উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/দাসত্বপ্রথা : ১

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

দাসত্বপ্রথাঃ ১

 তোমাদের অনেকেই টমকাকার কুটির পড়িয়াছ, এবং দাস-ব্যবসায় সম্বন্ধে অনেক কথা জান। ইউরোপের সভ্য সাহেবগণ আমেরিকায় যাইয়া চিনি, তুলা ইত্যাদির চাষ করিতেন, এবং ইউরোপের বাজারে সেই-সকল জিনিস বিক্রয় করিয়া ধনী হইতেন॥ এই-সকল কারবারে ক্ষেতে খাটিবার জন্য অনেক লোকের দরকার হইত। মাহিয়ানা করিয়া চাকর রাখিতে গেলে বিস্তর পয়সা লাগে, লাভ তত বেশি হয়না, সুতরাং অল্প পয়সায় যাহাতে কাজ চলে, সাহেবরা শীঘ্রই তাহার একটা উপায় স্থির করিলেন৷

 আফ্রিকায় নিগ্রোজাতির বাস। নিগ্রোরা বলিষ্ঠ, কর্মক্ষম, সরল এবং শান্ত স্বভাব। একদল লোক ইহাদিগকে বলপূর্বক ধরিয়া আমেরিকায় আনিয়া বিক্রয় করিতে লাগিল, এইরূপে দাস-ব্যবসায়ের সৃষ্টি হইল। এই-সকল লোকদের উপর কিরূপ পশুর মতন নিষ্ঠুর ব্যবহার করা হইত, নিম্নলিখিত গল্পটি পড়িলেই তাহা বুঝিতে পরিবে৷

 লাইবেরিয়া একজন নিগ্রো পাদরি আছেন। বাল্যকালে তাঁহাকে দাস ব্যবসায়ীদের হাতে পড়িয়া ভয়ানক কষ্ট পাইতে হইয়াছিল। তাঁহাকে ধরিবার সময় পাষণ্ডেরা তাঁহার গায়ে যে আঘাত করিয়াছিল, এই বৃদ্ধ বয়সেও তাহার চিহ্নসকল আছে। পাঁচ বৎসর বয়সের সময় তাঁহাকে চুরি করিয়া আনে। তাঁহার পিতা আফ্রিকার ঐস্থানের একজন ধর্মযাজক ছিলেন। একটি ছোট গ্রামের একটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কুটিরে তাঁহারা বাস করিতেন। ইহার নিকটেই তাঁহাদের কাঠের ছোট কালো দেবতাটির মন্দির ছিল। রোজ দুবেলা ছেলেদের সেই দেবতার কাছে লইয়া গিয়া হাতজোড় করিয়া পূজা করিতে শিখাইতেন। এইরূপ নির্দোষ সুখে তাঁহাদের জীবন চলিত, ভবিষ্যতের দারুণ দুঃখের কথা তাঁহারা স্বপ্নেও জানিতে পারেন নাই৷

 এই গ্রামের নিকটেই আর-একদল নিগ্রো বাস করিত। ইহারা টাকার লোভে পর্টুগীজ দাস-ব্যবসায়ীদিগকে এই গ্রামে পথ দেখাইয়া আনিল। এক-দিন রাত্রিতে সকলে নিশ্চিন্ত মনে নিদ্রা যাইতেছে, এমন সময় একদল সশস্ত্র লোক গ্রামে প্রবেশ করিয়া যতজনকে ধরিতে পারিল, বন্ধন করিল। মৃত লোককে বিক্রি করা যাইবে না, সুতরাং অধিক লোককে মারা হইল না৷

 পিতা তিনটি সস্তানকে লইয়া সময় থাকিতেই জঙ্গলে পালাইতে পারিয়াছিলেন। মাতা কনিষ্ঠ শিশুটিকে লইয়া গ্রামান্তরে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় লইলেন। পনেরো দিবস তাঁহারা সেই স্থানে ছিলেন, এই সময়ের মধ্যে আত্মীয়েরা অবশিষ্ট তিনটি সস্তান এবং তাঁহাদের পিতার সন্ধান লইতে যথাসাধ্য চেষ্টা করিলেন, কিন্তু তাঁহাদের কোনোরূপ খবরই পাওয়া গেল না। পনেরো দিনের পর একদিন রাত্রিতে দাস-ব্যবসায়ীরা এই গ্রামে আসিয়া সকলকে আক্রমণ করিল। আত্মীয়েরা কোথায় পলাইয়া গিয়াছিলেন, মাতা এবং পুত্র বন্দী হইলেন। ইহাদিগকে পর্টুগীজদিগের ছাউনীতে লইয়া আসিল। সেখানে সপ্তাহকাল তাঁহাদের উপর বিশেষ কোনো অত্যাচার হয় নাই, কারণ পর্টুগীজেরা এদিক ওদিক মানুষ ধরিতে ব্যস্ত ছিল। সেখানেও অন্য অনেক লোকের উপরে নানারকম লোমহর্ষণ অত্যাচার হইয়াছিল। অনেক পিতা পরিবারের জন্য যুদ্ধ করিয়া বন্দুকের গুলিতে হত হইলেন, অনেক মাতা শিশুসন্তানকে লইয়া পলায়নের চেষ্টা করাতে অস্ত্রাঘাতে প্রাণ হারাইলেন।

 যখন অনেকগুলি দাস’ সংগৃহীত হইল তখন ইহাদিগকে একটা ডিপোতে লইয়া যাওয়া হইল। সেখানে চারিশতের বেশি লোককে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া রাখা হইয়াছে। এরপর ইহাদিগকে শিকল দিয়া বাধিয়া আফ্রিকার সেই ভয়ানক রৌদ্রে একশত আশি মাইল পথ লইয়া গেল, এই সময় তাহাদের যে কি নিষ্ঠুর ব্যবহার সহ্য করিতে হইয়াছিল, তাহ বর্ণনা করা যায় না। ছেলেগুলি চোখের সামনে থাকিলে তাহদের কষ্ট দেখিয়া পিতামাতা নিরুৎসাহ হইতে পারে, এই বলিয়া বলপূর্বক তাহাদিগকে পৃথক করিয়া দেওয়া হইল। অনেক সময় স্ত্রীলোক এবং শিশুরা আর চলিতে না পারিয়া রাস্তায় পড়িয়া যাইত, তখন চাবুক মারিয়া তাহাদিগকে উঠিতে বাধ্য করিত। চাবুকে না কুলাইতে লোহার তীক্ষ লাঠিদ্বারা খোঁচা মারিত। বহু সংখ্যক লোক এত অত্যাচার সহ্য করিতে না পারিয়া প্রাণত্যাগ করিল। আমাদের পরিচিত শিশুটির মাতা তাহার মধ্যে একজন। শিশুটি কাঁদিতে কাঁদিতে বিষম প্রহার খাইয়া প্রাণের ভয়ে চুপ করিয়া রহিল।

 এইরূপে চলিয়া শেষে সমুদ্রের ধারে উপস্থিত হইল। সেখানে তাহাদিগকে লইয়া যাইবার জন্য জাহাজ প্রস্তুত। জাহাজ দেখিয়া তাহাদের মনে অধিকতর আতঙ্ক উপস্থিত হইল। তাহারা জাহাজ দেখিয়া মনে করিল যে, এটা বুঝি একটা ভয়ানক জানোয়ার, আর এটাকে খাওয়াইবার জন্য তাহাদিগকে ধরিয়া আনিয়াছে। ভয়ে হতভাগ্যেরা চীৎকার করিতে লাগিল, তাহাদিগকে বলপূর্বক জাহাজে তোলা হইল।

 জাহাজের ভিতরে আলমারিতে বই রাখিবার মতন করিয়া দাসদিগকে রাখা হইত। পরিণত বয়স্কদের জন ছয় ফুট লম্বা আর এক ফুট চার ইঞ্চি উচু স্থান আর পাশাপাশি যত লোক ধরে — বেচারাদের পাশ ফিরিবার সম্ভাবনা থাকিত না। ছেলেদের জন্য পাঁচ ফুট লম্বা এক ফুট উচু স্থান। এইরূপে তাহদের দুই মাস কাল থাকিতে হইত। সাত-আট দিন পর একদিন কেবলমাত্র এক ঘণ্টা কালের জন্য তাহাদিগকে উপরে আসিতে দেওয়া হইত। এত অত্যাচারে কয়জন বাঁচিয়া থাকিবে? তিনজনের ভিতরে দুইজন সাধারণত জাহাজেই মারা যাইত, অবশিষ্টেরাও জন্মের মত বিকলাঙ্গ হইয়া থাকিত।