উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/মহাভারতের কথা

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

মহাভারতের কথা

 রাত্রিকালে আকাশের উত্তর ভাগে সাতটি উজ্জ্বল তারা দেখিতে পাওয়া যায়, ইহাদিগকে ‘সপ্তর্ষি’ অর্থাৎ সাতমুনি বলে।

 সাতটি মহামুনি সাতটি ভাই —ব্রহ্মার সাতটি পুত্র। সকল মুনির আগে এই সাত মুনি জন্মিয়াছিলেন। তখন জীবজন্তুর জন্ম হয় নাই। এই সাত মুনির নাম—

 মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরাঃ, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু আর বশিষ্ঠ।

 বশিষ্ঠের পুত্র শক্তি, শক্তির পুত্র পরাশর, পরাশরের পুত্র মহামুনি ব্যাস। ব্যাসদেবের মৃত্যু নাই, বিশ্বসংসারে কোন বিষয়ই তাঁহার অজানা নাই। যাহা কিছু হইয়াছে, যাহা কিছু হইতেছে, আর যাহা কিছু হইবে সকলই তিনি জানেন।

 সাধারণ মানুষের চক্ষু আছে, তথাপি তাহারা অন্ধের ন্যায় কাজ করে। ধর্ম-অধর্মের কথা, পাপ-পুণ্যের কথা, তাহাদিগকে না বলিয়া দিলে, তাহারা কেমন করিয়া বুঝিবে? ইহাদের কথা ভাবিয়া ব্যাসদেবের বড়ই দয়া হইল।

 তাই তিনি সুন্দর ভাষায়, সুললিত ছন্দে অতি আশ্চর্য কবিতা রচনা করিয়া, জ্ঞান, ধর্ম, শাস্ত্র, ইতিহাস প্রভৃতির সার কথা সকলের পক্ষে সহজ করিয়া দিলেন। এই-সকল কবিতা রচনা করিয়া ব্যাসদেবের মনে এই চিন্তা হইল যে, এখন কি করিয়া তাঁহার শিষ্যদিগের পক্ষে ইহা শিক্ষা করার সুবিধা হয়।

 ব্যাসের চিন্তার কথা জানিতে পারিয়া, ব্রহ্ম তাঁহাকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য, এবং লোকের উপকারের নিমিত্ত, তাঁহার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ব্রহ্মাকে দেখিবামাত্র, ব্যাস নিতান্ত আশ্চর্য এবং ব্যস্ত হইয়া, তাঁহার বসিবার জন্য আসন দিয়া, জোড় হাতে তাঁহার নিকট দাঁড়াইয়া রহিলেন। তারপর ব্রহ্ম আসনে বসিয়া ব্যাসকেও বসিতে অনুমতি করিলে, তিনি আনন্দের সহিত তাঁহার নিকটে বসিয়া বিনীত ভাবে বলিলেন—

 “ভগবান, আমি একখানি সুন্দর কাব্য রচনা করিয়াছি, ইহাতে বেদ, বেদাঙ্গ, উপনিষৎ, পুরাণ, ইতিহাস প্রভৃতির সার আছে। ধর্ম, অধর্ম আর সংসারের সকল কাজের উপদেশ আছে। পৃথিবী, চন্দ্র সূর্য, গ্রহ, তারা, নদ, নদী, সমুদ্র, পর্বত, গ্রাম, নগর, বন উপবনের বর্ণনা আছে। এমন কবিতা আমি রচনা করিয়াছি, কিন্তু ভগবন্, আমার এই-সকল কবিতা লিখিয়া দিবার উপযুক্ত একজন ভাল লেখক খুঁজিয়া পাইতেছি না।”

 ব্রহ্মা বলিলেন, “বৎস, তুমি অতি মধুর কাব্য রচনা করিয়াছ। আর কোন কবিই এমন কাব্য লিখিতে পারিবে না। তুমি গণেশকে স্মরণ কর, তিনিই তোমার এই আশ্চর্য কাব্যের উপযুক্ত লেখক।”

 এই কথা বলিয়া ব্রহ্মা চলিয়া গেলেন। তারপর গণেশকে স্মরণ করিবামাত্র, তিনি আসিয়া ব্যাসের নিকট উপস্থিত হইলে, ব্যাস তাঁহাকে যথেষ্ট সম্মান এবং আদর দেখাইয়া, বিনয় পূর্বক বলিলেন—

 “হে গণপতি, আমি আমার মন হইতে বলিয়া যাইতেছি, আপনি কৃপা করিয়া আমার কাব্যখানি অবিকল লিখিয়া দিন।”

 এ কথায় গণেশ বলিলেন, “মুনিবর, আমি আপনার লেখক হইতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু দেখিবেন, লিখিতে লিখিতে যেন আমাকে কলম হাতে করিয়া বসিয়া থাকিতে না হয়;আমি খুবই তাড়াতাড়ি লিখিতে পারি।”

 তাহা শুনিয়া ব্যাস বলিলেন, “অতি উত্তম কথা। আমি যথাসাধ্য তাড়াতাড়িই বলিতে চেষ্টা করিব। কিন্তু দেখিবেন, যেন তাড়াতাড়ি লিখিতে গিয়া আপনি যাহা-তাহা লিখিয়া না বসেন। আমি যাহা বলিব, তাহার অর্থ বুঝিয়া তবে লিখিবেন, না বুঝিয়া লিখিতে পারিবেন না।”

 গণেশ বলিলেন, “আচ্ছা, তাহাই হইবে।”

 এইরূপ নিয়ম করিয়া ত লেখা আরম্ভ হইল। ব্যাস বড়ই বুদ্ধিমান্ লোক, তাই তিনি বলিয়াছেন, “অর্থ বুঝিয়া তবে লিখিতে হইবে।” সোজাসুজি লিখিয়া যাওয়ার কথা হইলে, আর তিনি গণেশের সঙ্গে পারিয়া উঠিতেন না! গণেশের মত লেখক ত্রিভুবনে নাই;তাঁহার কলমের কাছে ঝড় হার মানিয়া যায়, কবিতা রচনা করিয়া তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে চলিবার শক্তি ব্যাসেরও ছিল কি না সন্দেহ। কিন্তু ব্যাস অতি চমৎকার উপায়ে গণেশকে জব্দ করিলেন। এক একটি শ্লোক তিনি এমনি কঠিন করিয়া দিতে লাগিলেন যে, তাহার অর্থ বুঝিতে গণেশ যে সর্বজ্ঞ, তাঁহাকেও ভ্রূকুটি করিয়া ভাবনায় পড়িতে হয়। গণেশ যতক্ষণ ভাবেন, ততক্ষণে ব্যাস বিস্তর শ্লোক রচনা করিয়া ফেলেন। কাজেই গণেশের আর কলম থামাইবার আবশ্যকই হইল না।

 এই কাব্য প্রস্তুত করিয়া ব্যাসদেব সকলের আগে তাহা নিজের পুত্র শুকদেবকে শিখাইলেন। তারপর তাঁহার শিষ্যেরা তাহা শিক্ষা করেন। দেবলোকে নারদ, পিতৃলোকে অসিত দেবল, গন্ধর্ব যক্ষ ও রাক্ষসদিগের নিকট শুকদেব ও মনুষ্যলোকে বৈশম্পায়ন ইহার প্রচার করেন। দেবতারা এই পুস্তক আর চারিবেদ ওজন করিয়া দেখিয়াছিলেন যে, চারিখানি বেদ অপেক্ষা ব্যাসের এই কাব্যই অধিক ভারি। এইজন্য এই কাব্যের নাম মহাভারত” রাখা হইয়াছে।