কথামালা (১৯৪৪)/সারসী ও তাহার শিশু সন্তান



সারসী ও তাহার শিশু সন্তান।

এক সারসী, শিশু সন্তানগুলি লইয়া কোনও ক্ষেত্রে বাস করিত। ঐ ক্ষেত্রের শস্য সকল পাকিয়া উঠিলে, সারসী বুঝিতে পারিল, অতঃপর কৃষকেরা শস্য কাটিতে আরম্ভ করিবে। এই নিমিত্ত প্রতিদিন আহারের অন্বেষণে বাহিরে যাইবার সময়, সে শিশু সন্তানদিগকে বলিয়া যাইত, তোমরা আমার আসিবার পূর্ব্বে, যাহা কিছু শুনিবে, আসিবামাত্র সে সমুদয় অবিকল আমায় বলিবে।

 একদিন সারসী বাসা হইতে বহির্গত হইয়াছে, এমন সময়ে ক্ষেত্রস্বামী, শস্য কাটিবার সময় হইয়াছে কি না, বিবেচনা করিয়া দেখিবার নিমিত্ত তথায় উপস্থিত হইল, এবং চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, শস্য সকল পাকিয়া উঠিয়াছে, আর কাটিতে বিলম্ব করা উচিত নয়। অমুক অমুক প্রতিবেশীর উপর ভার দি, তাহারা কাটিয়া দিবে। এই বলিয়া, সে চলিয়া গেল।

 সারসী বাসায় আসিলে, তাহার সন্তানেরা ঐ সকল কথা জানাইল, এবং বলিল, মা, তুমি আমাদিগকে শীঘ্র স্থানান্তরে লইয়া যাও। আর তুমি আমাদিগকে এখানে রাখিয়া বাহিরে যাইও না। যাহারা শস্য কাটিতে আসিবে, তাহারা দেখিলেই আমাদের প্রাণবধ করিবে। সারসী বলিল, বাছা সকল, তোমরা এখনই ভয় পাইতেছ কেন? ক্ষেত্রস্বামী যদি প্রতিবেশীদিগের উপর ভার দিয়া নিশ্চিন্ত থাকে, তাহা হইলে শস্য কাটিতে আসিবার অনেক বিলম্ব আছে।

 পরদিন ক্ষেত্রস্বামী পুনরায় উপস্থিত হইল; দেখিল, যাহাদের উপর ভার দিয়াছিল, তাহারা শস্য কাটিতে আইসে নাই। কিন্তু শস্য সকল সম্পূর্ণ পাকিয়া উঠিয়াছিল; অতঃপর না কাটিলে ক্ষতি হইতে পারে, এই নিমিত্ত সে বলিল, আর সময় নষ্ট করা যায় না; প্রতিবেশীদিগের উপর ভার দিয়া নিশ্চিন্ত থাকিলে, বিস্তর ক্ষতি হইবে। আর তাহাদের ভরসায় না থাকিয়া, আপন ভাইবন্ধুদিগকে বলি, তাহারা সত্বর কাটিয়া দিবে। এই বলিয়া, সে আপন পুত্ত্রের দিকে মুখ ফিরাইয়া বলিল, তুমি তোমার খুড়াদিগকে আমার নাম করিয়া বলিবে, যেন তাহারা সকল কর্ম্ম রাখিয়া, কাল সকালে আসিয়া, শস্য কাটিতে আরম্ভ করে। এই বলিয়া ক্ষেত্রস্বামী চলিয়া গেল।

 সারস-শিশুগণ শুনিয়া অতিশয় ভীত হইল, এবং সারসী আসিবামাত্র কাতরবাক্যে বলিতে লাগিল, মা, আজ ক্ষেত্রস্বামী আসিয়া এই কথা বলিয়া গিয়াছে। তুমি আমাদের একটা উপায় কর। কাল তুমি আমাদিগকে এখানে ফেলিয়া যাইতে পারিবে না; যদি যাও, আসিয়া আর আমাদিগকে দেখিতে পাইবে না। সারসী শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিল, যদি কেবল এই কথা শুনিয়া থাক, তাহা হইলে ভয়ের বিষয় নাই। যদি ক্ষেত্রস্বামী ভাই বন্ধুদিগের উপর ভর দিয়া নিশ্চিন্ত থাকে, তাহা হইলে শস্য কাটিতে আসিবার এখনও অনেক বিলম্ব আছে। তাহাদেরও শস্য পাকিয়া উঠিয়াছে। তাহারা আগে আপনাদের শস্য না কাটিয়া, কখনও ইহার শস্য কাটিতে আসিবে না। কিন্তু ক্ষেত্রস্বামী, কাল সকালে আসিয়া যাহা বলিবে, তাহা মন দিয়া শুনিও, এবং আমি আসিলে, বলিতে ভুলিও না।

 পরদিন প্রত্যুষে সারসী আহারের অন্বেষণে বহির্গত হইলে, ক্ষেত্রস্বামী তথায় উপস্থিত হইল; দেখিল, কেহই শস্য কাটিতে আসে নাই; আর শস্য সকল অধিক পাকিয়াছিল, এজন্য ঝরিয়া ভূমিতে পড়িতেছে। তখন সে বিরক্ত হইয়া, আপন পুত্ত্রকে বলিল, দেখ, প্রতিবেশীর অথবা ভাই বন্ধুর মুখ চাহিয়া থাকা আর উচিত নহে। আজ রাত্রিতে তুমি যত জন পাও, ঠিকা লোক স্থির করিয়া রাখিবে। কাল সকালে তাহাদিগকে লইয়া, আপনারাই কাটিতে আরম্ভ করিব; নতুব বিস্তর ক্ষতি হইবে।

 সারসী, বাসায় আসিয়া এই সমস্ত কথা শুনিয়া বলিল, অতঃপর আর এখানে থাকা ভাল নয়; এখন অন্যত্র যাওয়া নিতান্ত আবশ্যক। যখন কেহ অন্যের উপর ভার দিয়া নিশ্চিন্ত না থাকিয়া, স্বয়ং আপন কর্ম্মে মন দেয়, তখন ইহা স্থির জানা উচিত যে, সে যথার্থই ঐ কর্ম্ম সম্পন্ন করা মনস্থ করিয়াছে।

অতঃপর—ইহার পর।
ক্ষেত্রস্বামী—ক্ষেতের অধিকারী।
ভরসায়—আশায়।

অবিকল—ঠিক সেইরূপ।
স্থানান্তরে-অন্যস্থানে।
প্রত্যুষে—প্রাতঃকালে।