কথামালা (১৮৮৫)/কুঠার ও জলদেবতা
এক দুঃখী, নদীর তীরে, গাছ কাটিতেছিল। হঠাৎ, কুঠার খানি, তাহার হাত হইতে ফস্কিয়া গিয়া, নদীর জলে পড়িয়া গেল। কুঠার খানি জন্মের মত হারাইলাম, এই ভাবিয়া, সেই দুঃখী অতিশয় দুঃখিত হইল, এবং, হায় কি হইল বলিয়া, উচ্চৈঃ স্বরে, রোদন করিতে লাগিল। তাহার রোদন শুনিয়া, সেই নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবতার অতিশয় দয়া হইল। তিনি তাহার সম্মুখে উপস্থিত হইলেন, এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি, কি জন্যে, এত রোদন করিতেছ? সে সমুদয় নিবেদন করিলে, জলদেবতা তৎক্ষণাৎ নদীতে মগ্ন হইলেন, এবং, এক স্বর্ণময় কুঠার হস্তে করিয়া, তাহার নিকটে আসিয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, এই কি তোমার কুঠার? সে কহিল, না মহাশয়! এ আমার কুঠার নয়। তখন তিনি, পুনরায়, জলে মগ্ন হইলেন, এবং, এক রজতময় কুঠার হস্তে লইয়া, তাহার সম্মুখে আসিয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, এই কি তোমার কুঠার? সে কহিল, না মহাশয়! ইহাও আমার কুঠার নয়। তিনি, পুনরায়, জলে মগ্ন হইলেন, এবং, তাহার লৌহময় কুঠারখানি হস্তে লইয়া, তাহাকে জিজ্ঞাসিলেন, এই কি তোমার কুঠার? সে, আপন কুঠার দেখিয়া, যার পর নাই আহ্লাদিত হইয়া কহিল, হাঁ মহাশয়! এই আমার কুঠার। আমি অতি দুঃখী; আর আমি কুঠার পাইব, আমার সে আশা ছিল না; কেবল আপনকার অনুগ্রহে পাইলাম; আপনি আমায়, জন্মের মত, কিনিয়া রাখিলেন।
জলদেবতা, প্রথমতঃ, তাহার নিজের কুঠার খানি তাহার হস্তে দিলেন; পরে, তুমি নির্লোভ, সত্যনিষ্ঠ, ও ধর্ম্মপরায়ণ; এজন্য, তোমার উপর অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছি; এই বলিয়া, তাহার গুণের পুরস্কার স্বরূপ, সেই স্বর্ণময় ও রজতময় কুঠার দুই খানি তাহাকে দিয়া, অন্তর্হিত হইলেন। সেই দুঃখী ব্যক্তি, অবাক হইয়া, কিয়ৎ ক্ষণ, সেই স্থানে দাঁড়াইয়া রহিল; অনন্তর, গৃহে গিয়া, প্রতিবেশীদের নিকট, এই বৃত্তান্তের সবিশেষ বর্ণন করিল। সকলে বিস্ময়াপন্ন হইলেন।
এই অদ্ভুত বৃত্তান্ত শুনিয়া, এক ব্যক্তির অতিশয় লোভ জন্মিল। সে পর দিন, প্রাতঃকালে, কুঠার হস্তে লইয়া, নদীর তীরে উপস্থিত হইল, এবং, গাছের গোড়ায় দুই তিন কোপ মারিয়া, যেন হঠাৎ হাত হইতে ফস্কিয়া গেল, এইরূপ ভান করিয়া, কুঠার খানি জলে ফেলিয়া দিল, এবং, হায় কি হইল বলিয়া, উচ্চৈঃ স্বরে রোদন করিতে লাগিল। জলদেবতা, তাহার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া, রোদনের কারণ জিজ্ঞাসিলেন। সে, সমস্ত কহিয়া, অতিশয় শোক ও দুঃখপ্রকাশ করিতে লাগিল।
জলদেবতা, পূর্ব্ববৎ, জলে মগ্ন হইয়া, এক স্বর্ণময় কুঠার হস্তে লইয়া, তাহার সম্মুখে উপস্থিত হইলেন, এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন, এই কি তোমার কুঠার? স্বর্ণময় কুঠার দেখিয়া, সেই লোভী, এই আমার কুঠার বলিয়া, ব্যগ্র হইয়া, কুঠার ধরিতে গেল। তাহাকে, এইরূপ লোভী ও মিথ্যাবাদী দেখিয়া, জলদেবতা অতিশয় অসন্তুষ্ট হইলেন, এবং কহিলেন, তুই অতি লোভী, অতি অভদ্র, ও মিথ্যাবাদী; তুই এ কুঠার পাইবার যোগ্য পাত্র নহিস। এই ভর্ৎসনা করিয়া, সেই স্বর্ণময় কুঠার খানি জলে ফেলিয়া দিয়া, জলদেবতা অন্তর্হিত হইলেন। সে, হতবুদ্ধি হইয়া, নদীর তীরে বসিয়া, গালে হাত দিয়া, ভাবিতে লাগিল; অনন্তর, আমার যেমন কর্ম্ম, তাহার উপযুক্ত ফল পাইলাম, এই বলিয়া, বিষণ্ণ মনে চলিয়া গেল।