একেই কি বলে সভ্যতা?/দ্বিতীয় অঙ্ক/দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক

দ্বিতীয় গর্তাঙ্ক।


নবকুমার বাবুর শয়ন মন্দির।

প্রসন্নময়ী, নৃত্যকালী, কমলা, এবং হরকামিনী, আসীন।

 প্রসন্ন। এই নেও—

 নৃত্য। কি খেল্‌লে ভাই?

 প্রসন্ন। চিড়িতনের দহলা।

 নৃত্য। আরে মলো, চিড়িতন যে রঙ, ত্র‌ুপ খেল্‌লি কেন?

 প্রসন্ন। তুই, ভাই, মিছে বকিস্ কেন? হাতে রঙ না থাকে পাব সে মা।

 নৃত্য। এই এলো, আমি টেক্কা মারলেম।

 হর। এই নেও।

 নৃত্য ও কিও, পাষ দিলে যে?

 হর। হাতে ত্রুপ না থাকলে পাষ দেবো না তো কি করবো।

 নৃত্য। এস কমল, এবার ভাই তোমার খেলা।

 কমল। আমি ভাই বিবি দিলাম।

 নৃত্য। মর, ও যে আমাদের পিট, তুই বিবি দিলি কেন?

 কমল। বাঃ বিবি দেবে না তে কি? সায়েব কোথা?

 নৃত্য। এই যে সাহেব আমার হাতে রয়েচে-।

 কমল। আমি তো ভাই আর জান নই।

 নৃত্য। মর ছুঁড়ি, খেলার ইসরায় বুঝিতে পারিস্ নে? তোর মোতন বোকা মেয়ে তে, আর দুটী নাই লা, তুই যদি তাস্ না খেলতে পারিস, তবে খেলতে অসিস্ কেন?

 কমল। কেন, খেলতে পারবে না কেন?

 নৃত্য। একে কি কেউ খেলা বলে? তুই আমার টেক্কার উপর বিবি দিলি।

 কমল। কেন? বিবিটে ধরণ গেলে বুঝি ভাল হতো?

 হর। আর ভাই, মিছে গোল করিস্ কেন?

 নৃত্য। (কমলার প্রতি) কি আপোদ, যখন সায়েৰ আমার হাতে আছে তখন তোর আর ভয় কি?

 কমল। বস্, তুই পাগল হলি না কি লো? তোর হাতে সাহেব তা আমি টের পাব কেমন করে লা?

 নৃত্য। তুই ভাই যদি তাল খেলা কাকে বলে তা জানতিস্ তৰে অবিশ্যি টের পেতিস্।

 কমল। ও প্রলয়, শুনলি তো ভাই, এমন কি কখন হয়? বিবি ধরা গেমে, বিবি পালাবার বাগ পেলে কি কেউ তা ছাড়ে?

 নেপথ্যে। ও প্রসন্ন-

 প্রসন্ন। চুপ্ কর্ লো, চুপ্ কর্, ঐ শোন্, মা ডাকচেন-

 নেপথ্যে। ও বোউ-

 প্রসন্ন (উচ্চস্বরে) কি, মা-

 নেপথ্যে। ওলো, তোরা ওখানে কি করচিস্ লা।

 প্রসন্ন। (উচ্চস্বরে) আমরা মা, দাদার বিছানা পাড়চি।

 হর। ও ঠাকুরঝি, তাস ষোডাটা ভাই, নুকোও, ঠাকরুণ দেখতে পেলে আর রক্ষে থাকবে না।

 প্রসন্ন। (তাস বালিশের নিচে গোপন করিয়া) আয় ভাই আমরা সকলে এই চাদর খানা ধরে ঝাড়তে থাকি, তা হলে মা কিছু টের পাবেন না।

 নৃত্য। আরে মলো—আবার টেক্কা—

 কমল। আরে তাতে বয়ে গেল কি? সায়েব কি বিবি ধরতে পারে না?

 হর। তোদের পায়ে পড়ি ভাই চুপ কর্, ঐ দেখ ঠাকরুণ উপরে অসচেন। ধর্, সকলে মিলে এই চাদর খানা ধর।

(গৃহিণীর প্রবেশ)।

 গৃহিণী। ওলো, তোরা এখানে কি করচিস লা।

 প্রসন্ন। এই যে মা, আমরা দাদার বিছানা পাড়চ্যি।

 গৃহিণী। ওমা, তোদের কি সন্ধ্য অবধি একটা বিছানা পাড়তে গেল? তা হবে না কেন? তোরা এখন সব কলিকালের মেয়ে কি না।

 নৃত্য। কেন জেঠাইমা, আমার কলিকালের মেয়ে কেন?

 গৃহিণী। আর তোরা দেখচি একবারে কাজের সদ্দার হয়ে পড়েচিস। ভাগ্যে অজ নব বাড়ী নেই, তা হলে তো সে এতক্ষন শুতে আসতো।

 প্রসন্ন। হ্যাঁ মা, দাদা আজ কোথায় গেছেন গা?

 গৃহিণী। ঐ যে রামমোহন রায়—না—কার কি সভা আছে—?

 কমলা। ছোটদাদা কি তবে তাঁর জ্ঞানতরঙ্গিণী সভায় গেছেন?

 হর। (জনান্তিকে প্রসম্নের প্রতি) তবেই হয়েচে! ও ঠাকুরঝি, আজ দেখচি্ তোর ভারি আহ্লাদের দিন। দেখ্, হয় তো তোর দাদা আজ আবার এসে তোকে নিয়ে সেই রকম রঙ্গ বাধায়।

 গৃহিণী। বউ মা কি বলছে, প্রসন্ন?

 নেপথ্যে। ও বেমোল, মা ঠাকরুণ কোথায় গো? কত্তা মশায় বৈটকখান থেকে উঠেছেন।

 গৃহিণী। তবে আমি যাই, তোরা মা বিছান করে শীঘ্র নীচে আয়।

[প্রস্থান।

 হর। (সহাস্য বদনে) ও ঠাকুরঝি? বল না রে সে দিন তোর ভাই কি করেছিল?

 প্রসন্ন। আ., ছি।

 নৃত্য। কেন, কেন, কি করেছিল? বলনা কেন, ভাই?

 হর। (সহাস্য বদনে) বল না ঠাকুরঝি?

 প্রসন্ন। না, ভাই, তুই যদি আমাকে এত বিরক্ত করিস্, তবে এই আমি চললেম।

 নৃত্য। কেন? বল না কি হয়েছিল। ও ছোট বউ, তা তুই ভাই বল।

 হর। তরে বলবো? সে দিন বাবু জ্ঞানতরঙ্গিণী সভা থেকে ফিরে এসে ঠাকরঝিকে দেখেই অমনি ধরে ওর গালে একটা চুমো খেলেন; ঠাকুরঝি তো ভাই পালাবার জন্যে ব্যস্ত, তা তিনি বললেন যে কেন? এতে দোষ কি? সায়েবরা যে বোনের গালে চুমো খায়, আর আমরা কল্লেই কি দোষ হয়?

 প্রসন্ন। ছি, যাও মেনে, বউ।

 নৃত্য। ও মা, ছি। ইংরিজী পড়লে কি লোক এত বেহায় হয় গা।

 হর। আরও শোন্ না, আবার বাবু বলেন কি?—

 প্রসন্ন। তোর দাদা মদ খেয়ে কি করে লো?

 হর। কেন ভাই, সে জ্ঞানতরঙ্গিণী সভাতেও যায় না, অণর বনের গায়েও হাত দেয় না, আর যা করুক, সে যাহউক ঠাকুরঝি, তুই ভাই তোর দাদকে নে না কেন? আমি না হয় বাপের বাড়ী গিয়ে থাকি; তোর ভাতার তে তোকে একবার মনেও করে না। তা নে, তুই ভাই, তোর দাদাকে নে।

 প্রসন্ন। হ্যাঁ, আর তুই গিয়ে তোর দাদাকে নে থাক্।

 নেপথ্যে। ছেড়ে দেও হামকো।

 নেপথ্যে। তোমাব পায়ে পড়ি, দাদাবাবু, এত চেচঁয়ে কথা কয়ো না, কত্তা মশায় ঐ ঘরে ভাত খাচ্চেন।

 নেপথ্যে। ডেম কত্তা মশায়! আমি কি কারো তক্কা রাখি?

 কমলা। ঐ যে ছোটদাদা আসচেন।

 নৃত্য। আর, ভাই, আমরা লুকয়ে একটু তামাসা দেখি।

 হর। (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া) না ভাই, আমার আর ওসব ভাল লাগে না। আঃ, সমস্ত রাতটা মুখ থেকে প্যাঁজ অপর মদের গন্ধ ভক্‌ ভক্ করো বেরোবে এখন, আর এমন নাক্ ডাকুনি-বোধ করি মরা মানুষও শুনলে জেগে উঠে! ছি!

 কমলা। আয় লো আয়। (সকলের গুপ্তভাবে অবস্থিতি)।

(নব বাবুকে লইয়া বৈদ্যনাথের প্রবেশ)।

 নব। (প্রমত্তভাবে) বোদে—মাই গুড ফেলো—তোকে আমি রিফরম্ কত্যে চাই। তুই বুঝলি?

 বোদে। যে আজ্ঞে।

 নব। বোদে—একটা বিয়ার—না, ঐ ব্রাণ্ডি ল্যাও।

 বৈদ্য। যে অজ্ঞে, আপনি যেয়ে ঐ বিছানায় বসুন। আমি ব্রাণ্ডি এনে দিচ্ছি। (স্বগত) দাদাবাবু যদি শীঘ্র ঘুমিয়ে না পড়ে, তবেই দেখছি আজ একটা কাণ্ড হবে এখন। কত্তা এঁকে এমন দেখলে কি আর কিছু বাকী রাখবেন।

 নব। (শষ্যোপরি উপবিষ্ট হইয়া) ল্যাও—ব্রাণ্ডি ল্যাও—জলদি।

 বৈদ্য। আজ্ঞে, এই যাই।

[প্রস্থান।

 নব। (স্বগত) ড্যাম কত্তা –ওলড ফুল আর কদ্দিন বাঁচবে? আমি প্রাণ থাকতে এ সভা কখনই এবলিশ কর্ত্তে পারবো না। বুড়ো একবার চখ্ বুজলে হয়, তা হলে অপর আমাকে কোন্ শালার সাধ্য যে কিছু বলতে পাবে? হা হা হা, ওণ্ট আই এঞ্জয় মিসেলফ্? (উচ্চস্বরে) ল্যাও—মদ্ ল্যাও।

 হর। (কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইয়া) কি সর্ব্বনাশ। ওলো ঠাকুরঝি—

 প্রসন্ন। (ঐ) কি?

 হর। ঐ দেখচিস্ কত্তা। ঠাকরুণের ঘরে ভাত খেতে বসেছেন।

 প্রসন্ন। তা আমি কি করবো?

 হর। তুই, ভাই, কাছে গিয়ে তোর দাদাকে চুপ করতে বল না।

 প্রসন্ন। (সভয়ে) ওমা, তা তে ভাই আমি পারবে না।

 হর। (সহাস্যে বদনে) আঃ, তার দোষ কি? তুই তে ভাই আর কচি মেয়েটী নোস, যে বেটাছেলের মুখ দেখলে ডরাবি? ষানালা।

 নব। ল্যাও-মদ ল্যাও।

 হর। ওমা? কি সর্ব্বনাশ। (অগ্রসর হইয়া) কর কি? কর্ত্তা বাড়ীয় ভেতরে ভাত খাচ্ছেন, তা জান?

 নব। (সচকি) একি? পয়োধরী যে? আরে এসো, এসো। এ অভাজনকে কি ভাই তুমি এত ভাল বাস, ষে এরজন্যে ক্লেশ স্বীকার করে এত রাত্রে এই নিকুঞ্জ বনে এসেছ—হা, হা, হা, এসো, এসো। (গাত্রোত্থান)।

 হর। ও ঠাকুবঝি, কি বকচে বুঝতে পারিস ভাই?

 প্রসন্ন। (সহস্য বদনে) ও,ভাই, তোদের কথা, আমি আর ওর কি বুঝবো।

 নব। (পরিক্রমণ করিতে করিতে) এসো ভাই, আমি তোমার ডেম্ড স্লেভ্। এসো-(ভূতলে পতন)।

 হর, প্রসন্ন, ইত্যাদি। (অগ্রসর হইয়া) ওমা, একি হলো? (ক্রন্দন)।

 নেপথ্যে। কেন, কেন, কি হয়েছে?

(গৃহিণীর পুনঃ প্রবেশ)।

 গৃহিণী। (নবকুমারকে অবলোকন করিয়া) একি, একি? এ আমার সোণার চাঁদ যে মাটিতে গড়াচ্চে? ওমা, কি হলো? (ক্রন্দন করিতে করিতে) ওঠো বাবা, ওঠো। ওমা, আমার কি হলো! ওমা, আমার কি হলো! ও প্রসন্ন, তুই ওঁকে একবার শীঘ্র ডেকে আনত লা। (প্রসন্নের প্রস্থান) ওমা, ওমা, আমার কি হলো! (ক্রন্দন)।

 নৃত্য। উঃ জেঠাই মা, দেখ্ দাদার মুখদিয়ে কেমন একটা বদগন্ধ বেরুচ্ছে।

 গৃহিণী। উঁঃ, ছি! তাইতো লো। ওমা, একি সর্ব্বনাশ! আমার দুধের বাছাকে কি কেউ বিষ্ টিষ্ খাইয়ে দিয়েছে না কি? ওমা, আমার কি হবে! (ক্রন্দন)।

(প্রসন্নের সহিত কর্ত্তার প্রবেশ)।

 কর্ত্তা। এ কি?

 গৃহিণী। এই দেখ, আমার নব কেমন হয়ে পড়েছে। ওমা, আমার কি হবে!

 কর্ত্তা। (অবলোকন করিয়া সরোষে) কি সর্ব্বনাশ, রাধেকৃষ্ণ! হা দুরাচার! হা নবাধম! হা কুলোঙ্গার।

 গৃহিণী। (সরোষে) একি? বুড়ো হলে লোক পাগল হয় না কি? যাও, তুমি আমার সোনার নবকে অমন কব্যে বকচো কেন?

 কর্ত্তা। (সরোষে) ষোনাব নব! হ্যা। ওকে যখন প্রসব করেছিলে, তখন নুন্ খাইয়ে মেরে ফেলতে পার নি?

 নব। হিয়র, হিয়র, হুরে।

 গৃহিণী। ওমা আমার কি হলে। এমন এলো মেলো বকচে কেম? ওমা, ছেলেটিকে তো ভূতে টূতে পায়নি?

 কর্ত্তা। তোমার কি কিছুমাত্র জ্ঞান নাই? তুমি কি দেখতে পাচ্চ না যে ও লক্ষীছাড়া মাতাল হয়েছে।

{gap}}নব। হিয়র, হিয়র।

 কর্ত্তা। (সরোষে) চুপ্, বেহায়া, তোর কি কিছুমাত লজ্জা নাই?

 নব। ড্যাম লজ্জা, মদ্ ল্যাও।

 কর্ত্তা। শুললে তো?

 গৃহিণী। আমার এ দুধের বাছাকে এসব্ কে শেখালে গা?

 কর্ত্তা। আর শেখাবে কে? এ কলকাতা মহালাপ নগর-কর্জি রাজধানী, এখানে কি কোন ভদ্র লোকের বসতি করা উচিত?

 গৃহিণী। ওমা, তাইতো, এত কে জানে, না?

 কর্ত্তা। কাল প্রাতেই আমি তোমাদের সকলকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীবৃন্দাবনে যাত্রা করবো। এ লক্ষীছাড়াকে আর এখানে রেখে কাজ নেই। চল, এখন আমরা যাই। এ বানরটা একটু ঘুমুক-

 নব। হিয়র, হিয়র, আই সেকেণ্ড দি বেজোলুসন।

 কর্ত্তা। হায় আমার বংশেও এমন কুলাঙ্গার জন্মেছিল?

 গৃহিণী। ও প্রসন্ন, ও কমলা, ওলো তোরা মা এখানে একটু থকে আয়

[কর্ত্তা এবং গৃহিণীর প্রস্থান।

 হর। (অগ্রসর হইয়া) ও ঠাকুরঝি, এই ভাই তোর দাদার দশা দেখ্। হায়, এই কলকেতায় যে অজ্ কাল কত অভাগা স্ত্রী আমার মতন এইরূপ যন্ত্রনা ভোগ করে তার সীমা নাই। হে বিধাতা! তুমি আমাদের উপর এত বাম হলে কেন?

 প্রসন্ন। তা এ অজ আর নতুন দেখিলি না কি? জ্ঞান তরঙ্গিণী সভাতে এই রকম জ্ঞানই হয়ে থাকে।

 হর। তা বই আর কি ভাই? আজ কাল কলকেতায় যাঁরা লেখা পড়া শেখেন, তাদের মধ্যে অনেকেরই কেবল এই জ্ঞানটী ভাল জন্মে। তা ভাই দেখ্ দেখি, এমন স্বামী থাকলিই বাকি আর না থাকলিই বা কি। ঠাকুরঝি তোকে বলতে কি ভাই, এই সব দেখে শুনে আমার ইচ্ছে করে যে গলায় দড়ি দে মরি। (দীর্ঘ-নিশ্বাস) ছি, ছি, ছি। (চিন্তা করিয়া) বেহায়ারা আবার বলে কি যে আমরা সায়েবদের মতো সভ্য হয়েচি। হা আমার পোড়া কপাল! মদ্ খাস করেই কি সভ্য হয়?—একেই কি বলে সভ্যতা?

ববদিকা পতন