কড়ি ও কোমল/চিরদিন
চিরদিন।
(১)
কোথা রাত্রি, কোথা দিন, কোথা ফুটে চন্দ্র সূর্য্য তারা,
কেবা আসে কেবা যায়, কোথা সে জীবনের মেলা,
কেবা হাসে কেবা গায়, কোথা খেলে হৃদয়ের খেলা,
কোথা পথ, কোথা গৃহ, কোথা পান্থ, কোথা পথহারা!
কোথা খসে পড়ে পত্র জগতের মহাবৃক্ষ হতে,
উড়ে উড়ে ঘুরে মরে, অসীমেতে না পায় কিনারা,
বহে যায় কাল বায়ু অবিশ্রাম আকাশের পথে,
ঝর ঝর মর মর শুষ্ক পত্র শ্যাম পত্রে মিলে!
এত ভাঙ্গা, এত গড়া, আনাগােনা জীবন্ত নিখিলে,
এত গান এত তান এত কান্না এত কলরব-
কোথা কে—কোথা সিন্ধু —কোথা উর্ম্মি— কোথা তার
ৰেলা;—
গভীর অসীম গর্তে নিৰ্বসিত নির্বাপিত সব!
জনপূর্ণ সুবিজনে, জ্যোতির্বিন্ধ আঁধারে বিলীন
আকাশ-গম্বুজে শুধু বসে আছে এক চিরদিন”।
(২)
কি লাগিয়া বসে আছ, চাহিয়া রয়েছ কার লাগি!
প্রলয়ের পর-পারে নেহারিছ কার আগমন!
কার দূর পদধ্বনি চিরদিন করিছ শ্রবণ!
চির-বিরহীর মত চির-রাত্রি রহিয়াছ জাগি।
অসীম অতৃপ্তি লয়ে মাঝে মাঝে ফেলিছ নিশ্বাস,
আকাশ-প্রান্তরে তাই কেঁদে উঠে প্রলয়-বাতাস,
জগতের উর্পাজাল ছিঁড়ে টুটে কোথা যায় ভাগি!
অনন্ত আঁধার মাঝে কেহ তব নাহিক দোসর,
পশে না তােমার প্রাণে আমাদের হৃদয়ের আশ,
পশে না তােমার কানে আমাদের পাখীদের স্বর—
সহস্র জগতে মিলি রচে তব বিজন প্রবাস,
সহস্র শবদে মিলি বাঁধে তব নিঃশকের ঘর,
হাসি, কাদি, ভালবাসি, নাই তব, হাসি, কান্না, মায়া,
আসি থাকি চলে যাই কত ছায়া কত উপছায়া!
(৩)
তাই কি? সকলি ছায়া? আসে, থাকে, আর মিলে যায়?
তুমি শুধু একা আছ, আর সব আছে আর নাই?
যুগ যুগান্তর ধ’রে ফুল ফুটে, ফুল ঝরে তাই?
প্রাণ পেয়ে প্রাণ দিই সে কি শুধু মরণের পায়?
এ ফুল চাহে না কেহ? লহে না এ পুজা-উপহার?
এ প্রাণ, প্রাণের আশা, টুটে কি অসীম শুন্যতায়।
বিশ্বের উঠিছে গান, বধিরতা বসি সিংহাসনে?
বিশ্বের কাঁদিছে প্রাণ, শূন্যে ঝরে অশ্রুবারি ধার?
যুগ যুগান্তের প্রেম কে লইবে, নাই ত্রিভুবনে?
চরাচর মগ্ন আছে নিশিদিন আশার স্বপনে—
বাঁশী শুনে চলিয়াছে, সে কি হায় বৃথা অভিসার!
বােলাে না সকলি স্বপ্ন, সকলি এ মায়ার ছলন,
বিশ্ব যদি স্বপ্ন দেখে সে স্বপন কাহার স্বপন।
সে কি এই প্রাণহীন প্রেমহীন অন্ধ অন্ধকার?
(৪)
ধ্বনি খুজে প্রতিধ্বনি, প্রাণ খুঁজে মরে প্রতিপ্রাণ।
জগৎ আপনা দিয়ে খুজিছে তাহার প্রতিদান।
অসীমে উঠিছে প্রেম, শুধিবারে অসীমের ঋণ—
যত দেয় তত পায়, কিছুতে না হয় অবসান।
যত ফুল দেয় ধরা তত ফুল পায় প্রতি দিন—
যত প্রাণ ফুটাইছে ততই বাড়িয়া উঠে প্রাণ।
যাহা আছে তাই দিয়ে ধনী হয়ে উঠে দীন হীন,
অসীমে জগতে এ কি পিরীতির আদান প্রদান!
কাহারে পুজিছে ধরা শ্যামল যৌবন উপহারে,
নিমেষে নিমেষে তাই ফিরে পায় নবীন যৌবন।
প্রেমে টেনে আনে প্রেম, সে প্রেমর পাথার কোথারে।
প্রাণ দিলে প্রাণ আসে,—কোথা সেই অনন্ত জীবন!
কুদ্র আপনারে দিলে, কোথা পাই অসীম আপন,
সে কি ওই প্রাণহীন প্রেমহীন অন্ধ অন্ধকারে!