এই কি ব্রাহ্ম বিবাহ

এই কি ব্রাহ্ম বিবাহ

এই কি ব্রাহ্ম বিবাহ।

শ্রীযুক্ত শিবনাথ শাস্ত্রী

প্রণীত।

আল্‌বার্ট প্রেস;

৩৭ নং মেছুয়াবাজার ষ্ট্রীট—ঠন্‌ঠনিয়া,

কলিকাতা

বৈশাখ,—১২৮৫।

মূল্য ৶৹ আনা।

এই কি ব্রাহ্ম বিবাহ।

 এত দিনের পর কেশব বাবুর নিজ কথা শুনিতে পাওয়া গেল। শ্রীযুক্ত বাবু প্রতাপচন্দ্র মজুমদার ও শ্রীযুক্ত বাবু গৌরগোবিন্দ রায় উভয়ে স্বাক্ষর করিয়া “ধর্ম্মতত্ত্বের অতিরিক্ত” একখানি সুদীর্ঘ পত্রে কেশব বাবুর পক্ষ সমর্থন করিয়াছেন এবং বলিয়াছেন যে “আচার্য্য মহাশয়ের সম্মতিক্রমে তাহা সাধারণের হিতার্থ লিপিবদ্ধ করিলাম।” সুতরাং এই সমুদায় কথা কেশব বাবুর নিজের কথা বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। এখানে একটু টীকা করা আবশ্যক—প্রচারক মহাশয়দ্বয় লিখিতেছেন, “সাধারণের হিতার্থ। তুমি আমি হইলে হয় ত লিখিতাম “সাধারণের অবগতির জন্য।” সে যাহা হউক আমি প্রচারক মহাশয়দ্বয়ের প্রকাশিত পত্রখানির তন্ন তন্ন করিয়া বিচার করিবার সংকল্প করিয়াছি, ব্রাহ্ম পাঠকগণের প্রতি এই অনুরোধ তাহারা আমার প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশপূর্ব্বক একটু ধীর ভাবে উভয় পক্ষের কথাগুলি পাঠ ও বিচার করিয়া দেখিবেন।

 ১। প্রচারক মহাশয় দ্বয় প্রথমেই বলিতেছেন:—

 “অপবাদ ও নিন্দা পরিহার পূর্ব্বক যদি কেহ কেহ নিরপেক্ষ ভাবে, বন্ধুতার অনুরোধে ও সাধারণের হিতকামনায় আচার্য্য মহাশয়কে ইতিপূর্ব্বে পত্র লিখিতেন বোধ করি তিনি তাঁহাদের কৌতুহল চরিতার্থ করিতেন।”

 মফস্বলের পাঠকগণ এ বিষয়ের প্রকৃত কথা জানেন না। সমালোচকে তাহার কিছু কিছু প্রকাশ হইয়াছে। গত পূজার পূর্ব্বে যখন বিবাহের প্রস্তাবের কথা প্রথম কলিকাতাতে প্রচার হয় তখন শ্রীযুক্ত বাবু আনন্দমোহন বসু কেশব বাবুর নিকট সবিশেষ বিবরণ জানিতে গিয়াছিলেন। কেশব বাবু তখন কিছু স্থির হয় নাই বলিয়া তাঁহাকে বিদায় করিয়াছিলেন। সবিশেষ বিবরণ কিছুই বলিলেন না। পরে ১১ মাঘের উৎসবের পর বিবাহের কথা যখন পুনরায় উঠিল, তখন আমি এবং আমার দুই জন বন্ধু মিলিত হইয়া ২রা ফেব্রুয়ারি কেশব বাবুর নিকট গমন করি। আমরা কেশব বাবুকে বলিলাম, যে “এরূপ জনরব যে ৬ই মার্চ্চ আপনার কন্যার বিবাহ? এ প্রস্তাব কতদূর অগ্রসর হইয়াছে, আমরা জানিতে ইচ্ছা করি।” তাহাতে তিনি বলিলেন যে, “প্রস্তাবের এখনও কিছু স্থির হয় নাই, একটী নিয়ম ভঙ্গিয়া গেলে হয় ত সমুদায় নিয়ম ভাঙ্গিয়া যাইতে পারে।” তাহাতে তাঁহাকে বিশেষ করিয়া জিজ্ঞাসা করা হইল, আপনি কি কন্যার বয়ঃপ্রাপ্তির পূর্ব্বে বিবাহ দিতে সম্মত হইবেন? তাহাতে তিনি বলিলেন, তাহারও অনেক নিয়ম আছে; ধর্ম্মের দিক অগ্রে দেখিতে হইবে। ধর্ম্মের দিক কিরূপ? জিজ্ঞাসা করাতে বলিলেন—পাত্রের ধর্ম্মবিশ্বাস, বিবাহপদ্ধতি প্রভৃতি। যখন কেশব বাবুর নিকট সবিশেষ কিছুই পাওয়া গেল না তখন আমরা উঠিলাম। উঠিবার সময় বলা হইল;—“লোকে আমাদিগকে ইতিমধ্যেই বলিতেছে তোমরা না কান্তগিরির ঘাড়ের মাস খাইয়াছিলে? তাহাতে তিনি যেন একটু বিরক্ত হইয়া বলিলেন,—“তোমরা কেশবচন্দ্র সেনেরও ঘাড়ের মাস ছিঁড়িও।” আমরা পরে চলিয়া আসিলাম। কেশব বাবু আমাদিগকে বলিয়াছিলেন যে অনুমান ১০ দিনের মধ্যে সমুদায় স্থির হইবে। কিন্তু দুই তিন দিনের মধেই শুনা গেল বিবাহ হওয়া স্থির এবং ৯ই ফেব্রুয়ারি দিবসের সুলভ ও মিরারে বিবাহের বিষয় প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করা হইল। সেই দিনেই ২৩ জনের স্বাক্ষরিত একখনি প্রার্থনা পত্র কেশব বাবুর হস্তে অর্পিত হইল এবং ঐ পত্র মুদ্রিত করিয়া সমুদায় সমাজে প্রেরিত হইল। অপরাধের মধ্যে সেই পত্রে বলা হইয়াছিল, যে, পাত্রটি শিশু, অগঠিত চরিত্র, ও বিদ্যাবুদ্ধি সম্বন্ধে ও কাঁচা, এরূপ পাত্রে এত গুলি নিয়ম ভঙ্গ করিয়া কন্যা দিলে লোকে মনে করিবে আপনি পাত্রের পদ ও ধন দ্বারা আকৃষ্ট হইয়াছেন; আপনার সম্বন্ধে এরূপ অপবাদ ও আমাদের সমাজের পক্ষে অনিষ্টকর।” এই টুকুই প্রচারক মহাশয় দিগের বিচারে অপবাদ ও নিন্দা বলিয়া গণ্য হইল। কেশববাবু একবার পত্রখানি পড়িলেন না অথচ পরের মুখে অম্লাস্বাদনের ন্যায় বুঝিলেন যে তাহা বিদ্বেষবিজম্ভিত এবং এই বিবেচনা করিয়াই ৬৬ বৎসরের প্রাচীন ব্রাহ্ম শিবচন্দ্র দেব, আনুষ্ঠানিক ব্রাহ্মদের অগ্রণী বাবু দুর্গামোহন দাস এবং বঙ্গদেশের শিক্ষিত সমাজের মুখশ্রীস্বরূপ আনন্দমোহন বসু প্রভৃতির স্বাক্ষরিত সেই পত্রখানি পড়া পাপ বলিয়া ফেলিয়া দিলেন। তথাপি আনন্দমোহন বাবু ১৬ ফেব্রুয়ারি কেশব বাবুকে এক পত্র লিখিয়া তাঁহার অভিপ্রায় জানিবার ইচ্ছা করিলেন। ঐ পত্র ২৩ ফাল্গুণের সমালোচকে এবং ১১ই এপ্রেলের “ব্রাহ্ম পবলিক ওপিনিয়নে” প্রকাশ হইয়াছে। পাঠক গণকে অনুরোধ করি, পত্রখানি পড়িয়া দেখিবেন আনন্দ মোহন বাবু কিরূপ সদ্ভাবের সহিত পত্রখানি লিখিয়াছিলেন। এতদ্ভিন্ন ১৯ ফেব্রুয়ারি শিবচন্দ্রদেব প্রভৃতি আবার কেশব বাবুকে আর এক খানি বিনয়পূর্ণ পত্র লেখেন। কেবল তাহাও নহে ঐ সময়ে বাবু উমেশ চন্দ্র দত্ত প্রভৃতি কয়েক জন গণ্য ব্রাহ্ম কেশববাবুর অভিপ্রায় জিজ্ঞাসা করিয়া আর এক পত্র লেখেন। ইহার কোন পত্রের উত্তর দেওয়া হয় নাই। কেশব বাবু আনন্দ মোহন বাবুর পত্রের উত্তর দিয়াছেন কিন্তু শুনিতে পাওয়া যায় তাহা গোপনীয় বলিয়া দিয়াছেন এবং তাহাতে তাঁহার নিজের অভিপ্রায় কিছুমাত্র প্রকাশ করেন নাই। পাঠকগণ বলুন দেখি—ইহা দেখিয়া এরূপ বলা যায় কিনা যে কেশববাবুর মনের অভিপ্রায় জানিবার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করা হইয়াছে। আর কেশববাবুরই বা একি ব্যবহার! তিনি এত বড় একটী কার্য্য করিতে গেলেন একবার স্বদলস্থ লোকদিগকে একটা কথাও বলিলেন না; বার বার জানিতে যাওয়া গেল কথা কাটাইয়া দিলেন; প্রার্থনা করা গেল প্রার্থনা পত্র অবহেলা করিয়া অপমান করিলেন। এই কি আচার্য্যের ব্যবহার!!!

 ২। প্রচারকদ্বয় বলেন;—“এ বিবাহের কতকগুলি ব্যাপারে যদি অপর কেহ দুঃখিত হইয়া থাকেন তাহা হইলে ইহা জানা কর্ত্তব্য যে তাঁহার হৃদয় তৎসম্বন্ধে সর্ব্বাপেক্ষা অধিক ব্যথিত হইয়াছে। অনুষ্ঠানটী সম্পূর্ণরূপে তাঁহার নিজের ইচ্ছানুরূপ হয় নাই, এজন্য তিনি মনের অসন্তোষ কখন সংগোপন করেন নাই। যদি কিছু অন্যায় ঘটিয়া থাকে তাহা অন্য লোকে বিবেকের অনুরোধে যেমন অন্যায় বলিয়া প্রতিবাদ করিবেন তিনিও সেইরূপ মুক্ত কণ্ঠে অন্যায় বলিতে প্রস্তুত।” এই বিবাহ সম্বন্ধে ব্রাহ্মদিগের দুইটী ক্ষোভের কারণ ঘটিয়াছে (১) বাল্য বিবাহ দোষ (২য়) পৌত্তলিকতা দোষ। প্রতাপ বাবুগৌর বাবুত এদুটীই অস্বীকার করিয়াছেন। তাঁহাদের পত্রের শেষ ভাগে এক স্থলে তাঁহারা বলিয়াছেন;—“বাস্তবিক উক্ত বিধির মূল তাৎপর্য্য এই যে যৌবনারম্ভই কন্যার উপযুক্ত বয়স। এ নিয়ম বর্ত্তমান বিবাহে পূর্ণ হইয়াছে। সুতরাং কেশব বাবু আপন কন্যার বয়স সম্বন্ধে পূর্ব্ব বিশ্বাসের বিরুদ্ধ ব্যবহার করেন নাই। দ্বিতীয়তঃ পৌত্তলিকতা সম্বন্ধে যে অভিযোগ তাহাও অমূলক”। জিজ্ঞাসা করি তবে কেশব বাবু দুঃখিত কেন? যদি বাল্য বিবাহের দোষ নাই, পৌত্তলিকতা দোষ নাই তবে কেশব বাবুর দুঃখের কারণও নাই?

 ৩। প্রচারকদ্বয় বলেন;—“কিন্তু তিনি ধনলোভে পৌত্তলিক অনুষ্ঠান করিয়াছেন অথবা বাল্য বিবাহ দিয়াছেন কিম্বা পুনরায় হিন্দুসমাজভুক্ত হইবার চেষ্টা করিয়াছেন এরূপ নীচ ও জঘন্য অপবাদের আমরা সকলেই বিরোধী।” এ কথা কে বলিল? আমরাও এরূপ অপবাদের বিরোধী।

 ৪। তাঁহারা পরে বলিতেছেন;—“সর্ব্বপ্রথমে ইহা বলা আবশ্যক যে আচার্য্য মহাশয় বিবেকের আদেশে এই কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। আমরা জানি কন্যার বিবাহে তাঁহার অত্যন্ত উপেক্ষা ছিল এবং তিনি এত গুরুতর ব্যাপারে সর্বদা নিশ্চিন্ত থাকিতেন এক দিনের জন্যও তিনি পাত্রানুসন্ধান করিতে ব্যস্ত হন নাই। ঘটনাক্রমে ঈশ্বর যখন পাত্র আনিয়া উপস্থিত করিলেন, তিনি তাহা অকুণ্ঠিত ভাবে গ্রহণ করিলেন। তিনি ফলবাদী নহেন, সুতরাং ফলের দিকে দৃষ্টি করেন নাই।” পাত্রটী ঈশ্বরানীত! কারণ কেশব বাবু পাত্র অন্বেষণ করিতে যান নাই, আপনি আসিয়াছে। পাঠকগণ হয় ত জানেন, যে কেশব বাবুর কন্যার সহিত বিবাহের প্রস্তাব হইবার পূর্ব্বে এই পাত্রেরই জন্য মান্দ্রাজে কন্যা দেখা হয়; কলিকাতার অপর তিন জন ব্রাহ্মের কন্যার সহিত ও পূর্ব্বে কথা হয়। তাঁহারা বিশ্বাস ও সংস্কারের বিরুদ্ধ কার্য্য করিতে অস্বীকৃত হওয়াতে পরে কেশব বাবুর নিকট প্রস্তাব উপস্থিত হয়। পূর্ব্বোক্ত ব্যক্তিদিগেরও ত নিকট পাত্র উপযাচক হইয়া গিয়াছিল। তবে কি এই বলিব যে ঈশ্বর পাত্রটী লইয়া দ্বারে দ্বারে ফিরিয়া দেখিলেন সকলেই বড় শক্ত অবশেষে কেশব বাবুর নিকট আসিয়া কৃতকার্য্য হইলেন!!! আর এই পাত্রে কন্যা দিব কি না এরূপ প্রশ্নের সঙ্গে বিবেকের কি সম্বন্ধ আমরা বুঝিতে পারি না। আর যেন ভাবিলাম যে ঈশ্বর পাত্রটী আনিলেন এবং এই পাত্রে কন্যা দিতে বলিলেন। ঈশ্বর বলিলেন “এই পাত্রে কন্যা দাও”। বেশ কথা! তিনি কি এরূপ ও বলিলেন, যদি গবর্ণমেণ্ট চাপাচাপি করে বয়সের নিয়ম ছাড়িয়া দাও; যদি তোমাকে একঘরে বলিয়া সম্প্রদানে আপত্তি করে কৃষ্ণবিহারীকে বসাইয়া দাও; তোমাদের পুরোহিত স্বীকার না করে তুমি তাহাদের পুরোহিত স্বীকার কর; বিবাহে পৌত্তলিক ক্রিয়া না থাকিলে বৈধ না হয় ত বর পক্ষে পৌত্তলিকতা করিবার অনুমতি দাও ইত্যাদি ইত্যাদি। ঈশ্বর কি এত দূর ও আদেশ করিয়াছেন অথবা বিবেক এতদূর বলিয়াছে? প্রশ্ন করিতেই লজ্জা হইতেছে।

 ৫। ইহার পর তাঁহারা বলেন যে কুচবিহারের ডেপুটী কমিশনর কন্যা দেখিয়া মনোনীত করেন। তাহার পর “অক্টোবর মাসের প্রথমে আচার্য্য মহাশয় আপনার মন্তব্য সমুদায় লিখিয়া পাঠাইয়া দেন। এই পত্রে তিনি ১৩টী প্রস্তাব করেন, তন্মধ্যে প্রধান প্রস্তাব কয়েকটী নিম্নে লিখিত হইল; (১) রাজা যে ব্রাহ্ম অথবা একেশ্বরবাদী “থিইষ্ট” তাহা লেখার স্বীকার করিতে হইবে। (২) ব্রাহ্মপদ্ধতি অর্থাৎ পৌত্তলিকতাবিবর্জ্জিত বিশুদ্ধ হিন্দুপদ্ধতি অনুসারে বিবাহ সম্পন্ন হইবে, কিন্তু তাহার সহিত স্থানীয় এমন সকল প্রথার যোগ থাকিতে পারিবে যাহাতে কিছু মাত্র পৌত্তলিকতা নাই। (৩) পাত্র পাত্রী উভয়ে বয়স প্রাপ্ত হইলে বিবাহ হওয়া বিধেয়। যদি তত দিন অপেক্ষা করা না হয় তাহা হইলে আপাততঃ কেবল নির্বন্ধপত্রের অনুষ্ঠান হউক; এবং রাজা ইংলণ্ড হইতে প্রত্যাগমন করিলে বিবাহ বিধিপূর্ব্বক সম্পন্ন হইবে। (৪) ধর্ম্ম সম্বন্ধীয় প্রস্তাব ঠিক রাখিতে হইবে, কোন বিষয়ে অন্যথা হইবে না। কিন্তু যে সকল ব্যাপারে কেবল বালকত্ব কিম্বা নির্ব্বুদ্ধি প্রকাশ পায় তাহা অনুষ্ঠান করিতে চাহিলে বিশেষ আপত্তি করা হইবে না।” দুঃখের বিষয় কেশব বাবু পূর্ব্বোক্ত চারিটী প্রধান নিয়মের কোনটীই রক্ষা করিতে পারেন নাই। রাজা আপনাকে ব্রাহ্ম বলিয়া লিখিয়া দিয়াছেন কি না প্রকাশ নাই। বরং প্রচারকদ্বয় এই পত্রে স্থানান্তরে বলিয়াছেন “তাঁহার ব্রাহ্ম ধর্ম্মে অনেক দিন হইতে বিশ্বাস আছে। এ কথা তিনি বন্ধু ভাবে লিখিয়া দিতেও প্রস্তুত”। ইহাতে স্পষ্ট বোধ হইতেছে রাজা আজিও লিখিয়া দেন নাই। পূর্ব্বে সুলভ গুজব তুলিয়াছিলেন যে রাজা প্রকাশ্যভাবে ব্রাহ্মধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছেন রবিবারের মিরার তাহা স্পষ্টাক্ষরে অস্বীকার করিয়াছেন। এতদ্ভিন্ন ইষ্ট পত্রিকা এবং ব্রাহ্ম পবলিক ওপিনিয়নে রাজার নিজের মুখের কথা প্রকাশ হইয়াছে। তাহা দেখিলেই পাঠকগণ জানিবেন রাজা নিজমুখে বলিয়াছেন “যে একদিন ব্রহ্মমন্দিরে গিয়া যদি আমি ব্রাহ্ম হই তবেত আমাকে খ্রীষ্টানও বলা যায় কারণ আমি খ্রীষ্টানদিগের ভজনালয়ে অনেক বার গিয়াছি।” পাঠকগণ বুঝুন রাজা কেমন ব্রাহ্ম।—

 (২) পদ্ধতি সম্বন্ধে ঐরূপ। কুচবিহারের ব্রাহ্মণ কলিকাতায় আসিয়া শ্রীযুক্ত গৌরগোবিন্দ রায় মহাশয়ের সহিত পরামর্শ করিয়া যে পদ্ধতি প্রস্তুত করেন প্রচারকদ্বয়ের নিজেরই কথা প্রমাণে দেখা যায় কার্য্যকালে তাহা অবলম্বিত হয় নাই। কর্তৃপক্ষ বলিয়া পাঠান—“পদ্ধতির মধ্যে স্থানে স্থানে ব্রাহ্মরীতি সন্নিবিষ্ট রহিয়াছে ইহা হইতে পারে না।” ব্রাহ্মধর্ম্মের একটু গন্ধ থাকে তাহাও তাঁহারা সহ্য করিতে পারিলেন না। (৩) পাত্র পাত্রীর কিরূপ বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া বিবাহ হইয়াছে তাহা সকলেই জানেন। সে বিষয়ে বলা বাহুল্য। (৪) ধর্ম্ম সম্বন্ধীয় নিয়মও কিরূপ ঠিক ছিল তাহা সকলেই জানেন হোমেই তাহার প্রকাশ।

 এখন জিজ্ঞাসা করি, কেশব বাবু প্রথমে এনিয়মগুলি করিয়াছিলেন কার আদেশে? যদি বল বিবেকের আদেশে, তবে এগুলির ভঙ্গ হওয়াতে ত তাঁহার বিবেক বিরুদ্ধ কার্য্য হইয়াছে? যদি বল বিবেকের আদেশে নয় কিন্তু বুদ্ধির আদেশে তবে ত তিনি ফলবাদীর ন্যায় কার্য্য করিয়াছিলেন। সে যাহা হউক আমাদের এই বড় দুঃখ যে কেশব বাবু নিজে যতগুলি নিয়ম নিৰ্দ্ধারণ করিয়া ছিলেন তাহার কোনটী রক্ষিত হইল না কিন্তু তাঁহারা যাহা যাহা বলিলেন সকল রক্ষিত হইল। তাঁহারা বলিলেন কেশব বাবু কন্যা সম্প্রদান করিতে পারিবেন না, তিনি দিতে পারিলেন না—(প্রমাণ ১৭ই মর্চ্চের মিরার); তাঁহারা বলিলেন ব্রাহ্ম পুরোহিত মন্ত্র পড়াইতে পারিবেনা সুতরাং পড়াইতে পারিলেন না (প্রমাণ ঐ দিবসের মিরার) তাঁহারা বলিলেন সামাজিক উপাসনা হইবে না—সমাজিক উপাসনা হইতে পারিল না। প্রমাণ এই পত্র, কারণ ইহার একস্থানে আছে “পরে ব্রাহ্মরীতি অনুসারে প্রতিজ্ঞা প্রার্থনা ও বর কন্যার প্রতি আচার্য্যের উপদেশ এই কয়েকটী অনুষ্ঠান স্বতন্ত্র স্থানে কতিপয় ব্রাহ্মের সম্মুখে সুসম্পন্ন হইল।” ইহা দেখিয়া কোন্‌ ব্রাহ্মের হৃদয়ে না ক্লেশ হয়।—

 ৬। তাহার পর বিবাহের প্রস্তাব কিছুকাল বন্ধ থাকে, পরে ১১ মাঘের সময় আবার উপস্থিত হয়। কেশব বাবু নিজে যে নিয়মে বিবাহ দিতে স্বীকৃত হইলেন তাহা কেন ভঙ্গ করিলেন এই প্রশ্নের উত্তরে প্রচারকদ্বয় বলেন;—“বারম্বার কুচবিহার হইতে তারযোগে শীঘ্র মীমাংসার জন্য অনুরোধ আসিতে লাগিল এবং অনেক আলোচনার পর ধার্য্য হইল যে ৬ মার্চ্চ দিবসে বিবাহ হইতে পারে যদি উহা কেবল বাগ্‌দানরূপে স্বীকৃত হয় এবং গবর্ণমেণ্ট পাত্র পাত্রীকে আপাততঃ ঐ ভাবে রাখেন। গবর্ণমেণ্ট ইহাতে সম্মত হওয়াতে অন্যান্য প্রস্তাবের আলোচনা ও মীমাংসা হইতে লাগিল।” সরল ভাষায় বলিতে গেলে বলা উচিত যে তারে সংবাদ আসিল now or never “হয় এখন নতুবা বিবাহের প্রস্তাব ভঙ্গ করিতে হয়।” কেশব বাবু অমনি দেখিলেন নিয়ম ধরিয়া থাকিতে গেলে পাত্রটী হাত ছাড়া হয় অমনি নিয়ম ভঙ্গ করিতে স্বীকৃত হইলেন। তবে অপমানিত বিবেকের প্রবোধের জন্য ও ব্রাহ্মদের অভিযোগের উত্তর দিবার জন্য এই কথা বলিলেন এই বিবাহকে বাগ্‌দানের ন্যায় গণ্য করিতে হইবে।

 ৭। ইহার পর কুচবিহার হইতে পুরোহিত আসিয়া শ্রীযুক্ত বাবু গৌরগোবিন্দ রায়ের সহিত পরামর্শ পূর্ব্বক এক নূতন পদ্ধতি স্থির করিলেন। তাঁহারা বলেন;—

 “এই রূপ বন্দোবস্ত করিয়া গবর্ণমেণ্টের প্রতিনিধি রাজাকে লইয়া ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখে কুচবিহারে চলিয়া গেলেন, এবং উক্ত পদ্ধতির এক খণ্ড পাণ্ডুলিপি সঙ্গে লইয়া গেলেন। উহার সঙ্গে এক খানি ক্রোড়পত্র সংলগ্ন ছিল তাহাতে এই কয়েকটী বিশেষ নিয়ম লেখা ছিল;—১। বিবাহের সময় কিম্বা-বিবাহের পূর্ব্বে বা পরে বর বা কন্যা কোন প্রকার পৌত্তলিক অনুষ্ঠানে যোগ দিবেন না। ২। বিবাহ মণ্ডপে কোন দেব দেবীর মূর্ত্তি অথবা অগ্নি অথবা ঘটাদি স্থাপন করা হইবে না। ৩। যে মন্ত্রাদি এই কাগজে লেখা হইল তাহাই পুরোহিত পাঠ করিবেন কিন্তু তদ্ব্যতীত অন্য কোন মন্ত্রাদি উচ্চারণ করা হইবে না। ৪। মন্ত্রাদির কোন অংশ পরিত্যাগ বা পরিবর্ত্তন করা হইবে না। পদ্ধতিসম্বন্ধে আরো নির্ব্বিরোধ থাকিবার মানসে কন্যাপক্ষ হইতে এরূপ প্রস্তাব হইল যে উল্লিখিত বিবাহরীতি ডিপুটী কমিসনর সাহেব অথবা তাঁহার প্রতিনিধি বিবাহের পূর্ব্বে স্বাক্ষর করিয়া দিবেন।”

 দুঃখের বিষয় পূর্ব্বোক্ত নিয়মের কোনটাই রক্ষিত হয় নাই। (১) বিবাহের পূর্ব্বে কন্যাকে প্রায়শ্চিত্ত করান হইয়াছিল এবং বিবাহের পরে অর্থাৎ সম্প্রদানের পরে বর হোমস্থানে উপস্থিত ছিলেন। প্রথম নিয়মটীর দশা ত এইরূপ হইল! দ্বিতীয়টীর অবস্থাও তদধিক। বিবাহ মণ্ডপে দেবমূর্ত্তি, অর্থাৎ হরগৌরী, অগ্নি অর্থাৎ হোমাগ্নি এবং ঘট তিন বর্ত্তমান ছিল। (৩) তৃতীয় নিয়মটীর দুর্দ্দশা আরও অধিক হইয়াছিল সেই পদ্ধতির মন্ত্রাদির অংশ পরিবর্ত্তন করা দূরে থাকুক সে পদ্ধতিই পরিত্যক্ত হইয়াছিল। (প্রমাণ এই পত্র)

 ৮। কেহ কেহ হয় ত বিবেচনা করিতে পারেন যে কন্যাপক্ষ প্রতারণা পূর্ব্বক এই সকল নিয়ম ভঙ্গ করাইয়াছিলেন; কিন্তু তাহা নহে। তাহারা কেশব বাবুর কুচবিহার যাত্রার পূর্ব্বেই কেশব বাবুকে স্পষ্টাক্ষরে বলিয়া পাঠান যে, ব্রাহ্মরীতি সংযুক্ত পদ্ধতি অনুসারে বিবাহ হইবে না। প্রতাপ বাবু ও গৌর বাবু নিজে বলিতেছেন:—“যাত্রার আয়োজন হইতেছে এমত সময়ে তারে সংবাদ আসিল,—বিবাহ পদ্ধতি এখনো দেখা হয় নাই, উহা ছাপাইবেন না। শনিবার রাত্রিতে আর একটী তারযোগে সংবাদ আসিল—পদ্ধতির মধ্যে স্থানে স্থানে ব্রাহ্মরীতি সন্নিবিষ্ট রহিয়াছে, ইহা হইতে পারে না। রবিবারে সত্বর এ কথার প্রতিবাদ করা হইল, এবং পূর্ব্বকার কথা স্মরণ করাইয়া দেওয়া হইল। বাই নাচ সম্বন্ধেও এ সময়ে আপত্তি উঠিল এবং স্পেশল ট্রেণের দিন পরিবর্ত্তন করিবার জন্যও অনুরোধ করা হইল। কিন্তু তদ্বিষয়ে এই উত্তর আসিল যে ট্রেণের ভাড়া ও সময়াদি ঠিক হইয়া গিয়াছে, এখন বন্ধ হইতে পারে না। সোমবারে তাড়াতাড়ি করিয়া ১১টার সময় সকলে যাত্রা করিলেন।”

 জিজ্ঞাসা করি কেশব বাবু যখন দেখিলেন যে, তিনি বিবেকের অনুরোধে যে যে নিয়ম করিলেন কন্যাপক্ষ তাহা রক্ষা করিবেন না বলিয়া সংবাদ দিলেন, তখন তিনি কোচবিহারে যাত্রা করিলেন কেন? এরূপ সংবাদ শুনিয়াও যাত্রা করাতে কি তাঁহাদের কথায় সম্মতি প্রকাশ করা হইল না? স্পেশাল ট্রেণের টিকিট কেনা হইয়াছিল এই কি একটা যুক্তির মধ্যে যুক্তি। না হয় কয়েক সহস্র টাকা ক্ষতি স্বীকার করিতেন। লোকে যদি জানিতে পারিত যে বরপক্ষ ব্রাহ্ম মতে বিবাহ দিতে স্বীকৃত হইলেন না বলিয়া কেশব বাবু কোচবিহার যাত্রা করিলেন না তাহা হইলে কি তাঁহার বিপক্ষেরাও স্বপক্ষ হইয় পড়িত না? তাহা না হইয়া আমরা কি দেখিলাম? না, কেশব বাবু স্পষ্ট জানিলেন যে বরপক্ষ বিবাহ পদ্ধতিতে ব্রাহ্মগন্ধও থাকিতে দিবেন না, তথাপি কন্যা লইয়া যাত্রা করিলেন। তিনি যে বলিয়াছিলেন যে ধর্ম্মের দিক অগ্রে দেখিব, এই কি ধর্ম্মের মুখ রক্ষা করা?

 ৯। ইহার পর কন্যা পক্ষ কন্যা লইয়া কুচবিহার পৌছিলেন,—কয়েক দিন ধূমধাম ও আমোদ প্রমোদে গেল। ইহার মধ্যে আবির খেলা ও বারাঙ্গনাদের হুলু প্রভৃতি হইল, তাহা প্রচারকদ্বয় উল্লেখ করেন নাই। বিবাহের এক দিন পূর্ব্বে কন্যাপক্ষীয় কর্ম্মচারিগণ আসিয়া বলিলেন, “কেশব বাবু বিবাহমণ্ডপে উপস্থিত থাকিতে পরিবেন না, উপবীতত্যাগী ব্রাহ্মণ অথবা অন্য জাতীয় ব্যক্তি পুরোহিত হইতে পরিবেন না, সামাজিক ব্রহ্মোপাসনা হইবে না। পাত্র কন্যা বিবাহসভায় পরস্পরের প্রতি অঙ্গীকার করিবেন না, উভয় পক্ষে হোম করিতে হইবে।” ইহা লইয়া অনেক বাগ্‌বিতণ্ডা চলিল। অনেক বাদানুবাদের পর শেষে কিরূপ মীমাংসা হইল শ্রবণ করুন;—

 “শেষে এই কথা হইল যে পূর্ব্ব অঙ্গীকার অনুসারে কন্যাপক্ষে কোন পৌত্তলিক অনুষ্ঠানের সহিত কিঞ্চিন্মাত্র সংস্রব থাকিবে না, এইরূপ বন্দোবস্ত না করিলে বিবাহ হইতে পারে না। রাত্রি ১১টার সময় তদ্রূপ অনুজ্ঞা আসিল এবং সকলের ভাবনা দূর হইল। বিবাহ সভায় উপস্থিত হইয়া আমরা দেখিলাম যে একটী ক্ষুদ্র মণ্ডপের মধ্যে কয়েকটী কলাগাছ ও ৯।১০টা ঘট এরং এক হাত লম্বা লাল কাপড়ে ঢাকা একটী সামগ্রী রহিয়াছে। কাহারও কাহারও মনে এরূপ সন্দেহ হইল যে হয়তো হরগৌরী প্রভৃতি হিন্দু দেবতা পূজার জন্য বিবাহ স্থলে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। একথা ডেপুটী কমিসনর সাহেবের নিকট তৎক্ষণাৎ জ্ঞাপন করাতে তিনি উহা অস্বীকার করিলেন এবং পণ্ডিতদিগের নিকট অনুসন্ধান করিয়া স্পষ্টরূপে বলিলেন যে ঐ সকল দ্রব্যের মধ্যে পূজার বস্তু কিছুই নাই এবং কোন হিন্দু দেবতা স্থাপন করা হয় নাই। তাঁহার এবং প্রধান পণ্ডিতের কথায় প্রতীতি হইল যে মণ্ডপে কিছুমাত্র পৌত্তলিকতা নাই, তবে স্থানীয় প্রাচীন প্রথা অনুসারে কতকগুলি মঙ্গলসূচক দ্রব্য সাজান হইয়াছে। যাহা হউক সাহেবের কথার উপর নির্ভর করিয়া কার্য্য আরম্ভ হইল। বাগ্দান, স্ত্রীআচার ও পরস্পরের সম্মতি প্রকাশের পর বর বিবাহমণ্ডপে উপস্থিত হইলে আচার্য্য মহাশয় উপস্থিত ব্রাহ্মদিগের সহিত মিলিত হইয়া সভাস্থলে ব্রহ্মোপাসনা করিলেন। তদনন্তর কন্যা সভাস্থ হইলে কেশব বাবু এবং তাঁহার ভ্রাতা, বরের পুরোহিত ও কন্যার পুরোহিত শ্রীযুক্ত গৌরগোবিন্দ রায় উপাধ্যায় বিবাহমণ্ডপে আসন গ্রহণ করিলেন। পৌত্তলিক দেবতার নাম পরিবর্জ্জন করিয়া প্রচলিত হিন্দু বিবাহের মন্ত্রাদি সংশোধন পূর্ব্বক পঠিত হইলে কন্যা অন্তঃপুরে চলিয়া গেলেন। পরে ব্রাহ্মরীতি অনুসারে প্রতিজ্ঞা, প্রার্থনা ও বরকন্যার প্রতি আচার্য্যের উপদেশ এই কয়েকটী অনুষ্ঠান স্বতন্ত্র স্থানে কতিপয় ব্রাহ্মের সম্মুখে সুসম্পন্ন হইল।”

 কন্যাপক্ষে কোনপ্রকার পৌত্তলিকতা থাকিবে না, এই নিয়মে বিবাহ দিতে স্বীকৃত হওয়াতে কি বরপক্ষে পৌত্তলিকতচরণ করিবার অনুমতি দেওয়া হইল না? ইহার পর বরপক্ষ যে কিছু করিয়াছেন তাহাতে তাঁহাদের দোষ কি? যাঁহারা হিন্দু ধর্ম্মের কিছুমাত্র জানেন তাঁহারা কি জানেন না যে, দেব বিগ্রহের পরিবর্ত্তে ঘট ব্যবহৃত হইয়া থাকে? যে বাড়ীতে প্রতিমা নির্ম্মাণের সামর্থ হয় না তাহারা ঘটস্থাপন করিয়া পূজাকার্য্য সমাধা করিয়া থাকে। কে না বুঝিতে পারিতেছেন যে কেশব বাবু কোনপ্রকার দেবতার বিগ্রহ রাখিতে অস্বীকৃত হওয়াতে রাণীরা এই কৌশল অবলম্বন করিয়াছিলেন। হরগৌরী নামক যে পদার্থদ্বয় ছিল তাহা বস্ত্রাবৃত করিয়া রাখিবার কারণ এই দুঃখের বিষয় প্রচারক মহাশয়দ্বয় এই স্থলে দুইটী সত্য গোপন করিয়াছেন। (১) কেশব বাবু সম্প্রদান করিতে পাইলেন না। কৃষ্ণবিহারী বাবুকে সম্প্রদান করিতে হইল। এবং (২) ব্রাহ্মপক্ষের পুরোহিত মন্ত্র পড়াইতে পাইলেন না, উপবীতধারী পৌত্তলিক পুরোহিত দ্বারা মন্ত্র পড়ান হইল। এই দুইটী কথা বলিতে ভুলিয়া গিয়াছেন, দুর্ভাগ্যক্রমে কেশব বাবুর কার্য্যের এ দুইটী প্রধান দোষ; এই দুইটীতে তিনি পূর্ব্ব হইতে সম্মত হইয়াছিলেন। প্রমাণস্বরূপ পাঠকগণ ১৭ই ফেব্রুয়ারি দিবসের মিরারে কুচবিহারের বিবাহ নামক প্রস্তাবটী পাঠ করিয়া দেখিবেন। আশ্চর্য্যের বিষয় এই ইঁহারা মিরারে যাহা স্বীকার করিয়াছেন, এত বড় পত্রের মধ্যে তাহার উল্লেখ করিতেই বিস্মৃত হইলেন।

 ১০। অতঃপর প্রচারকদ্বয় এই বিবাহের আপত্তিকারী দিগের আপত্তি খণ্ডনে অগ্রসর হইয়াছেন, আমি তাঁহাদের কথাগুলি সমগ্র উদ্ধৃত করিতেছি।

 “অনেকে বলিতেছেন যে বয়স সম্বন্ধে কেশব বাবু আপনার প্রস্তাবিত রাজবিধি [১৮৭২ শালের ৩ আইন] লঙ্ঘন করিয়াছেন এবং আপনার পূর্ব্ব বিশ্বাস ও আচরণের বিরুদ্ধ ব্যবহার করিয়াছেন, কিন্তু এ অভিযোগের বিরুদ্ধে সমূহ প্রমাণ আছে। প্রথমতঃ কুচবিহার স্বাধীন রাজ্য, তথায় উক্ত বিধি প্রচলিত নহে। কলিকাতায় বিবাহ হইলেও নৃপেন্দ্র নারায়ণ কুচবিহারে প্রত্যাগমন করিবামাত্র সে বিধি পালনের জন্য তিনি আর দায়ী হইতে পারেন না। এ অবস্থায় উক্ত বিধি অনুসারে বিবাহ দেওয়া নিষ্ফল ও অনাবশ্যক। এই হেতু বিধি পরিত্যাগ করিতে হইল। রাজা যদি ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্টের অধীন হইতেন নিশ্চয়ই বিধি অনুসারে বিবাহ সম্পন্ন হইত, এবং যদি আইন অনুসারে বিবাহ হইত পাত্র পাত্রী উভয়ের সম্বন্ধে বয়সের নিয়ম নিশ্চয়ই পালন করা হইত। কিন্তু ইহা জিজ্ঞাস্য হইতে পারে যে কেশব বাবু যেন আইনের আশ্রয় নাই লইলেন, তিনি স্ত্রীলোকের বিবাহের বয়স সম্বন্ধে ইতিপূর্ব্বে যেরূপ সংস্কার প্রকাশ করিয়াছেন ও উপদেশাদি দিয়াছেন তাহার কেন অন্যথা করিলেন? অন্যের বিবাহসম্বন্ধে শক্ত নিয়ম কিন্তু সুনীতি দেবী বিবাহে তিনি শৈথিল্য প্রদর্শন করিলেন কেন? তাঁহার পূর্ব্ব আচরণের সঙ্গে বর্তমান অনুষ্ঠানের বিরোধ কেন? ইতিপূর্বে আচার্য্য মহাশয় অনেকগুলি ব্রাহ্মবিবাহ সম্পন্ন করাইয়াছেন তাহাতে কন্যার বয়স অত্যন্ত অল্প ছিল, যথা ১১।১২।১৩। এই সকল বিবাহ দিতে তাহার কিছু আপত্তি ছিল বটে, কিন্তু তিনি তত সঙ্কুচিত হন নাই যেহেতু বাল্যবিবাহের দোষ এ সকল বিবাহে বিধিপূর্ব্বক নিবারণ করা হইয়াছিল। ব্রাহ্ম বিবাহের উদীচ্য কর্ম্মে এরূপ স্পষ্ট নিয়ম ছিল যে ঋতুমতী না হইলে পাত্রী পাত্রের সহিত সম্বন্ধ স্থাপন করিবেন না, তত দিন পর্য্যন্ত বিবাহ কেবল বাগ্দান স্বরূপ থাকিবে। যৌবনাবস্থা প্রাপ্তির পূর্ব্বে কন্যার প্রকৃত বিবাহ হওয়া অর্থাৎ পত্নী হওয়া নিষিদ্ধ, ব্রাহ্মসমাজে আইন হইবার অনেক দিন পূর্ব্ব হইতে এরূপ সংস্কার ছিল। যখন রাজবিধি প্রস্তুত হয় তখন কেবল এই নিয়ম বিধিবদ্ধ করা হইল। নারীজীবনে বাল্যাবস্থা কোন্‌ সময়ে যৌবনাবস্থায় পরিণত হয় তাহা নিৰ্দ্ধারণ করিয়া সেই সময় বিবাহোপযোগী বলিয়া নির্ণয় করা হইল। ডাক্তার চারলস সাহেব ১৪ বৎসর যৌবনাবস্থার প্রারম্ভ বলিয়া মত প্রকাশ করেন। আইনেও ঐরূপ ব্যবস্থা হইল। বাস্তবিক উক্ত বিধির মূল তাৎপর্য্য এই যে যৌবনারম্ভই কন্যার উপযুক্ত বয়স। এ নিয়ম বর্ত্তমান বিবাহে পূর্ণ হইয়াছে। সুতরাং কেশব বাবু সুনীতি দেবী বয়সসম্বন্ধে পূর্ব্ব বিশ্বাসের বিরুদ্ধ ব্যবহার করেন নাই।”

 বিবাহে আইন রক্ষণ হইল না সে কথা যাক্‌ কেশব বাবু কন্যার যৌবনারম্ভ অর্থাৎ ঋতু কালকেই বিবাহ কাল ভাবিতেন এ কথা কি যথার্থ? তিনি ব্রাহ্ম বিবাহ বিধি সংক্রান্ত আন্দোলনের সময় টাউন হলে যে বক্তৃতা করেন তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি।

 “Thirdly, we contemplate the abolition of early or premature marriages. There has always been a large amount of uncertainty and doubt in the public mind as to the minimum marriageable age of Native girls. Reference was therefore made a few months ago to the leading medical authorities in Calcutta, and what is the result? It has been what we had anticipated. The medical authorities in Calcutta almost unanimously declare, that sixteen is the minimum marriageable age of girls in this country. Dr. Charles makes a valuable suggestion; he holds that fourteen, being the commencement of adolescence, may for the present be regarded as the minimum age at which Native girls may be allowed to marry, and may serve as a starting point for reform in this direction. In conformity with his suggestion and the opinions given by the other referees, we have come to the conclusion that, for the present at least, it would be expedient to follow the provision in the Bill which makes fourteen the minimum marriageable age of girls in this country, leaving it in the hands of time to develope this reform slowly and gradually into maturity and fulness. Thus you see, gentlemen, that these marriage reforms are not directed exclusively against idolatry and caste, but are directed against the very root as well as the branches and fruits of that tree of corruption, which has for centuries caused many a man and woman in this country to suffer physically, intellectually, morally and spiritually. (Applause.) It is evident that a reformed system of marriage which will enable us to get rid of all our injurious and immoral customs is a desideratum, which, every one will allow, a really intelligent and liberal Government ought to enable us to secure.”

Town Hall Lecture 30th Sept. 1871.

 পূর্ব্বোক্ত কয় পঁক্তির মধ্যে বাঁকা অক্ষরে যে কয়টী কথা আছে তাহা পাঠকগণ মন দিয়া পড়ুন। তিনি কি বক্তৃতা করিবার সময় জানিতেন না যে, আমাদের দেশের অধিকাংশ বালিকাই ১৬ বৎসরের পূর্ব্বে ঋতুমতী হয়। আর প্রচারকদ্বয় যে লিখিয়াছেন “ইতিপূর্ব্বে আচার্য্য মহাশয় অনেক গুলি ব্রাহ্ম বিবাহ সম্পন্ন করাইয়াছেন, তাহাতে কন্যার বয়স অত্যন্ত অল্প ছিল; যথা ১১।১২।১৩ এ সকল বিবাহ দিতে তাঁহার কিছু আপত্তি ছিল বটে, কিন্তু তিনি সঙ্কুচিত হন নাই, যে হেতু বাল্য বিবাহের দোষ এ সকল বিবাহে বিধিপূর্ব্বক নিবারণ করা হইয়াছিল” এ কথা আমরা নূতন শুনিলাম। আদি সমাজের অবলম্বিত বিবাহ পদ্ধতিতে বরের প্রতি উপদেশের মধ্যে এক স্থানে আছে বটে যে ভার্য্যা ঋতুমতী না হইলে তাহার সহিত এক শয্যায় শয়ন করিবে না, কিন্তু কেশব বাবু যে যে বিবাহে ছিলেন তাহাতে কি কোন প্রকার রাজবিধি বা প্রতিজ্ঞা দ্বারা বরকে এরূপ কোন নিয়মে বদ্ধ করা হইয়াছিল? আমাদের ত স্মরণ হয় না। তাহা করা দূরে থাক, শ্রীযুক্ত বাবু নবগোপাল মিত্র যখন তাঁহার নিজের কন্যার বিবাহে ঐরূপ নিয়মের কথা বলিয়াছিলেন তখন মিরার এবং কেশব বাবুর প্রচারকগণ তাঁহাকে উপহাস করিয়া উড়াইয়া দিয়া ছিলেন। ফল কথা এই পূর্ব্বে কন্যার বয়স লইয়া এত টানা টানি হয় নাই, বিবাহ বিধির আন্দোলন উপস্থিত হইলে এ সম্বন্ধে বিশেষ রূপ চিন্তা আরম্ভ হইল এবং কেশব বাবু তখন ১৬ বৎসর কন্যার বিবাহ কাল বলিয়া স্থির করিলেন। ঠিক এই যুক্তিতে ত বলা যায় যে ব্রাহ্ম সমাজে উপবীত পরিত্যাগের গোলযোগ উঠিবার পূর্ব্বে ও কেশব বাবু অনেক বার উপবীতধারী আচার্য্যের উপাসনাতে যোগ দিয়া ছিলেন সুতরাং উপবীত ধারণ পাপ নয় এবং কেশব বাবুর আদি সমাজ পরিত্যাগ অন্যায় হইয়াছে। আর কন্যা ঋতুমতী হইলেই তাহার বিবাহ কাল হইল ইহা কোন ডাক্তার বলেন নাই বরং ডাক্তার মহেন্দ্র লাল সরকার স্পষ্টাক্ষরে ইহার প্রতিবাদ করিয়াছেন।

 দ্বিতীয়তঃ, ইহারা দুজনে কন্যার প্রায়শ্চিত্ত সম্বন্ধে এই কথা বলিতেছেন। কিন্তু কেশব বাবুর প্রচারক দিগের মধ্যে এক জন শ্রীযুক্ত বাবু গিরিশচন্দ্র সেন, বঙ্গ বন্ধুতে ইহা অপেক্ষপ আরও কিছু অধিক স্বীকার করিয়াছেন। ইহাকে কি প্রায়শ্চিত্ত বলে না? আমি এরূপ মনে করি না যে কেশব বাবু ইহাতেও সম্মত ছিলেন। বরং ইহা মনে করি যে রাজমাতৃগণ অন্যায় পূর্ব্বক তাঁহার কন্যাকে এই গুলি করাইয়াছেন। কিন্তু কুচবিহার হইতে এক ব্যক্তি লিখিয়াছেন যে এ কার্য্য কেশব বাবুর গৃহিণী এবং মাতার অগোচরে হয় নাই সুতরাং বর পক্ষদিগকে নিতান্ত প্রতারণা অপরাধে অপরাধী করাও যায় না। পাত্রটীকেও বিলক্ষণ সুখ্যাতি করা হইয়াছে। তিনি পৌত্তলিকতা মানেন না তবে কিনা গবর্ণমেণ্টের শাসনে ও আদেশে বিবাহের বৈধতা রক্ষার জন্য হোমের সময় তাঁহার কেবল উপস্থিত থাকিতে হইয়াছিল, “কেবল উপস্থিত থাকিতে হইয়াছিল”— অর্থাৎ স্বয়ং হোম করিতে হয় নাই। প্রচায়ক দ্বয় কোথায় ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য জাতিকে স্বয়ং হোম করিতে দেখিয়াছেন? আর রাজা হোমের সময় বসিয়া থাকিলেন কেন? উত্তর— “বিবাহের বৈধতা রক্ষার জন্য”। কিরূপ বৈধতা? বৈধ ব্রাহ্ম বিবাহ হইবে এই জন্য? না বৈধ হিন্দু বিবাহ হইবে এই জন্য? নিশ্চয় বলিতে হইবে বৈধ হিন্দু বিবাহ হইবে এই জন্য। তবে বিবাহটী কিরূপ বিবাহ পাঠক উত্তর করুন, আমি আর উত্তর করিব না। ভাল এক দিকে বয় পক্ষ যেমন হিন্দু বিবাহের বৈধতা রক্ষা করিবার উপায় করিলেন, কেশববাবু কি ব্রাহ্ম বিবাহের বৈধতা রক্ষা করিবার কোন উপায় করিয়াছিলেন? ব্রাহ্ম বিবাহের বৈধতা রক্ষার জন্য কি কি চাই? চারিটী বিষয় চাই। বর কন্যার উপাসনাতে যোগ দেওয়া; পুরোহিতের ব্রাহ্ম পুরোহিত হওয়া; পাত্র পাত্রীর ঈশ্বর সাক্ষী করিয়া উদ্বাহু প্রতিজ্ঞা করা; বিবাহ পদ্ধতির পৌত্তলিকতা সম্পর্ক শূন্য হওয়া। ইহার কোনটী কি এ বিবাহে রক্ষিত হইয়াছে? কোনটীই না। পাত্র পাত্রী উপাসনাতে যোগ দেন নাই। তাঁহারা বিবাহ মণ্ডপে ছিলেন এবং উপাসনা মণ্ডপের বাহিরে হইয়াছিল,বিশেষ উপাসনার সময় বাদ্যধ্বনিতে কিছুই শ্রুত হয় নাই (প্রমাণ ১৭ই ফেব্রুয়ারির মিরার)

 পুরোহিত ব্রাহ্ম পুরোহিত নন; পরন্তু এ কজন উপবীত ও ত্রিপুণ্ড্রধারী ব্রাহ্মণ; উদ্বাহু প্রতিজ্ঞা বিবাহ স্থানে হয় নাই, অনেকক্ষণ পরে অন্দরে গিয়া হইয়াছে—কলিকাতায় আসিয়া করিলেই হইত। চতুর্থতঃ, পদ্ধতি ও পৌত্তলিকতা দোষ শূন্য হয় নাই। তবে ব্রাহ্ম বিবাহের বৈধতা কিরূপ রক্ষিত হইয়াছে তাহা সকলে দেখুন। অথচ প্রচারকদ্বয় বলিয়াছেন “উপরে লিখিত বিবাহ বৃত্তান্ত পাঠে আপনারা সহজে বুঝিতে পারিবেন যে যাঁহারা বাল্য বিবাহ ও পৌত্তলিকতার দোষ আচার্য্য মহাশয়ের প্রতি আরোপ করিয়াছেন তাঁহারা ভ্রমবশতঃ এরূপ কার্য্য করিয়াছেন।” এক ব্যক্তি একবার আহার করিতে বসিয়া বলিয়াছিল—ব্যঞ্জনটা বেশ হইয়াছে, পরে এক এক করিয়া জিজ্ঞাসা করাতে বলিল—লবণ একটু অধিক, হরিদ্রা কম, ঝাল বেশি, জল অধিক, মসলার অভাব। প্রচারকগণও কি সেইরূপ বলিবেন যে বিবাহটী নির্দ্দোষ হইয়াছে তবে কিনা, বরের বয়স ১৫ কন্যার বয়স ১৩; তবে কিনা কেশব বাবুর জাতিভ্রষ্ট বলিয়া সম্প্রদান করিতে পান নাই; ব্রাহ্ম পুরোহিত পৌরহিত্য করিতে পান নাই; তবে কিনা বিবাহের পূর্ব্বে কন্যাকে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইয়াছিল এবং বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ নান্দীমুখ প্রভৃতি শাস্ত্রোক্ত রীতিতে হইয়াছিল; তবে কিনা উপাসনাটা এক পাশে বসিয়া নম নম করিয়া সারিতে হইয়াছিল এবং উদ্বাহু প্রতিজ্ঞা উপদেশাদি লুকাইয়া করিতে হইয়াছিল; তবে কিনা পাত্রকে হোমের সময় উপস্থিত থাকিতে হইয়াছিল এবং বাইনাচ প্রভৃতি বন্ধ করিতে পারা যায় নাই।” যদি কাহারও ইচ্ছা হয় ইহাকে ব্রাহ্ম বিবাহ বলুন। আমি বলিতে পারিব না। এক ব্যক্তি এক সময় খ্রীষ্টধর্ম্মাবলম্বন করেন। তাঁহার জ্যেষ্ট ভ্রাতা ও মাতা প্রভৃতি হিন্দুসমাজেই ছিলেন,কিছুদিন যায় তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যু কাল উপস্থিত হইল। তখন খ্রীষ্ট ধর্ম্মাবলম্বী ভ্রাতা তাহাকে দেখিতে গেলেন। গিয়া.দেখেন যে চারিদিকে প্রায়শ্চিত্তের আয়োজন। ব্রাহ্মণদিগের অর্থদান হইতেছে। নানা প্রকার পৌত্তলিক ক্রিয়ার আয়োজন হইয়াছে। খ্রীষ্টধর্ম্মাবলম্বী ভ্রাতা একজন পাদরি তিনি জ্যেষ্ঠের মৃত্যুশয্যার নিকট গেলেন এবং বলিলেন দাদা কর কি মৃত্যুকালে একবার খ্রীষ্ট্রের শরণাপন্ন হও এই কথা বলিয়া তিনি ভ্রাতার জন্য একটু প্রার্থনা করিলেন। ইতি মধ্যে জ্যেষ্ঠের মৃত্যু হইল। পাদরী ভ্রাতা বাহিরে আসিয়া বলেন যে তাহার মৃত্যু কালে খ্রীষ্টীয় প্রণালী অনুসারে ভজনা হইল তাহাই কি ঠিক? এ বিবাহও সেইরূপ ব্রাহ্ম বিবাহ।

 উপহাস দূরে থাকুক লিখিতে লিখিতে হৃদয় দুঃখে পরিপূর্ণ হইতেছে। ব্রাহ্ম সমাজের অবস্থা কি হইল? যাঁহারা এত কাল বীরের ন্যায় ধর্ম্মসংগ্রাম করিলেন তাঁহারাই আজি অসৎ কার্য্যকে সৎকার্য্য বলিয়া ঘোষণা আরম্ভ করিলেন। যদি তাঁহারা বাস্তবিক অনুতাপ করিতেন, যদি ইহাকে ব্রাহ্ম ধর্ম্মের চক্ষে দূষণীয় বলিতেন তাহা হইলে এত ক্ষোভ হইত না। কেশব বাবুর মুখ রক্ষার জন্য যাহা চিরকাল সকলে নিন্দনীয় বলিয়া আসিয়াছি তাহাকে অনিন্দনীয় বলিতে হইল; যাহা অপরের পক্ষে অমার্জ্জনীয় ভাবিয়াছি তাহা মার্জ্জনীয় ভাবিতে হইল যাহা; ব্রাহ্ম ধর্মের বিরোধী বলিয়া ঘোষণা করিয়াছি, তাহাকে ব্রাহ্ম ধর্ম্মের অবিরোধী বলিতে হইল!!! সত্যপ্রিয়তা তবে তুমি কোথায়? আমরা প্রতিবাদ করিয়াছি, ব্রাহ্ম ধর্মের ও ব্রাহ্ম সমাজের মুখে যে কালি পড়িতেছিল তাছ ধোঁত করিয়াছি, এই অপরাধ, এই অপরাধে আমরা অসৎ ও অভত্রলোক এই সুখ্যাতি ও পুরস্কার উপার্জন করিয়াছি।

 সে যাহা হউক, পূর্ব্বোক্ত কথা গুলির মধ্যে একটী ভয়ঙ্কর মত লুকাইয়া রহিয়াছে; বিশেষতঃ ব্রাহ্ম ভিন্ন অপরের ধরিবার উপায় নাই। সে মতটী এই, কেশব বাবু বর্তমান সময়ের জগতের মুক্তির পন্থা আবিষ্কার করিবার জন্য বিশেষ ভাবে প্রেরিত; তাঁহার অবলম্বিত প্রচার প্রণালী ও সমুদায় আধ্যাত্মিক উপায়ের নাম বিশেষ বিধান। তিনি সাধারণ ব্যক্তিগণ অপেক্ষ স্বতন্ত্র। অন্য ব্যক্তিদিগের সমুদায় কর্ম্ম নিজ বুদ্ধির অধীন হইয়া থাকে কেশব বাবুর দৈনিক আহার পর্য্যন্ত ঈশ্বরাদেশে হইয়া থাকে। প্রতাপ বাবুগৌর বাবু স্পষ্টাক্ষরে বলিয়াছেন কেশব বাবু নিজে এই রূপ বিশ্বাস করেন। আমাদেরও এই কথা সম্পূর্ণ সত্য বলিয়া বিলক্ষণ প্রতীতি হইতেছে কারণ এই বিবাহের আন্দোলনে তিনি ব্রাহ্মদিগের সহিত যেরূপ ব্যবহার করিয়াছেন এবং তাঁহার মুখ হইতে যেরূণ বাক্য সকল নির্গত হইয়াছে। তাহাতে আর এ বিষয়ে অণুমাত্র সন্দেহ মাই। বাবু শিবচন্দ্র দেব ৬৬ বৎসরের বৃদ্ধ, যিনি হয় ত কেশব বাবুর পিতার সমাধ্যায়ী; এবং বিশ্বাস, নিষ্ঠা, সৌজন্য ব্রাহ্ম ধর্ম্মাম্বুরাগের জন্য সাধারণের আদৃত; যিনি ব্রাহ্ম সমাজের প্রথম প্রতিষ্ঠার সময় রামমোহন রায়ের সহিত উপস্থিত থাকিতেন, সেই শিবচন্দ্র বাবু, বাবু দুৰ্গামোহন দাস, বাবু আনন্দমোহন বসু প্রভৃতি ২৩ জন আনুষ্ঠানিক ব্রাহ্ম স্বাক্ষর করিয়া যে প্রার্থনা পত্র তাঁহার হস্তে দিলেন, তাহা তিনি পাঠ করিলেন না। আমাদের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করাতে বলিলেন যে, তাহা পাঠ করা তিনি পাপ মনে করেন। কেবল তাহা নহে, তিনি আমাদের কাহার কাহারও নিকটে আস্ফালনপূর্বক বলিয়াছেন যে, অন্যের পক্ষে কন্যার অল্প বয়সে বিবাহ দিলে পাপ, তাঁহার পক্ষে এক বৎসরের বালিকার বিবাহ দিলে পাপ হয় না। এরূপ অহঙ্কার ও আস্ফালন পূর্ব্বোক্তরূপ বিশ্বাস না থাকিলে কখনই জন্মিতে পারে না। এই কথা গুলি লিখিতে লিখিতে আমি ভাবিতেছি যে, আমরাই কেশব বাবুর এই অপকার করিয়াছি, ব্রাহ্মদিগের মধ্যে কতকগুলি যদি তাঁহার পদলেহন ও পদধারণ করিয়া প্রার্থনা না করিতেন, যদি ব্রাহ্ম প্রচারকগণ তাঁহার ইচ্ছাকে আপনাদের শাস্ত্র স্বরূপ না করিতেন, যদি তাঁহার হস্তে ব্রাহ্ম সমাজের সমুদায় ভার অর্পিত না হইত, যদি নরপূজার আন্দোলন আশ্রমের আন্দোলন প্রভৃতি যাঁহারা করিয়াছিলেন তাঁহারা কিয়দ্দিন পরে নিরস্ত না হইতেন, যদি কেশব বাবু ও তাঁহার পক্ষীয় ব্যক্তিগণ মিরার ধর্ম্মতত্ত্ব সুলভ প্রভৃতিতে কটুক্তি অখ্যাতি ঘোষণা করিয়া বিপক্ষদিগকে ব্রাহ্ম সাধারণের চক্ষে অসৎ লোক বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে সমর্থ না হইতেন; যদি তাঁহার পারিপার্শ্বিদিগের মধ্যে তাঁহার ভ্রমকে ভ্রম বলিবার সাহস কাহারও থাকিত, তাহা হইলে তিনি এরূপ ভ্রমে পতিত হইতেন না। তিনি মহাপুরুষ হন, মহাপুরুষ থাকুন, আমরা তাঁহাকে অপরাপর মনুষ্যের ন্যায় ভ্রান্তজীব মনে করি, ঈশ্বরাদেশকে তাঁহার এক চেটিয়া ভাবি না। বর্ত্তমান সময়েই জগতে ধর্ম্মপ্রচারকদিগের মধ্যে তাঁহা অপেক্ষা অন্ততঃ দশগুণ মহৎ লোক দেখিতে পাই; আমরা দিব্য চক্ষে তাঁহার অনেক বুদ্ধির ত্রুটী ও বিচারশক্তির ভ্রান্তি দেখিতে পাইতেছি; আমরা ব্রাহ্মসমাজে তাঁহার কিম্বা অপর কোন ব্যক্তির একচ্ছত্র রাজত্ব হইলে তাহাকে শোচনীয় মনে করি; আমরা মত বিষয়ের স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্রতা রক্ষাকে ধর্ম্ম জগতের প্রাণ রক্ষার উপায় বিবেচনা করি। অতএব কোন ব্রাহ্ম তুষ্টই হউন আর রুষ্টই হউন, স্পষ্টাক্ষরে বলিতেছি আমরা সত্যের অনুবর্ত্তী কোন ব্যক্তি বিশেষের অনুবর্ত্তী নহি।

 আরও কতকগুলি কথা অবশিষ্ট আছে। এই সকল কথা বলাতেই আমি এবং আমার কতিপয় বন্ধু কেশব বাবুর ও তাহার প্রচারকগণের অপ্রিয় হইয়াছি। কিন্তু সেজন্য বিন্দু মাত্র দুঃখিত নই; তাঁহাদের মতাবলম্বী ব্রাহ্মদিগের চক্ষে হয় ত আমরা নিন্দনীয় তাহাতেও তিলমাত্র ভীত নই। বরং কেশব বাবুর ও প্রচারক মহাশয়দিগের ব্রাহ্মধর্ম্মবিরোধী মত গুলির প্রতিবাদ এত দিন ভাল করিয়া করিতে পারি নাই বলিয়া ব্রাহ্ম বন্ধুগণ আপনাদের নিকট এবং নিজের বিবেকের নিকট আপনাদিগকে অপরাধী বলিয়া গণ্য করি। ভূত কালে আমাদের যে ত্রুটী হইয়াছে আশা করি ভবিষ্যতে আর হইবে না। ঈশ্বরপ্রসাদে ব্রাহ্ম সমাজের নব জীবনের দিন উপস্থিত হইতেছে; এ সময়ে ব্রাহ্মদিগের অধ্যবসায় এবং মতের স্থিরতা নিতান্ত প্রয়োজন। যাঁহারা এই বিবাহের প্রতিবাদ করিয়াছেন তাঁহারা জানিবেন যে তাঁহারা ঈশ্বরের প্রিয় কার্য্য করিয়াছেন। এখন আর তাঁহারা পুনরায় এই বিবাহের উদ্যোগ কর্ত্তা ও প্রতিপোষকদিগের নিকট মস্তক অবনত করিতে পারেন না; তাহ হইলে সত্যের মর্য্যাদা রক্ষা হইবে না। যত দিন না তাঁহারা অনুশোচনা করেন, যত দিন না তাঁহারা আপনাদিগের দোষ ক্ষালন করিবেন, ততদিন তাঁহাদের নিকট মস্তক অবনত করিলে ব্রাহ্ম ধর্ম্মের এবং ব্রাহ্মসমাজের ক্ষতি করা হইবে। ব্রাহ্ম ধর্ম্ম প্রচারের জন্য ভাবিবেন না, ব্রাহ্মসমাজকমিটী ত্বরায় উপযুক্ত প্রচারকসকল নিয়োগ করিবেন, প্রচারপ্রণালী নিরূপণ করিবেন, তাহা যথা সময়ে সমুদায় সমাজে প্রেরিত হইবে। ব্রাহ্মসমাজকমিটী মফস্বলের সমুদায় সমাজের সহিত পরামর্শ না করিয়া কোন প্রকার গুরুতর ও স্থায়ী কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিবেন না; তাহারা আপনাদিগকে সপ্তম স্বর্গের লোক এবং সাধারণ ব্রাহ্মদিগকে নিকৃষ্ট জগতবাসীলোক বলিয়া গণনা করিবেন না; বর্ত্তমান আন্দোলনে যাঁহারা প্রবৃত্ত হইয়াছেন তাঁহারা কেবল আন্দোলন করিয়া নিরস্ত হইবেন না; এই উদ্যোগে ব্রাহ্ম সমাজকে নিয়মতন্ত্রপ্রণালীতে বদ্ধ করা তাঁহাদের সংকল্প। মফস্বলবাসী ব্রাহ্মবন্ধুদিগের প্রতি এইমাত্র অনুরোধ যে তাঁহারা কেবল সুদিনের জন্য ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করুন, প্রত্যেক ব্রাহ্ম ও প্রত্যেক ব্রাহ্মিকার কণ্ঠ হইতে প্রার্থনা-ধ্বনি স্বর্গের সিংহাসনের দিকে উত্থিত হউক; যিনি এতকাল ব্রাহ্ম সমাজকে রক্ষা করিয়াছেন, যিনি সত্যপক্ষকে কখনও পরিত্যাগ করেন নাই, যিনি নিয়তি চক্রের মধ্যে থাকিয়া মানবের সুখ দুঃখ জয় পরাজয়কে নিয়মিত করেন, তিনি আমাদের মিলিত প্রার্থনা নিশ্চয় পূর্ণ করিবেন।


Printed by Ashutosh Ghose and Co., Albert Press,
37 Machuabazar Street, Calcutta.

এই লেখাটি ১ জানুয়ারি ১৯২৯ সালের পূর্বে প্রকাশিত এবং বিশ্বব্যাপী পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্ভুক্ত, কারণ উক্ত লেখকের মৃত্যুর পর কমপক্ষে ১০০ বছর অতিবাহিত হয়েছে অথবা লেখাটি ১০০ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে ।