একঘরে
“একঘরে”
অর্থাৎ
বিলাতফেরতাদিগকে একঘরে করার বিষয়ে
কোন বিলাতফেরতার পূর্ণব্যক্ত মত;
যাহা জানিলে দেশের অনেক
উপকার সাধিত হইতে
পারে।
শ্রীদ্বিজেন্দ্রলাল রায় M. A., M. R. A. S.
প্রণীত ও প্রকাশিত।
(সুরধাম ২ নং নন্দকুমার চৌধুরীর দ্বিতীয় লেন।)
দ্বিতীয় সংস্করণ।
সন ১৩১৭ সাল।
PRINTED BY U. N. MANDAL AT THE
BHAISHAJA STEAM MACHINE PRESS.
25, Raja Nabokrishna’s Street, Calcutta.
ভূমিকা।
১৮৮৫ সালে ‘একঘরে’ প্রথম প্রকাশিত হয়। বহুদিন হইল মুদ্রিত পুস্তকগুলি নিঃশেষ হইয়া গিয়াছে। নানা কারণ বশতঃ ইহার নূতন সংস্করণ করি নাই। কিন্তু এখন নানাদিক হইতে পুনঃ পুনঃ অনুরুদ্ধ হইয়া ইহার দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করিলাম।
আমার বিশ্বাস যে এই ক্ষুদ্র পুস্তকখানি সমাজের কিঞ্চিৎ উপকার করিয়াছে। ইহার ভাষা অত্যধিক তীব্র হইয়াছে। ইচ্ছা ছিল যে ইহার ভাষা মোলায়েম করিয়া পুস্তকখানি পুনর্মুদ্রিত করিব। কিন্তু দেখিলাম যে তাহা করিতে গেলে পুস্তকখানি আদ্যন্ত নূতন করিয়া লিখিতে হয়। অতএব পূর্ব্বপ্রকাশিত সংস্করণের স্থানে স্থানে কিঞ্চিৎ ৰাদ দিয়া দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হইল। শ্রীদ্বিজেন্দ্রলাল রায়।
“একঘরে।”'
মহাশয়!
আমরা দীনহীন কাঙ্গাল মূৰ্খ বিলেত-ফেরত; আমাদিগকে কেন প্রাণে মারেন? আপনারা দেশের অহঙ্কার, আপনারা জাতির জ্যোতি, আপনার বিদ্যার প্রতিনিধি, আপনারা জ্ঞানের উৎস, আপনারা সত্যের নায়ক, আপনার সাহসের প্রতিমূর্ত্তি। আমরা আপনাদের নিষ্কলঙ্কচরণে পড়িতেছি; প্রাণে মারিবেন না।
আমরা—অন্ততঃ আমি যখন বিলাতে গিয়াছিলাম, তখনই বোধ হইয়াছিল কাজটা বড় ভাল হইতেছে না। ভাবিয়াছিলাম যে এ বিজ্ঞানের, উৎসাহের, বীর্য্যের, স্বাধীনতার রঙ্গভূমি ভারতবর্ষ ছাড়িয়া কোথায় এক ভীরুতার আলয়, মূৰ্খতার চণ্ডীমণ্ডপ—বিলেতে যাইতেছি,—একাজটা বড় ভাল হইতেছে না। একবার মনেও হইল, বুঝি অধর্ম্মের, অজ্ঞানের, অমোচ্য কলঙ্কের, অনন্ত নিরয়ের বীজ বপন করিতেছি। কিন্তু কি করিব—মুগ্ধ মানবের মন বিবেকের বাধা শুনিল না। জাহাজে চড়িলাম, প্যাণ্ট্ পরিলাম, কট্লেট খাইলাম, তাহার পর দেখুন এই বিপদ।—জাহাজটা যখন গভীরগর্জ্জনময় সাগরের নীলিমায় গিয়া পড়িল, তখনই বেশ বুঝিতে পারিলাম যে কাজটা বড় খারাপ হইয়া গেল। কিন্তু তখন ফিরিয়া আসি কিরূপে? কি করিব, বিলাতে যাইলাম, ইংরাজের সহিত মিশিলাম, রোষ্টচপ খাইলাম। এখন পস্তাচ্চি। সমস্ত দোষ স্বীকার করিতেছি, মস্তক অবনত করিতেছি;—প্রাণে মারিবেন না।
দীনতার প্রতিমা আমরা, জীর্ণ শীর্ণ মলিন রোরুদ্যমান আমরা, আপনাদের শতকমল-বিনিন্দিত পুণ্যময় চরণে পড়িতেছি;—প্রাণে মারিবেন না।
আমরা যে ঘোর পাপ করিয়াছি তাহার প্রায়শ্চিত্ত করিব;—মাথা মুড়াইব (তেড়ী ভাঙ্গিয়া যায় ক্ষতি নাই); ঘোল ঢালিব, গব্য চন্দনামৃত পান করিব—প্রাণে মারিবেন না।
এবার মাথায় ঘোল ঢালিয়া, গোবর দ্বারা পেটকে পবিত্র করিয়া টেবিল ভাঙ্গিয়া, বাড়ী ঘিরিয়া, রুদ্ধা প্রেয়সীর মুখ চুম্বন করিয়া তবে আর কাজ।
আবার আমরা রান্নাঘরের প্রশান্ত প্রান্তে,—রমণীয় কাষ্ট-পিঁড়িতে বসিয়া; অক্ষৌহিনী মক্ষিকার মিলিত ঝঙ্কারে; ধূমের অন্ধকারময়ী স্নিগ্ধতায়; আর্য-থালে; ঠাকুরের বকুনীর সহিত পৈতৃক ডাল ভাত খাইব; —প্রাণে মারিবেন না।
আর একবার আপনাদের চাঁদোয়ার নীচে, সুন্দর মাটীতে, এক ছেঁড়া কদলীপত্রে বসিয়া, অপর ছেঁড়া কদলীপত্রে ভোজ খাইব;—তাহাতে দই গড়াইয়া দিব; পরমান্ন ছড়াইয়া দিব ও তৎসঙ্গে পার্শ্বস্থ আঁস্তাকুঁড়ের শতমন্দারনিন্দী স্বৰ্গীয় গন্ধ সেবন করিব;—জাতে লউন।
আর একবার চাদর কোলে করিয়া, উৰ্দ্ধ-জানু হইয়া বসিয়া, কমনীয় খুরিতে পরমান্ন খাইয়া, মনোরম ঘটে জলপান করিয়া, চটিজুতা হারাইয়া,—সধর্ম্ম কলেবরে, শুষ্কহস্তে ততোধিক শুষ্কমুখে (কারণ হারায়িত চটি); ক্রোশান্তরে গিয়া, পানাপুকুরে মুখ হস্ত ধৌত করিব।
আমি বেশ দেখিতে পাইতেছি—আমাদের জাতিস্বৰ্গলাভে ঈষিত হারাধন সান্ন্যাল নামক কোন জাতিভ্রষ্ট বঙ্গীয় কবি, আমাদিগকে—অন্ততঃ আমাকে বিদ্রূপ করিয়া এই কবিতাটি লিখিবেন—
হায় হায়
বিলেত থেকে ফিরে এসে হরিদাস রায়—
ছেড়ে দিলেন মুরগী গরু জাতের ঠেলায়;
মুড়িইয়ে মাথা, ঢেলে ঘোল,
ধর্ল্লেন আবার মাছের ঝোল;
কুম্ড়োসিদ্ধ, বেগুণপোড়া, আলুভাতে তায়,;—
বিলেত থেকে ফিরে এসে হরিদাস রায়।
হায় হায়
বিলেত থেকে ফিরে এসে হরিদাস রায়—
লেখেন ব’সে তপ্তাপোষে, ঠেসে তাকিয়ায়;
খেয়ে তাওয়ায় তামাক মিঠে,
ভুলে গেলেন সিগারেটে!
মাথা হেঁটে, হাতে ঘেঁটে, দই চেটে খায়;
বিলেত থেকে ফিরে এসে হরিদাস রায়।
হায় হায়
বিলেত থেকে ফিরে এসে হরিদাস রায়—
দলে মিশি’ ভণ্ডঋষি হতে যদি চায়,—
পেটের মধ্যে থেকে থেকে
মুরগীগুলো উঠে ডেকে;
গরুগুলো হাম্বা করে—একি হলো দায়,—
বিলেত থেকে ফিরে এসে—হরিদাস রায়।
হায় হায়
বিলেত থেকে ফিরে এসে হরিদাস রায়—
হিন্দুর মেয়ে বিয়ে করে—হিন্দুর ঘরে যায়;
চেলি পরে হলুদ মেখে,
নারায়ণকে সাক্ষী রেখে,—
ঐ সময়টাই উঠে ডেকে মুরগীগুলো হায়;—
বিলেত থেকে ফিরে এসে হরিদাস রায়।
হায় হায়
বিলেত থেকে ফিরে এসে হরিদাস রায়—
প্যাণ্ট ছেড়ে, পরেন বেড়ে কালাপেড়ে হায়;–
—করুন যা তাঁর আসে মনে,
হারাধন সান্ন্যাল ভনে
বুদ্ধিমানে রোষ্টচপ টপাটপ খায়;
মনের মুখে চুরোট ফুঁকে হোটেল খানায়।
—কিন্তু আমরা ধর্ম্মের জন্য, সুখের জন্য, দেবভক্তির জন্য যাহ করিতে যাইতেছি, ইহা দ্বারা তাহা হইতে ভীত হইয়া পিছাইব না। কোন ভগ্নাশ যুবক, কোন গৃহ-হীন “একঘরে” আমাদের সম্পদে, গৌরবে ঈর্ষান্বিত হইয়া যে এরূপ ব্যঙ্গ ও শ্লেষ করিতে পারে, তাহার আর আশ্চর্য্য কি?
আমরা আপনাদের স্বৰ্গীয় রীতি নীতির অনুসরণ করিব। আমরা আপনাদের ন্যায় রুদ্ধকবাটে মুরগীর ঝোল খাইয়া, বাহিরে আসিয়া, অমায়িক ভাবে মিছা কথা কহিয়া, পুণ্য সঞ্চয় করিব। আমরা আপনাদের ন্যায় দু একবার গোপনে (কেন না সাবধানের বিনাশ নাই) —গোপনে হোটেলে যাইয়া চপ্টা আস্টা খাইয়া ইহজন্ম সার্থক করিব। ইহাতে দোষ কি?—ইহাতে ত একঘরে হইবার সম্ভাবনা নাই।
আমরা আপনাদের ন্যায় মাংস (প্রকাশ্যতঃ) ছাড়িয়া দিব; মাছ ধরিব (অবশ্য পুকুরে নহে); এত দিন অনাদৃত নবগ্রথিত পৈতা পরিব; গরদের কোঁচা ঝুলাইব, চন্দনের ফোঁটা কাটিব, হরি নামের মালা লইয়া ঘড়ির চেন করিব, টিকী রাখিব ও জাতিভ্রষ্ট কন্যা বা ভ্রাতার সহিত সঙ্গন্ধ ত্যাগ করিব।—জাতে লউন।
সত্য আমাদের মধ্যে অনেকের কন্যা নাই; কিন্তু কখন যে হইবে না এরূপ বলিলে কেবল আমাদের মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়। আমাদের সেই ভাবী কন্যাদিগের বিবাহে আপনারা বাধা দিবেন না, ও নিমন্ত্রণ খাইবেন। আপনাদের আশীর্ব্বাদে সে কন্যাগণ দীর্ঘজীবিনী হউক, ও তাহদের (ভাঙ্গ খাওয়া ব্যতীত আর সব বিষয়ে) শিবের মত স্বামী হউক। সম্ভাব্যকন্যাদায়গ্রস্ত যে আমরা,—আমাদের জাতে লউন। একবারে প্রাণে মারিবেন না।
আমরা আপনাদের ন্যায় বৃদ্ধ বয়সে পঞ্চম বর্ষীয়া কন্যা বিবাহ করিয়া প্রকাশ্যে বঙ্গবিধবাকে স্বার্থত্যাগের ধর্ম্মে দীক্ষিত করিব; ভাগবতের মহিমা পাঠ করিব; হিন্দুধর্ম্ম প্রচার করিব; অন্তঃপুরের গবাক্ষদ্বার রুদ্ধ করিয়া আসিয়া বারাঙ্গনালয়ে ভারতরমণীর সতীত্ব কীর্ত্তন করিব।
আমরা আপনাদের ন্যায় ভণ্ডামীর কুসুম দিয়া, জুয়াচুরীর মন্ত্র পড়িয়া, নীচাশয়তার মন্দিরে, মিথ্যার স্বর্ণপ্রতিমা গড়াইয়া পূজা কবিব।
আমরা আপনাদের দ্যায় প্রতারণার বর্ম্মে আচ্ছাদিত হইয়া, ভীরুতার অন্ধকারে, উচ্ছেদের কুঠার ন্যায়ের স্নেহের সত্যের প্রাণে বসাইব; জ্ঞানের দুর্গ অবরোধ করি; উন্নতির স্রোত রোধ করিব; বিধবার, পরিত্যক্তার সন্তানের, ভ্রাতার বুকে কঠিনতার ছুরী বিঁধিব; আর আপনার জাতির খাতিরে,—ভাবীকন্যাদায়ের খাতিরে, সম্ভাব্য জামাতার কৌলীনত্ব বা অর্থের খাতিরে,—জাতিচ্যুত পুত্রকে, কন্যাকে, জামাইকে, শুষ্কমুখে, স্থিরস্বরে, হাত নাড়িয়া, প্রেমের ভাষায় বলিব “যাও তুমি আমার কেহ নও।”
মহাশয় এ ভাষায় আর লিখিতে পারি না। এ সমাজের বিষয় আর এ বিদ্রূপের ভাষায়, আচ্ছাদিত ক্রোধে লেখা অসম্ভব। ইহার ভাষা ঠাট্টার ভাষা নহে। ইহার ভাষা অন্যায়ক্ষুব্ধ তরবারির বিদ্রোহী ঝনৎকার, ইহার ভাষা পদদলিত ভুজঙ্গমের ক্রুদ্ধদংশন, ইহার ভাষা অগ্নিদাহের জালা। এ ভীরুতার রাজত্বের, এ অন্যায়ের ধর্ম্মশালার এ প্রবঞ্চনার রাজনীতির বিষয় বলিতে—যদি শতশেলময়ী, দাবানলের স্ফুলিঙ্গময়ী, নরকের জ্বালাময়ী ভাষা থাকে, তাহাই ইহার উপযুক্ত ভাষা।
—মহাশয়, আপনি কোন্ লজ্জার মাথা খাইয়া বলিয়াছেন, যে “তোমাদিগকে আমরা সমাজে লইব, কেবল তোমরা প্রায়শ্চিত্ত কর।” হাঁ প্রায়শ্চিত্ত করিব, কিন্তু বলুন কোন্ পাপের?—আপনারা যাহা গোপনে করেন, আমরা তাহা প্রকাশ্যে করি বলিয়া? ও আপনার যেখানে অসত্যের, অধর্ম্মের প্রশ্রয় লন, আমরা সেখানে সত্যের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াই বলিয়া?
আর কিসের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করিব? কোন্ লোভে? এই সমাজে ঢাকিবার জন্য প্রায়শ্চিত্ত? এই জালময়, গহ্বরময়, কীটদষ্ট, ছেঁড়া সমাজে যাইবার জন্য প্রায়শ্চিত্ত? এ মূর্খতার দালানে, এ শঠতার ভাণ্ডারঘরে, এ নীচাশয়তার আঁস্তাকুড়ে ঢুকিবার জন্য প্রায়শ্চিত্ত?—আপনাদের উন্মত্ততা অথবা ধৃষ্টতা যদি এই সমাজে ঢুকিবার জন্য বিলেতফেরতাদিগকে প্রায়শ্চিত্ত করিতে বলেন।—বরং আমরা আপনাদের সমাজে এতদিন যে ছিলাম ইহার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করিতে বলেন, রাজি আছি। যে সমাজে পদে ভীরুতা, সত্যের গ্লানি, নির্ম্মমতা; যে সমাজে পদে পদে মিছা কথা, বিবেকের বেশ্যাবৃত্তি, সে সমাজ হইতে এতদিন বাহির হইয়া আসি নাই কেন, ইহার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করিতে বলেন ত রাজি আছি।
—মহাশয়, আমরা কি দুঃখে, কি অসহ্য জালায়, কি লজ্জাময় যন্ত্রণায়, প্রায়শ্চিত্ত করিব বলিয়া দিউন। সত্য, আপনাদের সমাজ হইতে আমরা ‘একঘরে’। কিন্তু তাই বলিয়া কোন হিন্দুসন্তান বিলেত-ফেরতাদিগের উপর ঘৃণার বা তাচ্ছল্যের দৃষ্টি-নিক্ষেপ করে? আমাদের সমাজ ছোট; হয়ত সহস্রাধিকও হইবে না। কিন্তু আপনাদের সপ্ত কোটীর সমাজে কয়টি মাইকেল বা লালমোহন ঘোষ দেখাইতে পারে। এ সমাজ ছোট কিন্তু মূর্খ নহে। যে সমাজে কেশবচন্দ্র সেন, রমেশচন্দ্র দত্ত ও সুরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়; যে সমাজে তরুদত্ত ও রমাবাই; সে সমাজ মূর্খ, হতাদর, ঘৃণ্য নহে। এ সমাজ একঘরে হইয়াও মহৎ। এ সমাজ ছোট, কিন্তু এ সমাজে প্রতিজন অন্ততঃ বলিতে পারে যে “আমি বিলেত-ফেরতা।” এ সমাজ ছোট—কিন্তু ইহা রাজার সমাজ।
আর একঘরে হওয়াতে কিছু লজ্জার বিষয় নাই। একঘরের অর্থ ‘কদাচারী’ নহে। একঘরে করা পৃথিবীর সর্ব্বত্র আছে। যেখানে যে বিভিন্নমত দলের সংখ্যা অতি কম, সেখানে সে দল একঘরে। আমাদের দেশে যিনি প্রথমে মেডিক্যাল কলেজে পুত্রকে পাঠাইয়াছিলেন, তিনি একঘরে হইয়াছিলেন। যিনি প্রথমে পৌত্তলিকতার বিপক্ষে দাঁড়াইয়াছিলেন, তিনি একঘরে হইয়াছিলেন। যিনি হিন্দুবিধবার বিবাহ দিয়াছিলেন, তিনি একঘরে হইয়াছিলেন। একদিন ঈশাও একঘরে হইয়াছিলেন, একদিন গ্যালিলিও একঘরে হইয়াছিলেন। দেখিতে পাইতেছি এ পৃথিবীতে যাঁহারা নবপ্রথার নবনীতির নবধর্ম্মের নেতা, তাহারা একঘরে। এ জগতের প্রশ্নময় পথে যাঁহারা অগ্রগামী, যাঁহারা জাতীয় জড়তার জীবন, যাঁহারা উন্নতির ধর্ম্মের জ্ঞানের প্রথম সহায়, তাঁহারা ‘একঘরে’। পৃথিবীতে অনেক সময়ই একঘরের অর্থ মূর্খতা, বা অধর্ম্ম নহে; ইহার অর্থ সাহস, উৎসাহ, স্বার্থত্যাগ।
কিন্তু আমরা যে একঘরে, এ একঘরেতে সাহসও নাই, কারণ ইহাতে শাস্তি নাই, বা কণামাত্রও স্বার্থত্যাগ নাই। এ একঘরের একমাত্র স্বার্থত্যাগ কন্যার বিবাহে পাত্রের অসদ্ভাব।
আমি ত প্রত্যক্ষ দেখিতেছি যে সব সমাজেই কন্যার বিবাহ হইতেছে। অর্থ ব্যয় করিলে জামাতার অভাব হয় না। আর তাহা হইলেও, কন্যার বিবাহের জন্য যদি এত মিছা কথা, ভীরুতা, ও লুকাচুরী, ত ইহার চেয়ে যে কন্যা চিরকাল অনূঢ়া থাকাও ভাল।
এ একঘরের আর একটি আরামময় ভীতি, যে ছেলের বিবাহে বা পৈতায় কেহ আমাদিগের সহিত খাইবে না। সুখী আমরা! আমরা পূর্ণান্তঃকরণে বলি ‘তথাস্তু’। বলা বাহুল্য যে আমরা হিন্দুর ফলারের বা ভোজের পক্ষপাতী নহি। আমরা কোন হট্টগোলময়, ছিন্নকদলীপত্রময়, ‘মহাশয় এ-পাতে’-ময়, গড়ায়িত-দধিময়, হারায়িত-চটী-জুতাময়, হিন্দু ফলারে বা ভোজে খাইতে উচ্চাভিলাষী নহি।
বলা বাহুল্য, যে আমরা আপনাদের ফলারের স্বৰ্গ হইতে ভ্রষ্ট হইয়া ম্ৰিয়মান হইয়া যাই নাই; আপনাদের ভণ্ডামীর প্রসাদ হইতে বঞ্চিত হইয়া দুঃখিত, লজ্জিত ও অপ্রস্তুত নহি।
ইউরোপে ‘একঘরে’র অর্থ অন্যরূপ। সেখানে একঘরের অর্থ কন্যার বিবাহে গোলযোগ নহে, বা নিষ্ফলারতা নহে। ক্রান্মার লাটিমার যে একঘরে হইয়াছিলেন, সে একঘরে এ ‘একঘরে’ নহে। সে একঘরের অর্থ অন্যরূপ। সে একঘরের অর্থ অনাহারের জ্বালা, কারাগারের যন্ত্রণা, জল্লাদের কুঠার, অনলের দাহ; সে একঘরের অর্থ বিচ্ছিন্নতার বিষাদ, একাকিতার হতাশা, সমাজের বিদ্বেষ, মৃত্যুর চিন্তা। তাহাতে তাহারা ভীত হয় নাই, স্বমাৰ্গ হইতে স্খলিত হয় নাই, সত্য হইতে চ্যুত হয় নাই, আলিঙ্গিত ধর্ম্ম হইতে অবিশ্বাসী হয় নাই। আর আপনার বিশ্বাস যে এক সম্ভাব্য কন্যাদায়ে, নিস্ফলারতার আরামময় ভীতিতে আমরা পুণ্যের প্রায়শ্চিত্ত করিব? যে একঘরের অর্থ দেশের মান্য, জাতির ভক্তি, যে একঘরের অর্থ পরিচ্ছন্নতা, স্বচ্ছন্দতা, নিরাস্তাঁকুড়তা, কদলীপত্রহীনতা, সেই একঘরের ভয়ে আমরা ভীরুতার মিথ্যার লজ্জাময় ঘৃণাময় পঙ্কে আত্মাকে কলুষিত করিব!!!
বলিতে ঘৃণা হয়, শরীরে শত বৃশ্চিকের দংশন জ্বালা হয়, যে এই লক্ষ্মীবর্জ্জিত দেশে আমার লক্ষ্মী-বর্জ্জিত জাতি, এই এক কন্যাদায়ে, এই ‘জাতের’ খাতিরে, আজ ভণ্ডামীর দোকান খুলিয়া বসিয়াছেন; ভীরুতার, শঠতার, ক্ষুদ্রতার রাজত্বে ঢকিয়াছেন; এ বিপুলা বসুন্ধরার কোণে নিশ্চল হইয়া পড়িয়া আছেন। এই এক প্রশ্ন হিন্দুসমাজের বিধাতা। এই কন্যার বিবাহ সর্ব্ব বিঘ্নের মূল, সর্ব্ব উন্নতির পর্ব্বতসম বাধা। ইহার কাছে দেশের হিতৈষিতা উৎসর্গীকৃত; ইহার কাছে হিন্দুর সাহস পরাজিত। ইহার জন্য অন্তরে ব্রাহ্ম হইলেও অনেকে প্রকাশ্যে ব্রাহ্ম হইতে পারেন না। ইহার জন্য অনেকে দশমাধিক বয়স্কা বালিকাকে বিদ্যালয়ে পাঠাইতে কুণ্ঠিত হন; ইহার জন্য কেহ দ্বাদশ বর্ষাধিক কন্যাকে অবিবাহিত রাখিতে সাহসী হন না; ইহার জন্য কেহ শিশু বিধবাকে বিবাহ দিতে অগ্রসর হন না; ইহার জন্য মিছা কথা, লুকাচুরি, অধর্ম্ম; ইহার জন্য লুকাইয়া খাওয়া; ইহার জন্য প্রকাশ্যে ভ্রাতৃত্যাগ, পুত্রত্যাগ, বন্ধুত্যাগ; ইহার মন্ত্রবলে জাতি অথর্ব্ব, নিৰ্জ্জীব; ইহার বিষময়ী জ্বালার ভয়ে সপ্ত কোটী মানব আজ ত্রস্ত, বদ্ধহস্ত,—“নিবাত নিষ্কম্পমিব প্রদীপম্।”
—অহো রমণীজাতি! আজ তুমিই বঙ্গের সর্বনাশের উপায় হইলে! তুমিই সর্ব্বপ্রকার মঙ্গল কর্ম্মের বাধা হইলে! তুমিই ভীরুতার, অধর্ম্মের কেন্দ্র হইলে! ঈশ্বর নিশ্চয়ই তোমাকে অন্য উদ্দেশ্যে বঙ্গে প্রেরণ করিয়াছিলেন। কোথায় তুমি বঙ্গবাসীর উন্নতির যজ্ঞে সহধর্ম্মিণী হইবে; কোথায় অধর্ম্মের সহিত সমরপরিশ্রান্ত বঙ্গীয় যুবকের মস্তক কোমল ক্রোড়ে রাখিবে; কোথায় তুমি এ জীবনের বিপন্ময় গিরি সঙ্কটে—অপ্সরাকণ্ঠে প্রেমের বিমল সঙ্গীত শুনাইবে; না তুমিই বঙ্গে সর্ব্ব উন্নতির বাধা, সর্ব্ব নিষ্কর্ম্মতার ওজোর, সর্ব্ব পাপের কারণ!!!
মহাশয়! আমরা সত্য সে জাতি নহি, যে শুদ্ধ ‘পৃথিবী ঘুরিতেছে’ বলিয়া চিরান্ধকার কারাগারে যাইতে প্রস্তুত; সে জাতি নহি, যে জাতি ‘এই হাতে মিথ্যা লিখিয়াছিল ইহা অগ্রে পুড়ুক,’ এ কথা জ্বলন্ত অনলের সম্মুখে নির্ভয়ে বলিতে পারে। কিন্তু যে সমাজ কস্তার কুলীন বা ধনী বরের প্রত্যাশায় মিছা কথা কহিতে পারে, শঠতার স্রোতে গা ঢালির দিতে পারে, ও সত্যের স্নেহের জ্ঞানের বিবেকের মস্তকে কুঠার মারিতে পারে, সে জাতির আশা নাই।
আমরা ভীরুর জাতি। বিলাত-ফেরতেরা অন্ততঃ আমি যে সে ভীরুতা হইতে মুক্ত তাহ বলি না। আমরা—অন্ততঃ আমি যে বিশ্বাসের জন্য হাত পুড়াইতে পারি, বা ক্রুশে ঝুলিতে পারি, তাহা বলি না। যদি কেহ বলে যে “বল পৃথিবী স্থির, নইলে তোমার নাসিকাটি কাটিয়া মুখ সমভূমি করিয়া দিব,” তাহা হইলে, যদি দেখি যে শাণিত ছুরির তামাসাটা সঙ্গীন হইয়া দাঁড়াইতেছে, ত বলি “তা যদি পৃথিবীর ঘোরার সহিত আমার নাসিকার অস্তিত্বের এত গূঢ় সম্বন্ধ থাকে, ত পৃথিবী মোটে ঘোরে না; পৃথিবী হিন্দু সমাজের মত স্থির ও নিশ্চল।”
কি করিব, হাত পুড়াইতে পারি না সত্য, মরিতে পারি না সত্য, কিন্তু মহাশয় আপনার সহিত আমার একটু প্রভেদ, যে এক কন্যাদায়ে বিবেককে এত মলিন করিতে পারি না। হিন্দু সমাজের ফলারে এত সুধা নাই, কন্যার এক ধনী বা কুলীনবরে এমন মাধুরী নাই, যাহার জন্য মিথ্যার কর্দ্দমে, ক্ষুদ্রতার আঁস্তাকুড়ে, লুকোচুরির ময়লাময় জঙ্গলে জীবনকে, ধর্ম্মকে, বিবেককে বিসর্জ্জন দিব।
মহাশয়! আপনি বলিয়াছেন যে, “প্রায়শ্চিত্ত না কর, অন্ততঃ বাহিরে হিন্দুয়ানিটা রাখিও”, অর্থাৎ ভণ্ডামিটা করিও।—মহাশয়! আমার যদি আপনার সহিত আলাপ না থাকিত, আপনার কথা কখন না শুনিতাম, আপনাকে চক্ষে না দেখিতাম, কেবল কাহার প্রতি আপনার প্রদত্ত ঐ উপদেশটি কোন সূত্রে আমার দৃষ্টিপথে আসিয়া পড়িত, ত আমি জ্যোতিষিক নিশ্চয়তার সহিত বলিয়া দিতে পারিতাম, যে আপনি বাঙ্গালী ও আপনার কন্যা আছে।
—আমি বেশ জানি যে আপনি আমাকে সমাজতঃ পরিত্যাগ করিয়াছেন। কিন্তু আপনার ইচ্ছা যে, আমি একবারে মোসলমান না হই; যাহাতে আপনি অন্ততঃ আমার বাটীতে পানটা নির্ভয়ে খাইতে পারেন, ও হুঁকোটা নির্ভয়ে টানিতে পারেন; অথচ আপনার বাটিতে আমি গেলে, আপনি আমাকে কল্কেটা পর্য্যন্ত দিবেন না। যাহা হৌক্ আপনি আপনার পুণ্যময় সমাজে বেশ আছেন, থাকুন। আমিও বেশ আছি। আমি দুনৌকায় পা দিয়া চলিতে ব্যগ্র নহি ও সে দরকারও আমার নাই। “সুখে থাক্তে কেন ভূতে কিলোয়?”
তবে একটা কথা বলি; যে আপনাদের সমাজে কয়টা টিকী আছে যাহা ধনীর পদতলে না গড়ায়?—শুনিতে পাই কালীসিংহ মহোদয় টাকা দিয়া ব্রাহ্মণদিগের টিকী খরিদ করিয়া, এক টিকীর প্রদর্শনী খুলিয়াছিলেন। আমি বিলাতে ঐরূপ নানাপ্রকার মেষের পশম প্রদশর্নী দেখিয়াছি বটে। তাহাতে নানাজাতীয় মেষের পশম প্রদর্শিত হইয়াছিল। কিন্তু বিলাতে এরূপ টিকীপ্রদর্শনী দেখিয়াছি কি না, ঠিক স্মরণ হয় না। কালীসিংহ মহোদয় বোধ হয় ভারতবর্ষে প্রথমে ঐরূপ প্রদর্শনী খোলেন। তাহাতে ভাটপাড়ার, নবদ্বীপের, কালীঘাটের, নানাজাতীয় পণ্ডিতের শাদা, কাল, মসৃণ, ছোট, বড়, খোলা, গেরো দেওয়া, ইত্যাদি নানাপ্রকার টিকী প্রদর্শিত হইয়াছিল ও তাহাদের নিম্নে (শুনিয়াছি) তাহাদের খরিদ দামও লিখিত হইয়াছিল, যথা:—
টিকী | দাম | ওজন | |
ভাটপাড়ার ভট্টাচার্য্যের টিকী | … | ৫৲ | ১ ছটাক |
ঐ তর্কবাগীশের টিকী | … | ৬৷৷৹ | ঐ |
ঐ ঐ (একটু মোলায়েম) | … | ৭৷৷৴৹ | ঐ |
নবদ্বীপের বিদ্যারত্নের টিকী | … | ৯৷৷৵৹ | ১৷৷৹ ছটাক |
ঐ ঐ পাকা | … | ১০৷৴১৫ | ঐ |
ঐ চূড়ামণির টিকী | … | ৭৸৶৹ | ১ ছটাক |
কলিকাতার শিরোমণীর টিকী | … | ৩৷৷৴১০ | ১৷৹,, |
ঐ ঐ তড়িন্ময় | … | ৪৵১৫ | ঐ |
ইত্যাদি, ইত্যাদি। এরূপ প্রদর্শনী খোলার জন্য কালীসিংহ মহোদয় আমাদের বিশেষ কৃতজ্ঞতার পাত্র। কারণ এরূপ প্রদর্শনী—খুব কৌতুহলদায়ক ও শিক্ষাপ্রদ। আমি ধনী হইলে ঐরূপ প্রদর্শনী বৎসরে বৎসরে একবার করিয়া খুলিতাম।
বাঙ্গালার কোন এক ব্রাহ্মণমহারাজের—(নাম করিলে মানহানির মোকদ্দমা হইতে পারে) সদাড়ি, দাড়িহীন নানাপ্রকার নানাজাতীয় রাঁধুনী ছিল। একদিন তাহার কুলগুরু (—টিকীওয়ালা) তাঁহাকে কহিলেন,—“আপনি হিন্দুরাজ হইয়া এরূপ নানাজাতীয় রাঁধুনী রাখিয়াছেন কেন?” মহারাজ উত্তর করিলেন যে, “হিন্দু রাঁধুনীতে ত মুরগী রাঁধে না, তাই মুসলমান রাখিতে হইয়াছে; আর মুসলমান ত শূকর রাঁধে না, তাই একজন হাড়ি রাঁধুনী রাখিতে হইয়াছে।” কুলগুরু কহিলেন—“এরূপ করিলে আমাদের আপনার বাটীতে আসা ভাল দেখায় না।” মহারাজ প্রশান্তভাবে উত্তর করিলেন যে, “আপনি আমার এখানে না আসিলে আমার যে বিশেষ ক্ষতি তাহা ত দেখিতে পাই না।” বলা বাহুল্য যে কুলগুরু মহারাজের প্রতি তাহার স্নেহাধিক্যে, বা নিজের দয়াগুণে, অথবা টিকীর মাহাত্ম্যে, তাঁহার সে ভীতি প্রদৰ্শন কার্য্যে পরিণত করেন নাই।
জানি মহাশয়, এই ত আপনাদের সমাজ, টাকা বা টিকী থাকিলে, মিছা কথা কহিলে, বা গোঁফ কামাইলে, সাত খুন মাফ। মহাশয় আমার দুরদৃষ্ট যে টাকা নাই, টিকী নাই, চন্দনের ফোঁটা নাই, কোশাকুশী নাই, ও গোঁফ আছে।
আপনি বলিয়াছেন যে, “তোমাকে জাতে উঠাইবার জন্য আমরা বিশেষ চেষ্টিত আছি। মহাশয় মাফ করিবেন, কিন্তু আপনার প্রথম কথাতেই আমার আপত্তি আছে। “জাতি” একথা আর হিন্দুর প্রতি ব্যবহার্য্য নহে। একদিন হিন্দু জাতি ছিল বটে; কিন্তু এখন হিন্দুকে জাতি বলিলে আর্য প্রয়োগ হয়। কাণা ছেলেকে ‘পদ্মলোচন’ বলিয়া ডাকিলে অন্য লোকের যে নিদারুণ কষ্ট হয়, কেহ কাককে ‘কলকণ্ঠ’ বলিয়া ডাকিলে অন্যের যে দুঃখ হয়, পেয়াদা শ্বশুরালয়ে যাইব বলিলে যেমন তাহাকে মারিতে ইচ্ছা করে, কেহ তাঁর ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণা স্ত্রীকে ‘সুন্দরি’ বলিয়া ডাকিলে অপরের যে যাতনা হয়, হিন্দুকে আজ জাতি বলিলে আমার তেমনি শরীরের বেদনা হয় ও গারে জ্বর আসে।
আর ‘উঠা’ এ কথাটিও এখানে অস্থান-প্রযুক্ত। উঠা শব্দে নীচু হইতে উঁচু যাওয়া বুঝায়, উঁচু হইতে নীচু যাওয়া বুঝায় না; আর উঠার এরূপ অর্থও বোধ হয় পণ্ডিতেরা দেন নাই। ইহার মাতৃশব্দ “উত্থা” এর নীচু হইতে উচু যাওয়া এইরূপ অর্থই প্রতিপন্ন হয়। অতএব এস্থলে (বিলেতফেরতাদিগের প্রতি প্রয়োগ করিবার সময়) উঠা স্থলে ‘নামা’ বলিবেন। ‘পালে মেশা’ বলিলেও আমার আপত্তি নাই।
সে যাহা হোঁক্, আমার অনুরোধ যে বিলেতফেরতাদিগকে আপনাদের পালে ঢুকাইবার এই মহতী উদার চেষ্টা হইতে আপনি বিরত হইবেন। বলিয়া দিই যে ও পালে মিশিবার জন্য তাহারা কিছুমাত্র ব্যগ্র নহে। বলিয়া দিই,—ও আপনারা জানিয়া বোধ হয় সুখী হইবেন, যে তাহারা সুখে ও স্বচ্ছন্দে আছে, ও খাইতেও পায়; এবং আপনাদের প্রতি আপাততঃ নাসিকার অগ্রভাগে বাম হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুলি স্থাপন করিয়া কনিষ্ঠাঙ্গুলি প্রসারণ করিয়া দেখাইতে তাহারা কিছুমাত্র শঙ্কিত নহে।
মহাশয় বিলেতফেরতাদিগকে ‘একঘরে করা’ বা ‘জাতে তোলা’! কথাটাই আপনাদের আস্পর্দ্ধা। আজ যাঁহারা দেশের নেতা, জাতীয় জড়তার জীবন, ধর্ম্মের শরীরে নবপ্রাণদাতা, বলিলে অত্যুক্তি হয় না তাঁহারা প্রায় সব আজ বিলেতফেরতায় কেন্দ্রীভূত। আজ এ দেশ হইতে যদি বিলেতফেরতার চলিয়া যায় ত দেশের কি দশা হয়? দেশে যে এ জ্ঞানের ক্ষীণপ্রভা তাহাও নিভিয়া যায়, উৎসাহের যে ক্ষীণতরঙ্গ তাহাও ভাঙ্গিয়া যায়।
গ্রীস একদিন সক্রেটিসকে একঘরে করিয়াছিল। রোম কোরায়লেনস্কে নির্ব্বাসিত করিয়াছিল। খ্রীষ্ট ইউরোপ একদিন লুথারকে পীড়ন করিয়াছিল। রোমের সমাজ সীজারের বুকে ছুরী বিধিঁয়াছিল।—ইহার জন্য তাহাদের পরে কাঁদিতে হইয়াছিল।
আপনি বলিয়াছেন “একটু হিন্দুয়ানি না রাখিলে কিরূপে তোমার বাড়ী যাই।” এখানে আপনার স্নেহের খাতিরে আপনাকে এককথা বলির দিই। ব্রাহ্মণ রাঁধুনী আপনার চক্ষে মুসলমানের চেয়ে সুশ্রী ও গৌরবর্ণ হয় ত রাখিলাম; ব্রাহ্মণ বলিয়া ত সে আমার চক্ষুশূল নয়। আপনি বলেন ‘পৈতা রাখিও,’ রাখিলাম; ও বিলাতেও আমার পৈতা ছিল। টেবিলের ধারে বসিয়া আহার না করিলেও ‘ভাগবত অশুদ্ধ’ হয় না; ও মুরগী না খাইলেও বাঁচি, ও আবশ্যক বোধ হইলে তাহা ছাড়িতেও পারি।
কিন্তু মহাশয়, এ সকল বিষয় আমি স্বৰ্গীয় ঘৃণার সহিত দেখি। পৃথিবীর নৈতিক সমরে এ সকল তুচ্ছ বিষয়। বুটজুতা পায়ে দেওয়া, টেবিলে খাওয়া, মাংসভক্ষণ করা এ সব সুবিধাও বিলাসের অঙ্গ, নীতি ও ধর্ম্মের নহে। ইহাদিগকে সমাজের রক্ষক করা, ইহাদের একম্বরের নিয়ন্তা করা, সমাজের কর্ত্তব্য নহে। যে সমাজ এ বালুময় ভিত্তির উপর স্থাপিত সে সমাজ থাকে না। এরূপ ভঙ্গুর সমাজ পৃথিবীর কুত্রাপি নাই ও থাকিতে পারে না।
সমাজের অন্য দৃঢ়তর বন্ধন আবশ্যক। যাহা সমাজের ক্ষয়কারী কীট, মর্ম্মাশী পিশাচ, সেই সকল বিষয় সমাজের প্রশ্ন করুন, সমাজের হর্ত্তা-কর্ত্তা-বিধাতা করুন। একঘরে করিতে চাহেন, আসুন আজ যে সব বিষয় সমাজের অমঙ্গলের হেতু, তাহাদিগকে একঘরে করি। আসুন আজ বলি, যে শঠতা করিবে, মিছা কথা কহিবে, তাহাকে একঘরে করিব; যে স্ত্রী ছাড়িয়া বেশ্যাবৃত্তি করিবে, তাহাকে একঘরে করিব; যে পঞ্চবর্ষীয়া শিশুবালিকার বিবাহ দিবে, তাহাকে একঘরে করিব; যে যুবতীবিধবার স্বেচ্ছিত বিবাহে বাধা দিবে তাহাকে একঘরে করিব; যে স্বজাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিবে তাহাকে একঘরে করিব। আসুন যে সব ব্যাধি জাতির বুকে বসিয়া অবাধে বুকের রক্ত পান করিতেছে, যাহারা নির্ভয়ে উন্নতির প্রেমের সত্যের হৃদয়ে শেল বিঁধিতেছে, তাহাদিগকে একঘরে করি; পীড়নের হেতু করি। সে একঘরেতে দেখিবেন দেশের মঙ্গল হইবে, জাতির জীবন হইবে। সে একঘরে অর্থ অধর্ম্মের প্রতি সমাজের কেন্দ্রীভূত ঘৃণা ও ক্রোধ; সে একঘরের অর্থ অনর্থের উচ্ছেদ; জ্ঞানের সত্যের উদাসের নবরাজ্য। নহিলে যেখানে কেশবচন্দ্র সেন, মনোমোহন ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী একঘরে, সে একঘরেতে কেহ ভীত হইবে না; কারণ তাহার অর্থ জাতির মান্য, দেশের ভক্তি। সে একঘরের অর্থ বিদ্যা, প্রতিভা, সত্য, দ্যায় ও ধর্ম্ম।
আপনি বলিয়াছেন—“একটু হিন্দুয়ানি রাখিও” নহিলে আপনি আমার বাটীতে আসিবেন না;—দুঃখের বিষয়। কিন্তু স্বপ্নেও ভাবিবেন না যে আপনাদের ভগ্ন কুটীরে যাইবার জন্য তথাপি অসত্যের বা ভণ্ডামীর প্রশ্রয় লইব। আপনি নহিলে আমার সহিত সম্বন্ধ ত্যাগ করিবেন? তথাস্তু। মহাশয় এখনও আপনাদের বয়সের প্রতারণা শিখি নাই। কিন্তু আশা করি চিরকাল এইরূপ হৃদয়কে আপনার সমাজের কলুষ হইতে রক্ষা করিয়া চলিতে পারিব। আশা করি যে জীবনের সুখদুঃখের মিশ্রিত আলোক-অন্ধকারে প্রাণের হাসিকান্নার ভিতর দিয়া এইরূপই চলিয়া বাইতে পারিব। আশা করি, তাহাতে ভাবীকন্যার বিবাহচিন্তা, একঘরের আরামময় ভীতি ও আপনার পরিত্যাগসঙ্কল্প ও স্থান পাইৰে না।
পরিত্যাগ করিবেন? করুন। সংসার পরিত্যাগ করে করুক, তথাপি এ মাথা সংসারের কাছেও হেঁট হইবে না। সংসার যদি ভণ্ডামি চায়, প্রতারণা চায়, সে সংসারকে আমি একঘরে করিব। না হয় সংসার ছাড়িয়া একটি নির্জ্জন পল্লীতে, নির্জ্জন কুটীরে গিয়া বাস করিব। সেও ভাল, ভণ্ডামীর সহিত সহবাস হইতে যে সে স্বপ্নও মধুর; প্রতারণা হইতে পর্ণকুটীরও ভাল। সেখানেও বিহঙ্গের সঙ্গীত নিকুঞ্জে ঝঙ্কারিত হইবে; সেখানেও পূর্ণিমার চাদ উঠিবে; সেখানেও মলয় সমীরণ রহিবে। আমার কুটীরের পার্শ্বে গোটা দুই ঝাউগাছ লাগাইয়া দিব, তাহারা সোঁ সোঁ করিয়া দিনরাত স্বপ্নময় সঙ্গীত ঢালিবে। কুটীরের সম্মুখে দুচারিটি বেলের, বকুলের, মালতির গাছ লাগাইয়া দিব; তাহারা সে কুটীরে স্বর্গের সৌরভ আনিয়া দিবে; কুটীরের পূর্ব্বদিকের জানালায় একটি রঞ্জিত চিক টাঙ্গাইয়া দিব; তাহাতে লাগিয়া প্রভাতের সূর্য্যকিরণ ভাঙ্গিয়া ভাঙ্গিয়া আমার ঘুমন্ত শিশুর গায়ে আসিয়া ঢলিয়া পড়িবে। ঈশ্বর আমাকে নিৰ্দ্ধনতার অন্ধকার, পরিত্যাগের বিষাদ দিউন, সেও ভাল; কিন্তু যেন আত্মার কলুষ, বিবেকের গ্লানি হইতে রক্ষা করেন।
মহাশয় এক কথা বলিয়া দেই। অন্যকারণে জাতিচ্যূত হিন্দু আপনাদের কাছে মাথা হেঁট করিতে পারে; বিলেতফেরতারা তাহা করিবে না, ও এত দিনও (দুইএকজন ছাড়া) কেহ তাহা করে নাই। হিন্দুসমাজ যদি তাহাদের সহিত মিশিতে চাহে ত ইহাকে অগ্রসর হইতে হইবে; তাহারা পিছাইবে না। হিন্দুসমাজকে দরওজা প্রশস্ততর ও উচ্চতর করিতে হইবে, তাহার মৌরুশী নীতি ও প্রথা ছাড়িতে হইবে। আমরা তাহার ভগ্নমন্দিরে যাইবার জন্য মাথা হেঁট করিব না। তাহার উঠিতে হইবে, আমরা নামিব না। হিন্দুরা যদি আমাদের অন্তরে ভালবাসেন বা ভক্তি করেন তবে এ তাচ্ছিল্যের এ বৈরাগ্যের ভাণ কেন? এ ঢাকাঢাকি কেন? এ সত্যের গ্লানি কেন? আমরাও হিন্দু; বিলাতে গিয়াছি বলিয়া, হিন্দুর পৌরাণিকী প্রথা প্রতি পূর্ণব্যক্ত ঘৃণা থাকিলেও হিন্দুর প্রতি স্নেহ ও ভালবাসা যায় নাই। যদি আপনাদের বিশ্বাস যে আমরা ইংরেজদের খোসামুদে ত সে ভুল। আমরা যাহার যেখানে যাহা ভাল দেখি তাহ লই; তাই বলিয়া ইংরাজদের অনেক প্রথার অনুবর্ত্তী বলিয়া তাহাদের খোসামুদে নহি, বা দেশের প্রতি বীতস্নেহ নহি। আমরা যেমন এখানে হিন্দুর আচরণে ও প্রথায়; দুঃখে লজ্জায় ঘৃণায় মরিয়া যাই, বিজাতীয় কেহ হিন্দুর নিন্দা করিলে যথাসাধ্য হিন্দুকে অন্যজাতির শ্লেষ ও বিদ্রূপের ভল্ল হইতে রক্ষা করি, কারণ তাহাতে আমাদেরও গায়ে লাগে। আর আপনাকে আপনার সমাজের বিষয় যাহা বলিলাম তাহা বিদ্বেষে নহে, শত্রুভাবে নহে; ভ্রাতার প্রতি ভ্রাতার যে ক্রোধ, অন্যায়ব্যবহারী পিতার প্রতি পুত্রের যে ক্রোধ, সেই ক্রোধে বলিয়াছি।
মহাশয়! আমি সামান্য; কিন্তু আমার সমাজ সামান্য নহে, মূর্খের নহে। এ সমাজে আসিতে চাহেন আসুন, সমাজে এ দ্বার চিরোন্মুক্ত, স্নেহের বাহু প্রসারিত। এখানে লুকোচুরী নাই, শঠতা নাই, নির্ম্মমতা নাই, প্রায়শ্চিত্ত নাই। আসুন, আপনাদিগকে ভাই বলিয়া, আর্য্য বলিয়া, হিন্দু বলিয়া এ সমাজে আলিঙ্গন করিয়া লইব। কিন্তু অতি উন্মাদস্বপ্নেও ভাবিবেন না যে, আমরা মাথা হেঁট করিয়া, বিবেককে কলুষিত করিয়া, পুণ্যের প্রায়শ্চিত্ত করিয়া, আলিঙ্গিত প্রথা ও নবজীবন বিসর্জ্জন দিয়া, আপনাদের সমাজে ঢুকিতে যাইব।
এক কথা বলিয়া দিই। বিলাতফেরতার মূর্খ হইলেও তাহাদের একঘরে করিয়া আপনাদের সমাজ বলবান হইবে না। কোন জাতি কোন কালে নিজের মধ্যে বিচ্ছেদের নীতি অবলম্বন করিয়া বড় হয় নাই। বরং সম্মিলনের নীতিতেই বড় হইয়াছিল। গ্রীস এই গৃহবিবাদে ডুবিল, ভারত এই গৃহবিবাদে উচ্ছন্ন হইল; রোম যে বড় হইয়াছিল তাহা দেশীয়কে জাতিচ্যুত করিয়া নহে, বিজাতিকে স্বজাতি করিয়া লইয়া। বৃটেন ও বড় হইয়াছে বিচ্ছিন্নতায় নহে, মিলনে। জাতিতে কেন, পৃথিবীর চারিদিকেই সংযোগই—উন্নতি, বল, সভ্যতা, জীবন; বিচ্ছিন্নতা—অবনতি ব্যাধি, বর্ব্বরতা, মৃত্যু।
এ সমাজে আর গৃহ বিবাদ কেন? আজ যাহারা এই ক্ষীণ সমাজে নূতন নূতন ব্যাধি আনিতেছে—তাহারা হিন্দু নহে, হিন্দুর শয়তান। যাহার এই বিচ্ছিন্ন সমাজে আবার নূতন পার্থক্যের বেড়া রচনা করিতেছে—তাহা্রা ইহার শক্র। যাহারা এই অৰ্দ্ধমৃত জীর্ণ শীর্ণ জাতিতে আবার বিচ্ছেদের কুঠার মারিতেছ—তাহারা ইহার হত্যাকারী জল্লাদ। বঙ্গ! তুমি জান না যে আজ তোমার অন্ধকারে, তোমার এ ভগ্নগৃহে যাহারা বাস করিতেছে, তাহারা তোমার সন্তান নহে; তাহারা তোমার শবলোলুপ, রক্ত-পিপাসু পিশাচ। তোমার সন্তান বা সকলে চলিয়া গিয়াছে।
হতভাগ্য হিন্দু! তোমার এ বরাহ বিবাদ আর ঘুচিল না; তোমার অপমানের কলঙ্কের মূল এ অন্তর্দাহ আর ঘুচিল না; তোমার সোণার গৃহে কালসাপ, কুসুমে কীট, এ ব্যাধি আর ঘুচিল না! তোমার প্রাণের কলুষ, জ্ঞানের হলাহল, বুকের চাপা এ বিবাদ আর ঘুচিল না।
আজ এ জাতির যা কিছু জীৰন—‘একঘরে’ করার ব্যগ্রতাতে পরিলক্ষিত, আর অন্যদিকে উত্থানশক্তিহীন। যে বরাহ-বিবাদ পূর্ব্বে রাজায় রাজায় ছিল, তাহা আজ ভ্রাতায় ভ্রাতায় পরিণত হইয়াছে; সেই চিরশত্রু হিন্দুর রক্তপায়ী প্রেতাত্মা আজ হিন্দুর ঘরে ঘরে ঘুরিতেছে।
হিন্দুসমাজ পচিতেছে—
পৃথিবীর লজ্জা, মনুষ্যজাতির আবর্জ্জনা, প্রতাড়িত পদাহত হিন্দুসমাজ—আজ পচিতেছে।
জীর্ণ, শীর্ণ, ভাঁড় হিন্দুসমাজ আজ পচিতেছে।
শঠতার ভাণ্ডার, মিথ্যাকথার ওস্তাদ, লুকোচুরীর সর্দ্দার, ভীরুতার সেনাপতি, হিন্দুসমাজ আজ পচিতেছে—
এ মিথ্যা, এ প্রতারণা, এ ভাঁড়ামি, এ নির্ম্মমতা, এ নির্ব্বিবেকতা সে পচার দুৰ্গন্ধ ও দূষিত বায়ু।
কেন আর এ ভাঙ্গা ঘরে মারিস তোদের সিঁধকাটি।
ছিন্ন তরুর মূলে হ’তে কেন তুলে দিস্ মাটি।
বিষে জ্বর জ্বর প্রাণে কেন হানি’স্, বিষবাণ,
পাপের বন্যায়ভরা দেশে আনিস্ নরক খাল কাটি,
কেন শীর্ণ মলিন দুঃখে, মারিস কুঠার মায়ের বুকে।
দু’দিন গেলে দিস্রে ফেলে, পুরাস প্রাণের আকাঙ্ক্ষাটি।
এই লেখাটি ১ জানুয়ারি ১৯২৯ সালের পূর্বে প্রকাশিত এবং বিশ্বব্যাপী পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্ভুক্ত, কারণ উক্ত লেখকের মৃত্যুর পর কমপক্ষে ১০০ বছর অতিবাহিত হয়েছে অথবা লেখাটি ১০০ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে ।