৪৪

আমাদের এই পল্লিখানি পাহাড় দিয়ে ঘেরা,
দেবদারুর কুঞ্জে ধেনু চরায় রাখালেরা!
কোথা হতে চৈত্রমাসে  হাঁসের শ্রেণী উড়ে আসে,
অঘ্রানেতে আকাশপথে যায় যে তারা কোথা,
আমরা কিছুই জানি নেকো সেই সুদূরের কথা।
আমরা জানি গ্রাম ক’খানি, চিনি দশটি গিরি-
মা ধরণী রাখেন মোদের কোলের মধ্যে ঘিরি।

সে ছিল ওই বনের ধারে ভুট্টাখেতের পাশে
যেখানে ওই ছায়ার তলে জলটি ঝরে আসে।
ঝর্না হতে আনতে বারি  জুটত হোথা অনেক নারী,
উঠত কত হাসির ধ্বনি তারি ঘরের দ্বারে,
সকাল-সাঁঝে আনাগোনা তারি পথের ধারে।
মিশত কুলু-কুলুধ্বনি তারি দিনের কাজে,
ওই রাগিণী পথ হারাতো তারি ঘুমের মাঝে।

সন্ধ্যাবেলায় সন্ন্যাসী এক, বিপুল জটা শিরে,
মেঘে-ঢাকা শিখর হতে নেমে এলেন ধীরে।
বিস্ময়েতে আমরা সবে  শুধাই, ‘তুমি কে গো হবে!’
বসল যোগ নিয়ে নির্ঝরিণীর কূলে।
নীরবে সেই ঘরের পানে স্থির নয়ন তুলে।

অজানা কোন্ অমঙ্গলে বক্ষ কাঁপে ডরে-
রাত্রি হল, ফিরে এলেম যে যার আপন ঘরে।

পরদিনে প্রভাত হল দেবদারুর বনে,
ঝর্নাতলায় আনতে বারি জুটল নারীগণে।
দুয়ার খোলা দেখে আসি,  নাই সে খুশি, নাই সে হাসি-
জলশূন্য কলসখানি গড়ায় গৃহতলে,
নিব-নিব প্রদীপটি সেই ঘরের কোণে জ্বলে।
কোথায় সে যে চলে গেল রাত না পোহাতেই,
শূন্য ঘরের দ্বারের কাছে সন্ন্যাসীও নেই।

চৈত্রমাসে রৌদ্র বাড়ে, বরফ গ’লে পড়ে-
ঝর্নাতলায় বসে মোরা কাঁদি তাহার তরে।
আজিকে এই তৃষার দিনে  কোথায় ফিরে নিঝর বিনে,
শুষ্কলস ভরে নিতে কোথায় পাবে ধারা!
কে জানে সে নিরুদ্দেশে কোথায় হল হারা!
‘কোথাও কিছু আছে কি গো’ শুধাই যারে তারে—
‘আমাদের এই আকাশ-ঢাকা দশ পাহাড়ের পারে?

গ্রীষ্মরাতে বাতায়নে বাতাস হু হু করে,
বসে আছি প্রদীপ-নেবা তাহার শূন্য ঘরে।
শুনি বসে দ্বারের কাছে  ঝর্না যেন তারেই যাচে-
বলে, ওগো, আজকে তোমার নাই কি কোনো তৃষা?

জলে তোমার নাই প্রয়োজন, এমন গ্রীষ্মনিশা?’
আমিও কেঁদে কেঁদে বলি, ‘হে অজ্ঞাতচারী,
তৃষ্ণা যদি হারাও তবু ভুলো না এই বারি।’

হেনকালে হঠাৎ যেন লাগল চোখে ধাঁধা-
চারি দিকে চেয়ে দেখি নাই পাহাড়ের বাধা।
ওই যে আসে কারে দেখি-  আমাদের যে ছিল সে কি!
‘ওগো তুমি কেমন আছ, আছ মনের সুখে?
খোলা আকাশতলে হেথা ঘর কোথা কোন্ মুখে?
নাইকো পাহাড়, কোনোখানে ঝর্না নাহি ঝরে,
তৃষ্ণা পেলে কোথায় যাবে বারিপানের তরে?

সে কহিল, ‘যে ঝর্না বয় সেথা মোদের দ্বারে
নদী হয়ে সেই চলেছে হেথা উদার ধারে।
সেই আকাশ সেই পাহাড় ছেড়ে  অসীম-পানে গেছে বেড়ে,
সেই ধরারেই নাইকো হেথা পাষাণবাঁধা বেঁধে।’
‘সবই আছে, আমরা তো নেই’ কইনু তারে কেঁদে।
সে কহিল করুণ হেসে, ‘আছ হৃদয়মূলে।’
স্বপন ভেঙে চেয়ে দেখি আছি ঝর্নাকূলে।

জোড়াসাঁকো। কলিকাতা ১০ মাঘ ১৩০৯