ইংরেজ ডাকাত/সপ্তম পরিচ্ছেদ
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
পরদিবস, অর্থাৎ ইংরাজী ১৮৮৯ সালের ৭ই মার্চ্চ তারিখের প্রাতঃকালে প্রথমে বালি, পরে কোন্নগর ষ্টেশনে গিয়া পলায়িত কয়েদীদ্বয়ের অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কোনরূপ সংবাদ না পাইয়া শ্রীরামপুর ষ্টেশনে গমন করিলাম। এ স্থানের ষ্টেশনমাষ্টার একজন ইংরাজ। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করায় জানিলাম যে, ৬ই মার্চ্চ তারিখের প্রাতঃকালে দুইজন ইংরাজ (যাহাদের আকৃতি-প্রকৃতি, হিলি ও ওয়ার্ণারের সহিত কতক মিলিল) আসানসোলের দুইখানি টিকিট লইয়া হাবড়া হইতে প্রথম যে গাড়ি ছাড়ে, সেই গাড়িতে গমন করিয়াছে। এই সংবাদ মনে লাগিল; কারণ, তাহার পূর্ব্বে অর্থাৎ ৫ই মার্চ্চের রাত্রিতেই উহারা পলায়ন করিয়াছে।
এই সংবাদ পাইয়া প্রথমে যে ট্রেণ পাইলাম, সেই ট্রেণে আসানসোল গমন করিলাম। সেইস্থানের অনুসন্ধানে অবগত হইলাম যে, ৬ই মার্চ্চ তারিখে কোন ব্যক্তি শ্রীরামপুরের টিকিট লইয়া তথায় অবতরণ করে নাই। সেইস্থানে অন্যান্য লোকের নিকট অনুসন্ধান করিয়া, কোন সংবাদ না পাওয়াতে বর্দ্ধমানে ফিরিয়া আসিলাম। বর্দ্ধমানে যে সকল ব্যক্তি গাড়ির ভিতর টিকিট পরীক্ষা করে, তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়াও কোন সংবাদ পাইলাম না। পরিশেষে অনন্যোপায় হইয়া রাত্রি বারটার সময় কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিলাম।
৮ই মার্চ্চ প্রত্যুষে পাঁচটার সময় কলিকাতা হইতে বহির্গত হইলাম। মনে করিলাম, প্রথমে বর্দ্ধমানে গিয়া ট্রেণ হইতে অবতরণ করিব, ও সেইস্থান হইতে প্রত্যেক ষ্টেশনে আগমন পূর্ব্বক ক্রমে হাবড়ায় আসিয়া উপস্থিত হইব। এই কার্য্যে যে কয়েকদিবস অতিবাহিত হইবেক, তাহার মধ্যে আর কলিকাতায় ফিরিব না।
প্রত্যুষে ছয়টার গাড়িতে আরোহণ করিয়া দশটার সময় বর্দ্ধমান ষ্টেশনে অবতরণ করিলাম। দেখিলাম, প্লাটফরমের উপর আমাদিগের এইস্থানের একজন ইংরাজ ইনস্পেক্টর “হাবিৎ” সাহেব ও একজন ইংরাজ কনষ্টেবল “ডালসুরি” সাহেব দণ্ডায়মান। আমাকে দেখিয়াই হাবিৎ সাহেব কহিলেন, “তোম্ কঁহা যাতা হয়”।
আমি। তোমরাও যে কার্য্যে যাইতেছ, আমিও সেই কার্য্যের নিমিত্ত যাইতেছি।
হাবিৎ। এ কালা বাঙ্গালি আছে না, যে তুই ধর্বি; ও ইংরাজ আছে, ও গোরা আছে, উস্কো পাস্ পিস্তল আছে। উস্কো পাকড়না তোমার কাম নেহি হায়, উস্কা পাকড়না হাম্ লোক্কা কাম—সাহেব লোক্কা কাম।
আমি। আচ্ছা সাহেব তুমিই পাক্ড়িও।
হাবিৎ। হাম্ জরুর পাক্ড়েগা। হামরা পেট তোমারা মাফিক মোটা নেহি হ্যায়। আর হাম্ তোমারা মাফিক উস্কো নজদিক্ জাতে ডরতা নেই।
আমি। আমরা বাঙ্গালি, সকল কাজেই আমাদিগের ভয়, তা’তে আবার উহাদিগের নিকট পিস্তল আছে, বলিতেছ। এরূপ অবস্থায় আমি না হয়, উহাদিগকে না ধরিতেই পারিব; কিন্তু তোমরা সাহসী ইংরাজ, তোমরা ত ধরিতে পারিবে। আমি না হয়, তোমাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ থাকিব।
হাবিৎ। হাঁ, হাম্ তোম্কো বহুত রোজসে জান্তা হায়, তোম্ আচ্ছা আদ্মি হ্যায়। তেম্ হামরা সৎ সৎ রহ, হাম্ যাঁহা যায়েগা, হামারা সাৎ চল। যব হাম্ উস্কো পাক্ড়েগা, তোম্কে হাম্ জরুর সাত্করকে লে যায়েগা। ইস্মে বহুৎ রূপেয়া এনাম হ্যায়, ঐ রূপেয়া সে হাম্ তোম্কো কুছ দেগা। হাম্ রূপেয়া নেই মাংতা হ্যায়, হাম্ নাম মাংতা, ক্রেডিট (Credit) মাংতা।
আমি। আচ্ছা সাহেব তা’ই হবে, আমি তোমার সঙ্গেই থাক্ব। এ ইংলণ্ড নয়, এ বাঙ্গালা দেশ, এইস্থানে কিরূপ উপায়ে তোমরা পলাতক কয়েদীদিগের অনুসন্ধান কর, তাহা দেখিতে আমার বড়ই ইচ্ছা হইয়াছে। তোমরা বীরপুরুষ, তাহা আমি জানি; কিন্তু তোমার বুদ্ধির জোর কতদূর, তাহা এইবার দেখা যাইবে।
এই বলিয়া আমি সেই স্থানে দাঁড়াইলাম। প্রথমে হাবিৎ সাহেব এইরূপ দুই চারি কথা আমাকে কহিলেন। ডালসুরি নূতন লোক, তিনি চুপ্ করিয়াই আমাদিগের কথোপকথন শুনিতে লাগিলেন। আমি যে ট্রেণে গমন করিয়াছিলাম, সেই ট্রেণ বর্দ্ধমান ষ্টেশন ছাড়িয়া পশ্চিমাভিমুখে চলিয়া গেল। সেই সময় কলিকাতাভিমুখ হইতে একখানি মাল-গাড়ি আসিয়া, বর্দ্ধমান ষ্টেশনে উপস্থিত হইল। সেই সময় হাবিৎ সাহেব বাঙ্গালা মিশ্রিত হিন্দিকথা পরিত্যাগপূর্ব্বক, ইংরাজী কথাতেই আমাদিগের সহিত সেই পলাতক কয়েদী সম্বন্ধে গল্প করিতেছিলেন। হিলি কিরূপ বলশালী, কিরূপ চতুর, এবং কিরূপ দুর্বৃত্ত, তাহাই আমাদিগকে বুঝাইতেছিলেন। আরও বুঝাইতেছিলেন যে, তিনি বিশেষরূপে অবগত হইয়াছেন যে, হিলি ও ওয়ার্ণার পিস্তল সঙ্গে লইয়া জেল হইতে বহির্গত হইয়াছে।
দিবা এগারটার সময় উক্ত মাল-গাড়ির গার্ড পামর সাহেব আসিয়া আমাদিগের সহিত যোগ দিলেন। তিনি আগমন করায় আমাদিগের গল্প ভঙ্গ হইল। পামর সাহেব কহিলেন, “আমি যখন মাল-গাড়ি লইয়া আসিতেছিলাম, সেই সময়ে বৈঁচি ও দেবিপুর ষ্টেশনের মধ্যে দুইজন ইংরাজকে পদব্রজে আসিতে দেখিয়াছি। আমার বোধ হয়, আপনারা সেই দুই ব্যক্তিরই অনুসন্ধান করিতেছেন।”
পামরের কথা শুনিয়া আমরা আর স্থির থাকিতে পারিলাম; তিনজনেই তখন এক হইয়া এই পরামর্শ করিলাম যে, আমরা মেমারি ষ্টেশনে অবতরণ পূর্ব্বক পদব্রজে পূর্ব্বকথিত ষ্টেশন দ্বয় অভিমুখে গমন করিব। তাহা হইলে সেই দুই ব্যক্তিকে নিশ্চয় পথের উপরেই পাইব।