উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/আকাশের কথা : ৩

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

আকাশের কথা ঃ ৩

 যদিও আমরা এখন ঘরে কথা বলিতে বসি নাই, তথাপি একটা কথা বলিলে তত দোষের হইবে না। প্রথম রাত্রিতে যে-সকল উজ্জ্বল তারা দেখা যায়, তাহাদের তিনটি গ্রহ। একটি লালচে রঙ্গের, সেটিকে পশ্চিমে দেখা যায়, আর প্রথম রাত্রিতেই সে অস্ত যায়। এটি মঙ্গলগ্রহ। ইংরাজিতে ইহার নাম Mars। আর-একটি প্রথম রাত্রির তারার মধ্যে সকলের চাইতে বড়। ইহার নাম বৃহস্পতি (Jupiter)। গ্রহদের মধ্যে এইটিই সকলের চাইতে বড়। এই গ্রহটি মঙ্গলের কিছু পরে অস্ত যায়। আকাশের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে উহার খোঁজ লইবে। আর-একটি গ্রহ ছায়াপথের উপরে। ইহার নাম শনি (Saturn)। দূরবীন দিয়া দেখিবার পক্ষে ইহার মতন সুন্দর জিনিস আর আকাশে নাই। এইসকল গ্রহকে আকাশের দক্ষিণ ভাগে দেখিতে পাইবে।

 আজকালকার প্রথম রাত্রির আকাশে সম্প্রতি আমাদের পরিচয় করিবার উপযুক্ত বেশি জিনিস নাই। কিন্তু যদি রাত্রিতে জাগিতে পার, তাহা হইলে কয়েকটা দেখিবার আছে।

 রাত্রি প্রভাত হইবার কিঞ্চিৎ পূর্বে উঠিলে পূর্বদিকের আকাশে দুটা খুব উজ্জ্বল তারা দেখিতে পাইবে। ইহাদের মধ্যে যেটা বেশি উজ্জ্বল, সেটা নক্ষত্র নহে, গ্রহ। ইহাকেই শুকতারা (Venus) বলে। শুকতারার চাইতে কম উজ্জ্বল যেটা, সেটার নামই সিরিয়স। নক্ষত্রের মধ্যে এইটাই সকলের চাইতে উজ্জ্বল।

 সিরিয়সের খুব কাছেই ছায়াপথটাকে বেশ পবিষ্কার দেখিতে পাওয়া যাইবে। আচ্ছা, ওটাকে ধরিয়া ক্রমাগত উত্তর দিকে যাই। অবশ্য, ঠিক উত্তর হইবে না, মোটামুটি উত্তর।

 খানিক দূর গেলেই দেখিবে যে অনেকগুলি উজ্জ্বল তারা মিলিয়া এই ছবির[১] একস্থানের মতন দেখিতে হইয়াছে। এইনক্ষত্রমণ্ডলীকে প্রায় সকলেই চিনে। ইহার বাঙ্গালা নাম কালপুরুষ, ইংরাজি নাম ওরায়ণ (Orion)। অনেকে ইহাকে আদম সুরৎও বলে। মোটামুটি ইহাকে দেখিতে একটা মানুষের মতন। চারি কোণের চারিটা তারা যেন হাত-পা। একটা কোমরবন্ধও আছে তাহাতে আবার একটা তলোয়ার ঝুলিতেছে। খুব যোদ্ধা, তাহাতে আর সন্দেহ নাই।

 আকাশের একটা ম্যাপ দেখিলে দেখিতে পাইবে যে, তাহাতে ওরায়ণের চেহারা দেওয়া হইয়াছে। উহা কাল্পনিক বলিয়া এখানে তাহা দেওয়ার বিশেষ দরকার বোধ হইতেছে না। কিন্তু ম্যাপের সেই ছবিখানি দেখিতে হাসি পায়। ওরায়ণের বা ঁহাতে একটা জন্তুর ছাল, ডান হাতে এক প্রকাণ্ড গদা! কোথাকার এক ক্ষ্যাপা ষাঁড় শিং বাগাইয়া গুতাইতে আসিতেছে, ওরায়ণ তাহার সঙ্গে সাংঘাতিক যুদ্ধ করিতেছেন!

 ওরায়ণের কোমরবন্ধের ভিতর দিয়া একটা লাইন টানিলে তাহার একদিক সিরিয়সের কাছ দিয়া যায়, অপর দিক প্রায় ষাঁড়ের মাথায় গিয়া ঠেকে। ষাঁড়ের মাথার মধ্যে সকলের চেয়ে বড় তারাটির নাম রোহিণী! ইংরাজিতে ইহাকে বলে Aldebaran। ওরায়ণের ডান হাতের তারাটির নাম আর্দ্রা, বাম হাতের তারাটির নাম মৃগশিরা।

 এই ষাঁড়ই আমাদের পঞ্জিকার বৃষরাশি। সূর্য এক-এক মাসে আকাশের এক-এক স্থানে থাকে। সেই স্থানগুলিকে এক-একটা রাশি বলে। বৈশাখ মাসে আকাশের যে স্থানে সূর্য থাকে, তাহার নাম মেষরাশি। এইরূপে মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ, মীন-বারো মাসে এই বারোটা রাশির ভিতর দিয়া সূর্য ঘুরিয়া আইসে। অবশ্য সূর্য যে বাস্তবিকই বৎসরে এতটা পথ হাঁটিয়া আইসে, আর আমরা এক জায়গায় গালে হাত দিয়া বসিয়া তাহা দেখি, এরূপ নহে। আসলে আমরাই সূর্যের চারিধারে ঘুরিতেছি বলিয়া এরূপ দেখা যায়।

 রাশিগুলির কোনটা কোথায় আছে তাহা খুঁজিয়া বাহির করা তোমাদের পক্ষে সহজ হইবে না। বৃষরাশিটাকে চিনিলে। ছায়াপথের এধারে বৃষরাশি, ওধারে মিথুনরাশি। তারপর কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক ঘুরিয়া আসিলেই আবার ছায়াপথে উপস্থিত হওয়া যায়। আজকাল শনিগ্রহটি ইহারই নিকটে দেখিতে পাইবে।

 সিরিয়স হইতে সোজা চলিয়া ওরায়ণের কোমরবন্ধ, তৎপর বৃষরাশির মাথা। এই লাইন ধরিয়া আর খানিক দূর গেলে আর একটি খুব ছোট নক্ষত্রমণ্ডলী পাওয়া যায়। ছোটছোট কয়েকটি নক্ষত্র এক জায়গায় দল বাঁধিয়া আছে, দেখিলে সহজেই চিনিতে পারিবে। এই নক্ষত্রমণ্ডলীর নাম কৃত্তিকা। ইংরাজিতে ইহাদিগকে বলে the Pleiades আমাদের দেশের সাধারণ লোকে বলে, কৃত্তিকারা সাত বোন অর্থাৎ, সাধারণ চক্ষে ঐ স্থানে সাতটি ছোট-ছোট তারা দেখা যায়। কিন্তু দৃষ্টি খুব প্রখর হইলে ইহা অপেক্ষা বেশিও দেখা যায়। আবার একটু কানা গোছের হইলে সাতটিও দেখিতে পায় না। তোমরা এই তারাগুলি গণিয়া পরীক্ষা করিতে পার, কাহার চশমার দরকার।

 এই তারাগুলিকে অনেকে সপ্তর্ষিমণ্ডল বলে, কিন্তু তাহা ভুল। সপ্তর্ষিমণ্ডলকে ইংরাজিতে বলে Great Bear (বড় ভল্লুক)। উহার সামনের দুটি তারার ভিতর দিয়া লাইন টানিলে ধ্রুবতারাকে পাওয়া যায়। এইজন্য এই তারা দুটির নাম হইয়াছে প্রদর্শক (the pointers)।

 পৃথিবীর মেরুদণ্ড টাকে খুব লম্বা করিয়া বাড়াইয়া দিলে ঐ ধ্রুবতারার খুব কাছ দিয়া যায়। এইজন্যই ধ্রুবতারার উদয় অস্ত নাই, উহা সর্বদাই একস্থানে রহিয়াছে। উহার কাছে অন্যান্য তারাগুলিকে লক্ষ্য করিয়া দেখিলে দেখিতে পাইবে যে উহারা এই ধ্রুবতারারই চারিদিকে ঘোরে। আসলে ধ্রুবতারাও একেবারে স্থির নহে, কারণ, সে আকাশের সুমেরুর ঠিক উপরে নাই। ধ্রুবতারা আকাশের সুমেরুর চারিধারে ঘরে। কিন্তু সে আকাশের সুমেরুর খুব কাছে। বলিয়া এত অল্প স্থানের ভিতর ঘোরে যে, সহজ চক্ষে আমরা তাহাকে স্থির বলিয়াই মনে করি।

 যাহারা পৃথিবীর ঠিক মাঝখানে (বিষুবরেখার উপরে) আছে তাহারা ধ্রুবতারাকে আকাশের প্রান্তে দেখিতে পায়। বিষুবরেখার দক্ষিণের লোকেরা ধ্রুবতারা দেখিতে পায় না। বিষুবরেখা হইতে যত উত্তরে আসিবে, ধ্রুবতারাকে তত ঊর্ধ্বে দেখিতে পাইবে। সুমেরুতে দাঁড়াইতে পারিলে, উহ একেবারে মাথার উপরে আসিবে। ঠিক মাথার উপর হইতে আকাশের উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত স্থানটুকুকে তিন ভাগ করিলে যতখানি হয়, আমরা আকাশের প্রান্ত হইতে ধ্রুবকে মোটামুটি ততখানি উপরে দেখিতে পাই। সুতরাং ঠিক উত্তর দিকটি একবার স্থির করিয়া

উপেন্দ্র—১২২ লইতে পারিলে, ধ্রুবকে বাহির করা মুস্কিল হইবে না। তবে একটু সহিষ্ণুতার ও সাবধানতার প্রয়োজন হইবে, কারণ ধ্রুব বেশি উজ্জ্বল তারা নহে।

 ঠিক খাড়া জিনিসের ছায়া বেলা ঠিক বারোটার সময় যেদিকে পড়ে সেইটা উত্তরদিক। দড়ির আগায় ভার বাঁধিয়া ঝুলাইলে সেই দড়িকে ঠিক খাড়া মনে করা যায়। বারোটার সময় ঐরূপ দড়ির ছায়া কোথায় পড়ে, তাহা খড়ি দিয়া চিহ্নিত করিয়া লইবে। রাত্রিতে ঐ খড়ির দাগ দেখিয়া উত্তর দিক স্থির করিবে। তারপর ধ্রুবতারা খুঁজিয়া বাহির করিবে।

 প্রাচীনকালে দিগদর্শন যন্ত্র ছিল না। তখনকার নাবিকেরা ধ্রুবতারা দেখিয়া দিক স্থির করিত।

 আমরা ধ্রুবকে আকাশের প্রান্ত হইতে অনেকখানি উপরে দেখিতে পাই। তোমরা যদি ধ্রুবকে খুঁজিয়া বাহির করিতে পার, তবে দেখিবে যে, ধ্রুব হইতে আকাশের প্রান্তের মধ্যে যে তারাগুলি আছে তাহাদেরও উদয় অস্ত নাই।

  1. পত্রিকার পাতায় ছবিটি বিবর্ণ হয়ে যাওয়ায় দেওয়া সম্ভব হল না।