এতদ্দেশীয় স্ত্রীলোকদিগের পূর্ব্বাবস্থা/পুনর্ব্বিবাহ, সহমরণ ও ব্রহ্মচর্য্য

পুনর্ব্বিবাহ, সহমরণ ও ব্রহ্মচর্য্য।

 ঋগ্বেদের সময় সহমরণ ছিল না। যিনি বিধবা হইতেন, তিনি স্বামীর মৃতদেহের সহিত কিয়ৎকালের জন্য স্থাপিত হইয়া উঠিয়া আসিতেন। পরে তিনি অন্য পুরুষকে বিবাহ করিতে পারিতেন। ঋষিরা বিধবা বিবাহ করিতেন। অনন্তর বিধবার পুনর্ব্বিবাহ, পতিপরায়ণা নারীদিগের বিষতুল্য জ্ঞান হইতে লাগিল। তাঁহারা বলিতে লাগিলেন বৈবাহিক বন্ধন কেবল ঐহিক বন্ধন নহে—ইহা ঐহিক ও পারলৌকিক বন্ধন। পতি সাকার হউক বা নিরাকার হউক, সেই পতির সহিত মিলিত হইয়া, লোকান্তরে দুই জনে উন্নতি সাধন করিতে হইবে। অতএব এই বিশুদ্ধ ভাব পরিত্যাগ করিয়া পশুবৎ ভাব গ্রহণ পূর্ব্বক, পশুবৎ হইয়া অধোগতি প্রাপ্তির কি আবশ্যক? বৈবাহিক বন্ধনে স্ত্রী ও স্বামী, পরস্পরের অর্দ্ধেক শরীর, অৰ্দ্ধেক জীবন, অৰ্দ্ধেক হৃদয়। এইরূপ চিন্তা সতীর হৃদয়ে মন্থিত হইলে, সহমরণের প্রথা প্রচলিত হইল। বিধবার এই বাসনা যে, স্বর্গে স্বামীর সহিত বাস করাই শ্রেষ্ঠ কল্প ও তাঁহার সহযোগে, তাঁহার পিতৃ ও মাতৃকুল পবিত্র করা, উচ্চ কার্য্য। বিধবার শারীরিক ও মানসিক ভাব পরিত্যাগ পূর্ব্বক, আত্ম বলে বলীয়ান হইয়া, আত্মার চক্ষে আধ্যাত্মিক রাজ্যের মহাত্ম্য দৃষ্টি করত—চিতারূঢ় হইয়া, দগ্ধ হইতে লাগিলেন। পট্টবস্ত্রপরিধানা—কপালে সিন্দূর, হস্তে বটশাখা, রসনা ধ্বনি করিতেছে—“হরের্নাম, হরের্নাম, হরের্নামৈব কেবলম্‌—এ জগৎ মিথ্যা—আমার পতিই আমার সর্ব্বস্ব—যে রাজ্যে তিনি আছেন, আমি সেই রাজ্যে যাই। সত্যং সত্যং সত্যং।” এই ধ্যান ও এই গভীর ভাব প্রকাশে, সূক্ষ্ম শরীরের উদ্দীপন হইত ও দগ্ধ হইবার অগ্রে নারীর আপন আত্মা ইচ্ছাবলে, শরীর ও মন হইতে বিভিন্ন হইত।

 কিয়ৎ কাল পরে মনু এই বিধি দিলেন যে, বিধবা দিগের পক্ষে ব্রহ্মচর্য্য উত্তম কল্প, কারণ ব্রহ্মচর্য্য দ্বারা বহিরিন্দ্রিয়, অন্তরিন্দ্রিয়, সহিষ্ণুতা অভ্যাসিত হইতে হইতে আত্মার উন্নতি সাধন হয়। যদবধি পতি ছিল, তদবধি পতির সহিত এক মন, এক প্রাণ, এক শরীর হইয়া থাকাতে আধ্যাত্মিক শিক্ষার প্রারম্ভ হইয়াছিল। এক্ষণে পতির প্রীতার্থে, ব্রহ্মচর্য্য অনুষ্ঠান করিলে নিরাকার পতিকে হৃদয়ে আনয়ন করা হয় ও অভ্যাস নিষ্কাম ভাবে পরিচালিত হইলে আত্মার বল ও শক্তির বৃদ্ধি অনিবার্য্য।