২৫৩


আহ্বান গীত।


পৃথিবী জুড়িয়া বেজেছে বিষাণ,
 শুনিতে পেয়েছি ওই—
সবাই এসেছে লইয়া নিশান,
 কইরে বাঙ্গালী কই!
সুগভীর স্বর কাঁদিয়া বেড়ায়
 বঙ্গসাগরের তীরে,
“বাঙ্গালীর ঘরে কে আছিস্‌ আয়”
 ডাকিতেছে ফিরে ফিরে!
ঘরে ঘরে কেন দুয়ার ভেজানাে,
 পথে কেন নাই লােক,
সারা দেশ ব্যাপি মরেছে কে যেন,
 বেঁচে আছে শুধু শােক।
গঙ্গা বহে শুধু আপনার মনে
 চেয়ে থাকে হিমগিরি,
রবিশশি উঠে অনন্ত গগণে
 আসে যায় ফিরি ফিরি।

কত না সংকট, কত না সন্তাপ
 মানব শিশুর তরে,
কত না বিবাদ কত না বিলাপ
 মানব শিশুর ঘরে!
কত ভায়ে ভায়ে নাহি যে বিশ্বাস,
 কেহ কারে নাহি মানে,
ঈর্ষা নিশাচরী ফেলিছে নিশ্বাস
 হৃদয়ের মাঝখানে।
হৃদয়ে লুকানাে হৃদয় বেদনা,
 সংশয় আঁধারে যুঝে,
কে কাহারে আজি দিবে গাে সান্তনা,
 কে দিবে আলয় খুঁজে!
মিটাতে হইবে শােক তাপ ত্রাস,
 করিতে হইবে রণ,
পৃথিবী হইতে উঠেছে উচ্ছ্বাস—
 শােন শােন সৈন্যগণ।

পৃথিবী ডাকিছে আপন সন্তানে,
বাতাস ছুটেছে তাই—
গৃহ তেয়াগিয়া ভায়ের সন্ধানে
চলিয়াছে কত ভাই!
বঙ্গের কুটীরে এসেছে বারতা,
শুনেছে কি তাহা সবে?
জেগেছে কি কবি শুনাতে সে কথা
জলদ-গম্ভীর রবে?
হৃদয় কি কারো উঠেছে উথলি?
আঁখি খুলেছে কি কেহ?
ভেঙ্গেছে কি কেহ সাধের পুতলি?
ছেড়েছে খেলার গেহ?
কেন কানাকানি, কেনরে সংশয়?
কেন মর’ ভয়ে লাজে?
খুলে ফেল দ্বার ভেঙ্গে ফেল ভয়,
চল পৃথিবীর মাঝে।

ধরা-প্রান্তভাগে ধূলিতে লুটায়ে,
জড়িমা-জড়িত তনু,
আপনার মাঝে আপনি গুটায়ে,
ঘুমায় কীটের অণু!
চারিদিকে তার আপন উল্লাসে
জগৎ ধাইছে কাজে,
চারিদিকে তার অনন্ত আকাশে
স্বরগ সঙ্গীত বাজে1
চারিদিকে তার মানব মহিমা
উঠিছে গগণ পানে,
খুঁজিছে মানব আপনার সীমা,
অসীমের মাঝ খানে।
সে কিছুই তার করে না বিশ্বাস,
আপনারে জানে বড়,
আপনি গণিছে আপন নিশ্বাস,
ধূলা করিতেছে জড়!

সুখ দুঃখ লয়ে অনন্ত সংগ্রাম,
জগতের রঙ্গভূমি—
হেথায় কে চায় ভীরুর বিশ্রাম,
কেনগাে ঘুমাও তুমি!
ডুবিছ ভাসিছ অশ্রুর হিল্লোলে,
শুনিতেছ হাহাকার—
তীর কোথা আছে দেখ মুখ তুলে,
এ সমুদ্র কর পার।
মহা কলরবে সেতু বাঁধে সবে,
তুমি এস, দাও যােগ—
বাধার মতন জড়াও চরণ—
একিরে করম ভােগ!
তা যদি না পার’ সর’ তবে সর,
ছেড়ে দেও তবে স্থান,
ধূলায় পড়িয়া মর’ তবে মর’—
কেন এ বিলাপ গান!

ওরে চেয়ে দেখ্‌ মুখ আপনার,
ভেবে দেখ্‌ তােরা কারা?
মানবের মত ধরিয়া আকার,
কেনরে কীটের পারা?
আছে ইতিহাস আছে কুলমান,
আছে মহত্বের খণি,
পিতৃপিতামহ গেয়েছে যে গান,
শােন্ তার প্রতিধ্বনি!
খুঁজেছেন তারা চাহিয়া আকাশে
গ্রহতারকার পথ—
জগৎ ছাড়ায়ে অসীমের আশে
উড়াতেন মনােরথ।
চাতকের মত সত্যের লাগিয়া
তৃষিত আকুল প্রাণে,
দিবস রজনী ছিলেন জাগিয়া
চাহিয়া বিশ্বের পানে।

তবে কেন সবে বধির হেথায়,
কেন অচেতন প্রাণ,
বিফল উচ্ছাসে কেন ফিরে যায়
বিশ্বের আহ্বান গান।
মহত্বের গাথা পশিতেছে কানে,
কেনরে বুঝিনে ভাষা?
তীর্থযাত্রী যত পথিকের গানে,
কেন রে জাগে না আশা?
উন্নতির ধ্বজা উড়িছে বাতাসে,
কেনরে নাচেনা প্রাণ,
নবীন কিরণ ফুটেছে আকাশে
কেনরে জাগেনা গান?
কেন আছি শুয়ে, কেন আছি চেয়ে,
পড়ে আছি মুখোমুখি,
মানবের হােত চলে গান গেয়ে,
জগতের সুখে সুখী!

চল দিবালােকে, চল লােকালয়ে,
চল জন কোলাহলে—
মিশাব হৃদয় মানব হৃদয়ে
অসীম আকাশ তলে!
তরঙ্গ তুলিব তরঙ্গের পরে,
নৃত্য গীত নব নব,
বিশ্বের কাহিনী কোটি কণ্ঠ স্বরে
এক-কণ্ঠ হ’য়ে কব!
মানবের সুখ মানবের আশা
বাজিবে আমার প্রাণে,
শত লক্ষকোটি মানবের ভাষা
ফুটিবে আমার গানে!
মানবের কাজে মানবের মাঝে
আমরা পাইব ঠাঁই—
বঙ্গের দুয়ারে তাই শৃঙ্গ বাজে—
শুনিতে পেয়েছি ভাই।

মুছে ফেল ধূলা, মুছ অশ্রুজল,
ফেল ভিখারীর চীর—
পর’ নব সাজ, ধর’ নব বল,
তোল’ তোল’ নত শির!
তোমাদের কাছে আজি আসিয়াছে
জগতের নিমন্ত্রণ—
দীনহীন বেশ ফেলে যেও পাছে—
দাসত্বের আভরণ।
সভার মাঝারে দাঁড়াবে যখন
হাসিয়া চাহিবে ধীরে—
পূরব রবির হিরণ কিরণ
পড়িবে তোমার শিরে!
বাঁধন টুটিয়া উঠিবে ফুটিয়া
হৃদয়ের শতদল,
জগত মাঝারে যাইবে লুটিয়া
প্রভাতের পরিমল।

!উঠ বঙ্গ কবি, মায়ের ভাষায়
মুমূর্ষুরে দাও প্রাণ—
জগতের লোক সুধার আশায়
সে ভাষা করিবে পান
চাহিবে মোদের মায়ের বদনে,
ভাসিবে নয়ন জলে,
বাঁধিবে জগৎ গানের বাঁধনে
মায়ের চরণ তলে।
বিশ্বের মাঝারে ঠাঁই নাই ব’লে,
কাঁদিতেছে বঙ্গভূমি,
গান গেয়ে কবি জগতের তলে
স্থান কিনে দাও তুমি।
একবার কবি মায়ের ভাষায়
গাও জগতের গান—
সকল জগৎ ভাই হয়ে যায়—
ঘুচে যায় অপমান।