ইন্দিরা/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

 যখন আমার চৈতন্য হইল, তখন কাক কোকিল ভাকিতেছে। বংশপত্রাবচ্ছেদে বালারুণকিরণ ভূমে পতিত আমি গাত্রোত্থান করিয়া গ্রামানুসন্ধানে গেলাম। কিছু দূর গিয়া এক খানি গ্রাম পাইলাম। আমার পিত্রালয় যে গ্রামে, সেই গ্রামের সন্ধান করিলাম; আমার শ্বশুরালয় যে গ্রামে, তাহারও সন্ধান করিলাম। কোন সন্ধান পাইলাম না। দেখিলাম, আমি ইহার অপেক্ষা বনে ছিলাম ভাল। একে লজ্জায় মুখ ফুটিয়া পুরুষের সঙ্গে কথা কহিতে পারি না, যদি কই, তবে সকলেই আমাকে যুবতী দেখিয়া আমার প্রতি সতৃষ্ণ কটাক্ষ করিতে থাকে। কেহ ব্যঙ্গ করে—কেহ অপমান সূচক কথা বলে। আমি মনে২ প্রতিজ্ঞা করিলাম, “এই খানে মরি, সেও ভাল; তবু আর পুরুষের নিকট কোন কথা জিজ্ঞাসা করিব না।” স্ত্রীলোকেরা কেহ কিছু বলিতে পারিল না—তাহারাও আমাকে জন্তু মনে করিতে লাগিল। বোধ হয়, কেননা তাহারাও বিস্মিতের মত চাহিয়া কেবল এক জন প্রাচীনা বলিল, “মা, তুমি কে? অমন সুন্দর মেয়ে কি পথে ঘাটে একা বেরুতে আছে? আহা মরি, মরি, কি রূপ গা? তুমি আমার ঘরে আইস।” তাহার ঘরে গেলাম। সে আমাকে ক্ষুধাতুরা দেখিয়া খাইতে দিল। সে মহেশপুর চিনিত। তাহাকে আমি বলিলাম যে, তোমাকে টাকা দেওয়াইব —তুমি আমাকে রাখিয়া আইস।” তাহাতে সে কহিল যে, আমার ঘর সংসার ফেলিয়া যাইব কি প্রকারে? তখন সে যে পথ বলিয়া দিল, আমি সেই পথে গেলাম। সন্ধ্যা পর্য্যন্ত পথ হাঁটিলাম—তাহাতে অত্যন্ত শ্রান্তি বোধ হইল। এক জন পথিককে জিজ্ঞাসা করিলাম, “হাঁ গা, মহেশপুর এখান হইতে কত দূর?” সে আমাকে দেখিয়া স্তম্ভিতের মত রহিল। অনেক ক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিল, “তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?” যে গ্রামে প্রাচী্না আমাকে পথ বলিয়া দিয়াছিল, আমি সে গ্রামের নাম করিলাম। তাহাতে পথিক কহিল যে, “তুমি পথ ভুলিয়াছ। বরাবর উল্টা আসিয়াছ। মহেশপুর এখান হইতে দুই দিনের পথ।”

 আমার মাথা ঘুরিয়া গেল। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি কোথায় যাইবে?” সে বলিল, “আমি এই নিকটে গৌরীগ্রামে যাইব।” আমি অগত্যা তাহার পশ্চাৎ২ চলিলাম।

 গ্রামমধ্যে প্রবেশ করিয়া সে আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি এখানে কাহার বাড়ী যাইবে?” আমি কহিলাম, “আমি এখানে কাহাকেও চিনি না। একটা গাছ তলায় শয়ন করিয়া থাকিব।”

পথিক কহিল, “তুমি কি জাতি??
আমি কহিলাম, “আমি কায়স্থ।”

 সে কহিল, “আমি ব্রাহ্মণ। তুমি আমার সঙ্গে আইস। তোমার ময়লা মোটা কাপড় বটে, কিন্তু তুমি বড় ঘরের মেয়ে। ছোট ঘরে এমন রূপ হয় না।”

 ছাই রূপ! ঐ রূপ, রূপ, শুনিয়া আমি জ্বালাতন হইয়া উঠিয়াছিলাম। কিন্তু এ ব্রাহ্মণ প্রাচীন, আমি তাহার সঙ্গে গেলাম।

 আমি সে রাত্রে ব্রাহ্মণের গৃহে, দুই দিনের পর একটু বিশ্রাম লাভ করিলাম। পর দিন প্রাতে উঠিয়া দেখিলাম যে, আমার অত্যন্ত গাত্র বেদনা হইয়াছে। পা ফুলিয়া উঠিয়াছে; বসিবার শক্তি নাই।

  যত দিন না গাত্রের বেদনা আরাম হইল, ততদিন আমাকে কাজে কাজেই ব্রাহ্মণের গৃহে থাকিতে হইল। ব্রাহ্মণ ও তাঁহার গৃহিণী আমাকে যত্ন করিয়া রাখিল। কিন্তু মহেশপুর যাইবার কোন উপায় দেখিলাম না। কোন স্ত্রীলোকেই পথ চিনিত না, অথবা যাইতে স্বীকার করিল না। পুরুষে অনেকেই স্বীকৃত হইল-কিন্তু তাহা- দিগের সঙ্গে একাকিনী যাইতে ভয় করিতে লাগিল। ব্রাহ্মণও নিষেধ করিলেন। বলিলেন, “উহাদিগের চরিত্র ভাল নহে, উহাদিগের সঙ্গে যাইও না। উহাদের কি মতলব বলা যায় না। আমি ভদ্র সন্তান হইয়া তোমার ন্যায় সুন্দরীকে পুরুষের সঙ্গে কোথাও পাঠাইতে পারি না।” সুতরাং আমি নিরস্ত হইলাম।


 একদিন শুনিলাম যে ঐ গ্রামের কৃষ্ণদাস বসু নামক একজন ভদ্রলোক সপরিবারে কলিকাতায় যাইবেন। শুনিয়া আমি ইহা উত্তম সুযোগ বিবেচনা করিলাম। কলিকাতা হইতে আমার পিত্রালয় এবং শ্বশুরালয় অনেক দূর বটে, কিন্তু সেখানে আমার জ্ঞাতি খুল্লতাত বিষয় কর্থোপলক্ষে বাস করিতেন। আমি ভাবিলাম যে কলিকাতায় গেলে অবশ্য আমার খুল্লতাতের সন্ধান পাইব। তিনি অবশ্য আমাকে পিত্রালয়ে পাঠাইয়া দিবেন। না হয়, আমার পিতাকে সম্বাদ দিবেন।

  আমি এই কথা ব্রাহ্মণকে জানাইলাম। ব্রাহ্মণ বলি- লেন, “এ উত্তম বিবেচনা করিয়াছ। কৃষ্ণদাস বাবুর সঙ্গে আমার জানাশুনা আছে। আমি তোমাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া বলিয়া দিয়া আসিব। তিনি প্রাচীন, আর বড় ভাল মানুষ।”

  ব্রাহ্মণ আমাকে কৃষ্ণদাস বাবুর কাছে লইয়া গেলেন। বাহ্মণ কহিলেন, “এটি ভদ্রলোকের কন্যা। বিপাকে পড়িয়া পথ হারাইয়া এ দেশে আসিয়া পড়িয়াছেন। আ- পনি যদি ইহাঁকে সঙ্গে করিয়া কলিকাতায় লইয়া যান, তবে এ অনাখিনী আপন পিত্রালয়ে পঁহুছিতে পারে।” কৃষ্ণদাস বাবু সম্মত হইলেন। আমি তাঁহার অন্তঃপুরে গেলাম। পরদিন তাঁহার পরিবারস্থ স্ত্রীলোকদিগের সঙ্গে কলিকাতা যাত্রা করিলাম। প্রথম দিন চারি পাঁচ ক্রোশ হঁটিয়া গঙ্গাতীরে আসিতে হইল। পর দিন নৌ- কায উঠিলাম।

 কলিকায পঁহুছিলাম। কৃষ্ণদাস বাবু কালীঘাটে পূজা   দিতে আসিয়াছিলেন। ভবানীপুরে বাসা করিলেন। আ- মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন,

"তোমার খুড়ার বাড়ী কোথায়? কলিকাতায় না ভবা- নীপুরে?"

 তাহা আমি জানিতাম না।

 জিজ্ঞাসা করিলেন, “কলিকাতার কোন্ জায়গায় তাঁহার বাসা?

 তাহা আমি কিছুই জানিতাম না। আমি জানিতাম, যে মন মহেশপুর একখানি গগুগ্রাম, কলিকাতা তেমনি এক খানি গগুগ্রাম মাত্র। একজন ভদ্রলোকের নাম করি- লেই লোকে বলিয়াদিবে। এখন দেখিলাম যে, কলি- কাতা অনন্ত অটালিকার সমুদ্র বিশেষ। আমার জ্ঞাতি খুড়াকে সন্ধান করিবার কোন উপায় দেখিলাম না। কৃ- ষ্ণদাস বাবু আমার হইয়া অনেক সন্ধান করিলেন, কিন্ত কলিকাতায় একজন সামান্য গ্রাম্য লোকের ওরূপ সন্ধান করিলে কি হইবে?

  কৃষ্ণদাস বাবু কালীর পূজা দিয়া কাশী যাইবেন, কল্পন ছিল। পূজা দেওয়া হইল, এক্ষণে সপরিবারে কশী যাই- বার উদ্যেগ করিতে লাগিলেন। আমি কাঁদিতে লাগি- লাম। তিনি কহিলেন, “তুমি আমার কথা শুন। রাম রাম দত্ত নামে আমার একজন আত্মীয় লোক ঠনঠনিয়ায় বাস করেন। কল্য তাঁহার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল। তিনি বলিলেন, যে মহাশর আমার পাচিকার অভাবে বড় কষ্ট হইতেছে। আপনাদিগের দেশের অনেক ভদ্রলোকের মেয়ে পরের বাড়ী রাঁধিয়া খায়। অমাকে একটি দিতেপারে ন?” আমি বলিয়াছি, চেষ্টা দেখিব।” তুমি এ কার্য্য স্বীকার কর―নহিলে তোমার উপায় দেখি না। আমার এমত শক্তি নাই যে তোমায় আবার খরচ পত্র করিয়া কাশী লইয়া যাই। আর সেখানে গিয়াই বা তুকি কি করিবে? বরং এখানে থাকিলে তোমার খুড়ার সন্ধান করিতে পারিবে।”

  অগত্যা স্বীকৃত হইতে হইল, কিন্তু রাত্রিদিন “রূপ! রপ! শুনিয়া আমার কিছু ভয় হইয়াছিল। পুরুষজাতি মাত্র আমার শত্রু বলিয়া বোধ হইয়াছিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,

  রাম রাম বাবুর বয়স কত?”

 উ। “তিনি আমার মত প্রাচীন।”

 “তাঁহার স্ত্রী বর্ত্তমান কি না?”

 উ। “দুইটি।”

 “অন্য পুরুষ তাঁহার বাড়ীতে কে থাকে?”

 উ। “তাঁহার দ্বিতীয় পক্ষের পুত্র অবিনাশ,বয়স দশ বৎসর। আর একটি অন্ধ ভাগিনেয়।”

  আমি সম্মত হইলাম। পর দিন কৃষ্ণদাস বাবু আমাকে রাম রাম দত্রের বাড়ী পাঠাইয়া দিলেন। আমি তাঁহার বাড়ী পাচিকা হইয়া রহিলাম। শেষে কপালে এই ছিল! রাঁধিয়া খাইতে হইল।