উনিশে মে: ভাষার সংকট/ধ্রুবপদ উনিশ/কিলকথা

কিল কথা

তখন ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর চলচ্চিত্রজীবনী দেখানো হত ফিল্ম ডিভিজনের অস্থায়ী পর্দায়। গ্রামে গ্রামে প্রজেক্টার লাগিয়ে দেখানো হত গমগমে কণ্ঠস্বরের এক আঞ্চলিক ধারাভাষ্যকারের কণ্ঠে বাংলায়। দেখানো হত তাঁর দীর্ঘাঙ্গ, ঈষৎ ঝুঁকে হাঁটার ভঙ্গি, ছায়াছবি শেষ করা হত তাঁর প্রিয় কবিতার পঙ্‌ক্তি কবি রবার্ট ফ্রস্টের ‘এণ্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ’ দিয়ে। গ্রাম দেশে তখন আর কোথায় উত্তমকুমার অশোককুমার দিলীপকুমার, তখন তিনিই হিরো, দেশ দেশ ভাব যে দেশভাগের ক্ষতে। কত রকমের ফুলঝুরি উড়তো আকাশে, আকাশ থেকে জাতীয় পতাকা নেমে আসতো আলোর মালায়। প্রধানমন্ত্রীর ডকুমেণ্টারি জুড়ে থাকতেন তীক্ষ্ণ নাসা এক সুন্দরী, তাঁর কন্যা প্রিয়দর্শিনী। আর থাকত সঞ্জীব রাজীব নামের দুই শিশুর হুটোপুটিও। সঞ্জীবই তো জানতাম, নাকি বড় ভাই রাজীবের সঙ্গে মিলিয়ে সঞ্জয় হয়ে গেছিল সঞ্জীব। শৈশবের সবকথা কি মনে থাকে হুবহু। তখনও বেঝার মতো বয়স হয়নি, যে প্রধানমন্ত্রীর নাতির নাম সঞ্জীব না হয়ে সঞ্জয় হলে আমাদের কী। আমাদের মাটির বাড়ি তো আর রাজপ্রাসাদ হয়ে যাবে না। তখনও বুঝতে পারিনি যে কল্পলোকের রাজপুত্রদের শৈশব দেখিয়ে আমাদের শিশুকালটাকে নিলাম করে দেওয়া হচ্ছে সস্তাদরে। তখন একটা কথা খুব প্রচলিত ছিল গাঁয়ে গঞ্জে ‘দিল্লিকা লাড্ডু যো খায়া ওভি পস্তায়া যো নাহি খায়া ও ভি পস্তায়া’। দিল্লিতে অনেক রকম যন্তর মন্তর মিনার মন্দির মসজিদ গুরুদ্বার তিনমূর্তি বাড়ি। সেই ভবনে থাকেন পণ্ডিত প্রধানমন্ত্রী। আবেগ আর ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করাটাই প্রধান বলে নেতারা হয়তো কোনো কালে বুঝতেই পারেন না গড্ডালিকা প্রবাহ কী চায়। কালস্রোতের ধারা কোন খাতে বইবে, মানবতার অপমান কোন চূড়ান্তে পৌঁছবে, স্বদেশকে বিদেশ করে বন্দী শিবিরের নামে খোঁয়াড়ে রাখা হবে দেশের নাগরিককে। শুধু দেশের নাগরিক নয়, দেশনায়ক প্রথম প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন স্বজন, তার মানে তিনি জানতেন তাঁর দূরদর্শী দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল সত্যের মুখ বুঝতে পেরেছিলেন মূল স্রোতে ফিরতে চাইবেন ফেলে আসা দেশবাসী তাই দেশভাগের অব্যবহিত পরে কুম্ভীরাশ্রুর স্রোতে ভেসে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ওপারে আমাদের যে স্বজনরা রইলেন তাদের জন্য আমাদের দুয়ার খোলা রইল।’ দেশ ভাগ হয়েছিল পূর্বে পশ্চিমে, পাঞ্জাব ভেঙে দুভাগ হলেও যোদ্ধার জাত ওসব জলহীন দৃষ্টির ভারি কণ্ঠস্বরের আবেগে ভুলে নি। কেউ ছেড়ে এসেছে প্রিয় শহর লাহোর কেউ বা পাটিয়ালা জলন্ধর ছেড়ে চলে গেছে। জয়ের নেশায় যতজন এসেছে তাঁর থেকে বেশি ফেরত পাঠিয়েছে। যদিও বিখ্যাত উর্দু লেখক বলেছেন, ‘ক্ষত হয়তো শুকিয়ে যাবে কিছু দিনের মধ্যে কিন্তু মানসিক আঘাত শুকোবার নয়।’ তবুও এপার ওপার পাঞ্জাবিদের ক্ষতে শুধুই স্বভূমি হারনোর বেদনা। আর এপারে পূর্বদেশের শিয়ালদহে উত্তরপূর্বের মহিষাসন ও ইতিউতি সীমান্ত স্টেশন সীমারেখা ও সীমানদী লঙ্ঘন করে লাখে লাখে এসেছে পোকায় খাওয়া ভাগের দেশে। শুধুই প্রবেশ উল্টো সংখ্যাটা নিতান্তই নগণ্য। এপারে ওপারে সৃষ্টি হল নতুন জাতির, যার নাম সংখ্যালঘু। ওপারে যারা সংখ্যালঘু হয়ে স্বাভাবিক উৎপীড়নের শিকার হতে হতে রয়ে গেলেন এপারের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে জানলেন হিন্দুস্থানের দেশের নায়ক তাদের জন্য দরজা খুলে রেখেছেন, তখন আর ভয় কাকে। এবার আগে আর স্বার্থান্বেষী নেতাদের দেশভাগে যারা ভিটেমাটি ছেড়ে চলে এলেন কাতারে কাতারে লাখে লাখে, তারা কে, কী তাদের পরিচয়, কোথায় হবে তাদের বাসস্থান। এসব ভাবা হয় নি। নতুন ইহুদিদের জন্য খোলা হল দরমার বেড়া আর শন নেরার ছাউনি দেওয়া শিবির, চাল ডাল নুন ডোলের নগদেরও ব্যবস্থা হল। পুনর্বাসনের নামে ভারতের খরা প্রবণ এলাকাগুলিকে বেছে নেওয়া হল দ্রাঘিমা রেখার উপর, পুনর্বাসনের নামে বন্দীজীবন বরাদ্দ হল নতুন করে। এদিকে তিব্বতিদের দল যখন চলে এলেন দলাই লামার সঙ্গে, তাদের জন্য ব্যবস্থা হল পাঁচতারা স্বাচ্ছন্দ্য, হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালাকে বানিয়ে দেওয়া হল স্বর্গপুরী, নতুন তিব্বত হল ভারতবর্ষে। বাঙালি কিন্তু একটা সিলেট নোয়াখালি চট্টগ্রাম ঢাকা কিংবা বরিশাল ময়মনসিংহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া গড়তে পারল না ভাগের দেশে। পাঁচতারা ধর্মশালার বিপরীতে বাঙালিকে মধ্যপ্রদেশের দণ্ডকারণ্যের বনে, উড়িষ্যার বিহার কর্ণাটক মুম্বাইয়ের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পুনর্বাসনের নামে খোঁয়াড়জাত করা হল। কলকাতা শিলিগুড়ি বর্ধমানের শাকপাতা কচুর লতি ধ্বংস করে উদ্বাস্তু বাঙালি দখল নিল জবরদখল কলোনিগুলিতে, শেষ পেরেকটি গাঁথা হল সুন্দরবনের মরিচঝাঁপি কেলেঙ্কারিতে যখন মুখ পুড়ল সাম্যবাদী সরকারের। শুধু নতুন দিল্লির ইপিডিপি কলোনির চাকচিক্যে ঢাকা পড়ে থাকল বাঙালির বিপন্ন অস্তিত্ব। এদিকে আসামেও অকারণে লড়িয়ে দেওয়া, খুঁচিয়ে পচা ঘা করা হল পুরনো ক্ষতের। বলা হল বাঙালি থাকলে অসমিয়া জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হবে, তাই আসাম শরীর থেকে চক্রান্ত করে সিলেট হেঁটে দেওয়া হল, ওদিকে রংপুর জেলার বৃহদংশের অসমীয়া করণ হয়ে গেছে অনেক আগেই। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় ভাজন আসামের প্রথম মুখ্যমন্ত্রীও বললেন, আসাম অসমীয়ার’ দেশের বৃদ্ধ বিবেক নাকি তখন বলেছিলেন ‘তাই যদি হয়, ভারত তবে কার?’ দেশ যখন ভাগ হয় ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর নাতি দুজনের বয়স তখন তিন আর এক। চুয়াল্লিশ আর ছেচল্লিশে জন্ম। বৈষম্যের ট্র্যাডিশন সমানে চলছে বাঙালির প্রতি অবিচার বাড়াতে দেশনায়করা আঞ্চলিক মোড়লরা ভুলে যান ভারতীয়তা, শক হুন ভোটবর্মি পারসিকদের এক দেহে লীন হওয়ার ঐতিহ্য। ভুলে যান পিতৃসূত্রে রাজপরিবারে প্রিয় নাতিরাও যে পারসিক, সুদূর ইরান। স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে গুজরাট ভারুচের বাসিন্দা হয়ে যান রাজবদান্যতায়, ঘাণ্ডি থেকে গান্ধিও হয়ে যান মহাত্মাজির অনুপ্রেরণায়, সৌজন্যে। তখনও ছিল অনুপ্রেরণা। ভারতে উদার ঐতিহ্য আর দেশাত্মবোধ সবাইকে এক দেহে লীন করে দিয়েছে। দুর্ভাগ্য শুধু বাঙালির, স্বাধীনতার আগে থেকেই অসমীয়া উগ্র জাতিয়তাবাদের শিকার হয়েছে বাঙালি। দেশভাগের পরপরই প্রথম প্রধানমন্ত্রীর আর এক প্রিয়জন, আসামের রাজ্যপালও নির্ধারিত করে দিলেন বাঙালি শূন্য ভবিষ্যৎ আসামের রূপরেখা। বললেন, যাক বাঙালি আর থাকল না সব কিছুতেই তাঁর দীর্ঘ নাক গলানোর জন্য। এসব কথা যখন বলা হচ্ছে তখন অসমিয়া আসামের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষাভাষী বটে, কিন্তু নিরঙ্কুশ নয়। নিঃসপত্ন ভাষাগোষ্ঠী হতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হল উগ্রতার, খাসি মিজো নাগা মনিপুরিকে আলাদা করতে হল, তাও কী হয়, একশ বছরের বেশিদিনের বাসিন্দা বাঙালি মুসলমানদের প্রশাসনিক কারসাজিতে অসমিয়া সাজানো হল। এতসব অনৃতায়নের পর অসমিয়ার গরিষ্ঠতা সীমিত হয়। নিরঙ্কুশ হয় না। ইতিমধ্যে অধুনার বরাক উপত্যকায় খাল কেটে কুমির আনার প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয় ১৯৮৫-তে। তৎকালীন কাছাড় জেলার বদরপুর বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে উপত্যকার শিবসাগর জেলার সোনারি বিধানসভা কেন্দ্রে হেরে যাওয়া কংগ্রেস নেতা বিমলা প্রসাদ চালিহা নির্বাচিত হন একশ শতাংশ বাঙালির ভোটে কাছাড় জেলার বদরপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে এবং সেই জয়সুত্রে আসামের মুখ্যমন্ত্রীও হয়ে যান বিষ্ণুরামকে মাদ্রাজ সরিয়ে দিয়ে। বাঙালির ভোটে জেতা মুখ্যমন্ত্রী মসনদে বসেই বলে বসলেন অসমিয়া হবে রাজ্যের রাজকীয় ভাষা, ইংরেজি হবে সংযোজক ভাষা সাময়িকভাবে। সেই মতো আইনও হয়ে যায় বিতর্কিত ভাষা আইন ১৯৬০। বরাক উপত্যকা সরব হয়ে ওঠে কালা আইনের বিরুদ্ধে, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়ও বাঙালি বিদ্বেষ উত্তাল তখন। যার ফলশ্রুতিতে বরাক উপত্যকায় শুরু হয় সর্বাত্মক হরতাল, ১৯ মে ১৯৬১ ইংরেজিতে। এগারোজন শহিদের রক্তে ভাষাবেদি সিক্ত হয় সেদিন। কিছুটা হলেও দিল্লির টনক নড়ল, নেতারা এলেন মাঝারি, লালবাহাদুর এলেন, প্রথম প্রধানমন্ত্রী এলেন না, তিনি গৌহাটিতে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন করে গেলেন দুর্গাপুর। সারা ভারত কংগ্রেস দলের অধিবেশন যে ওখানে। শোকজ্ঞাপন করলেন নেতারা, কুট্টি আঁকলেন তার বিখ্যাত কুম্ভীরাশ্রুর কার্টুন। ভাষা বিল সংশোধিত হল, বরাক উপত্যকার জন্য রইল বাংলা ভাষা। নাকের বদলে নরুন। আইন লঙ্ঘনের চেষ্টাও হতে থাকল বারবার। বরাক উপত্যকাও প্রতিবাদে গর্জে উঠল। রাজশক্তি দেখল, এতো মস্তো বড়ো গেরো, মরিয়া না মরে এ কেমন বৈরী। তখন নতুন উপায়ে বাঙালি বধের আয়োজন হতে থাকল, আরও দু’দফায় ভাষা শহিদ হলেন তিনজন। ইতিমধ্যে ওপারের স্বজনরা যখন অত্যাচিরত হয়ে দেশ ছেড়ে আসতে বাধ্য হচ্ছেন সামরিক শাসনের নির্মময়তায়, তারা নিশ্চিন্তে এসে বসবাস শুরু করেছেন পিতৃভূমিতে। তারা তো নিশ্চিন্ত তাদের আছে অশ্রুসজল রাজকীয় পাঞ্জা, প্রথম প্রধানমন্ত্রীর জীবনব্যাপী মৌখিক নির্ভরপত্র। তারা বুঝতেও পারেন নি যে স্বাভাবিক ভারতীয় নাগরিকত্বের আশ্বাসও ছিল ভুয়ো। কথিত আছে পদ্মবিভূষণ চালিহা তাঁর রাজত্বকালে তিনলাখ বাঙালি তাড়িয়েছেন। তারপর শুরু হয় কুখ্যাত আসাম আন্দোলন। বিদেশি খেদা আন্দোলনের নামে স্বদেশি বাঙালি বিতাড়নের এক অভিনব রোষের আক্রোশ। রাজ্যটাকেই কিছু নেতৃত্বলোভী স্বার্থান্বেষীর উৎপাতে স্তব্ধ করে দেওয়া হল। সেইবিরাম সময়ের মুখ্যমন্ত্রী তো রাজধর্ম পালন করেছিলেন, কড়া হাতে মোকাবিলাকরেছিলেন উগ্রজাতীয়তাবাদী আন্দোলন। তখন কে জানত, প্রথম প্রধানমন্ত্রীর কন্যা প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু হবে আততায়ীর গুলিতে,আর বাঙালির কপাল পুড়বে স্থায়ীভাবে। মৃত প্রধানমন্ত্রীর সুপুত্র চুয়াল্লিশে জন্ম যার, প্রথম প্রধানমন্ত্রীর প্রপৌত্র ভারতের ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাবেন মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে। শিশুনায়ক মসনদে বসেই ঘোষণা করলেন স্বদেশীর ঢালাও নাগরিকত্ব দেওয়া যাবে না আসামে দোর্দণ্ড প্রতাপ গনিখান চৌধুরী অজিত পাঁজা তখন তাঁর মন্ত্রী। কেউ রা টি কাড়লেন না। হয়ে গেল আসাম সমঝোতা। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্নকে কাট অফ করে নিয়ে ১৯৫১-র নাগরিক পঞ্জির ভিত্তিতে নির্ধারিত হল নাগরিকত্ব। সই করলেন প্রথম প্রধানমন্ত্রীর প্রপৌত্র, ছাত্রনেতা আর জাতীয়তাবাদী নেতা। তারপর জাতীয়তাবাদের জোয়ারে ভেসে গেল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা, ছাত্রনেতা হলেন মুখ্যমন্ত্রী পুলিশ মন্ত্রী। ক্ষমতা আর দুর্নীতি নিয়ে বেশ তো চলল কিছুদিন। বিদেশি বিতাড়নের উচ্চবাচ্য হল না ক্ষমতায়নের ফলে, এই ফাঁকে, ঝোপ বুঝে কোপ মারতে তৎপর হল আসাম সমঝোতার দুবছর আগের এক বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনি। আলফার তাণ্ডব চলে পাঁচ সাত বছর। সেই সময়কাল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি অসমিয়া সবার কাছেই চরম সংকটের সময়, দহন বেলা। আবার এক ছাত্র নেতা ঝোপে কোপ মারার রাজনীতি করলেন, উচ্চতম বিচারালয়ে স্বজাতি এক বিচারপতির এজলাসে দরখাস্ত করলেন ১৯৮৩-র আইএমডিটি আক্ট বাতিলের সুপারিশ করে। সেই অ্যাক্ট অনুযায়ী বেআইনি অনুপ্রবেশকারী ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হত। ২০০৫ সালে সেই আইনটি বাতিল হয়ে যায়। পুরনো আইন অনুযায়ী চিহ্নিত অনুপ্রবেশকারীর কোনো দায়দায়িত্ব ছিল না তার নাগরিকত্ব প্রমাণ করার। এবার ঠিক হল উল্টো পথে চলবে আইন, রাষ্ট্র ঠিক করবে কে অনুপ্রবেশকারি বিদেশি, আর তকমাদাগা বাঙালিকেই প্রমাণ করতে হবে সে তা নয়। আশ্চর্য এই দেশ আর তার বিচার ব্যবস্থা, আসামে একজন ছিলেন লাচিত বরফুকন মোগলের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন আর একজন এই ছাত্রনেতা বাঙালি বিজয়ের পর এখন আসামের মুখ্যমন্ত্রী। এদিকে উচ্চতম ন্যায়লয়ের নির্দেশে এবং তত্ত্বাবধানে ২০১৩-য় জন্ম হয় এক দৈত্যের। যার নাম এনআরসি, ন্যাশনেল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স, শুধু আসামের জন্য জাতীয় নাগরিক সুচি। সেই দৈত্য এখন পর্যন্ত চল্লিশ লক্ষ বাঙালিকে গ্রাস করেছে, বলির নিমিত্ত চিহ্নিত করেছে। এর জন্য দায়ি কে, এত সহজ নয় চিহ্নিতকরণ, বাঙালিও তো হতে পারে বাঙালির শত্রু, দেশভাগের সময় রবীন্দ্রনাথ নেতাজি বিবেকানন্দ সুস্থ নজরুল না থাকলে কী হবে, তৎকালীন বিখ্যাত বাঙালিরা তো ছিলেন, পৌঁছতে পারতেন অহিংসাপুরুষের কাছে, তিনিও তো বলেছিলেন দেশভাগ যেন তাঁর বুকের উপর দিয়ে হয়। তাই প্রথম প্রধানমন্ত্রী তো নিমিত্তমাত্র, ভারতীয় হেতুবাদ তো তাই বলে। কিংবা নয় তার কন্যা প্রপৌত্র প্রপৌত্রবধূ। চিহ্নিত করে কোনো সমাধানসূত্র পাওয়া যাবে না, বাঙালিকে সর্বাবস্থায় বলিপ্রদত্ত হতেই হবে, সে জোড়া বলদই হোক গাইবাছুর হোক হাতই হোক কিংবা জলজ পুষ্পের ঘায়েই হোক, মরতে তোমাকে হবেই। পদ্মকালেই দেখা গেছে প্রকোপ বেড়েছে, বলছে ভয় নেই, বাঙালি হিন্দুর রক্ষাকবচ থাকছে। কিসের রক্ষাকবচ বলা যাবে না দেশপ্রেমী হলে। মুসলমানকে দোষী সাব্যস্ত করে বের করে দিলে তো ভালোই, সে একটা দেশ পাবে যদি পায়। আর তা তা থৈ নৃত্যরত হিন্দু বাঙালির অবস্থা তো আরও করুন, ভয়াবহ। সে তো কিছুই পাবে না, দেশ না নাগরিকত্ব না, কোনো পরিষেবা পাওয়ার যোগ্য থাকবে না, নাগরিকত্বহীন ভাড়াটে হয়ে থাকতে হবে স্বদেশে, আসামের বাঙালি এখন আরও ভালো দিনের ভরসায় তাকিয়ে আছে পনেরতম প্রধানমন্ত্রীর মুখ চেয়ে। আশায় আশায়। এছাড়াও আছে বাঙালির আর এক আপনজন, এক তৃণপুষ্প, নয় কোটি বাঙালির নেতৃত্ব দিচ্ছেন যে মমতাময়ী, তিনিও তো বলছেন, চলে এসো, বাজার গরম করে রেখেছি। কোথায় থাকতে দেবেন বঙ্গমাতা, আবার মরিচঝাঁপি খুলবেন?