ঐতিহাসিক চিত্র/১৩১৪/বৈশাখ/বাঙ্গালীর ইতিহাস


বাঙ্গালীর ইতিহাস।

 বাঙ্গালা ভাষা যাহাদের মাতৃভাষা, তাহারা সকলেই বাঙ্গালী। কেহ হিন্দু, কেহ মুসলমান,—কেহ বৌদ্ধ, কেহ খৃষ্টীয়ান,—কিন্তু সকলেই বাঙ্গালী। তাহাদের কথাই বাঙ্গালার ইতিহাসের প্রধান কথা। প্রচলিত ইতিহাসে সে কথা অধিক নাই। তাহাতে যুদ্ধবিগ্রহের কথা, জযুপরাজয়ের কথা, রাজা এবং রাজপুরুষদিগের কথা। তাহাকে বাঙ্গালীর ইতিহাস বলিয়া গ্রহণ করা যায় না।

 বাঙ্গালীর ইতিহাস লিখিত হয় নাই। বাঙ্গালী নিজে চেষ্টা না করিলে সে ইতিহাস লিখিত হইতে পারে না। চেষ্টার অভাবে অনেক কথা লুপ্ত হইয়া গিয়াছে,—এখনও দিন দিন কত কথা লুপ্ত হইয়া যাইতেছে।

 বিজেতা বিজয়-কাহিনী লিপিবদ্ধ করিবার জন্যই ব্যস্ত হইয়া থাকে। যাহারা যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয় না, তাহাদের কথা বিজেতার নিকট নিতান্ত ছোট কথা। সেই জন্য বিজেতা ইতিহাস লিখিলে, তাহাতে সকল কথা স্থান প্রাপ্ত হয় না। বাঙ্গালা দেশের যে সকল ইতিহাস প্রচলিত, তাহার সকল গুলিই এই শ্রেণীর ইতিহাস,—বিজেতার লেখনীপ্রসূত, অথবা তাহা হইতে অংশতঃ অথবা সম্পূর্ণরূপে ভাষান্তরিত। যথারীতি অনুসন্ধান করিয়া, সত্যাসত্যের সমুচিত সমালোচনা করিয়া, বাঙ্গালী এখনও বাঙ্গালীর ইতিহাস লিখিবার জন্য যথাযোগ্য আগ্রহ প্রকাশ করে নাই। ইহার জন্য কাহাকেও ভর্ৎসনা করা যায় না। স্বদেশকে জানিবার জন্য আগ্রহ উপস্থিত না হইলে, সে চেষ্টা প্রবর্ত্তিত হইতে পারে না। কিছুদিন হইতে আগ্রহের আভাস এবং কিছু কিছু চেষ্টার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যাইতেছে। কিন্তু এখনও সমুচিত চেষ্টা প্রবর্ত্তিত হয় নাই।

 বাঙ্গালীর ইতিহাস-সঙ্কলনে প্রবৃত্ত হইলে, চারিদিকে যেন অকূল সমুদ্র দর্শন করিতে হয়। কোথায় তাহার আরম্ভকাল, তাহা স্মৃতিপথ হইতে সম্পূর্ণরূপে অপসৃত হইয়া গিয়াছে। বহু পুরাতন কাহিনী বলিয়াই এরূপ ঘটিয়া থাকিবে। সেই জন্য অনেকে ভারতবর্ষের পুরাতন ইতিহাসকেই বাঙ্গালীর পুরাতন ইতিহাস বলিয়া ধরিয়া লইতে পরামর্শ দান করেন। কিন্তু তাহাতে সংশয়ের অভাব নাই।

 ভারতবর্ষ বহু প্রদেশে বিভক্ত মহাদেশ। এক প্রদেশ হইতে অন্য প্রদেশ অনেক বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বাঙ্গালা দেশ সেইরূপ। সমগ্র ভারতবর্ষের সহিত বাঙ্গালাদেশের সংস্রব থাকিলেও, বাঙ্গালাদেশের বিশেষত্বের অভাব নাই; সমগ্র ভারতবাসীর সহিত বাঙ্গালীর সংস্রব থাকিলেও, বাঙ্গালীর বিশেষত্ব দেখিতে পাওয়া যায়। সুতরাং বাঙ্গালীর একটি স্বতন্ত্র ইতিহাস। ছিল। সে ইতিহাস বিলুপ্ত না হইলে, বাঙ্গালীর সর্ব্বপ্রকার বিশেষত্বের কার্য কারণশৃঙ্খলা বুঝিতে পারা যাইত।

 বাঙ্গালা দেশের সহিত আর্য্যাবর্ত্তের সংস্রব ছিল; দাক্ষিণাত্যেরও সংস্রবের অভাব ছিল না। কেবল তাহাই নহে,—সমগ্র প্রাচারাজ্যের সহিত বাঙ্গালা দেশের একটি সাক্ষাৎ সংস্রব বর্ত্তমান ছিল। তাহা ছাড়া, পারস্য, আরব এবং মীশর দেশের সঙ্গে ও বাঙ্গালা দেশের কিছু কিছু সাক্ষাৎ সংস্রব বর্ত্তমান থাকারও প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায়। বাঙ্গালাদেশের সমুদ্রোপকূলে তাহার যে সকল প্রমাণ প্রাপ্ত হইবার সম্ভাবনা ছিল, তাহা কালক্রমে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। সে সংস্রব কতদিনের সংস্রব, কত দূরদেশের সহিত সংস্রব, কোন্ শ্রেণীর কিরূপ সংস্রব, কিরূপে তাহার আরম্ভ, কিরপেই বা তাহার শেষ,—ইহার সকল কথাই বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে।

 ললিতবিস্তরে দেখিতে পাওয়া যায়, উক্ত গ্রন্থ রচিত হইবার সময়ে “বঙ্গলিপি” নামক পৃথক লিপি প্রচলিত ছিল। তাহা দ্বিসহস্র বৎসরের কথা। তখন “বঙ্গলিপি” স্বতন্ত্র লিপি বলিয়া পরিচিত ছিল; তাহাকে চেষ্টা করিয়া শিক্ষা করিতে হইত। বিশেষ পার্থক্য না থাকিলে, এরূপ হইত না।

 যুগে সেরূপ পার্থক্য সংস্থাপিত হইয়াছিল,—কিরূপ কারণে সেরূপ পার্থক্য সংস্থাপিত হইয়াছিল—এ সকল কথা কতকাল বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। সে “বঙ্গলিপি” কিরূপ ছিল? তাহাই বা কে বলিতে পারে? কেবল লিপি কেন,—বঙ্গভাষাও স্বতন্ত্র ভাষা। তাহার গঠনপ্রণালীতে স্বাতন্ত্র্যের অভাব নাই। বাঙ্গালীর আচারব্যবহারেও এইরূপ কত স্বাতন্ত্র্য লক্ষিত হয়। তাহার শিল্পের স্বাতন্ত্র্য সর্ব্বত্র সুপরিচিত। এই সকল কারণে বাঙ্গালীর পুরাতন ইতিহাস পৃথক্‌ ভাবে আলোচিত না হইলে, অনেক কথাই বুঝিতে পারা যায় না।

 বাঙ্গালীর আধুনিক ইতিহাসেও স্বাতন্ত্র্যের অভাব নাই। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশ যে পথে গিয়াছে, বাঙ্গালী সকল বিষয়ে, সকল সময়ে সে পথ অবলম্বন করিতে সম্মত হয় নাই। আধুনিক ইতিহাসে বাঙ্গালী ভীরু এবং কাপুরুষ বলিয়া তিরস্কৃত হইলেও, বাঙ্গালী স্বাতন্ত্র্যাপ্রিয়-স্বাধীনতার উপাসক, —অপরাজিত পৃথক জাতি। বাঙ্গালী কখন বৌদ্ধ হইয়াছে, কখন হিন্দু হইয়াছে, কখন হিন্দুমুসলমান্‌ বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছে; কিন্তু কদাচ দীর্ঘকাল পরাধীন থাকিতে সম্মত হয় নাই। পাঠান, মোগল কেহই বাঙ্গালীকে সম্পূর্ণ রূপে জয় করিতে পারেন নাই; ইংরেজেরাও বাঙ্গালীকে রণক্ষেত্রে পরাভূত করিয়া, শাসনভার গ্রহণ করেন নাই। ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থান অস্ত্রবলে পরাভূত,—বাঙ্গালা দেশ অস্ত্রবলে পরাভূত হয় নাই।

 বাঙ্গালীর ইতিহাস লিখিতে হইলে, বিবরণসংকলনে ব্যাপৃত হইতে হইবে। তাহার জন্যই “ঐতিহাসিক চিত্র” জন্ম গ্রহণ করিয়াছিল। তাহা যে মরিয়াও মারিতেছে না, ইহাতেই আশা হয়,—বাঙ্গালী তাহার ইতিহাস-সংকলনের জন্য কিছু কিছু আগ্রহ প্রকাশ করিতে শিখিতেছে। এই আগ্রহ প্রবল হইলে, প্রকৃত অধ্যবসায় আসিয়া বিবরণসংকলনের সহায়তাসাধন করিবে। এই ব্রত একের নহে, অনেকের।;—অনেকের নহে, সকলের। বাঙ্গালীমাত্রে ইহার সহায়তাসাধন না করিলে, এই কঠিন ব্রত প্রতিপালিত হইতে পারে না। “ঐতিহাসিক চিত্রের” তৃতীয় পর্য্যায় আরম্ভ হইতেছে। আবার সকলকে সবিনয়ে ইহার সহায়তাসাধনের জন্য অনুরোধ করি।

শ্রীঅক্ষয়কুমার মৈত্রেয়।

এই লেখাটি ১ জানুয়ারি ১৯২৯ সালের পূর্বে প্রকাশিত এবং বিশ্বব্যাপী পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্ভুক্ত, কারণ উক্ত লেখকের মৃত্যুর পর কমপক্ষে ১০০ বছর অতিবাহিত হয়েছে অথবা লেখাটি ১০০ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে ।