ষষ্ঠ সর্গ।
দীক্ষা।

প্রভাত হইল নিশা, উদিল অরুণ,
খুলিয়া ফেলিল দূরে কৃষ্ণ আবরণ,
যাহাতে আবৃত ছিল এই ধরণীর
অনন্ত সৌন্দর্য্য পূর্ণ সুষুপ্ত বদন।

আসিল চেতনা ফিরে, নিদ্রা অবসানে
জাগিয়া উঠিল জীব সকলে আবার;
বসিল সৌন্দর্য্য-হাট, জীবনের রণে
অনন্ত কল্লোলে পূর্ণ হইল সংসার।

যথাকালে দেবব্রত নবীন নিকটে
আসিয়া দেখিল রাধা রয়েছে বসিয়া;
বিশুষ্কা মলিনা, যেন কোমলা ব্রততী
গিয়াছে আতপ তাপে আধ শুকাইয়া।

তাহার সে কৃষ্ণ-তার বিশাল লোচন
এখন হ’য়েছে পূর্ণ ঘোর নিরাশায়,
অকুলে ডুবিছে যেন সকলি তাহার,
দেখিছে সমস্ত বিশ্ব তাই শূন্যময়।

নবীন বলিল চাহি দেবব্রত প্রতি
আপন রোগের সেই যাতনা অপার;
বলিলেন আর নাহি বাঁচিবার আশা
হ’বে না রোগের তাঁ’র কোন প্রতিকার।

করিয়া ভবের খেলা শেষ তিনি সব
মরণের দ্বারে আসি এবে উপস্থিত;
ত্বরায় লইতে হ’বে অনন্ত বিদায়
তবু কেন কাঁদে প্রাণ মমতায় এত?

নবীন বলিল তাঁ’র দীর্ঘ পীড়া হেতু
প্রতিপ্রাণা রাধালতা শুকাইয়া যায়;
এত ভালবাসে রাধা,কেন তিনি আগে
বুঝিতে পারেন নাই হায় হায় হায়।

দেবব্রত কিন্তু তাহা বুঝিল সকল
ভাবিল সংসার কিবা প্রতারণাময়;
অন্তরে বাহিরে কত অনন্ত প্রভেদ,
বাহিরের রূপ কিবা পূর্ণ ছলনায়।

মাদকতা মোহপূর্ণ বাহিরের রূপ
মানব জগতে মধ্য-আকর্ষণ প্রায়;
রূপেতে আকৃষ্ট সবে রূপেতে পাগল,
অন্তর কাহার কেহ বুঝিতে না চায়।

গোপন করিয়া ভাব দেবব্রত তবে
কহিতে লাগিল কত শান্তি পূর্ণ কথা;
সুগভীর তত্ত্ব কত আলোচনা করি
বলিতে লাগিল তাঁ’রে শাস্ত্রের বারতা।

জন্ম,মৃত্যু,জরা,ব্যাধি,সুখ,দুঃখ,আর
কর্ম্মফল,যোগবল,বিষয় লইয়া;
কত কথা দেবব্রত বলিল তখন
শাস্ত্রের রহস্য কত প্রকাশ করিয়া।

অবশেষে বলিলেন নবীনের প্রতি
“হিন্দু-ধর্ম্মে আপনার যদি আস্থা হয়,
পারেন ছাড়িতে যদি ধর্ম্মে অবিশ্বাস
আপনাকে রোগ মুক্ত করিব নিশ্চয়।

“নিমেষে সকল ব্যাধি যাইবে চলিয়া
ব্রাহ্মণ্য আসিবে যেই ফিরে আপনার,
করিতে হইবে এবে ত্রি-সন্ধ্যা কেবল
পালন করিতে আর ব্রাহ্মণ আচার।

‘সম্মত হয়েন যদি ইহাতে আপনি
করিতে চাহেন যদি ব্রাহ্মণের কাজ,
শিখাব গায়ত্রী,সন্ধ্যা,শিখাব আচার,
শিখাইব প্রাণায়াম আপনাকে আজ।”

শুনিল সকল কথা নবীন তখন
উৎসাহে হইল পূর্ণ হৃদয় তাহার;
কোথায় মরণ কোথা নূতন জীবন,
শুনিয়া হইল প্রাণে আশার সঞ্চার।

দেবব্রত বাক্যে তিনি হ’লেন সম্মত
পালন করিতে তাঁ’র সকল আদেশ;
মৃত্যুর দুয়ারে আসি ব্রাহ্মণের কাজ
শিখিতে হইল তাঁ’র আগ্রহ অশেষ।

সকল হইলে স্থির দেবব্রত তবে
চাহিয়া রাধিকা প্রতি বলিলেন আর;
“পতির সহায় সতী ধরমে করমে,
সস্ত্রীক করিবে ধর্ম্ম শাস্ত্রের বিচার।

“সস্ত্রীক করিলে ধর্ম্ম চিত্তের সংযম,
চিত্তের সংযমে স্থির সাধকের মন;
মনোযোগে অনুরাগ হয় ধর্ম্মে তা’র
অনুরাগে সিদ্ধি লাভ হয় অনুক্ষণ।

“পতির দীক্ষার সহ দীক্ষা ল’হ তুমি
ইহা আমি অনুরোধ করি বার বার,
শিখিবেন দাদা আজ ব্রাহ্মণের কাজ,
পতি ধর্ম্ম, পতিব্রত হইবে তোমার।”

সরমে মরমে মরি রাধিকা তখন
নতমুখে সে কথায় হইল সম্মত
উঠিয়া করিতে গেল দীক্ষা আয়োজন,
দেবব্রত চলিলেন হইতে প্রস্তুত।