এরাও মানুষ/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
প্রাচীন প্রথা-অনুযায়ী বাতোয়ালার পিতার প্রাণহীন দেহকে তারা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বেঁধে রাখলো, আট দিন আর আট রাত্রি ধরে গ্রামের সমস্ত মেয়েরা মৃতদেহকে ঘিরে কাঁদলো, অঝোরে বিলাপ করলো। অশৌচের চিহ্নস্বরূপ মাথায় ছাই মাখলো, সারা মুখ কালি দিয়ে কালো করলো। আটদিন আটরাত ধরে সেই মৃতদেহকে ঘিরে তারা কেঁদে কেঁদে নাচলো, শোকে আছড়ে আছড়ে পড়লো, সারা গা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেল।
তাদের পাশে দাঁড়িয়ে পাঁচখানা গাঁয়ের লোক ধীরে সৎকারের শেষ মন্ত্র গেয়ে চললো,···
“বাবা, তুমিই আজ সত্যিকারের সুখী।
দুঃখী আমরা, যারা পড়ে রইলাম,
যারা তোমার জন্যে শোক করছি।”
জীবনের একঘেয়ে বিষাদের ছন্দকে ভাঙ্গবার জন্যে যদি পাল-পার্বণের ব্যবস্থা না থাকতো, কে চাইতো বেঁচে থাকতে? নিচ্ছিদ্র দুঃখের মধ্যে এই সব পুরানো রীতি-নীতি তাই বাঁচিয়ে রেখেছিল প্রাণের আগুনকে, বৈচিত্রকে।
তা না হলে, যে মরে গেল, তার দিকে চেয়ে দেখবার আর কি আছে? তার কাছে চাইবার বা আশা করবার আর কিছুই নাই। মানুষের সঙ্গে তার সব সম্পর্ক গিয়েছে ছিড়ে, কি আর আছে তার মূল্য? আজ আর তো সে সমাজের কেউ নয়! “একটা শুকনো পাতার মতন, শুকনো এক টুকরো হাড়ের মতন, নিস্প্রয়োজন, নিরর্থক।
কিন্তু আবহমানকাল থেকে চলে আসছে, এই পৃথিবী ছেড়ে যে-যাত্রী চল্লো নাঙ্গাকৌরার দেশের দিকে, তার যাত্রাপথের চারদিকে নাচতে হবে, গাইতে হবে, তার শেষ-যাত্রা যেন মানুষের সুরে শব্দে সজাগ হয়ে থাকে।
এক সপ্তাহ সেইভাবে মৃতদেহকে নিয়ে শোক করবার পর, তাকে সমাহিত করতে হবে। গাছের গায়ে তার মৃতদেহ থেকে মাংস গলে পড়বে এবার···চারদিক থেকে ছুটে এসেছে, শবলোভী মাছির দল।
তা ছাড়া তখন এসে পড়েছে শিকারের দিন। মৃতকে নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। এই হলো শিকারের সময়। প্রত্যেকদিন সন্ধ্যার পর গ্রামের চারদিক থেকে উঠেছে ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশের দিকে···পোড়া ঘাসের গন্ধে ভারী হয়ে থাকে বাতাস। তার মাঝে ভেসে আসে টম্-টম্ বাজনার আওয়াজ। চারদিকে বন হয়ে উঠেছে সবুজ। বুনো লতার তাজা গন্ধে রক্তে লাগে দোলা।
তাই মৃতদেহকে এখন তাড়াতাড়ি বীজের মতন মাটীর ভেতর পুঁতে ফেলতে হবে। শোক যা করবার তা করা হয়ে গিয়েছে, রীতি-নীতি যা পালন করবার, তা যথারীতি পালন করা হয়ে গিয়েছে। এখন মাটীর তলায় থাকুক মৃতদেহ, তাদের বেরুতে হবে শিকারে।
আজকাল অবশ্য এমন নিখুঁতভাবে পুরানো রীতি-নীতি লোকে মানতে চায় না। বিশেষ করে যারা শাদা লোকগুলোর সংস্পর্শে এসেছে, যারা শাদা লোকগুলোর দাসত্ব করে তারা এই সব পুরানো রীতি-নীতির কথা শুনে ঠাট্টা করে।
অল্প বয়সে ছেলে-ছোকরার দল এমনি ধারা ঠাট্টা তো করবেই। আজ বুড়োলোকদের তারা মানতে চায় না। বুড়োদের বিদ্যে-বুদ্ধির তারিফ করে না। কোন কিছু বিচার করে ভেবে দেখতেও চায় না। ছেলে-ছোকরার দল ভাবে যে হাসলেই বুঝি সব যুক্তি উড়ে চলে গেল।
কিন্তু পুরানো রীতি-নীতি এত হাল্কা জিনিস নয়। শত শত বৎসর ধরে শত শত বৃদ্ধের বিচার-বুদ্ধির ফলে, অভিজ্ঞতার ফলে এই সব আচার-নীতি গড়ে উঠেছে। সমস্ত জাতের অভিজ্ঞতা এই সব পুরানো রীতি-নীতির মধ্যে তিল তিল করে জড়ো হয়েছে। হেসে উড়িয়ে দিলেই হলো?
এই যে আটদিন ধরে মৃতদেহকে গাছের সঙ্গে প্রকাশ্যে সকলের দেখবার জন্যে রাখা হয়, শাদা লোকগুলো এই রীতির ওপর ভারী চটা। তারা জানে না, কেন মৃতদেহকে এইভাবে এতদিন রাখা হয়। দূর দূরান্ত বনের ভেতর, দূর গাঁয়ের যে-সব লোক আছে, তাদের আসতে তো সময় লাগে! তাদের সকলের তো আসা চাই! টম্-টম্ বাজিয়ে তাদের সকলকে খবর দিতেও তো সময় লাগে!
তা ছাড়া, সেকালের জ্ঞানী লোকেরা দেখেছে, অনেক সময় যাকে মনে হয়েছে মৃত বলে, আসলে সে কিন্তু তখনও মরেনি। হয়ত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল মাত্র। তারা দেখেছে, এমনি বহু লোককে ঘুম থেকে আবার জেগে উঠতে। তাই তারা নিয়ম করে গেল, মরলেই যাতে মানুষকে মাটির ভেতর পুঁতে না ফেলা হয়। একটা সময় পর্যন্ত দেখতে হবে, সেটা ঘুম, না মৃত্যু! শাদা লোকেরা এ সব কথা বুঝবে কি করে?
বাতোয়ালা মনে মনে এইসব কথাই ভাবছিল আর মাঝে মাঝে চাপা গলায় বিসিবিংগুইকে জানাচ্ছিলো।
সামনে বৃদ্ধ পিতার অন্তিম সৎকার হচ্ছে। বিসিবিংগুই তার পাশেই বসে আছে। উৎসবের পরের দিনই তাদের দুজনার ঝগড়া বাইরে থেকে মিটমাট হয়ে যায়। দুজনেই স্বীকার করে নেয় অতিরিক্ত মদ্যপানের দরুণ তারা সাময়িকভাবে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলো। তাই তাদের পুরানো অন্তরঙ্গতা মনে হয় অব্যাহতই রয়েছে।
কিন্তু বিসিবিংগুই মনে মনে জানে, সেদিনকার ব্যাপারের দরুণ বাতোয়ালা প্রকৃতপক্ষে তাকে মন থেকে ক্ষমা করতে পারে নি। সুযোগ পেলেই সে তার উপযুক্ত প্রতিশোধ নেবে। নীরবে সেই সুযোগের অপেক্ষায় আছে বাতোয়ালা।