে ধরাধরি করে উঠিয়ে নিয়ে পালাল। পাখিরা সব “হও ছুও” ক’রে তার পিছনে চলল। সোনালি আর জিন্ম কুঁকড়োর কাছে ছুটে এসে দেখলে, তিনি চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে আছেন।

 জিন্ম বললে, “আমরা এসেছি বন্ধু, আমাদের সঙ্গে কথা কও”

 সোনালি বললে, “আমি এসেছি একটিবার চেয়ে দেখো।”

  কুঁকড়ো আস্তে-আস্তে চোখ মেলে বললেন, “ভয় নেই, কালও আবার সূর্য উঠবে, আলো ফুটবে।” এদিকে হায়দারিকে ‘তুও দিয়ে তাড়িয়ে সব পাখি কুঁকড়োকে ‘জয় জয়’ বলে খাতির করতে এল।

 কুঁকড়ো রেগে হাকলেন, “ছুঁও মৎ, তফাত রও।”  জিন্মা বললে, “আর কেন। কে কেমন তা বোঝা গেছে, সরে পড়ে।”

 সোনালি বললে, “সত্যিকার পাখি যদি থাকে তো সে বনে, তোরা কি পাখি।” তার পর কুঁকড়োর দিকে ফিরে সোনালি বললে, “চলে, আর এখানে কেন, বনে চলে যাই চলো।”

 কুঁকড়ো বললেন, “ন, আমাকে এখানেই থাকতে হবে।”

 “এত কাণ্ডের পরেও, সৰ জেনেও?” সোনালি অবাক হয়ে শুধোলে।

 কুঁকড়ো জবাব দিলেন, “হা, সব জেনেও থাকতে হবে।”

 সোনালি অবাক হয়ে রইল। কুঁকড়ো আবার বললেন, “হঁ। সোনালি, এখন শুধু আমার গানের জন্তেই থাকব, আর কারু জন্যে নয়। মনে হচ্ছে এ দেশ ছাড়লে বিদেশে বিভুয়ে গান আমার শুকিয়ে মরবে। আঃ, এই আকাশ, এই দিন– একে আবার আমি গান গেয়ে আলো দিয়ে কাল জাগিয়ে তুলৰ, মরতে দেব না।” পাখিগুলো আবার মুখ কাচুমাচু করে কুঁকড়োর দিকে এগিয়ে এল। তিনি ঘাড় নেড়ে মানা করলেন, “না, আর না, কেউ না, এখন শুধু আমি আর আমার গান, আর আমার কেউ নেই, কিছু নেই, সরে যাও, আমি দিনের আসা গাই।” সব পাখিরা দূরে সরে গেল; কুঁকড়ো সোজা দাড়িয়ে স্বর ধরলেন, “আ-আ-আ,” কিন্তু এ কী। গান কোথায় গেল। তার মনের ভিতর ঘুরছে— সা-স-সা। তিনি আবার চাইলেন গাইতে, অমনি মনে হল স্বরটা ওড়ব না খাড়ব? ওটা পঞ্চম নাধৈবত। তেতালা না চৌতালা? এমনি সব নানা শাস্ত্রের বিড়বিড় হিজিবিজি র্তার গলার মধ্যে বুকের মধ্যে ঘটুঘটু করতে লাগল। কুঁকড়ো নিশ্বেস ছেড়ে বললেন, “হায় আমার গান পর্যন্ত রাখলে না; সব কেড়ে নিলে— কোথায় আমার গান।” বলে কুঁকড়ে ঘাড় হেঁট করলেন।

 সোনালিয়া কাছে ছুটে এল, কুঁকড়ো তার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কেঁদে বললে, “তুমি ছাড়া আর কেউ নেই, তোমার ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু নেই জগতে, ও আমার স্বপন-পাখি।” সোনালি আস্তে-আস্তে বললে, “চলো চলে যাই, যেখানে কেবলই গান আর ফুল ফুটছে সেই বন, সেখানে সা-রে-গা-মা-ব’লে কেউ মাথা বকায় না— দিনরাত গেয়েই চলে।”

 কুঁকড়ো সোনালিকে বললেন, “যাব, তোমার সঙ্গেই যাব, দুজনে যাব, শুধু যাবার আগে এদের একবার চোখ ফুটিয়ে দিয়ে যাব।” বলে কুঁকড়ে সবাইকে ডেকে বললেন, “ওগো কুলতলার নিষ্কর্মার দল! এই সবজি-বাগান হাওয়া খাবার জায়গাও নয়, গুলতোন করবার আডডাও নয়, এখানে কাজ চলেছে, ফুল থেকে ফল আস্তে-আস্তে তৈরি হচ্ছে, হট্টগোলের জায়গা এটা নয়, ওই শোনো মৌমাছিরাও এই কথাই বলছে।” অমনি সব মৌমাছি ব’লে উঠল, “কাজের সময়, সরো না মশয়! সরো না মশয়! এসো না মশয়! এসো না মশয়।”

 তার পর মুরগিদের ডেকে কুঁকড়ো বললেন, “ওই-সব পোষা মোরগের পালক দেখে ভুলো না। ভুলো না। যে ধান ছড়ায় তারি কাছে ওরা ছুটে যায়, গোলাম বনে সেলাম বাজায়। ওদের সবখানিই মিথ্যে দিয়ে গড়, সত্যির মধ্যে কেবল ওদের পেটটি। আর ময়ুর তোমাকে বলি, দেব-সেনাপতির বাহন ব’লে বিধাতা তোমায় ভালো সাজ দিয়েছেন কিন্তু তাই ব’লে সাহস বলে জিনিস তোমায় একটুও তিনি দেন নি; দিয়েছেন তোমার বুকের মধ্যে হিংসে আর দেমাকের বিষ এমনি ভাবে যে তোমার গলার খানিক পালক পুড়ে কালি হয়ে গেছে; আর তোমার ল্যাজের ডগাটি পর্যন্ত হয়ে গেছে নীল, পাছে কারু বাড় দেখতে হয় সেই ভয়ে।”

 চড়াই অমনি ব’লে উঠল, “ছুট।”

 কুঁকড়ো চড়ায়ের দিকে ফিরে বললেন, “কী কুক্ষণে শহুরে চড়ায়ের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল বনের তাল চড়াই, সেই থেকে কেবলই তুমি ভয়ে-ভয়ে আছ, পাছে কেউ তোমার শহুরে খোলস খুলে নেয়। নকল-শহুরে। তোমার চলন নিজের নয়, বলন নিজের নয়, কেননা তোমার আনন্দ নেই, আছে কেবল ধরা-পড়বার ভয়। তুমি নিজেকে পছন্দ কর না কাজেই অন্তকেও ভালোবাস না। তোমার কী নাম দের? তুমি জলন্ত সলতের পোড়া গুল, তোমাকে র্কাচি দিয়ে ছেটে দেওয়াই দরকার।”

 চিনি-দিদি ব’লে উঠলেন, “বেশ বেশ।”

 চড়াইট ল্যাজ-গুড়িয়ে এক কোণে সরে পড়ল, আর পেরুর উপরে এই অপমানের ঝালট ঝাড়তে গেলে কোনো বিপদে পড়বে কি না সেটা মনে মনে বিচার করতে লাগল। ঠিক এই সময় দূর থেকে চিড়িয়াখানার মালিক ডাক দিলেন, “আয়—আঃ—আয় আঃ!” অমনি সব পোশাকী মোরগ সেই দিকে দৌড় দিলে।  চিনি-দিদি বললেন, “চললে নাকি। চললে নাকি।” বলে তাদের সঙ্গে ছুটলেন।

 সোনালি কুঁকড়োকে বললে, “আর কেন? চলে এইবার।” বলে কুঁকড়োকে নিয়ে বনের দিকে আস্তে আস্তে চলে গেল। জিন্ম ফ্যাল ফ্যাল করে সেইদিকে খানিক চেয়ে থেকে আস্তে আস্তে গোলাবাড়িতে ফিরে গেল মাথা নাড়তে নাড়তে।

 চিনি-দিদি ফিরে দেখলেন সবাই চলে গেছে। তিনি তবু যেন সবাইকে খাতির ক’রে বেড়াতে লাগলেন আর কেবলই বলতে লাগলেন, “আসছে সোমবারে আসবে তো? নমস্কার। মনে থাকে যেন আসছে সোমবার”

 খালি উঠোনময় চিনি-দিদি ঘুরে বেড়াচ্ছেন এইভাবে, এমন সময় কাক ফুকরোলে, “কাছিম মিয়া, কাছিম মিয়া”...। চিনি-দিদি তার ছেলেকে বলছিলেন, “আঃ, আজ মজলিস কেমন জমেছিল দেখিছিস্!” গুটি-গুটি কাছিম এসে কুলতলায় বসলেন।