ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/উদয়পুর মন্দিরের ব্রাহ্মণ
উদয়পুরমন্দিরের ব্রাহ্মণ।
এই ভীষণ গুহা হইতে প্রায় ২২৫ক্রোশ দূরে, যে দিকে শুষ্কতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাইতেছে—সেই উত্তরপশ্চিমাভিমুখে, মেওয়ারদেশের শুভ্রনগর, উদয়পুর;—আমাদের যাত্রাপথে থামিবার একটি সুন্দর আড্ডা। এই মহাদুর্ভিক্ষের পথটি ধরিয়া আমি এখন চলিতেছি।
এইখানে পৌঁছিয়াই বহুদূর হইতে দেখা যায় - রাশীকৃত প্রাসাদ ও মন্দির ধব্ধব্, করিতেছে; চারিদিক্ পর্ব্বতে বেষ্টিত। বৃষ্টির অভাবে, সরস নবীন শাখাপল্লবের স্থলে, শুষ্ক মরা পাতা; অত্রত্য ধরণীর কি অস্বাভাবিক বিষন্নতা!—এই বসন্তকালেও বেশভূষা পরিহার করিয়া পীতবর্ণ ধারণ করিয়াছে। এ সমস্ত সত্ত্বেও, দূর হইতে মনে হয়—নগরটি, বনাচ্ছন্ন ঢালুদেশের পাদমূলে, তরুপুঞ্জের মধ্যে, রহস্যময় শান্তির নীড়ে বেশ আরামে রহিয়াছে।
কিন্তু যতই নিকটবর্ত্তী হইতেছি, দুঃখকষ্টের নিদর্শন চারিদিকে ক্রমশ প্রকাশ পাইতেছে! নগরতোরণ পর্য্যন্ত যে রাস্তাটি গিয়াছে, তাহার দুই ধারে সারি সারি মরা-গাছ; রাস্তায় ভিক্ষুকেরা বিচরণ করিতেছে—সেরূপ জীব কেহ কখন চক্ষে দেখে নাই; উহাদের কঠিন প্রাণ যেন কিছুতেই বাহির হইতে চাহে না; কিন্তু এবার বোধ হয় শেষ হইয়া আসিয়াছে;—যেন কতকগুলা আরকে-রক্ষিত শব; কতকগুলা শুষ্ক চলন্ত অস্থিপঞ্জর; চক্ষু কোটরে ঢোকা; ভিক্ষা চাহিবার সময় মনে হয়, যেন উহাদের স্বর কণ্ঠের গভীরদেশ হইতে নিঃসৃত হইতেছে। ইহারা গ্রামপল্লির লোক, কিংবা ঐ সব লোকের ভগ্নাবশেষ বলিলেও হয়। ইহারা দেহভার কোনপ্রকারে বহন করিয়া সহরের দিকে চলিয়াছে। উহারা শুনিয়াছে, সেখানে এখনো একমুষ্টি আহার জুটিতে পারে। কিন্তু চলিতে চলিতে প্রায়ই উহারা পথের মাঝে মুচ্ছিত হইয়া পড়ে; দেখা যায়, কতকগুলা লোক ঘননিবিড় ধূলারাশির উপর ইতস্তত শুইয়া আছে; ক্রমে যন্ত্রণার ছটফটানিতে তাহাদের সর্ব্বাঙ্গ ধূলায় আচ্ছন্ন হইয়া যায়; তথন উহাদের নগ্নদেহ কঙ্কালের বর্ণ ধারণ করে। এই পথের ধারেই উদয়পুর| মহারাজের প্রাসাদের ঘের-উদাস, বিষাদময়। কতকগুলা মসজিদ, মন্দিরের ভগ্নাবশেষ, মর্ম্মর প্রস্তরের ও অন্যান্য প্রস্তরের চতুষ্ক (kiosque), মৃত মহারাজদিগের অগ্নিসৎকারের স্থান, কতকগুলা গম্বুজওয়ালা ইমারৎ, কতকগুলা মরা-গাছ, যাহার শাখার উপর কতকগুলা বানর বসিয়া আছে। -এই সমস্ত প্রাচীর ছাড়াইয়া উঠিয়াছে, দেখিতে পাওয়া যায়।
দ্বারদেশে—উচ্চ ধবল প্রাকারাবলীর দ্বারদেশে, যেখানে খোলা তলোয়ার হস্তে কতকগুলা সিপাহী পাহারা দিতেছে—দুর্ভিক্ষক্লিষ্ট হতভাগ্য লোকদিগের জনতা প্রবল বন্যার ন্যায় সবেগে আসিয়া যেন কল্-কপাটের সম্মুখে আটকাইয়া পড়িয়াছে। এইখানে উহারা সমবেত হইয়া হস্ত প্রসারিত করিয়া রহিয়াছে। কেহ যে উহাদের গতিরোধ করিতেছে, এরূপ নহে; কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ন্যায় নগরের এই সব প্রবেশপথগুলিই ভিক্ষুকদিগের মনোমত স্থান।
তিন শতাব্দী হইল, উদয়পুরনগর স্থাপিত হয়। ইহারই পূর্ব্বদিকে কয়েকক্রোশ দূরে পুরাতন রাজধানী চিতোরের ধ্বংসাবশেষ অবস্থিত। এই উদয়পুর ইহারি মধ্যেই যেন জরাজীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে; সমস্ত চুনকাম-করা, মনে হয় যেন শুভ্র শোকবস্ত্রে আচ্ছাদিত। ইহার অভ্যন্তরে কতক গুলি দেবমন্দির,—শাদা-থাম, শাদা চূড়া; যেটি সর্ব্বাপেক্ষা বড় ও যাহার মাহাত্ম্য সর্ব্বাপেক্ষা অধিক—সেটি জগন্নাথরায়জির মন্দির। মহারাজের প্রাসাদগুলিও খুব শাদা,—একটি শৈলের উপর অধিষ্ঠিত; উহার এক পার্শ্ব হইতে সমস্ত সহর অবলোকন করা যায়। এই সকল প্রাসাদের ধবলপ্রভা একটা গভীর বৃহৎ সরোবরের উপর প্রতিফলিত,—চারিদিকে পর্ব্বত ও বনরাজি ঘিরিয়া আছে।
ঘটনাক্রমে প্রথম হইতেই দুইটি ব্রাহ্মণ যুবকের সহিত আমার আলাপ পরিচয় হয়। ইহারা দুই সহোদর এবং উভয়েই বৃহৎ মন্দিবের পুববাহিত; যে সময়ে আমার আবাসগৃহ হইতে আমি বাহির হই না,—সেই নিস্তব্ধতার সময়ে, সেই জ্বলন্ত উত্তাপের সময়ে—ইহারা বুঝিয়া-সুঝিয়াই আমার সহিত এই পান্থশালায় সাক্ষাৎ করিতে আইসে। এই দুই ভায়ের একইরকম মুখ;—অতীব সুন্দর সূক্ষ্মাবয়ব মুখশ্রী; উভয়েরই বড়-বড় চোখ;যোগিজনের মত একটু রহস্যময় (Mystic)। ইহাদের বিশুদ্ধ কুল সঙ্কর্য্যদোষে কলুষিত না হইয়া, তিনসহস্র বৎসর হইতে অক্ষুন্নভাবে চলিয়া আসিতেছে। ইহারা সেই সব ধ্যানপরায়ণ ঋষিদের বংশধর—যাহারা প্রথম হইতেই, আমাদের মত অধম মানবকুলের বাহিরে ও বহু উর্ধে আপনাদিগকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে; যাহারা অপরিমিত পানাহারে, কিংবা বাণিজ্যে, কিংবা যুদ্ধে কখন লিপ্ত হয় নাই;—যাহারা একটি ক্ষুদ্র পশুকেও কখন হত্যা করে নাই; সাহারা আহারের জন্য কখন জীবহিংসা করে নাই। যে মাটির ছাঁচে ইহারা গঠিত, তাহা আমাদের হইতে ভিন্ন এবং আমাদের অপেক্ষা নির্ম্মল; মৃত্যুর পূর্ব্বেই ইহারা যেন একটু অশরীরী ভাব ধারণ করে; এবং ইহাদের ইন্দ্রিয়চেতনা এতটা স্থূলতাবর্জিত যে, এই অস্থায়ী জীবনের পরপার জিনিষসকলও বেশ দিব্যচক্ষে দেখিতে পায়।
কিন্তু সে যাহাই হউক, আমি যে আশা করিয়াছিলাম উহাদের নিকট হইতে কিছু জ্ঞানালোেক পাইব, এখন দেখিতেছি, আমার সে আশা আকাশ কুসুমবৎ অলক। অনুষ্ঠান-আড়ম্বরের অপব্যবহারে পুরুষানুক্রমে ইহাদের ব্রাহ্মণ্যধর্ম্ম তমসাবুত হইয়া পড়িয়াছে;—সাঙ্কেতিক রূপকের মধ্যে যে অর্থ প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে, তাহা এক্ষণে উহারা অবগত নহে।
“আমরা যে দেবতার পূজা করি, সেই দেবতার পরমভক্ত করণসিংহের পুত্র,—রাজশ্রী জগৎসিংহ। ১৬৮৪ সালে সিংহাসনে আরোহণ করিয়া তিনি এই বৃহৎ মন্দিরের নির্ম্মাণকার্য্য আরম্ভ করাইয়া দেন। এই মহারাজা সরোবরের উপর আর ও দুইটি মন্দির নির্ম্মাণ করান। উহাদের নির্ম্মাণে ২৪ বৎসর লাগে। উদঘাটন-অনুষ্ঠানের সময় যখন আমাদের দেবতা বিগ্রহমন্দিরের মধ্যে স্থাপিত হয়, সেই ১৭০৮ সালে, পার্শ্ববর্তী অনেক রাজরাজড়া অনুচরবর্গের সহিত মহাসমারোহে এখানে আসিয়াছিলেন, তাহাদের সঙ্গে বিস্তর হাতী আসিয়াছিল।”
ঐ দুই ভায়ের মধ্যে একজন এইরূপ আমার নিকট বর্ণনা করিল। তখন বেলা দ্বিপ্রহর,—সমস্ত নিস্তব্ধ; পান্থশালার ভিতরে আধো-আধো অন্ধকাব;—সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ; রৌদ্র, মাছি, শুষ্ক বাতাস, দুর্ভিক্ষের বাতাস, কিছুই ভিতরে প্রবেশ করিবার জো নাই। উদয়পুরের মন্দিরাদিসম্বন্ধে, পৌরাণিক সমস্ত দেবদেবীর সম্বন্ধে, ইহাদের অগাধ পাণ্ডিত্য; কিন্তু মনুষেব অনন্ত আশার কারণ কি—পরলোকসম্বন্ধে উহাদের আধ্যাত্মিক দৃষ্টি কিরূপ—এ সমস্ত বিষয় প্রশ্ন করায় উহারা যে উত্তর করিল, তাহা হইতে আমার কিছুই বোধগম্য হইল না; তৎক্ষণাৎ যেন আমাদের পরস্পরের মধ্যে সমস্ত সংস্রব চলিয়া গেল; আমাদের মন যে একজাতীয়, তাহা যেন আর অনুভব করিতে পারিলাম না। আমাদের মধ্যে যেন একটা তমিস রজনীর যবনিকা পড়িয়া পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দিল। পুরোহিতসম্প্রদায়ের অধিকাংশ লোক যেরূপ সচরাচর হইয়া থাকে, উহারাও সেইরূপ দিব্যদর্শী, কিন্তু আবার সেইরূপ সরলমতি; উহারা কোন রহস্যেরই ব্যাখ্যা করিতে পারে না।
এই দুই পুরোহিত প্রতিদিনই আমার জন্য কিছু-না-কিছু সাদাসিধা উপহার লইয়া আইসে, -কখন ফুল, কখন উহাদের ধরণে প্রস্তুত সামান্য মিষ্টান্ন। উহারা খুব ভদ্র ও মধুর প্রকৃতি। তথাপি আমাদের মধ্যে যেন একটা আকাশ-পাতাল ব্যবধান। উহারা আমার প্রতি যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করে, কিন্তু সেই সঙ্গে বর্ণভেদগত অপরিহার্য একটু ঘৃণার ভাবও যেন মিশ্রিত। রক্তমাংসকলুষিত যে সব খাদ্যে আমি পুরুষানুক্রমে অভ্যস্ত সেই কর্দায্য সামগ্রী উহার প্রাণান্তেও ভক্ষণ করিবে না; এমন কি আমার হস্ত হইতে জলপাত্রও গ্রহণ করিবে না; শুধু তাহা নহে, আমার সমক্ষে কোনকিছু আহার করা কিংবা পান করাও উহারা কলঙ্কের বিষয় মনে করে;—সে কলঙ্ক কিছুতেই ক্ষালিত হইবার নহে।
অন্যদিন যে সময়ে উহারা আইসে, আজ প্রাতে তাহার কিছু পূর্ব্বে আসিয়া আমার ঘরের দরজা খুলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল; সেই সঙ্গে সূর্যের জ্বলন্ত কিরণচ্ছটা, একরাশি উড়ন্ত ধূলা, অগ্নিকুণ্ডবৎ আগুনের একটা তপ্তনিশ্বাসও প্রবেশ করিল। আজ উহাদের একটা উৎসবদিন, এই কথা আমাকে জানাইতে আসিয়াছে। আজ উহারা আমার নিকট আর আসিতে পারিবে না; সূর্যাস্তের পর, ইচ্ছা করিলে আমি উহাদের নিকট যাইতে পারি;—মন্দিরের প্রথম ঘেরটির মধ্যে গেলে উহাদের সহিত আমার সাক্ষাৎ হইতে পারিবে, ইত্যাদি।
এখানে উৎসবাদির সময়ে যেরূপ মাল লোকে গলায় পরে, সেইরূপ মালা উহারা আমাকে দিয়া গেল; এই মালা খাঁটি জুঁই ফুলের;—এই জাতীয় জুঁইফুল দক্ষিণভারতে অপরিজ্ঞাত-এই ছোট ছোট শাদা-ফুলের মালা আমার শৈশবের পর, আর কখন দেখি নাই—এতদিনের পর আজ আবার দেখিলাম। আমার শৈশবদশায়, আমাদের পারিবারিক গৃহের প্রাঙ্গণে যুথী-অলঙ্কৃত প্রাচীরের ছায়ায় বসিয়া,—আমার বন্ধুদ্বয় আজ আমাকে যে ফুলের মালা উপহার দিয়াছেন—সেইরূপ মালা গাঁথিবার চেষ্টা করিতাম। হঠাৎ আজ সেই সুদূর অতীতের স্মৃতি আমার মনে জাগিয়া উঠিল। সেই প্রাচীরের ধারে-ধারে,—বৃক্ষপত্রের পতন, সেই প্রাঙ্গণের তৃণগুল্ম, সেই প্রস্ফুটিত কুসুমরাশি আমার মনে পড়িয়া গেল। তখন আমার চক্ষে আমাদের সেই গৃহপ্রাঙ্গণই আমার সমস্ত জগৎ ছিল। অসীম অতীতে ফিরিয়া গিয়া, ক্ষণেকের জন্য আমার মন হইতে এই ব্রাহ্মণ্যের দেশ মুছিয়া গেল; উদয়পুরের সহর, উদয়পুরের দেববৃন্দ, উদয়পুরের সূর্য্য, উদয়পুরের দুর্ভিক্ষও মুছিয়া গেল।
যাহাই হউক, দিবাবসানে শ্রীজগন্নাথ-রাজির উৎসবস্থলে আমি ঠিক আসিয়া উপস্থিত হইলাম।
জগন্নাথরায়জির মন্দিরটি সদ্যপতিত তুষারবৎ শুভ্র। ৩০/৪০ ধাপের একটা উঁচু সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিতে হয়। কতকগুলা পাথরের হাতী প্রহরিরূপে সোপান রক্ষা করিতেছে।
এই উত্তরভারতের মন্দিরচূড়াগুলিতে দাক্ষিণাত্যের ন্যায় দেবমূর্তি ও পশুমূর্তির অসঙ্গত মিশ্রণ দেখা যায় না; এই চূড়াগুলি বেশ প্রকৃতিস্থ ও শান্তধরণের; দূর হইতে মনে হয়, যেন সমাধিস্থানের ‘"ইউ” (ঝাউ) বৃক্ষ। শ্রীজগন্নাথজির মন্দিরের এইরূপ অনেকগুলি চূড়া আছে;—সমস্তই শুভ্রসদ্যপতিততুষারবৎ শুভ্র।
আমি জানিতাম হিন্দু ভিন্ন,—উচ্চবর্ণের লোক ভিন্ন—এই মন্দিরের মধ্যে কেহ প্রবেশ করিতে পায় না। তাই আমি মন্দিরের প্রাঙ্গণে থাকিয়া আমার বন্ধুদ্বয়কে ডাকিয়া পাঠাইলাম।
তাহারা আসিল। কিন্তু আমার পান্থশালায় তাদের যেমনটি দেখিয়াছিলাম, এখন আর তারা সেরূপ নাই আমাদের মধ্যে যেন আরও অতলস্পর্শ ব্যবধান পড়িয়া গিয়াছে। প্রথমেই উহারা অন্যদিনের মত আজ আমার হস্তস্পর্শ করিতে পারিবে না বলিয়া ক্ষমাপ্রার্থনা করিল, কারণ আজ তাহাদের পৌরোহিত্যকাজ করিতে হইবে, পবিত্র সামগ্রীসকল স্পর্শ করিতে হইবে। আজ এই প্রথম উহাদিগকে প্রায়-নগ্ন অবস্থায় দেখিলাম; উহাদের দেবতার সম্মুখে উহারা এইরূপ নগ্নভাবেই অবস্থিতি করে। তাম্রপ্রতিমূর্তির বক্ষোদেশের ন্যায় উহাদের সুন্দর বক্ষের উপর যজ্ঞোপবীতটি তির্যভাবে লম্বমান; উহাদের বিস্ফারিত নেত্রযুগল কেমন একটা অন্যমনস্কভাব, যাহা পূর্ব্ব্বে আমি কখন দেখি নাই।
কিন্তু তবু উহাদের ভদ্রতার কোন ক্রটি নাই। বিষ্ণুদেবের একটা তাম্রময় বিগ্রহের পদতলে, এমন কি, মন্দিরদ্বয়েব ঠিক সম্মুখে, একটা সম্মানের আসনে উহারা আমাকে বসাইল।
বেশভূষায়, দোকানদারে, মন্দিরপ্রাঙ্গণ অচ্ছিন্ন: তাদের ঝুড়িগুলি শাদা জুঁইফুলের মালায় পূর্ণ। এই সমস্ত ফুলরাশির মধ্যে, দুর্ভিক্ষের প্রেমূর্তিগুলা -ভয়ঙ্করবর্ণবিশিষ্ট কতকগুলা নরকঙ্কাল ইতস্তত বিচরণ করিতেছে;— উহাদের চোখ জরবিকারগ্রস্ত রোগাব ন্যায়।
আমার সম্মুখে ব্রাহ্মণেরা মন্দিরের সোপান দিয়া ওঠানাবা করিতেছে, সোপানের উপবে দুই পার্শ্বে বড়-বড় পাথরের হাতী আকাশের দিকে শুড় তুলিয়া রহিয়াছে। সকলেরই শুভ্র পরিচ্ছদ, কটিদেশে অসি, এবং পক্ষের উপর থাকে-থাকে অনেকগুলি মালার গোচ্ছা। বৃদ্ধদিগের তুষারশুভ্র শ্মশ্ররাজি—রাজপুতের পরণে দুই পাশে চড়াইয়া তোলা,—দেখিতে কতকটা শাদা বৃদ্ধ মার্জ্জারের নত। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিশু;—পা এত ছোট যে, অতি কষ্টে ধাপের উপর উঠিতেছে; কিন্তু উহাদের মুখে একটা গাম্ভীর্যের ভাব ও তীক্ষ্ণদর্শিতা প্রকটিত;—মাথায় জরির কাজকরা মখমলের টুপি। রমণীগণ দেখিতে চমৎকার,—পুরাতন গ্রীসীয়-বরণে পরিচ্ছদপরিহিত;জরির নক্সা-কাটা বিবিধ বর্ণের নমস্তু; অথবা, কালো রঙের মলমম্বস্ত্রের উপর রুপালি-চুমকি-বসানো। তমসাচ্ছন্ন ও দুর্গম মন্দিরের অভ্যন্তরপ্রদেশ হইতে গুহাসমুখিত গভীর নাদের ন্যায় একপ্রকার সঙ্গীতধ্বনি-মধ্যে মধ্যে বৃহৎ ঢকার বজ্জবৎ গার্জ্জনধ্বনি আমার কর্ণকুহরে আসিয়া পৌঁছিতেছে। মন্দিরের উপরে উঠিবার পূর্ব্ব্বে প্রত্যেকেই, অবনত হইয়া সোপানের নিম্নতম ধাপটি চুম্বন করিতেছে এবং উপরে উঠিয়া পবিত্র নন্দিরচ্ছায়া হইতে বাহির হইবার পূর্ব্ব্বেও, দ্বারদেশে ফিরিয়া আসিয়া দ্বারদেশের মাটি চুম্বন করিতেছে-প্রণাম করিতেছে। দুর্ভিক্ষের প্রেতমূর্ত্তিরাও ক্রমশ আসিয়া জমা হইতেছে এবং উৎসবসাজে-সজ্জিত জনতার গতিরোধ করিতেছে—উহাদের শুষ্ক হস্তের দ্বারা যাত্রীদিগকে আটুকাইতেছে; মলমলের অবগুণ্ঠনবস্ত্রের মধ্যে অঙ্গুলী প্রবিষ্ট করিয়া দিতেছে; ভিক্ষালাভের উদ্দেশে, বানবের ন্যায় ক্ষিপ্রভাবে বিবিধ চেষ্টা, ও অসংযতভাবে,অনায়ভাবে নানাপ্রকার অঙ্গচালনা করিতেছে।
তাঁহার পর, প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় যেরূপ হইয়া থাকে—হঠাৎ একটা বাতাস উঠিল; কিন্তু তাহাতে তপ্তনগর শীতল হইল না। ধূলার কুজ্ঞাটিকার মধ্যে—পীতাভ, বিষঃ ও ম্লান সূর্য অস্তমিত হইল।
এ সমস্ত সত্ত্বেও, রাস্তায় উৎসবঘটা সমস্তরাত্রি সমান চলিতে লাগিল। সুগন্ধি রঙিনচূর্ণ মুঠামুটা উঠাইয়া লোকেরা পরস্পরের উপর নিক্ষেপ কবিতে লাগিল;—উহা লোকের মুখে ও পরিচ্ছদে লাগিয়া রহিল। এইরূপ ঝটাপটি করিয়া যখন উহারা বাহির হইল, তখন দেখা গেল, উহাদের মুখের অর্ধভাগ নীল কিংবা বেগুনী কিংবা লাল রঙে রঞ্জিত;উহাদের শুভ্র পরিচ্ছদে উজ্জ্বল-রং-মাখানো আহস্ত অঙ্কিত হইয়াছে;গোলাপী কিংবা হলদে কিংবা সবুজ-রং-মাখানো পাচ-আঙুলের দাগ পড়িয়াছে।