ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ/গল্কণ্ডা

গল্কণ্ডা।

  হৈদরাবাদের কোন-এক উপনগর যেখানে শেষ হইয়াছে—সেই বাঁকের, মুখে একটা পুরাতন প্রাচীরের গায়ে এই কথাগুলি উৎকীর্ণ রহিয়াছে। “গণ্ডার পথ"। ভগ্নাবশেষের পথ, নিস্তব্ধতার পথ;—এরূপ লিখিলেও ক্ষতি ছিল না।

 ঘোড়াদের দুকি-চালে পথে খুব ধূলা উড়িয়াছে। এই বিজন পথের ধারে-ধারে প্রথমেই দেখা যায় কতকগুলি ক্ষুদ্র পোড়ো” মজিদ, আর কতকগুলি সরু-সৰু ক্ষুদ্র ধ্বজমন্দির—যাহা একটু ভগ্নদশাপন্ন হইলেও অতীব শোভন ও সুষমাবিশিষ্ট। তাহার পব আর কিছুই নাই; কেবল পাংশুবর্ণ তাপদগ্ধ বিস্তীর্ণ ময়দান, আর কতকগুলা পাষাণস্তপ ছোট-ছোট পাহাড়ের আকারে, ঢিবির আকারে, “পিরামিডের” আকারে, ইতস্তত বিকীর্ণ এবং দেখিতে এরূপ অদ্ভুত যে, উহাদিগকে এই পৃথিবীর কোন পদার্থ বলিয়া মনেই হয় না।

 গাড়িতে একঘণ্টার পথ অতিক্রম করিয়া, একটা জনশূন্য আ-তল-শুষ্ক হ্রদের ধারে আসিয়া পড়িলাম। ইহারই পশ্চাদ্ভাগে প্রাচীরবদ্ধ একটা বৃহৎ মৃতনগরের দিগন্তব্যাপী উপচ্ছায়া। অত্রত্য ময়দানভূমির ন্যায় ইহাও ভীষণ ধূসরবর্ণ। ইহাই সেই গল্কা, যাহা তিন শতাব্দী ধরিয়া এসিয়ার একটি পরমাশ্চর্য দ্রষ্টব্য-পদার্থ বলিয়া প্রখ্যাত ছিল। কে না জানে, ভগ্নাবশেষের অবস্থাতেই—নগর প্রাসাদাদি মানুষের সমস্ত কীর্তিমন্দির গুলিই আসল অপেক্ষা অনেক বড় বলিয়া মনে হয়। কিন্তু এই যে মৃতনগরের উপচ্ছায়াটি দেখা যাইতেছে, ইহা বাস্তবিকই একটা প্রকাণ্ড ব্যাপার। ইহার দস্তুর প্রথম-প্রাকারটি অনুন ৩০ফী উচ্চ। বুরুজ, অস্ত্র নিক্ষেপের জন্য রন্ধময় স্থান, প্রস্তরময় আবৃত প্রহরিস্থানসমস্তই উহাতে বিদ্যমান; এবং উহা আঁকিয়া-বাঁকিয়া চলিতে-চলিতে সুদূর মরুভূমিতে গিয়া শেষ হইয়াছে। এমনই ত প্রাকারটি ভীমদর্শন—তাহার উপর আবার একটা বিরাট্‌কায় প্রকাণ্ড দুর্গনগর সমুত্থিত;—আসলে পর্ব্বত, কিন্তু মানুষ ইহাকে এইরূপ কাজে লাগাইয়াছে। ইহা সেই শ্রেণীর পর্ব্বত—সেই পাষাণস্তূপ, যাহা অত্রত্য ভূভাগের একটা বিস্ময়জনক অপূর্ব্ব বিশেষত্ব। পূর্ব্বতন রাজাদিগের ও জনসাধারণের চিত্তে বিরাট পদার্থের জন্য—অলৌকিক পদার্থের জন্য যে একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল, তাহা এই ক্ষেত্রে পূর্ণমাত্রায় পরিতৃপ্ত হইয়াছে। প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড শিলারাশির মধ্যে অসংখ্য প্রাচীর পরস্পরকে বেষ্টন করিয়া আছে—পরস্পরের উপর চাপিয়া আছে;—উহাদের দন্তুর রেখাবলী পরস্পরের সহিত জড়াইয়া গিয়াছে। যে সকল গণ্ডশৈল দুঃসাহসীর ন্যায় অতিমাত্র ঝুঁকিয়া আছে, তাহাদের ঠিক ধারেই বুরুজসকল সম্মুখে প্রসারিত;—নীচে অতলস্পর্শ খাত। উচ্চতার বিভিন্ন ধাপে,—কত মস্‌জিদ, কত জটিল-নক্‌সার খিলান, কত প্রকাণ্ড পোস্তার গাঁথুনি। খেয়ালের ঝোঁকেই হউক, কিম্বা কোন উপধর্ম্মের খাতিরেই হউক,—সর্ব্বোচ্চ শিখরের উপর একটা গণ্ডশৈল এরূপভাবে স্থাপিত যে, মনে হয় যেন একটা গোলাকার পশু চূড়ার উপরে আসনপিঁড়ি হইয়া বসিয়া আছে।

 এই মৃতনগরের প্রবেশপথে ধাতু ও পাথরের গোলাগুলি স্তূপাকারে সজ্জিত এবং পুরাকালীন সমস্ত যুদ্ধ-আয়োজন প্রস্তুত রহিয়াছে;—ইহাদেরি পাশাপাশি “পুনরাবৃত্তিকারী” আধুনিক বন্দুকসকল পুঞ্জীকৃত। নিজামের সিপাইশান্ত্রীরা পাহারা দিতেছে। প্রবেশপথে উহাদিগকে প্রবেশানুমতিপত্র দেখাইতে হয়। এই সমস্ত ভগ্নাবশেষের মধ্যে ইচ্ছা করিলেই প্রবেশ করা যায় না; এখনও উহা দুষ্প্রবেশ্য দুর্গরূপে বিদ্যমান। শোনা যায়, নিজাম তাঁহার গুপ্তনিধি এইখানেই লুকাইয়া রাখিয়াছেন।

 এই গল্কণ্ডার দ্বারগুলি অতীব ভীষণ;—বহুলোকের সমবেত চেষ্টা ভিন্ন উহা উদ্ঘাটিত হয় না। প্রাকারভিত্তির গভীরদেশে দ্বারের ভাজওয়ালা জোড়া-কপাটগুলি দেওয়ালের গায়ে সংলগ্ন, ধাতুপত্রে মণ্ডিত এবং লম্বা-লম্বা ছোরার মত তীক্ষ্ণধার লৌহকণ্টকে সমাকীর্ণ। পূর্ব্বকালে। হস্তিগণ আত্মবিনোদনার্থ নগরের মধ্যে দলে-দলে প্রবেশপূর্ব্বক দন্তের দ্বারা অনেক কাঠের কাজ নষ্ট করিয়া বিস্তর ক্ষতি করিত। উহাদিগকে অপসারিত করিবার জন্যই দ্বারের কপাটগুলি এইরূপ ভীষণ বর্ম্মে আবৃত। আমার ক্ষুদ্র যানবাহন যখন এই নগরের মধ্যে প্রবেশ করিল (যদিও কোচম্যানের মাথায় জরির পাগড়ি ছিল এবং সহিস একটা লম্বা চামর মইয়া ঘোড়ার গাত্র হইতে মাছি তাড়াইতেছিল), তখনই আমাদের য়ুরোপীয় ক্ষুদ্র ও দীনহীনতা সহসা প্রকাশ হইয়া পড়িল!•••

 এই-সব স্থূলকায় প্রাচীর হইতে বাহির হইয়া প্রথমেই যে রাস্তায় আসিয়া পড়িলাম, সেই রাস্তাটিতেই যা-কিছু লোকের বসতি। কতকগুলি নিঃস্ব লোক প্রাসাদের ভগ্নাবশেষের মধ্যে বাসা করিয়া আছে এবং সেইখানে উহারা দুর্গরক্ষী সৈনিকদিগের ব্যবহারার্থ দুইচারিখানি সামান্য দোকান খুলিয়াছে।

 তা ছাড়া, এই বিশাল ঘেরের মধ্যে আর সমস্তই শূন্য ও নিস্তব্ধ। গল্ক ণ্ডা এখন শুধু ভস্মাচ্ছন্ন একটা শ্মশানক্ষেত্র,—স্বস্থানচ্যুত গণ্ডশৈলে সমাকীর্ণ। প্রকাণ্ডকায় সুপ্ত পশুর পৃষ্ঠদেশের ন্যায় সেই সব পাষাণস্তুপ —যাহা মানবগঠিত পদার্থ অপেক্ষা অধিকতর ঘাতপ্রতিরোধী—ইতস্তত উথিত হইয়াছে; সেই সব গোলাকার মসৃণ গণ্ডশেল,—যাহা সমস্ত দেশময় পরিব্যাপ্ত - -পর্বতের ন্যায় ইতস্তত মাথা তুলিয়া আছে।[]  এই দুর্গনগরের দ্বারগুলিও নিম্নস্থ প্রাকারদ্বারের ন্যায় ভীমদর্শন ও লৌহকণ্টকে আচ্ছাদিত। দুর্গাদি অতিক্রম করিয়া, গণ্ডশৈলসমূহ অতিক্রম করিয়া, কখন খোলা-পথে,কখন বা অন্ধকার-সিড়ি দিয়া উপরে উঠিতে হয়। সমস্তই এরূপ বিশাল যে, দেখিয়া হতবুদ্ধি হইতে হয়। যে ভারতে প্রকাণ্ড পদার্থ দেখিয়া আর বিস্ময় উৎপন্ন হয় না, সেই ভারতের পক্ষেও এ সমস্ত প্রকাণ্ড বলিয়া মনে হয়। দন্তুর প্রাকারাবলী, নৈসর্গিক গণ্ডশৈলসমূহ পর্যায়ক্রমে উপযুপরি উথিত হইয়া সমস্ত স্থানটিকে দুর্গম করিয়া তুলিয়াছে। অবরোধের সময়ে, জলরক্ষণের জন্য কতকগুলি গভীর-নিখাত চৌবাচ্ছা রহিয়াছে। এই গভীর গহ্বরগুলি শৈলগাত্র খনন করিয়া নির্ম্মিত। তা ছাড়া, কতকগুলা কালো-কালো গর্ত্ত রহিয়াছে—যাহা সুরঙ্গপথের মুখ। এই সুরঙ্গটি পর্ব্বতের হৃদয় ভেদ করিয়া চলিয়া গিয়াছে। যখন শত্রুর আক্রমণে হতাশ হইয়া পলায়ন ভিন্ন আর কোন উপায় থাকে না, তখন এই সুরঙ্গটিই পলায়নের প্রকৃষ্ট পথ। শেষদিন পর্য্যন্ত যাহাতে ভজনার ব্যাঘাত না হয়, এইজন্য উচ্চ হইতে উচ্চতর প্রত্যেক শিখরে একএকটি মজিদ রহিয়াছে। যাহাতে দীর্ঘকাল পর্য্যন্ত অসংখ্য শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করা যাইতে পারে, এই উদ্দেশ্যে কল্পনাচক্ষে বাস্তববৎ প্রত্যক্ষ করিয়াই যেন সমস্ত আয়োজন পূর্ব্ব হইতে সজ্জিত।

 আধুনিক কামানসৃষ্টির তিন শতাব্দী পূৰ্বে গণ্ডাব প্রবলপবাক্রান্ত সুলতানগণ এই দুর্গ হইতে কিরূপে দূরীকৃত হইয়াছিলেন, তাহা বুঝা কঠিন।

 যতই উচ্চে উঠা যায়, ততই মাথার উপর সূর্যের প্রখর উত্তাপ,—ততই যেন চতুর্দিস্থ মরুদৃশ্যের বিষাদময় মণ্ডলপরিধিটি বিস্তৃত হইতে থাকে। শিখরস্থ ইমারৎগুলি উচ্চতা অনুসারে একদিকে যেমন অধিকতর ভীমদর্শন, তেমনি আবার ভগ্নদশাপন্ন। উহারা এতটা ঝুঁকিয়া আছে যে, দেখিলে মাথা ঘুরিয়া যায় মনে হয় যেন নীচে পড়িবার জন্য উন্মুখ। কত ভাঙা খিলান;—তাহাতে প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড ফাট ধরিয়াছে। কতকগুলি দেবমন্দিরের ভগ্নাবশেষ রহিয়াছে যাহার উদ্দেশ্য অথবা নির্মাণকাল কিছুই নির্ণয় করা যায় না। ইসলামের পূর্ব্ববর্তী কাল হইতে কতকগুলা দেবমূর্তি -বানরমুণ্ডধারী কতকগুল হনুমান্;—বাদুড়দিগের সহিত গুহাগহ্বরের মধ্যে একত্র বাস করিতেছে। ছোট-ঘোট ধূপবর্তিকার মগন্ধে স্থানটি আমোদিত। রহস্যময় ভক্তগণ এখনও বোধ হয় সময়ে-সময়ে এই ধূপবর্তিকাগুলি এখানে গোপনে লইয়া আইসে।

 সর্ব্বোচ্চ-শিখরে, শেষ ছাদটির উপর একটি মসজিদ রহিয়াছে এবং একটি চতুক (Kiosk) *যেখান হইতে পূর্ব্বতন সুষ্ঠানের সমস্ত দেশ পরিবীক্ষণ এবং দিগন্তনিঃসৃত শত্রুবাহিনীর আগমন নিরীক্ষণ করিতেন। মাঠ-ময়দান উদ্যান-উপবন প্রভৃতি যে সমস্ত দৃশ্য এখান হইতে দেখা যায়, সমস্তই তখনকার কালে প্রসিদ্ধ ছিল। কিন্তু আজ এই সমস্ত ক্ষেত্র নিৰ্জীব ও প্রাণশূন্য।

 দেশের হাওয়া বদলাইয়াছে। আর এখন বৃষ্টি হয় না। বেশ মনে হয়, অনাবৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ভারতের অবনতি হইতেছে—ভারত অবসন্ন হইয়া পড়িতেছে। এই সমস্ত গণ্ডশৈল ও প্রাকারাবলীর পরপারে অবস্থিত দুর্গনগরটি, মানিস্তব্ধতার মধ্যে,—ভূতল পর্য্যন্ত নামিয়া গিয়াছে। নগরের বহিঃপ্রাচীর,— নিজামের সংরক্ষিত সেই দস্তুর প্রাচীরটি, প্রাচীন গল্কণ্ডার—সেই পরমাশ্চর্য্য হীরকখনি গল্কার গঠনরেখাভঙ্গী অঙ্কিত করিবার জন্যই যেন আঁকিয়া-বাঁকিয়া বহুদূর পর্য্যন্ত প্রসর্পিত হইয়াছে। কিন্তু জিজ্ঞাসা কবি, ইহাতে লাভ কি? বাহিরের বিস্তীর্ণ মরুক্ষেত্রেরই

 চতুষ্কন চতুস্তম্ভযুক্ত মণ্ডপ। বোধ হয় এই ফার্সি শব্দ (Kiosk) “চতুষ্কশব্দেরই অপভ্রংশ। Kiosk= girlen summer-house অর্থাৎ “হাওয়া-খানা"। অনুবাদ। অনুরূপ এই যে মরুময় কটিবন্ধটি – ইহাকে বিশেষ করিয়া প্রাচীরে ঘিরিয়া রাখায় কি ফল? এখানেও সেই একই ধূসর মরুভূমি-সেই একই মসৃণ গণ্ডশৈলপুঞ্জ—যাহা দেখিয়া মনে হয়, যেন ভন্মরাশির উপর কতকগুলা বৃহৎকায় পশু দলে-দলে বসিয়া আছে। সুদূরপ্রান্তে হৈদরাবাদ দীর্ঘ শাদারেখার ন্যায় অস্পষ্ট দেখা যাইতেছে; এবং ময়দানভূমির সীমান্তদেশে এই সব গণ্ডশৈল—ছিন্নাঙ্গ পর্ব্বতের আকারে বিচিত্রভঙ্গী দুর্গের আকারে ইতস্তত পুঞ্জীকৃত হইয়া ধ্বংসনগরের বিভ্রমটিকে যেন আরো দীর্ঘীকৃত করিয়া সুদূর অসীমে প্রসারিত হইয়াছে।

 কিন্তু এই মৃতনগরের প্রাচীর ছাড়াইয়া অদূরে কতকগুলি বড়-বড় গম্বুজ রহিয়াছে, যাহা সুধালেপের দ্বারা সযত্নে ধবলীকৃত এবং যাহাতে ভগ্নাবশেষের ভাব কিছুমাত্র নাই। ছোট-ছোট বনের মধ্য হইতে এই গম্বুজগুলি সমুথিত। এই সব বনের উদ্ভিজ্জ এরূপ সরস ও তাজা যে, এই তাপদগ্ধ শুভূমিতে কিরূপে উৎপন্ন হইল, ভাবিয়া বিস্মিত হইতে হয়। এগুলি গল্কার প্রাচীন রাজাদিগের সমাধিমন্দির। মৃত ব্যক্তিদিগের প্রতি ভারতবাসীর যে স্বাভাবিক শ্রদ্ধাভক্তি, তাহারি প্রভাবে এই সকল সমাধিমন্দির অক্ষত রহিয়াছে। আবার সম্প্রতি উহার চারিধারে সমাধি-উদ্যান স্থাপিত রহিয়াছে।

 এই পরীরাজ্যের অনেক সুলতান সুলতানাই এই সব গম্বুজতলে চিরনিদ্রায় মগ্ন। কেবল উহাদের মধ্যে একজন এই নীরব সঙ্গীদিগের সহবাস হইতে বঞ্চিত; ইনি গল্কার শেষ সুলতান। ইনি পুর্ব্ব হইতেই স্বকীয় পারত্রিক নিবাস প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছিলেন। কিন্তু বিজয়ী ঔরঙ্গজেব তাহাকে তাহার রাজ্য হইতে দুরীকৃত করিয়া সেই সঙ্গে তাঁহার সমাধিমন্দির হইতেও তাঁহাকে বহিস্কৃত করিলেন। তিনি নির্বাসিত হইয়া প্রবাসেই ইহলীলা সংবরণ করেন।

 এই চিরবিশ্রামের স্থানগুলি অতীব সুন্দর। আমাদের দেশের ন্যায় এই প্রাচ্য সমাধিক্ষেত্রেও সেই “সাইপ্রেস"-ঝাউগাছগুলি দেখিতে পাওয়া যায়;—কেবল ভারতের প্রখর সূর্য্যোত্তাপে একটু ম্লানপ্রভ হইয়াছে, এইমাত্র। ফ্রাসের “সেকেলে” উদ্যানের ন্যায়, অত্রত্য উদ্যানেও, সরু-সরু বালির পথগুলি সোজা চলিয়াছে; উহার ধারে-ধারে আলবালভূমিতে সারি-সারি গোলাপগাছ। কতকগুলি রমণী ও কতকগুলি বালিকা এই কৃত্রিম মরু-উদ্যানের রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত। উহারা প্রাতঃসন্ধ্যা দুই বেলা মাটির কলসীতে কোন কূপবিশেষের দুর্লভ জল আনিয়া এই সব গাছের তলায় ঢালিয়া দেয়; এবং এই সব অতলস্পর্শ গভীর কূপ হইতে পুরুষেরা অতি কষ্টে উহাদের জন্য জল উত্তোলন করে।

 দুর হইতে মনে হয়, যেন এই সব সুধালিপ্ত গম্বুজগুলি জীবন-উদ্যমে পূর্ণ। কিন্তু এই সব বিশাল মসজিদের অভ্যন্তরে একটিও চিত্র নাই, একটিও অলঙ্কার নাই। পূর্ব্বেকার সমস্ত বিলাসসামগ্রী এক্ষণে পসর জরাজীর্ণতার মধ্যে বিলীন হইয়া গিয়াছে।

 তথাপি, এই সব শূন্যগর্ভ গম্বুজের নীচে, সমাধিস্থানের প্রত্যেক প্রস্তর-বেদিকার উপর, এখনও পুষ্পমাল্যাদি দেখিতে পাওয়া যায়। তিনশত বৎসর হইতে যে রাজবংশ বিলুপ্ত হইয়াছে, সেই রাজবংশীয় রাজাদিগের গতি শ্লাঘ্য ভক্তির নিদর্শনস্বরূপ এই পূজাপুস্পাঞ্জলি।

 তাপদগ্ধ মরুভূমির মধ্যে শুধু জলসেকের বলে এই যে উদ্যানগুলি সংরক্ষিত-ইহাদের কি-একটা অপূর্ব্ব মোহিনী শক্তি আছে; ইহাদের দেখিলে, স্বদেশে ফিরিবার জন্য কেমন-একটা ব্যাকুলতা উপস্থিত হয়। এই সব উদ্যানে সাইপ্রেস্‌-ঝাউ প্রতিবেশী তালীবনের সহিত একত্র বাস করিতেছে; এবং গোলাপ-আলবালের চারিপারে, আমাদের দেশে প্রজাপতিরা যেরূপ পুষ্প হইতে পুষ্পস্তরে উড়িয়া বসে, এখানে সেইরূপ মনিয়া-চড়াই ফুলের উপর উড়িয়া-উড়িয়া বসিতেছে।

  1. নিজামরাজ্যের এই সব গঙশৈলসম্বন্ধে একটা পৌরাণিকী কথা প্রচলিত আছে। পৃথিবীর সৃষ্টি শেষ হইয়া গেলে ঈশ্বর যখন দেখিলেন, কতকগুলা অতিরিক্ত উপকরণ উদ্বৃত্ত হইছে, তখন তিনি এই সমস্ত লইয়া, হাতে গোলা পাকাইয়া, সেই সব গোলোকপিণ্ড পৃথিবীর উপ-এই প্রদেশে-ইতস্তত নিক্ষেপ করিলেন।