ইন্দুমতী/পরামর্শ

অষ্টম সর্গ।
পরামর্শ।

অতীত প্রহর নিশি, তৃতীয়ার চাঁদ
উঠে ধীরে ধীরে, ওই পূরব গগনে,
জগৎ করিয়া আলো। মাঝে মাঝে কত
ছোট ছোট মেঘ, ভাসি যায় ধীরে ধীরে
নীলিমার কোলে, যেন গতিশীল পোত
অনন্ত বারিধি কোলে যেতেছে ভাসিয়া।
রহিয়া রহিয়া, যেন চমকিয়া উঠি,
ছুটিছে উদাস ভাবে মলয় পবন।
ফুটেছে বাগানে আজ কত শত ফুল
সৌরভে আকুল করি সারাটী প্রাঙ্গণ।
 প্রাঙ্গণ উদ্যানে ইন্দু শ্বেত শিলাসনে
বসিয়া বিষাদে চাহি চন্দ্রমার পানে,
ভাবিতেছিলেন নিজ জীবনের কথা,
একে একে যত সব অতীত কাহিনী।
মনে হয় তাঁ’র, যেন জগতে সকলি
নিশার স্বপন সম, এই আছে, নাই!

যেন শূন্যগর্ভ সব। সুখেতে বিষাদ,
বিষাদে আনন্দ, আলো ছায়া, পাপ পুণ্য,
জড়াইয়া পরস্পরে আছে পাশাপাশি।
অনন্ত মঙ্গলময় এক মহাসূত্রে
রেখেছে গাঁথিয়া যেন এক সাথে সব।
 এমন সময়ে আসি পঙ্কজিনী ধীরে,
পুত্রের মৃত্যুর পর প্রথম সাক্ষাতে,
চাপিয়া ধরিল ত্রস্তে ইন্দুর নয়ন।
পরশে বুঝিয়া ইন্দু বলিয়া উঠিল
“চিনেছি তোমায়, ছাড়, স্নেহময়ী দিদি।”
সম্ভ্রমে উঠিয়া শীঘ্র লয়ে পদধূলি
বিস্ময়ে দেখিল চাহি, প্রফুল্ল আননা
পঙ্কজিনী দিদি তা’র। শোক দুঃখ ছায়া
লেশ মাত্র নাহি তাঁ’র অন্তরে বাহিরে।
মহিমা মণ্ডিত কিবা স্বর্গীয় মাধুরী
ললাটে বদনে তাঁ’র শোভিছে সুন্দর।
প্রশান্ত স্নেহের ভাব, হাসিভরা মুখ,
দেখিয়া দেখিয়া ইন্দু ফেলিল কাঁদিয়া—
“ক্ষমা কর দিদি তুমি, আমি যে তোমার
এই বিপদের হেতু, ক্ষমা কর তুমি।”
দ্বিতীয় কথাটী আর কহিবার আগে
এক হাতে চাপি’ ধরি ইন্দুর বদন,

জড়াইয়া দেহ তা’র অন্য হাত দিয়া,
টানিয়া আপন বক্ষে মাতা পঙ্কজিনী,
বলিল ‘‘এসেছি ভগ্নি তোমার দুয়াবে
ক্ষমা ভিক্ষা হেতু, নহে ক্ষমা করিবারে।
ক্ষমা কর দোষ বোন্ আমার পতির।
ক্ষমাযোগ্য তিনি এবে। একটী আঘাতে
ফিরিয়াছে মতি গতি, হয়েছে আশ্চর্য্য
পরিবর্ত্তন তাঁহার। কে বলে জগতে
নাই পুণ্যের শকতি? মহৎ কার্য্যের
নাহি কোন শুভ ফল? নবীন জীবন
পারে না মানবে দিতে, জড়েতে চেতনা?
নবীন জীবন, আর নবীন চেতনা
দিয়াছে সন্তান তা’র পিতারে আপন,
সতীত্বের বেদীমূলে দিয়া নিজ প্রাণ।
শশাঙ্ক আমার ধন্য, ধন্যা আমি আর
জননী বলিয়া তা’র। ধন্য পিতৃকুল।
রাণীমা বংশের যোগ্য করিয়াছে কাজ।
মরণ অধীন সবে। কিন্তু বল বোন্‌
ক’জন মরিতে পারে মানুষের মত?
জগতে সকলে আসে কাজ করিবারে
কয় জন পারে বল করিবারে তাহা?
সংসারে আসিয়া বাছা করিবারে কাজ

অচিরে সম্পন্ন করি কাজ আপনার,
অনন্ত জীবন লভি গিয়াছে চলিয়া
পুণ্যময় স্বর্গধামে,স্থানে আপনার।
তা’র জন্য বৃথা দুঃখ,তাহার পুণ্যেতে
হ’ব সবে পুণ্যময়,তেজে তেজোময়।”
 একি গরিয়সী কথা! চমকিলা ইন্দু।
বুঝিলা মানবী নহে মাতা পঙ্কজিনী।
সম্ভবে দেবীর হেন,হেন দেব পুত্র।
কিন্তু বহুক্ষণ সেই নির্জ্জন প্রাঙ্গণে,
পঙ্কজিনী বুকে মুখ চাপি ইন্দুমতী
কাঁদিলেন,পুত্রহারা জননীর মত।
হইল অনেক কথা। কতক্ষণ পরে
উভয়ে উঠিয়া গেল যথায় নগেন্দ্র,
পুত্রশোকে জর জর,বিশুষ্ক মলিন,
অনুতাপানলে দগ্ধ, দীন হীন বেশে,
তৃণাসনে বসি একা ছিলেন বাহিরে,
অট্টালিকা পুরোভাগে,সেই চন্দ্রালোকে।
তাঁহাকে দেখিয়া ইন্দু হইল কাতরা,
উথলি উঠিল অশ্রু নয়নে তাহার।
পঙ্কজিনী বাক্য শুনে উঠিয়া নগেন্দ্র
আছাড়ি পড়িল ইন্দু চরণ সমীপে।
“ক্ষমা কর দেবি মোরে, ঘোর মোহবশে

করিয়া তোমাকে আমি বড় অপমান,
অনুতাপে জ্বলিতেছি,আর পুত্রশোকে।
ঈশ্বর আছেন সত্য আছে পাপ-পুণ্য,
পাপের ভীষণ দণ্ড আছে পাপী তরে।
থাকিলে পুণ্যের পথ নিজে ভগবান
তাহারে করেন রক্ষা, দেন আশীর্ব্বাদ।
কুমারের বিনিময়ে যে শিক্ষা পেয়েছি,
ভুলিব না কভু তাহা জীবনে আমার।
ছেড়েছি বাসনা আমি সংসারের সব,
প্রবৃত্তির হইয়াছে নিবৃত্তি এখন,
খুলিয়াছে জ্ঞানচক্ষু এখন আমার।
আদরে শিখিতে যাহা পারি নাই আগে,
কালের দণ্ডেতে তাহা শিখেছি এখন।
ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখি ধর্ম্মে রাখি মতি,
কঠোর কর্ত্তব্য পথে,রাণীমা আদর্শে,
চলিব এখন হ’তে, কিন্তু দেবি তুমি!
মন খুলে ক্ষমা কর এখন আমায়।”
ইন্দু। ক্ষমিয়াছি দোষ তব। কিন্তু দাদা! ওই
অনন্ত ঈশ্বর কাছে চাহ ক্ষমা তুমি,
চাহিলে মিলিবে ক্ষমা,পাবে শান্তি সুখ।
কায়মনোবাক্যে ডাক তাঁহারে এখন।
আর কিছু যেন ছিল বলিবার কথা

নারিলা বলিতে তাহা। কি এক উচ্ছ্বাসে
কণ্ঠরোধ হ’ল তা’র। তাই দ্রুত বেগে
ফিরিয়া আসিল একা অন্দর প্রাঙ্গণে
 পতিরে পাঠায়ে দিয়া প্রাসাদে আপন
পঙ্কজিনী ফিরে গেল ইন্দুমতী কাছে।
দুইজনে পরামর্শ লাগিল করিতে,
করিবে কি কাজ সবে তাহারা এখন।
এই স্থির হ’ল,নগেন্দ্রে লইয়া সাথে,
তাহারা যাইবে শীঘ্র তীর্থ পর্য্যটনে,
ভারতের নানা স্থানে যত তীর্থ আছে,
ইন্দুর পতির আর করিবে সন্ধান।