ইন্দিরা (১৮৭৩)/প্রথম পরিচ্ছেদ
ইন্দিরা।
প্রথম পরিচ্ছেদ।
অনেক দিনের পর আমি শ্বশুর বাড়ী যাইতেছিলাম। আমি উনিশ বৎসরে পড়িয়াছিলাম, তথাপি এ পর্য্যন্ত শ্বশুরের ঘর করি নাই। তাহার কারণ, আমার পিতা ধনী, শ্বশুর দরিদ্র। বিবাহের কিছু দিন পরেই শ্বশুর আমাকে লইতে লোক পাঠাইয়াছিলেন, কিন্তু পিতা পাঠাইলেন না। বলিলেন, “বিহাইকে বলিও, যে, আগে আমার জামাতা উপার্জ্জন করিতে শিখুক—তার পর বধূ লইয়া যাইবেন—এখন আমার মেয়ে লইয়া গিয়া খাওয়াইবেন কি?” শুনিয়া আমার স্বামীর মনে বড় ঘৃণা জন্মিল —তাহার বয়স তখন ২০ বৎসর, তিনি প্রতিজ্ঞা করিলেন, যে স্বয়ং অর্থোপার্জ্জন করিয়া পরিবার প্রতিপালন করিবেন। এই ভাবিয়া তিনি পশ্চিমাঞ্চলে যাত্রা করিলেন। তখন রেইল হয় নাই—পশ্চিমের পথ অতি দুর্গম ছিল। তিনি পদব্রজে, বিনা অর্থে, বিনা সহায়ে, সেই পথ অতিবাহিত করিয়া, পঞ্জাবে গিয়া উপস্থিত হইলেন। যে ইহা পারে, সে অর্থ উপার্জ্জন করিতেও পারে। স্বামী অর্থোপার্জ্জন করিতে লাগিলেন—বাড়ীতে টাকা পাঠাইতে লাগিলেন—কিন্তু সাত আট বৎসর বাড়ী আসিলেন না, বা আমার কোন সম্বাদ লইলেন যে সময়ে আমার ইতিহাস আরম্ভ করিতেছি, তাহার কিছু পূর্ব্বে তিনি বাড়ী আসিলেন। রব উঠিল যে, তিনি কোমিসেরিয়েটের (কমিসেরিয়েট্ বটে ত?) কর্ম্ম করিয়া অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিপতি হইয়া আসিয়াছেন। আমার শ্বশুর আমার পিতাকে লিখিয়া পাঠাইলেন, “আপনার আশীর্ব্বাদে উপেন্দ্র (আমার স্বামীর নাম উপেন্দ্র— নাম ধরিলাম, প্রাচীনারা মার্জ্জনা করিবেন; হাল আইনে। তাঁহাকে আমার “উপেন্দ্র” বলিয়া ডাকাই সম্ভব)— বধূমাতাকে প্রতিপালন করিতে সক্ষম। পালকী বেহারা পাঠাইলাম, বধূমাতাকে এ বাটীতে পাঠাইয়া দিবেন। নচেৎ আজ্ঞা করিলে পুত্রের বিবাহের আবার সম্বন্ধ করিব।”
পিতা দেখিলেন, নুতন বড়মানুষ বটে। পাল্কী খানার ভিতরে কিংখাপ মোড়া, উপরে রুপার বিট, বাট রুপার হাঙ্গরের মুখ। দাসী মাগী যে আসিয়াছিল, সে গরদ পরিয়া আসিয়াছে, গলায় বড় মোটা সোনার দানা। চারিজন কালো দাড়িওয়ালা ভোজপুরে পাল্কীর সঙ্গে আসিয়াছিল।
আমার পিতা হরমোহন দত্ত বুনিয়াদি বড়মানুষ। হাসিয়া বলিলেন, “মা, ইন্দিরে! আর তোমাকে রাখিতে পারি না। এখন যাও, আবার শীঘ্র লইয়া আসিব। দেখ, আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ দেখিয়া হাসিও না।”
তাই আমি শ্বশুর বাড়ী যাইতেছিলাম। আমার শ্বশুর বাড়ীমনোহরপুর। আমার পিত্রালয় মহেশপুর; উভয় গ্রামের মধ্যে দশ ক্রোশ পথ। সুতরাং প্রাতে আহার করিয়া যাত্রা করিয়াছিলাম, পৌঁছিতে পাঁচ সাত দণ্ড রাত্রি হইবে, জানিতাম।
পথে কালাদীঘি নামে এক বৃহৎ দীর্ঘিকা আছে। তাহার জল প্রায় অর্দ্ধক্রোশ। পাহাড় পর্ব্বতের ন্যায় উচ্চ। তাহার ভিতর দিয়া পথ। চারি পার্শ্বে বট গাছ। তাহার ছায়া শীতল, জল নীলমেঘের মত, দৃশ্য অতি মনোহর। তথায় মনুষ্যের সমাগম বিরল। ঘাটের উপরে একখানি দোকান আছে মাত্র। নিকটে যে গ্রাম আছে, তাহারও নাম কালাদীঘি। এই দীঘিতে একা লোক জন আসিতে ভয় করিত। দস্যুতার ভয়ে এখানে দলবদ্ধ না হইয়া লোক আসিত। এই জন্য লোকে “ডাকাতে কালাদীঘি” বলিত। দোকানদারকে লোকে দস্যুদিগের সহায় বলিত। আমার সে সকল ভয় ছিল না। আমার সঙ্গে অনেক লোকষোলজন বাহক, চারি জন দ্বারবান, এবং অন্যান্য লোক ছিল।
যখন আমরা এইখানে পঁহুছিলাম, তখন বেলা আড়াই প্রহর। বাহকেরা বলিল, “যে আমরা কিছু জল, টল না খাইলে আর যাইতে পারি না।” দ্বারবানেরা বারণ করিল -বলিল, “এস্থান ভাল নয়।” বাহকের উত্তর করিল, “আমরা এত লোক আছি-আমাদিগের ভয় কি? আমার সঙ্গের লোক জন ততক্ষণ কেহই কিছুই খায় নাই। শেষে সকলেই বাহকদিগের মতে মত করিল।
দীঘির ঘাটে-বটতলায় আমার পাল্কী নামাইল। আমি ক্ষণেক পরে, অনুভবে বুঝিলাম যে লোক জন তফাতে গিয়াছে। আমি তখন সাহস পাইয়। অল্প দ্বার খুলিয়া দীঘি দেখিতে লাগিলাম। দেখিলাম, বাহকেরা সকলে দোকানের সম্মুখে, এক বটবৃক্ষ তলে বসিয়া জলপান খাইতেছে। সে স্থান আমার নিকট হইতে প্রায় দেড় বিঘা। দেখিলাম যে, সম্মুখে অতি নিবিড় মেঘের ন্যায়, বিশাল দীর্ঘিকা বিস্তৃত রহিয়াছে, চারিপার্শ্বে পর্ব্বতশ্রেণীবৎ উচ্চ অথচ সুকোমল শ্যামল তৃণাবরণ-শোভিত “পাহাড়;”— পাহাড় এবং জলের মধ্যে বিস্তৃত ভূমিতে দীর্ঘ বৃক্ষশ্রেণী; পাহাড়ে অনেক গোবৎস চরিতেছে—জলের উপরে জলচর পক্ষিগণ ক্রীড়া করিতেছে—মৃদু পবনের মৃদু ২ তরঙ্গ হিল্লোলে স্ফটিক ভঙ্গ হইতেছে—ক্ষুদ্রোর্ম্মিপ্রতিঘাতে কদাচিৎ জলজ পুষ্পপত্র এবং শৈবাল দুলিতেছে। দেখিতে পাইলাম যে আমার দ্বারবানেরা জলে নামিয়া স্নান করিতেছে—তাহাদের অঙ্গচালনে তাড়িত হইয়া শ্যামসলিলে শ্বেত মুক্তাহার বিক্ষিপ্ত হইতেছে। দেখিলাম যে বাহকেরা ভিন্ন আমার সঙ্গের লোক সকলেই এক কালে স্নানে নামিরাছে। সঙ্গে দুইজন স্ত্রীলোক—একজন শ্বশুর বাড়ীর, একজন বাপের বাড়ীর, উভয়েই জলে। আমার মনে একটু ভয় হইল—কেহ নিকটে নাই—স্থান মন্দ, ভাল করে নাই। কি করি,আমি কুলবধু মুখ ফুটিয়া কাহাকে ডাকিতে পারিলাম না।
এমত সময়ে পাল্কীর অপর পার্শ্বে কি একটা শব্দ হইল। যেন উপরিস্থ বটবৃক্ষের শাখা হইতে কিছু গুরু পদার্থ পড়িল। আমি সে দিগের কপাট অল্প খুলিয়া দেখিলাম। দেখিলাম, যে একজন কৃষ্ণবর্ণ বিকটাকার মনুষ্য।
দেখিতে২ আর এক জন মানুষ গাছের উপর হইতে লাফাইয়া পড়িল! দেখিতে দেখিতে আর একজন, আবার একজন! এইরূপে চারিজন প্রায় এক কালীনই গাছ হইতে লাফাইয়া পড়িয়াই-পাল্কী স্কন্ধে করিয়া। উঠাইল। উঠাইয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিল।
দেখিতে পাইয়া আমার দ্বারবানেরা “কোন্ হায় রে! কোন হায়রে রব তুলিয়া জল হইতে দৌড়াইল।
তখন বুঝিলাম যে, আমি দস্যু হস্তে পড়িয়াছি। তখন আর লজ্জায় কি করে! পাল্কীর উভয় দ্বার মুক্ত করিলাম। দেখিলাম যে, আমার সঙ্গের সকল লোকে অত্যন্ত কোলাহল করিয়া পশ্চাদ্ধাবিত হইয়াছে। প্রথমে ভরসা হইল। কিন্তু শীগ্রই সে ভরসা দূর হইল। তখন নিকটস্থ অন্যান্য বৃক্ষ হইতে লাফাইয়া পড়িয়া বহু সংখ্যক দস্যু দেখা দিতে লাগিল। আমি বলিয়াছি, জলের ধারে বটবৃক্ষের শ্রেণী। সেই সকল বৃক্ষের দিয়া দস্যুরা পাল্কী লইয়া যাইতেছিল। সেই সকল বৃক্ষ হইতে মনুষ্য লাফাইয়া পড়িতে লাগিল। তাহাদের কাহারও হাতে বাঁশের লাঠি, কাহারও হতে বটের ডাল। লোক সংখ্যা অধিক দেখিয়া আমার সঙ্গের লোকেরা পিছাইয়া পড়িতে লাগিল। তখন আমি নিতান্ত হতাশ্বাস হইয়া মনে করিলাম, লাফাইয়া পড়ি। কিন্তু বাহকেরা যে রূপ দ্রুত বেগে যাইতেছিল—তাহাতে পাল্কী হইতে নামিলে আঘাত প্রাপ্তির সম্ভাবনা। বিশেষতঃ এক জন দস্যু আমাকে লাঠি দেখাইয়া কহিল যে, নামিবি ত মাথা ভাঙ্গিয়া দিব।” সুতরাং আমি নিরস্ত হইলাম।
আমি দেখিতে লাগিলাম যে, এক জন দ্বারবান অগ্রসর হইয়া আসিয়া পাল্কী ধরিল, তখন এক জন দস্যু তাহাকে লাঠির আঘাত করিল। সে অচেতন হইয়া। মৃত্তিকাতে পড়িল। তাহাকে আর উঠিতে দেখিলাম না। বোধ হয়, সে আর উঠিল না।
ইহা দেখিয়া অবশিষ্ট রক্ষিগণ নিরস্ত হইল। বাহকেরা আমাকে নির্ব্বিঘ্নে লইয়া গেল। রাত্রি এক প্রহর পর্য্যন্ত তাহার এই রূপ বহন করিয়া পরিশেষে পাল্কী নামাইল। দেখিলাম, সে স্থান নিবিড় বন-অন্ধকার। দস্যুরা একটা মশাল জ্বালিল। তখন আমাকে কহিল, “তোমার যাহা কিছু আছে, দাও—নহিলে প্রাণে মারিব।” আমার অলঙ্কার বস্ত্রাদি সকল দিলাম—অঙ্গের অলঙ্কারও খুলিয়া দিলাম। তাহারা এক খানি মলিন, জীর্ণ বস্ত্র দিল, তাহা পরিয়া পরিধানের বহুমূল্য বস্ত্র ছাড়িয়া দিলাম। দস্যুরা আমার সর্ব্বস্ব লইয়া, পাল্কী ভাঙ্গিয়া রুপা খুলিয়া লইল। পরিশেষে অগ্নি জ্বালিয়া ভগ্ন শিবিকা দাহ করিয়া দস্ততার চিহ্ন মাত্র লোপ করিল।
তখন তাহারাও চলিয়া যায়! সেই নিবিড় অরণ্যে, অন্ধকার রাত্রে, আমাকে বন্য পশুদিগের মুখে সমর্পন করিয়া যায় দেখিয়া, আমি কাঁদিয়া উঠিলাম। আমি কহিলাম, “তোমাদিগের পায়ে পড়ি, আমাকে সঙ্গে লইয়া চল।” দস্যুর সংসর্গও আমার স্পৃহণীয় হইল।
এক প্রাচীন দস্যু সকরুণ ভাবে বলিল, “বাছা! অমন রাঙ্গা মেয়ে আমরা কোথায় লইয়া যাইব? এ ডাকতির এখনি সোহরত হইবে—তোমার মত রাঙ্গা মেয়ে আমাদের সঙ্গে দেখিলেই আমাদের ধরিবে।”
এক জন যুব দস্যু কহিল, “আমি ইহাকে লইয়া ফাটকে যাই, সেও ভাল, তবু ইহাকে ছাড়িতে পারি না।” সে আর যাহা বলিল, তাহা লিখিতে পারি না—এখন মনেও আনিতে পারি না। সেই প্রাচীন দস্যু ঐ দলের সর্দ্দার। সে যুবাকে লাঠি দেখাইয়া কহিল, “এই লাঠির বাড়ি এই খানে তোর মাথা ভাঙ্গিয়া রাখিয়া যাইব। ও সকল পাপ কি আমাদের সয়?” তাহারা চলিয়া গেল। যতক্ষণ তাহাদিগের কথা বার্ত্তা শুনাগেল—ততক্ষণ আমার জ্ঞান ছিল। তার পর সেইখানে আমি অজ্ঞান হইয়া পড়িলাম। হইয়াছে।