কথা-চতুষ্টয়/মেঘ ও রৌদ্র
মেঘ ও রৌদ্র।
প্রথম পরিচ্ছেদ।
পূর্ব্বদিনে বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। আজ ক্ষান্তবর্ষণ প্রাতঃকালে ম্লান রৌদ্র এবং খণ্ড মেঘে মিলিয়া পরিপক্কপ্রায় আউষ ধানের ক্ষেত্রের উপর পর্য্যায়ক্রমে আপন আপন সুদীর্ঘ তুলি বুলাইয়া যাইতেছিল; সুবিস্তীর্ণ শ্যাম চিত্রপট একবার আলোকের স্পর্শে উজ্জ্বল পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করিতেছিল আবার পরক্ষণেই ছায়া-প্রলেপে গাঢ় স্নিগ্ধতায় অঙ্কিত হইতেছিল।
যখন সমস্ত আকাশ-রঙ্গভূমিতে মেঘ এবং রৌদ্র, দুইটি মাত্র অভিনেতা, আপন আপন অংশ অভিনয় করিতেছিল, তখন নিম্নে সংসার রঙ্গভূমিতে কত স্থানে কত অভিনয় চলিতেছিল তাহার আর সংখ্যা নাই।
আমরা যেখানে একটি ক্ষুদ্র জীবননাট্যের পট উত্তোলন করিলাম সেখানে গ্রামে পথের ধারে একটি বাড়ি দেখা যাইতেছে। বাহিরের একটিমাত্র ঘর পাকা, এবং সেই ঘরের দুই পার্শ্ব দিয়া জীর্ণপ্রায় ইষ্টকের প্রাচীর গুটিকতক মাটির ঘর বেষ্টন করিয়া আছে। পথ হইতে গরাদের জান্লা দিয়া দেখা যাইতেছে একটি যুবা পুরুষ খালি গায়ে তক্তপোষে বসিয়া বামহস্তে ক্ষণেক্ষণে তালপাতার পাখা লইয়া গ্রীষ্ম এবং মশক দূর করিবার চেষ্টা করিতেছেন এবং দক্ষিণ হস্তে বই লইয়া পাঠে নিবিষ্ট আছেন।
বাহিরে গ্রামের পথে একটি ডুরে কাপড়-পরা বালিকা আঁচলে গুটিকতক কালো জাম লইয়া একে একে নিঃশেষ করিতে করিতে উক্ত গরাদে-দেওয়া জানলার সম্মুখ দিয়া বারম্বার যাতায়াত করিতেছিল। মুখের ভাবে স্পষ্টই বোঝা যাইতেছিল ভিতরে যে মানুষটি তক্তপোষে বসিয়া বই পড়িতেছে তাহার সহিত বালিকার ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে—এবং কোন মতে সে তাহার মনোযোগ আকর্ষণ পূর্ব্বক তাহাকে নীরবে অবজ্ঞাভরে জানাইয়া যাইতে চাহে যে, সম্প্রতি কালোজাম খাইতে আমি অত্যন্ত ব্যস্ত আছি, তোমাকে আমি গ্রাহ্যমাত্র করি না।
দুর্ভাগ্যক্রমে, ঘরের ভিতরকার অধ্যয়নশীল পুরুষটি চক্ষে কম দেখেন, দূর হইতে বালিকার নীরব উপেক্ষা তাহাকে স্পর্শ করিতে পারে না। বালিকাও তাহা জানিত, সুতরাং অনেক ক্ষণ নিষ্ফল আনাগোনার পর নীরব উপেক্ষার পরিবর্ত্তে কালোজামের আঁটি ব্যবহার করিতে হইল। অন্ধের নিকটে অভিমানের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা এতই দুরূহ।
যখন ক্ষণে ক্ষণে দুই চারিটা কঠিন আঁটি যেন দৈবক্রমে বিক্ষিপ্ত হইয়া কাঠের দরজার উপর ঠক্ করিয়া শব্দ করিয়া উঠিল তখন পাঠরত পুরুষটি মাথা তুলিয়া চাহিয়া দেখিল। মায়াবিনী বালিকা তাহা জানিতে পারিয়া দ্বিগুণ নিবিষ্ট ভাবে অঞ্চল হইতে দংশনযোগ্য সুপক্ক কালোজাম নির্ব্বাচন করিতে প্রবৃত্ত হইল। পুরুষটি ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া বিশেষ চেষ্টাসহকারে নিরীক্ষণপূর্ব্বক বালিকাকে চিনিতে পারিল এবং বই রাখিয়া জানলার কাছে উঠিয়া দাঁড়াইয়া হাস্যমুখে ডাকিল—গিরিবালা!
গিরিবালা অবিচলিতভাবে নিজের অঞ্চলের মধ্যে জাম পরীক্ষাকার্য্যে সম্পূর্ণ অভিনিবিষ্ট থাকিয়া মৃদুগমনে আপনমনে এক এক পা করিয়া চলিতে লাগিল।
তখন ক্ষীণদৃষ্টি যুবা পুরুষের বুঝিতে বাকি রহিল না, যে, কোন একটি অজ্ঞানকৃত অপরাধের দণ্ডবিধান হইতেছে। তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিয়া কহিলেন—“কই, আজ আমাকে জাম দিলে না?” গিরিবালা সে কথা কানে না আনিয়া বহু অন্বেষণ ও পরীক্ষায় একটি জাম মনোনীত করিয়া অত্যন্ত নিশ্চিন্ত মনে খাইতে আরম্ভ করিল।
এই জামগুলি গিরিবালাদের বাগানের জাম এবং যুবা পুরুষের দৈনিক বরাদ্দ। কি জানি, সে কথা কিছুতেই আজ গিরিবালার স্মরণ হইল না। তাহার ব্যবহারে প্রকাশ পাইল যে এগুলি সে একমাত্র নিজের জন্যই আহরণ করিয়াছে। কিন্তু নিজের বাগান হইতে ফল পাড়িয়া পরের দরজার সম্মুখে আসিয়া ঘটা করিয়া খাইবার কি অর্থ পরিষ্কার বুঝা গেল না। তখন পুরুষটি কাছে আসিয়া তাহার হাত ধরিল। গিরিবালা প্রথমটা আঁকিয়া বাঁকিয়া হাত ছাড়াইয়া চলিয়া যাইবার চেষ্টা করিল, তাহার পরে সহসা অশ্রুজলে ভাসিয়া কাঁদিয়া উঠিল, এবং আঁচলের জাম ভূতলে ছড়াইয়া ফেলিয়া দিয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল।
সকালবেলাকার চঞ্চল রৌদ্র এবং চঞ্চল মেঘ বৈকালে শান্ত ও শ্রান্ত ভাব ধারণ করিয়াছে;—শুভ্র স্ফীত মেঘ আকাশের প্রান্তভাগে স্তূপাকার হইয়া পড়িয়া আছে এবং অপরাহ্নের অবসন্নপ্রায় আলোক গাছের পাতায় পুষ্করিণীর জলে এবং বর্ষাস্নাত প্রকৃতির প্রত্যেক অঙ্গে প্রত্যঙ্গে ঝিক্ঝিক্ করিতেছে। আবার সেই বালিকাটিকে সেই গরাদের জানলার সম্মুখে দেখা যাইতেছে এবং ঘরের মধ্যে সেই যুবা পুরুষটি বসিয়া আছে। প্রভেদের মধ্যে, এ বেলা বালিকার অঞ্চলে জাম নাই এবং যুবকের হস্তেও বই নাই। তদপেক্ষা গুরুতর এবং নিগূঢ় প্রভেদও কিছু কিছু ছিল।
এবেলাও বালিকা কি বিশেষ আবশ্যকে সেই বিশেষ স্থানে আসিয়া ইতস্ততঃ করিতেছে বলা কঠিন। আর যাহাই আবশ্যক থাক্ ঘরের ভিতরকার মানুষটির সহিত আলাপ করিবার যে আবশ্যক আছে ইহা কোন মতেই বালিকার ব্যবহারে প্রকাশ পায় না। বরঞ্চ বোধ হইল সে দেখিতে আসিয়াছে সকাল বেলায় যে জামগুলা ফেলিয়া গেছে বিকাল বেলায় তাহার কোনটার অঙ্কুর বাহির হইয়াছে কি না।
কিন্তু অঙ্কুর না বাহির হইবার অন্যান্য কারণের মধ্যে একটি গুরুতর কারণ এই ছিল যে, ফলগুলি সম্প্রতি যুবকের সম্মুখে তক্তপোষের উপরে রাশীকৃত ছিল; এবং বালিকা যখন ক্ষণে ক্ষণে অবনত হইয়া কোন একটা অনির্দ্দেশ্য কাল্পনিক পদার্থের অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিল তখন যুবক মনের হাস্য গোপন করিয়া অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে একটি একটি জাম নির্ব্বাচন করিয়া সযত্নে আহার করিতে ছিল। অবশেষে যখন দুটো একটা আঁটি দৈবক্রমে বালিকার পায়ের কাছে, এমন কি, গায়ের উপরে আসিয়া পড়িল তখন গিরিবাল বুঝিতে পারিল যুবক বালিকার অভিমানের প্রতিশোধ লইতেছে। কিন্তু এই কি উচিত! যখন সে আপনার ক্ষুদ্র হৃদয়টুকুর সমস্ত গর্ব্ব বিসর্জ্জন দিয়া আত্মসমর্পণ করিবার অবসর খুঁঁজিতেছে তখন কি তাহার সেই অত্যন্ত দুরূহ পথে বাধা দেওয়া নিষ্ঠুরতা নহে? ধরা দিতে আসিয়াছে এই কথাটা ধরা পড়িয়া বালিকা যখন ক্রমশঃ আরক্তিম হইয়া পলায়নের পথ অনুসন্ধান করিতে লাগিল তখন যুবক বাহিরে আসিয়া তাহার হাত ধরিল।
সকালবেলাকার মত এবেলাও বালিকা আঁকিয়া বাঁকিয়া হাত ছাড়াইয়া পালাইবার বহু চেষ্টা করিল—কিন্তু কাঁদিল না। বরঞ্চ রক্তবর্ণ হইয়া ঘাড় বাঁকাইয়া উৎপীড়নকারীর পৃষ্ঠদেশে মুখ লুকাইয়া প্রচুর পরিমাণে হাসিতে লাগিল এবং যেন কেবলমাত্র বাহ্য আকর্ষণে নীত হইয়া পরাভূত বন্দীভাবে লৌহগরাদে বেষ্টিত কারাগারের মধ্যে প্রবেশ করিল।
আকাশে মেঘ রৌদ্রের খেলা যেমন সামান্য, ধরাপ্রান্তে এই দুটি প্রাণীর খেলাও তেম্নি সামান্য তেম্নি ক্ষণস্থায়ী। আবার, আকাশে মেঘ রৌদ্রের খেলা যেমন সামান্য নহে এবং খেলা নহে কিন্তু খেলার মত দেখিতে মাত্র, তেম্নি এই দুটি অখ্যাতনামা মনুষ্যের একটি কর্ম্মহীন বর্ষাদিনের ক্ষুদ্র ইতিহাস সংসারের শত শত ঘটনার মধ্যে তুচ্ছ বলিয়া প্রতীয়মান হইতে পারে কিন্তু ইহা তুচ্ছ নহে। যে বৃদ্ধ বিরাট অদৃষ্ট অবিচলিত গম্ভীর মুখে অনন্তকাল ধরিয়া যুগের সহিত যুগান্তর গাঁথিয়া তুলিতেছে, সেই বৃদ্ধই বালিকার এই সকাল বিকালের তুচ্ছ হাসিকান্নার মধ্যে জীবনব্যাপী সুখ দুঃখের বীজ অঙ্কুরিত করিয়া তুলিতেছিল। তথাপি বালিকার এই অকারণ অভিমান বড়ই অর্থহীন বলিয়া বোধ হইল। কেবল দর্শকের কাছে নহে, এই ক্ষুদ্র নাট্যের প্রধান পাত্র উক্ত যুবকের নিকটেও। এ বালিকা কেন যে এক দিন বা রাগ করে, একদিন বা অপরিমিত স্নেহ প্রকাশ করিতে থাকে—কোন দিন বা দৈনিক বরাদ্দ বাড়াইয়া দেয়, কোন দিন বা দৈনিক বরাদ্দ একেবারেই বন্ধ করে, তাহার কারণ খুঁজিয়া পাওয়া সহজ নহে। এক এক দিন সে যেন তাহার সমস্ত কল্পনা ভাবনা এবং নৈপুণ্য একত্র করিয়া যুবকের সন্তোষসাধনে প্রবৃত্ত হয়, আবার এক একদিন তাহার সমস্ত ক্ষুদ্র শক্তি তাহার সমস্ত কাঠিন্য একত্র সংহত করিয়া তাঁহাকে আঘাত করিতে চেষ্টা করে। বেদনা দিতে না পারিলে তাহার কাঠিন্য দ্বিগুণ বাড়িয়া উঠে; কৃতকার্য্য হইলে সে কাঠিন্য অনুতাপের অশ্রুজলে শতধা বিগলিত হইয়া অজস্র স্নেহ-ধারায় প্রবাহিত হইতে থাকে।
এই তুচ্ছ মেঘরৌদ্র খেলার প্রথম তুচ্ছ ইতিহাস পরপরিচ্ছেদে সংক্ষেপে বিবৃত করা যাইতেছে।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
গ্রামের মধ্যে আর সকলেই দলাদলি, চক্রান্ত, ইক্ষুর চাষ, মিথ্যা মকদ্দমা এবং পাটের কারবার লইয়া থাকিত, ভাবের আলোচনা এবং সাহিত্য চর্চ্চা করিতে কেবল শশিভূষণ এবং গিরিবালা।
ইহাতে কাহারে ঔৎসুক্য বা উৎকণ্ঠার কোন বিষয় নাই। কারণ গিরিবালার বয়স দশ এবং শশিভূষণ একটি সদ্য বিকশিত এমে, বিএল। উভয়ে প্রতিবেশী মাত্র।
গিরিবালার পিতা, হরকুমার এককালে নিজগ্রামের পত্তনীদার ছিলেন। এখন দুরবস্থায় পড়িয়া সমস্ত বিক্রয় করিয়া তাঁহাদের বিদেশী জমিদারের নায়েবী পদগ্রহণ করিয়াছেন। যে পরগনায় তাহাদের বাস সেই পরগনারই নায়েবী সুতরাং তাঁহাকে জন্মস্থান হইতে নড়িতে হয় না।
শশিভূষণ এম, এ পাশ করিয়া আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছেন কিন্তু কিছুতেই কোন কর্ম্মে ভিড়িলেন না। লোকের সঙ্গে মেশা বা সভাস্থলে দুটো কথা বলা সেও তাঁহার দ্বারা হইয়া উঠে না। চোখে কম দেখেন বলিয়া চেনা লোককে চিনিতে পারেন না এবং সেই কারণেই ভ্রুকুঞ্চিত করিয়া দৃষ্টিপাত করিতে হয়, লোকে সেটাকে ঔদ্ধত্য বলিয়া বিবেচনা করে।
কলিকাতায় জনসমুদ্রের মধ্যে আপন মনে একলা থাকা শোভা পায় কিন্তু পল্লিগ্রামে সেটা বিশেষ স্পর্দ্ধার মত দেখিতে হয়। শশিভূষণের বাপ যখন বিস্তর চেষ্টায় পরাস্ত হইয়া অবশেষে তাঁহার অকর্ম্মণ্য পুত্রটিকে পল্লীতে তাঁহাদের সামান্য বিষয়রক্ষাকার্য্যে নিয়োগ করিলেন তখন শশিভূষণকে পল্লীবাসীদের নিকট হইতে বিস্তর উৎপীড়ন, উপহাস এবং লাঞ্ছনা সহিতে হইয়াছিল। লাঞ্ছনার আরও একটা কারণ ছিল; শান্তিপ্রিয় শশিভূষণ বিবাহ করিতে সন্মত ছিলেন না—কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতাগণ তাঁহার এই অনিচ্ছাকে দুঃসহ অহঙ্কার জ্ঞান করিয়া কিছুতেই ক্ষমা করিতে পারিতেন না।
শশিভূষণের উপর যতই উপদ্রব হইতে লাগিল শশিভূষণ ততই আপন বিবরের মধ্যে অদৃশ্য হইতে লাগিলেন। একটি কোণের ঘরে তক্তপোষের উপর কতকগুলি বাঁধানো ইংরাজি বই লইয়া বসিয়া থাকিতেন—যখন যেটা ইচ্ছা হইত পাঠ করিতেন, এই ত ছিল তাঁহার কাজ বিষয় কি করিয়া রক্ষা হইত তাহা বিষয়ই জানে। এবং পূর্ব্বেই আভাসে বলা গিয়াছে মানুষের মধ্যে তাঁহার সম্পর্ক ছিল কেবল গিরিবালার সহিত।
গিরিবালার ভাইরা ইস্কুলে যাইত এবং ফিরিয়া আসিয়া মূঢ় ভগ্নীটিকে কোন দিন জিজ্ঞাসা করিত পৃথিবীর আকার কিরূপ, কোন দিন বা প্রশ্ন করিত সূর্য্য বড় না পৃথিবী বড়, সে যখন ভূল বলিত তখন তাহার প্রতি বিপুল অবজ্ঞা দেখাইয়া ভ্রম সংশোধন করিত। সূর্য্য পৃথিবী অপেক্ষা বৃহৎ এ মতটা যদি গিরিবালার নিকট প্রমাণাভাবে অসিদ্ধ বলিয়া বোধ হইত এবং সেই সন্দেহ যদি সে সাহস করিয়া প্রকাশ করিত, তবে তাহার ভাইরা তাহাকে দ্বিগুণ উপেক্ষাভরে কহিত “ইস্! আমাদের বইয়ে লেখা আছে আর তুই—”
ছাপার বইয়ে এমন কথা লেখা আছে শুনিয়া গিরিবালা সম্পূর্ণ নিরুত্তর হইয়া যাইত দ্বিতীয় আর কোন প্রমাণ তাহার নিকট আবশ্যক বোধ হইত না।
কিন্তু তাহার মনে মনে বড় ইচ্ছা করিত সেও দাদাদের মত বই লইয়া পড়ে। কোন কোন দিন সে আপন ঘরে বসিয়া কোন একটা বই খুলিয়া বিড়বিড় করিয়া পড়ার ভান করিত এবং অনর্গল পাতা উল্টাইয়া যাইত। ছাপার কালে কালো ছোট ছোট অপরিচিত অক্ষরগুলি কি যেন এক মহারহস্যশালার সিংহদ্বারে দলে দলে সার বাঁধিয়া স্কন্ধের উপরে ইকার ঐকার রেফ উঁচাইয়া পাহারা দিত, গিরিবালার কোন প্রশ্নের কোনই উত্তর করিত না। কথা মালা তাহার বাঘ্র শৃগাল অশ্বগর্দ্দভের একটি কথাও কৌতূহলকাতর বালিকার নিকট ফাঁস করিত না এবং আখ্যানমঞ্জরী তাহার সমস্ত আখ্যানগুলি লইয়া মৌনব্রতের মত নীরবে চাহিয়া থাকিত।
গিরিবালা তাহার ভাইদের নিকট পড়া শিখিবার প্রস্তাব করিয়াছিল কিন্তু তাহার ভাইরা সে কথায় কর্ণপাতমাত্র করে নাই। একমাত্র শশিভূষণ তাহার সহায় ছিল।
গিরিবালার নিকট কথামালা এবং আখ্যানমঞ্জরী যেমন দুর্ভেদ্য রহস্যপূর্ণ ছিল শশিভূষণও প্রথম প্রথম অনেকটা সেইরূপ ছিল। লোহার গরাদে দেওয়া রাস্তার ধারের ছোট বসিবার ঘরটিতে যুবক একাকী তক্তপোষের উপর পুস্তকে পরিবৃত হইয়া বসিয়া থাকিত; গিরিবালা গরাদে ধরিয়া বাহিরে দাঁড়াইয়া অবাক্ হইয়া এই নতপৃষ্ঠ পাঠ-নিবিষ্ট অদ্ভুত লোকটিকে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিত; পুস্তকের সংখ্যা তুলনা করিয়া মনে মনে স্থির করিত শশিভূষণ তাহার ভাইদের অপেক্ষা অনেক বেশি বিদ্বান। তদপেক্ষা বিস্ময়জনক ব্যাপার তাহার নিকট আর কিছুই ছিল না। কথামালা প্রভৃতি পৃথিবীর প্রধান প্রধান পাঠ্যপুস্তকগুলি শশিভূষণ যে নিঃশেষপূর্ব্বক পাঠ করিয়া ফেলিয়াছে এবিষয়ে তাহার সন্দেহমাত্র ছিল না। এই জন্য, শশিভূষণ যখন পুস্তকের পাত ওল্টাইত সে স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া তাহার জ্ঞানের অবধি নির্ণয় করিতে পারিত না। অবশেষে এই বিস্ময়মগ্ন বালিকাটি ক্ষীণদৃষ্টি শশিভূষণেরও মনোযোগ আকর্ষণ করিল। শশিভূষণ একদিন একটা ঝকঝকে বাঁধানো বই খুলিয়া বলিল—গিরিবালা ছবি দেখবি আয়। গিরিবালা তৎক্ষণাৎ দৌঁঁড়িয়া পালাইয়া গেল।
কিন্তু পরদিন সে পুনর্ব্বার ডুরে কাপড় পরিয়া সেই গরাদের বাহিরে দাঁড়াইয়া সেইরূপ গম্ভীর মৌন মনোযোগের সহিত শশিভূষণের অধ্যয়ন কার্য্য নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতে লাগিল। শশিভূষণ সেদিনও ডাকিল এবং সেদিনও সে বেণী দুলাইয়া উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া পালাইল।
এইরূপে তাহাদের পরিচয়ের সূত্রপাত হইয়া ক্রমে কখন ঘনিষ্ঠতর হইয়া উঠিল এবং কখন যে বালিকা গরাদের বাহির হইতে শশিভূষণের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল, তাহার তক্তপোষের উপর বাঁধানো পুস্তকস্তূপের মধ্যে স্থান পাইল ঠিক সে তারিখটা নির্ণয় করিয়া দিতে ঐতিহাসিক গবেষণার আবশ্যক।
শশিভূষণের নিকট গিরিবালার লেখাপড়ার চর্চ্চা আরম্ভ হইল। শুনিয়া সকলে হাসিবেন, এই মাষ্টারটি তাহার ক্ষুদ্র ছাত্রীকে কেবল যে অক্ষর, বানান এবং ব্যাকরণ শিখাইত তাহা নহে—অনেক বড় বড় কাব্য তর্জ্জমা করিয়া শুনাইত এবং তাহার মতামত জিজ্ঞাসা করিত। বালিকা কি বুঝিত তাহা অন্তর্যামীই জানেন, কিন্তু তাহার ভাল লাগিত তাহাতে সন্দেহ নাই। সে বোঝা না-বোঝায় মিশাইয়া আপন বাল্য হৃদয়ে নানা অপরূপ কল্পনাচিত্র আঁকিয়া লইত। নীরবে চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া মন দিয়া শুনিত, মাঝে মাঝে এক একটা অত্যন্ত অসঙ্গত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিত এবং কখন কখন অকস্মাৎ একটা অসংলগ্ন প্রসঙ্গান্তরে গিয়াও উপনীত হইত। শশিভূষণ তাহাতে কখনো কিছু বাধা দিত না— বড় বড় কাব্য সম্বন্ধে এই অতি ক্ষুদ্র সমালোচকের নিন্দা প্রশংসা টীকা ভাষ্য শুনিয়া সে বিশেষ আনন্দ লাভ করিত। সমস্ত পল্লীর মধ্যে এই গিরিবালাই তাহার একমাত্র সমজদার বন্ধু।
গিরিবালার সহিত শশিভূষণের প্রথম পরিচয় যখন, তখন গিরির বয়স আট ছিল, এখন তাহার বয়স দশ হইয়াছে। এই দুই বৎসরে সে ইংরাজি ও বাঙ্গলা বর্ণমালা শিখিয়া দুই চারিটা সহজ বই পড়িয়া ফেলিয়াছে। এবং শশিভূষণের পক্ষেও পল্লিগ্রাম এই দুই বৎসর নিতান্ত সঙ্গবিহীন বিরস বলিয়া বোধ হয় নাই।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
কিন্তু গিরিবালার বাপ হরকুমারের সহিত শশিভূষণের ভালরূপ বনিবনাও হয় নাই। হরকুমার প্রথম প্রথম এই এম্ এ, বি, এলের নিকট মকদ্দমা মামলা সম্বন্ধে পরামর্শ লইতে আসিত; এম্ এ বি এল্ তাহাতে বড় একটা মনোযোগ করিত না, এবং আইন বিদ্যা সম্বন্ধে নায়েবের নিকট আপন অজ্ঞতা স্বীকার করিতে কুণ্ঠিত হইত না। নায়েব সেটাকে নিতান্তই ছল মনে করিত। এমন ভাবে বছর দুয়েক কাটিল।
সম্প্রতি একটি অবাধ্য প্রজাকে শাসন করা আবশ্যক হইয়াছে। নায়েব মহাশয় তাহার নামে ভিন্ন ভিন্ন জেলায় ভিন্ন ভিন্ন অপরাধ ও দাবীতে নালিষ রুজু করিয়া দিবার অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়া পরামর্শের জন্য শশিভূষণকে কিছু বিশেষ পীড়াপীড়ি করিয়া ধরিলেন। শশিভূষণ পরামর্শ দেওয়া দূরে থাক্ শান্ত অথচ দৃঢ়ভাবে হরকুমারকে এমন গুটি দুই চারি কথা বলিলেন, যাহা তাহার কিছুমাত্র মিষ্ট বোধ হইল না।
এদিকে আবার প্রজার নামে একটি মকদ্দমাতেও হরকুমার জিতিতে পারিলেন না। তাঁহার মনে দৃঢ় ধারণা হইল শশিভূষণ উক্ত হতভাগ্য প্রজার সহায় ছিল। তিনি প্রতিজ্ঞা করিলেন এমন লোককে গ্রাম হইতে অবিলম্বে তাড়াইতে হইবে।
শশিভূষণ দেখিলেন তাঁহার ক্ষেতের মধ্যে গোরু প্রবেশ করে, তাঁহার কলাইয়ের খোলায় আগুন লাগিয়া যায়, তাঁহার সীমানা লইয়া বিবাদ বাধে, তাঁহার প্রজারা সহজে খাজনা দেয় না এবং উল্টিয়া তাঁহার নামে মিথ্যা মকদ্দমা আনিবার উপক্রম করে, এমন কি, সন্ধ্যার সময় পথে বাহির হইলে তাঁহাকে মারিবে এবং রাত্রে তাহার বসত বাটীতে আগুন লাগাইয়া দিবে এমন সকল জনশ্রুতিও শোনা যাইতে লাগিল। অবশেষে শান্তিপ্রিয় নিরীহ প্রকৃতি শশিভূষণ গ্রাম ছাড়িয়া কলিকাতায় পালাইবার আয়োজন করিলেন।
যাত্রার উদ্যোগ করিতেছেন এমন সময়ে গ্রামে জয়েণ্ট ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের তাঁবু পড়িল। বর্কন্দাজ কন্ষ্টেবল্ খান্সামা কুকুর ঘোড়া সহিস্ মেথরে সমস্ত গ্রাম চঞ্চল হইয়া উঠিল। ছেলের দল ব্যাঘ্রের অনুবর্ত্তী শৃগালের পালের ন্যায় সাহেবের আড্ডার নিকটে সশঙ্কিত কৌতূহল সহকারে ঘুরিতে লাগিল।
নায়েব মহাশয় যথারীতি আতিথ্য শিরে খরচ লিখিয়া সাহেবের মুর্গি আণ্ডা ঘৃত দুগ্ধ যোগাইতে লাগিলেন। জয়েণ্ট সাহেবের যে পরিমাণে খাদ্য আবশ্যক নায়েব মহাশয় তদপেক্ষা অনেক বেশি অক্ষুণ্ন চিত্তে সরবরাহ করিয়াছিলেন কিন্তু প্রাতঃকালে সাহেবের মেথর আসিয়া যখন সাহেবের কুকুরের জন্য একেবারে চার সের ঘৃত আদেশ করিয়া বসিল তখন দুগ্রর্হবশতঃ সেটা তাহার সহ্য হইল না—মেথরকে উপদেশ দিলেন যে, সাহেবের কুত্তা যদিচ দেশি কুকুরের অপেক্ষা অনেকটা ঘি বিনা পরিতাপে হজম করিতে পারে তথাপি এতাধিক পরিমাণে স্নেহপদার্থ তাহার স্বাস্থ্যের পক্ষে কল্যাণজনক নহে। তাহাকে ঘি দিলেন না।
মেথর গিয়া সাহেবকে জানাইল যে, কুকুরের জন্য মাংস কোথায় পাওয়া যাইতে পারে ইহাই সে নায়েবের নিকট সন্ধান লইতে গিয়াছিল কিন্তু সে জাতিতে মেথর বলিয়া নায়েব অবজ্ঞাপূর্ব্বক তাহাকে সর্ব্বলোকসমক্ষে দূর করিয়া তাড়াইয়া দিয়াছে, এমন কি সাহেবের প্রতিও উপেক্ষা প্রদর্শন করিতে কুণ্ঠিত হয় নাই।
একে ব্রাহ্মণের জাত্যভিমান সাহেব লোকের সহজেই অসহ্য বোধ হয় তাহার উপর তাঁহার মেথরকে অপমান করিতে সাহস করিয়াছে ইহাতে ধৈর্য্য রক্ষা করা তাঁহার পক্ষে অসম্ভব হইয়া উঠিল। তৎক্ষণাৎ চাপ্রাসিকে আদেশ করিলেন—বোলাও নায়েবকো।
নায়েব কম্পান্বিত কলেবরে দুর্গা নাম জপ করিতে করিতে সাহেবের তাম্বুর সম্মুখে খাড়া হইলেন। সাহেব তাম্বু হইতে মচ্মচ্ শব্দে বাহির হইয়া আসিয়া নায়েবকে উচ্চ কণ্ঠে বিজাতীয় উচ্চারণে জিজ্ঞাসা করিলেন—টুমি কি কারণবশটো আমার মেঠরকে ডূর করিয়াছে?
হরকুমার শশব্যস্ত হইয়া করযোড়ে জানাইলেন, সাহেবের মেথরকে দূর করিতে পারেন এমন স্পর্দ্ধা কখনই তাঁহাতে সম্ভবে না; তবে কিনা কুকুরের জন্য একেবারে চারি সের ঘি চাহিয়া বসাতে প্রথমে তিনি উক্ত চতুষ্পদের মঙ্গলার্থে মৃদুভাবে আপত্তি প্রকাশ করিয়া পরে ঘৃত সংগ্রহ করিয়া আনিবার জন্য ভিন্ন ভিন্ন স্থানে লোক পাঠাইয়াছেন।
সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন কাহাকে পাঠানো হইয়াছে এবং কোথায় পাঠানো হইয়াছে।
হরকুমার তৎক্ষণাৎ যেমন মুখে আসিল নাম করিয়া দিলেন। সেই সেই নামীয় লোকগণ সেই সেই গ্রামে ঘৃত আনিবার জন্য গিয়াছে কি না সন্ধান করিতে অতি সত্বর লোক পাঠাইয়া দিয়া সাহেব নায়েবকে তাম্বুতে বসাইয়া রাখিলেন।
দূতগণ অপরাহ্ণে ফিরিয়া আসিয়া সাহেবকে জানাইল ঘৃত সংগ্রহের জন্য কেহ কোথাও যায় নাই। নায়েবের সমস্ত কথাই মিথ্যা এবং মেথর যে সত্য বলিয়াছে তাহাতে আর হাকিমের সন্দেহ রহিল না। তখন জয়েণ্ট সাহেব ক্রোধে গর্জ্জন করিয়া মেথরকে ডাকিয়া কহিলেন, এই শ্যালকের কর্ণ ধরিয়া তাম্বুর চারিধারে ঘোড়দৌড় করাও। মেথর আর কাল বিলম্ব না করিয়া চতুর্দ্দিকে লোকারণ্যের মধ্যে সাহেবের আদেশ পালন করিল।[১]
দেখিতে দেখিতে কথাটা ঘরে ঘরে রাষ্ট্র হইয়া গেল, হরকুমার গৃহে আসিয়া আহার ত্যাগ করিয়া মুমূর্ষুবৎ পড়িয়া রহিলেন।
জমীদারী কার্য্য উপলক্ষে নায়েবের শত্রু বিস্তর ছিল তাহারা এই ঘটনায় অত্যন্ত আনন্দলাভ করিল কিন্তু কলিকাতায় গমনোদ্যত শশিভূষণ যখন এই সংবাদ শুনিলেন তখন তাঁহার সর্ব্বাঙ্গের রক্ত উত্তপ্ত হইয়া উঠিল। সমস্ত রাত্রি তাঁহার নিদ্রা হইল না।
পরদিন প্রাতে তিনি হরকুমারের বাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইলেন, হরকুমার তাঁহার হাত ধরিয়া ব্যাকুলভাবে কাঁদিতে লাগিলেন। শশিভূষণ কহিলেন, সাহেবের নামে মানহানির মকদ্দমা আনিতে হইবে, আমি তোমার উকীল হইয়া লড়িব।
স্বয়ং ম্যাজিষ্ট্রেট্ সাহেবের নামে মকদ্দমা আনিতে হইবে শুনিয়া হরকুমার প্রথমটা ভীত হইয়া উঠিলেন—শশিভূষণ কিছুতেই ছাড়িলেন না।
হরকুমার বিবেচনা করিতে সময় লইলেন। কিন্তু যখন দেখিলেন কথাটা চারিদিকে রাষ্ট্র হইয়াছে, এবং শক্রগণ আনন্দ প্রকাশ করিতেছে তখন তিনি আর থাকিতে পারিলেন না, শশিভূষণের শরণাপন্ন হইলেন—কহিলেন, বাপু শুনিলাম তুমি অকারণে কলিকাতায় যাইবার আয়োজন করিতেছ সে ত কিছুতেই হইতে পারিবে না। তোমার মত একজন লোক গ্রামে থাকিলে আমাদের সাহস কত থাকে। যাহা হউক আমাকে এই ঘোর অপমান হইতে উদ্ধার করিতে হইবে।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
যে শশিভূষণ চিরকাল লোকচক্ষুর অন্তরালে নিভৃত নির্জ্জনতার মধ্যে আপনাকে রক্ষা করিবার চেষ্টা করিয়া আসিয়াছেন তিনি আজ আদালতে আসিয়া হাজির হইলেন। ম্যাজিষ্ট্রেট্ তাঁহার নালিশ শুনিয়া তাঁহাকে প্রাইভেট্ কাম্রার মধ্যে ডাকিয়া লইয়া অত্যন্ত খাতির করিয়া কহিলেন, শশিবাবু, এ মকদ্দমাটা গোপনে মিট্মাট্ করিয়া ফেলিলে ভাল হয় নাকি!
শশিবাবু টেবিলের উপরিস্থিত একখানি আইন গ্রন্থের মলাটের উপর তাঁহার কুঞ্চিতভ্রূ ক্ষীণদৃষ্টি অত্যন্ত নিবিষ্টভাবে রক্ষা করিয়া কহিলেন, আমার মক্কেলকে আমি এরূপ পরামর্শ দিতে পারি না। তিনি প্রকাশ্যভাবে অপমানিত হইয়াছেন, গোপনে ইহার মিট্মাট্ হইবে কি করিয়া।
সাহেব দুইচারি কথা কহিয়া বুঝিলেন এই স্বল্পভাষী স্বল্পদৃষ্টি লোকটিকে সহজে বিচলিত করা সম্ভব নহে, কহিলেন, অল্রাইট্ বাবু, দেখা যাউক কতদূর কি হয়!
এই বলিয়া ম্যাজিষ্ট্রেট্ সাহেব মকদ্দমার দিন ফিরাইয়া দিয়া মফস্বল ভ্রমণে বাহির হইলেন।
এদিকে জয়েণ্ট সাহেব জমিদারকে’পত্র লিখিলেন, তোমার নায়েব আমার ভৃত্যদিগকে অপমান করিয়া আমার প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করে, আশা করি তুমি ইহার সমুচিত প্রতিকার করিবে।
জমিদার শশব্যস্ত হইয়া তৎক্ষণাৎ হরকুমারকে তলব করিলেন। নায়েব আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা খুলিয়া বলিলেন। জমিদার অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া কহিলেন, সাহেবের মেথর যখন চারিসের ঘি চাহিল তুমি বিনা বাক্যব্যয়ে তৎক্ষণাৎ কেন দিলে না? তোমার কি বাপের কড়ি লাগিত?
হরকুমার অস্বীকার করিতে পরিলেন না যে, ইহাতে তাঁহার পৈতৃক সম্পত্তির কোনরূপ ক্ষতি হইত না। অপরাধ স্বীকার করিয়া কছিলেন, আমার গ্রহ মন্দ তাই এমন দুর্ব্বুদ্ধি ঘটিয়াছিল।
জমিদার কহিলেন, তাহার পর আবার সাহেবের নামে নালিশ করিতে তোমাকে কে বলিল?
হরকুমার কহিলেন, ধর্ম্মাবতার, নালিশ করিবার ইচ্ছা আমার ছিল না; ঐ আমাদের গ্রামের শশি, তাহার কোথাও কোন মকদ্দমা জোটে না, সে ছোঁড়া নিতান্ত জোর করিয়া প্রায় আমার সম্মতি না লইয়াই এই হেঙ্গামা বাধাইয়া বসিয়াছে।
শুনিয়া জমিদার শশিভূষণের উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিলেন। বুঝিলেন, লোকটা অপদার্থ নব্য উকীল, কোন ছুতায় একটা হুজুক তুলিয়া সাধারণের সমক্ষে পরিচিত হইবার চেষ্টায় আছে। নায়েবকে হুকুম করিয়া দিলেন মকদ্দমা তুলিয়া লইয়া যেন অবিলম্বে ছোট বড় ম্যাজিষ্ট্রেট যুগলকে ঠাণ্ডা করা হয়।
নায়েব সাহেবের জন্য কিঞ্চিৎ ফলমূল শীতলভোগ উপহার লইয়া জয়েণ্ট্ ম্যাজিষ্ট্রেটের বাসায় গিয়া হাজির হইলেন। সাহেবকে জানাইলেন সাহেবের নামে মকদ্দমা করা তাঁহার আদৌ স্বভাববিরুদ্ধ, কেবল শশিভূষণ নামে গ্রামের একটি অজাতশ্মশ্রু অপোগণ্ড অর্ব্বাচীন উকীল তাঁহাকে এক প্রকার না জানাইয়া এইরূপ স্পর্দ্ধার কাজ করিয়াছে। সাহেব শশিভূষণের প্রতি অত্যন্ত রিরক্ত এবং নায়েবের প্রতি বড় সন্তুষ্ট হইলেন এবং কহিলেন রাগের মাথায় নায়েব বাবুকে “ডণ্ড বিঢান” করিয়া তিনি “ডুঃ খিট্” আছেন। সাহের বাঙ্গালা ভাষার পরীক্ষায় সম্প্রতি পুরস্কার লাভ করিয়া সাধারণের সহিত সাধুভাষায় বাক্যালাপ করিয়া থাকেন।
নায়েব কছিলেন, মা বাপ কখনো বা রাগ করিয়া শাস্তি ও দিয়া থাকেন কখনও বা আদর করিয়া কোলেও টানিয়া লন, ইহাতে সন্তানের বা মা বাপের দুঃখের কোন কারণ নাই।
অতঃপর জয়েণ্ট্ সাহেবের সমস্ত ভৃত্যবর্গকে যথাযোগ্য পারিতোষিক দিয়া হরকুমার মফস্বলে ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের সহিত দেখা করিতে গেলেন। ম্যাজিষ্ট্রেট তাহার মুখে শশিভূষণের স্পর্দ্ধার কথা শুনিয়া কহিলেন, আমিও আশ্চর্য্য হইতেছিলাম যে, নায়েব বাবুকে বরাবর ভাল লোক বলিয়া জানিতাম, তিনি যে সর্ব্বাগ্রে আমাকে জানাইয়া গোপনে মিট্মাট্ না করিয়া হঠাৎ মকদ্দমা আনিবেন একি অসম্ভব ব্যাপার! এখন সমস্ত বুঝিতে পারিতেছি।
অবশেষে নায়েবকে জিজ্ঞাসা করিলেন, শশি কন্গ্রেসে যোগ দিয়াছে কি না। নায়েব অম্লানমুখে বলিলেন হাঁ। সাহেব তাঁহার সাহেবী বুদ্ধিতে স্পষ্টই বুঝিতে পারিলেন, এ সমস্তই কন্গ্রেসের চাল। একটা পাকচক্র বাধাইয়া অমৃতবাজারে প্রবন্ধ লিখিয়া গবর্মেণ্টের সহিত খিটমিট করিবার জন্য কনগ্রেসের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চেলাগণ লুক্কায়িতভাবে চতুর্দ্দিকে অবসর অনুসন্ধান করিতেছে। এই সকল ক্ষুদ্র কণ্টকগণকে একদমে দলন করিয়া ফেলিবার জন্য ম্যাজিষ্ট্রেটের হস্তে অধিকতর সরাসরি ক্ষমতা দেওয়া হয় নাই বলিয়া সাহেব ভারতবর্ষীয় গবমেণ্টকে অত্যন্ত দুর্ব্বল গবর্মেণ্ট বলিয়া মনে মনে ধিক্কার দিলেন। কিন্তু কন্গ্রেস্ওয়ালা শশিভূষণের নাম ম্যাজিষ্ট্রেটের মনে রহিল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
সংসারে বড় বড় ব্যাপারগুলি যখন প্রবলভাবে গজাইয়া উঠিতে থাকে তখন ছোট ছোট ব্যাপারগুলিও ক্ষুধিত ক্ষুদ্র শিকড়জাল লইয়া জগতের উপর আপন দাবী বিস্তার করিতে ছাড়ে না।
শশিভূষণ যখন এই ম্যাজিষ্ট্রেটের হাঙ্গামা লইয়া বিশেষ ব্যস্ত, যখন বিস্তৃত পুঁথিপত্র হইতে আইন উদ্ধার করিতেছেন, মনে মনে বক্তৃতায় শান দিতেছেন, কল্পনায় সাক্ষীকে জেরা করিতে বসিয়া গিয়াছেন ও প্রকাশ্য আদালতের লোকারণ্য দৃশ্য এবং এই যুদ্ধপর্ব্বের ভাবী পর্ব্বাধ্যায়গুলি মনে আনিয়া ক্ষণে ক্ষণে কম্পিত ও ঘর্ম্মাক্ত হইয়া উঠিতেছেন, তখন তাঁহার ক্ষুদ্র ছাত্রীটি তাহার ছিন্নপ্রায় চারুপাঠ ও মসীবিচিত্র লিখিবার খাতা, বাগান হইতে কখন ফুল কখন ফল, মাতৃভাণ্ডার হইতে কোন দিন আচার, কোন দিন নারিকেলের মিষ্টান্ন, কোন দিন পাতায় মোড়া কেতকীকেশর-সুগন্ধি গৃহনির্ম্মিত খয়ের আনিয়া নিয়মিত সময়ে তাঁহার দ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইত।
প্রথম দিনকতক দেখিল শশিভূষণ একখানা চিত্রহীন প্রকাণ্ড কঠোরমূর্ত্তি গ্রন্থ খুলিয়া অন্যমনস্ক ভাবে পাতা উল্টাইতেছেন, সেটা যে মনোযোগ দিয়া পাঠ করিতেছেন তাহাও বোধ হইল না। অন্য সময়ে শশিভূষণ যে সকল গ্রন্থ পড়িতেন, তাহার মধ্য হইতে কোন না কোন অংশ গিরিবালাকে বুঝাইবার চেষ্টা করিতেন, কিন্তু ঐ স্থূলকায় কালো মলাটের পুস্তক হইতে গিরিবালাকে শুনাইবার যোগ্য কি দুটো কথাও ছিল না? তা না থাক্, তাই বলিয়া ঐ বই খানা কি এতই বড়, আর গিরিবালা কি এতই ছোট?
প্রথমটা, গুরুর মনোযোগ আকর্ষণের জন্য গিরিবালা সুর করিয়া বানান করিয়া বেণীসমেত দেহের উত্তরার্দ্ধ সবেগে জুলাইতে জুলাইতে উচ্চৈঃস্বরে আপনিই পড়া আরম্ভ করিয়া দিল। দেখিল তাহাতে বিশেষ ফল হইল না। কালো মোটা বইখানার উপর মনে মনে অত্যন্ত চটিয়া গেল। ওটাকে একটা কুৎসিত কঠোর নিষ্ঠুর মানুষের মত করিয়া দেখিতে লাগিল। ওই বইখানা যে গিরিবালাকে বালিকা বলিয়া সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে তাহা যেন তাহার প্রত্যেক দুর্ব্বোধ পাতা দুষ্ট মানুষের মুখের মত আকার ধারণ করিয়া নীরবে প্রকাশ করিতে লাগিল। সেই বইখানা যদি কোন চোরে চুরি করিয়া লইয়া যাইত, তবে সেই চোরকে সে তাহার মাতৃভাণ্ডারের সমস্ত কেয়াখয়ের চুরি করিয়া পুরস্কার দিতে পারিত। সেই বইখানার বিনাশের জন্য সে মনে মনে দেবতার নিকট যে সকল অসঙ্গত ও অসম্ভব প্রার্থনা করিয়াছিল তাহা দেবতারা শুনেন নাই এবং পাঠকদিগকেও শুনাইবার কোন অবশ্যক দেখি না।
তখন ব্যথিতহৃদয় বালিকা দুই একদিন চারুপাঠহস্তে গুরু গৃহে গমন বন্ধ করিল। এবং সেই দুই একদিন পরে এই বিচ্ছেদের ফল পরীক্ষা করিয়া দেখিবার জন্য সে অন্য ছলে শশিভূষণের গৃহসম্মুখবর্ত্তী পথে আসিয়া কটাক্ষপাত করিয়া দেখিল শশিভূষণ সেই কালো বইখানা ফেলিয়া একাকী দাঁড়াইয়া হাত নাড়িয়া লোহার গরাদেগুলার প্রতি বিজাতীয় ভাষায় বক্তৃতা প্রয়োগ করিতেছেন। বোধ করি, বিচারকের মন কেমন করিয়া গলাইবেন এই লোহাগুলার উপর তাহার পরীক্ষা হইতেছে। সংসারে অনভিজ্ঞ, গ্রন্থবিহারী শশিভূষণের ধারণ ছিল যে, পুরাকালে ডিমস্থিনীস্, সিসিরো, বার্ক, শেরিডন্ প্রভৃতি বাগ্মীগণ বাক্যবলে যে সকল অসামান্য কার্য্য করিয়া গিয়াছেন; যেরূপ শব্দভেদী শরবর্ষণে অন্যায়কে ছিন্নভিন্ন, অত্যাচারকে লাঞ্ছিত এবং অহঙ্কারকে ধূলিশায়ী করিয়া দিয়াছেন আজিকার দোকানদারীর দিনেও তাহা অসম্ভব নহে। প্রভুত্বমদগর্ব্বিত উদ্ধত ইংরাজকে কেমন করিয়া তিনি জগৎ সমক্ষে লজ্জিত ও অনুতপ্ত করিবেন তিলকুচি গ্রামের জীর্ণ ক্ষুদ্র গৃহে দাঁড়াইয়া শশিভূষণ তাহারই চর্চ্চা করিতেছিলেন। আকাশের দেবতারা শুনিয়া হাসিয়াছিলেন কি তাঁহাদের দেবচক্ষু অশ্রুসিক্ত হইতেছিল তাহা কেহ বলিতে পারে না।
সুতরাং সে দিন গিরিবালা তাঁহার দৃষ্টিপথে পড়িল না। সে দিন বালিকার অঞ্চলে জাম ছিল না; পূর্ব্বে একবার জামের আঁটি ধরা পড়িয়া অবধি ঐ ফল সম্বন্ধে সে অত্যন্ত সংকুচিত ছিল। এমন কি, শশিভূষণ যদি কোন দিন নিরীহভাবে জিজ্ঞাসা করিত, “গিরি, আজ জাম নেই,” সে সেটাকে গূঢ় উপহাস জ্ঞান করিয়া সক্ষোভে “যাঃ ও” বলিয়া তর্জ্জন করিয়া পলায়নের উপক্রম করিত। জামের আঁটির অভাবে আজ তাহাকে একটা কৌশল অবলম্বন করিতে হইল। সহসা দূরের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করিয়া বালিকা উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিল—“স্বর্ণ, ভাই, তুই যাস্নে, আমি এখনি যাচ্চি।”
পুরুষ পাঠক মনে করিতে পারেন, যে, কথাটা স্বর্ণলতা নামক কোন দূরবর্ত্তিনী সঙ্গিনীকে লক্ষ্য করিয়া উচ্চারিত, কিন্তু পাঠিকারা সহজেই বুঝিতে পারিবেন, দূরে কেহই ছিল না, লক্ষ্য অত্যন্ত নিকট! কিন্তু হায়, অন্ধ পুরুষের প্রতি সে লক্ষ্য ভ্রষ্ট হইয়া গেল। শশিভূষণ যে, শুনিতে পান নাই, তাহা নহে, তিনি তাহার মর্ম্মগ্রহণ করিতে পারিলেন না। তিনি মনে করিলেন, বালিকা সত্যই ক্রীড়ার জন্য উৎসুক— এবং সে দিন তাহাকে খেলা হইতে অধ্যয়নে আকর্ষণ করিয়া আনিতে তাঁহার অধ্যবসায় ছিল না—কারণ তিনিও সে দিন কোন কোন হৃদয়ের দিকে লক্ষ্য করিয়া তীক্ষ্ণ শর সন্ধান করিতেছিলেন। বালিকার ক্ষুদ্র হস্তের সামান্য লক্ষ্য যেমন ব্যর্থ হইয়াছিল তাহার শিক্ষিত হস্তের মহৎ লক্ষ্যও সেইরূপ ব্যর্থ হইয়াছিল পাঠকেরা সে সংবাদ পূর্ব্বেই অবগত হইয়াছেন।
জামের আঁটির একটা গুণ এই যে, একে একে অনেকগুলি নিক্ষেপ করা যায়, চারিটি নিষ্ফল হইলে অন্ততঃ পঞ্চমটি ঠিক স্থানে গিয়া লাগিতে পারে। কিন্তু, স্বর্ণ হাজার কাল্পনিক হোক, তাহাকে “এখনি যাচ্চি” আশা দিয়া অধিকক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকা যায় না। থাকিলে স্বর্ণের অস্তিত্ব সম্বন্ধে লোকের স্বভাবতই সন্দেহ জন্মিতে পারে। সুতরাং সে উপায়টি যখন নিষ্ফল হইল তখন গিরিবালাকে অবিলম্বে চলিয়া যাইতে হইল। তথাপি, স্বর্ণনাম্নী কোন দূরস্থিত সহচরীর সঙ্গ লাভ করিবার অভিলাষ আন্তরিক হইলে যেরূপ সবেগে উৎসাহের সহিত পদচারণা করা স্বাভাবিক হইত, গিরিবালার গতিতে তাহা লক্ষিত হইল না। সে যেন তাহার পৃষ্ঠ দিয়া অনুভব করিবার চেষ্টা করিতেছিল পশ্চাতে কেহ আসিতেছে কি না; যখন নিশ্চয় বুঝিল কেহ আসিতেছে না, তখন আশার শেষতম ক্ষীণতম ভগ্নাংশটুকু লইয়া একবার পশ্চাৎ ফিরিয়া চাহিয়া দেখিল, এবং কাহাকেও না দেখিয়া সেই ক্ষুদ্র আশাটুকু এবং শিথিলপত্র চারুপাঠখানি খণ্ড খণ্ড করিয়া ছিঁড়িয়া পথে ছড়াইয়া দিল। শশিভূষণ তাহাকে যে বিদ্যাটুকু দিয়াছে সেটুকু যদি সে কোন মতে ফিরাইয়া দিতে পারিত, তবে বোধ হয় পরিত্যজ্য জামের আঁটির মত সে সমস্তই শশিভূষণের দ্বারের সন্মুখে সশব্দে নিক্ষেপ করিয়া দিয়া চলিয়া আসিত। বালিকা প্রতিজ্ঞা করিল দ্বিতীয় বার শশিভূষণের সহিত দেখা হইবার পূর্ব্বেই সে সমস্ত পড়াশুনা ভুলিয়া যাইবে—তিনি যে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিবেন তাহার কোনটিরই উত্তর দিতে পারিবে না! একটি, একটি, একটিরও না্! তখন শশিভূষণ অত্যন্ত জব্দ হইবে!
গিরিবালার দুই চক্ষু জলে ভরিয়া আসিল। পড়া ভুলিয়া গেলে শশিভূষণের যে কিরূপ তীব্র অনুতাপের কারণ হইবে তাহা মনে করিয়া সে পীড়িত হৃদয়ে কিঞ্চিৎ সাত্ত্বনা লাভ করিল, এবং কেবল মাত্র শশিভূষণের দোষে বিস্মৃতশিক্ষা সেই হতভাগিনী ভবিষ্যৎ গিরিবালাকে কল্পনা করিয়া তাহার নিজের প্রতি করুণারস উচ্ছ্বলিত হইয়া উঠিল। আকাশে মেঘ করিতে লাগিল; বর্ষাকালে এমন মেঘ প্রতিদিন করিয়া থাকে। গিরিবালা পথের প্রান্তে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াইয়া অভিমানে ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিল; এমন অকারণ কান্না প্রতিদিন কত বালিকা কাঁদিয়া থাকে! উহার মধ্যে লক্ষ্য করিবার বিষয় কিছুই ছিল না!
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
শশিভূষণের আইন সম্বন্ধীয় গবেষণা এবং বক্তৃতা-চর্চ্চা কি কারণে ব্যর্থ হইয়া গেল তাহ পাঠকদের অগোচর নাই। ম্যাজিষ্ট্রেটের নামে মকদ্দমা অকস্মাৎ মিটিয়া গেল। হরকুমার তাঁহাদের জেলার বেঞ্চে অনরারি ম্যাজিষ্ট্রেট্ নিযুক্ত হইলেন। একখানা মলিন চাপকান ও তৈলাক্ত পাগড়ি পরিয়া হরকুমার আজকাল প্রায়ই জেলায় গিয়া সাহেব সুবাদিগকে নিয়মিত সেলাম করিয়া আসেন।
শশিভূষণের সেই কালো মোটা বইখানার প্রতি এতদিন পরে গিরিবালার অভিশাপ ফলিতে আরম্ভ করিল; সে একটি অন্ধকার কোণে নির্বাসিত হইয়া অনাদৃত বিস্মৃত ভাবে ধূলিস্তর সংগ্রহে প্রবৃত্ত হইল। কিন্তু তাহার অনাদর দেখিয়া যে বালিকা আনন্দ লাভ করিবে সেই গিরিবালা কোথায়!
শশিভূষণ যে দিন প্রথম আইনের গ্রন্থ বন্ধ করিয়া বসিলেন সেই দিনই হঠাৎ বুঝিতে পারিলেন গিরিবালা আসে নাই। তখন একে একে কয় দিনের ইতিহাস অল্পে অল্পে তাঁহার মনে পড়িতে লাগিল। মনে পড়িতে লাগিল একদিন উজ্জ্বল প্রভাতে গিরিবালা অঞ্চল ভরিয়া নববর্ষার আর্দ্র বকুলফুল আনিয়াছিল। তাহাকে দেখিয়াও যখন তিনি গ্রন্থ হইতে দৃষ্টি তুলিলেন না, তখন তাহার উচ্ছ্বাসে সহসা বাধা পড়িল। সে তাহার অঞ্চলবিদ্ধ একটা সুঁচ সুতা বাহির করিয়া নতশিরে একটি একটি করিয়া ফুল লইয়া মালা গাঁথিতে লাগিল—মালা অত্যন্ত ধীরে ধীরে গাঁথিল, অনেক বিলম্বে শেষ হইল—বেলা হইয়া আসিল, গিরিবালার ঘরে ফিরিবার সময় হইল, তথাপি শশিভূষণের পড়া শেষ হইল না। গিরিবালা মালাটা তক্তপোষের উপর রাখিয়া ম্লানভাবে চলিয়া গেল। মনে পড়িল, তাহার অভিমান প্রতিদিন কেমন করিয়া ঘনীভূত হইয়া উঠিল; কবে হইতে সে তাঁহার ঘরে প্রবেশ না করিয়া ঘরের সন্মুখবর্ত্তী পথে মধ্যে মধ্যে দেখা দিত এবং চলিয়া যাইত; অবশেষে কবে হইতে বালিকা সেই পথে আসাও বন্ধ করিয়াছে। সেও ত আজ কিছুদিন হইল। গিরিবালার অভিমান ত এতদিন স্থায়ী হয় না। শশিভূষণ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া হতবুদ্ধি হতকর্ম্মের মত দেয়ালে পিঠ দিয়া বসিয়া রহিলেন। ক্ষুদ্র ছাত্রীটি না আসাতে তাঁহার পাঠ্যগ্রন্থগুলি নিতান্ত বিস্বাদ হইয়া আসিল। বই টানিয়া টানিয়া লইয়া দুই চারি পাতা পড়িয়া ফেলিয়া দিতে হয়। লিখিতে লিখিতে ক্ষণে ক্ষণে সচকিতে পথের দিকে দ্বারের অভিমুখে প্রতীক্ষাপূর্ণ দৃষ্টি বিক্ষিপ্ত হইতে থাকে এবং লেখা ভঙ্গ হয়।
শশিভূষণের আশঙ্কা হইল গিরিবালার অসুখ হইয়া থাকিবে। গোপনে সন্ধান লইয়া জানিলেন সে আশঙ্কা অমূ লক। গিরিবালা আজকাল আর ঘর হইতে বাহির হয় না। তাহার জন্য পাত্র স্থির হইয়াছে।
গিরি যে দিন চারুপাঠের ছিন্নখণ্ডে গ্রামের পঙ্কিল পথ বিকীর্ণ করিয়াছিল তাহার পরদিন প্রত্যূষে ক্ষুদ্র অঞ্চলে বিচিত্র উপহার সংগ্রহ করিয়া দ্রুতপদে ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিতেছিল। অতিশয় গ্রীষ্ম হওয়াতে নিদ্রাহীন রাত্রি অতিবাহন করিয়া হরকুমার ভোরবেলা হইতে বাহিরে বসিয়া গা খুলিয়া তামাক খাইতেছিলেন। গিরিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কোথায় যাচ্চিস্? গিরি কহিল “শশি দাদার বাড়ি!” হরকুমার ধমক দিয়া কহিলেন, “শশি দাদার বাড়ি যেতে হবে না, ঘরে যা!” এই বলিয়া আসন্ন-শ্বশুর-গৃহবাস বয়ঃপ্রাপ্ত কন্যার লজ্জার অভাব সম্বন্ধে বিস্তর তিরস্কার করিলেন। সেই দিন হইতে তাহার বাহিরে আসা বন্ধ হইয়াছে। এবার আর তাহার অভিমান ভঙ্গ করিবার অবসর জুটিল না। আমসত্ব, কেয়াখয়ের এবং জারকনেবু ভাণ্ডারের যথাস্থানে ফিরিয়া গেল। বৃষ্টি পড়িতে লাগিল, বকুল ফুল ঝরিতে লাগিল, গাছ ভরিয়া পেয়ারা পাকিয়া উঠিল এবং শাখাশৃংখলিত পক্ষীচঞ্চুক্ষত সুপক্ক কালোজামে তরুতল প্রতিদিন সমাচ্ছন্ন হইতে লাগিল। হায়, সেই ছিন্নপ্রায় চারুপাঠখানিও আর নাই!
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
গ্রামে গিরিবালার বিবাহে যে দিন শানাই বাজিতেছিল সে দিন অনিমন্ত্রিত শশিভূষণ নৌকা করিয়া কলিকাতা অভিমুখে চলিতেছিলেন।
মকদ্দমা উঠাইয়া লওয়া অবধি হরকুমার শশিকে বিষচক্ষে দেখিতেন। কারণ, তিনি মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন, শশি তাঁহাকে নিশ্চয় ঘৃণা করিতেছে। শশির মুখে চখে ব্যবহারে তিনি তাহার সহস্র কাল্পনিক নিদর্শন দেখিতে লাগিলেন। গ্রামের সকল লোকেই তাঁহার অপমান বৃত্তান্ত ক্রমশঃ বিস্মৃত হইতেছে, কেবল শশিভূষণ একাকী সেই দুঃস্মৃতি জাগাইয়া রাখিয়াছেন মনে করিয়া তিনি তাঁহাকে দুই চক্ষে দেখিতে পারিতেন না। তাহার সহিত সাক্ষাৎ হইবামাত্র তাঁহার অন্তঃকরণের মধ্যে একটুখানি সলজ্জ সঙ্কোচ এবং সেই সঙ্গে প্রবল আক্রোশের সঞ্চার হইত। শশিকে গ্রামছাড়া করিতে হইবে বলিয়া হরকুমার প্রতিজ্ঞা করিয়া বসিলেন।
শশিভূষণের মত লোককে গ্রামছাড়া করা কাজটা তেমন দুরূহ নহে। নায়েব মহাশয়ের অভিপ্রায় অনতিবিলম্বে সফল হইল। একদিন সকাল বেলা পুস্তকের বোঝা এবং গুটিদুইচার টিনের বাক্স সঙ্গে লইয়া শশি নৌকায় চড়িলেন। গ্রামের সহিত তাঁহার যে একটি সুখের বন্ধন ছিল সেও আজ সমারোহ সহকারে ছিন্ন হইতেছে। সুকোমল বন্ধনটি যে কত দৃঢ় ভাবে তাঁহার হৃদয়কে বেষ্টন করিয়া ধরিয়াছিল তাহা তিনি পূর্ব্বে সম্পূর্ণরূপে জানিতে পারেন নাই। আজ যখন নৌকা ছাড়িয়া দিল, গ্রামের বৃক্ষচূড়াগুলি অস্পষ্ট এবং উৎসবের বাদ্যধ্বনি ক্ষীণতর হইয়া আসিল, তখন সহসা অশ্রুবাষ্পে হৃদয় স্ফীত হইয়া উঠিয়া তাঁহার কণ্ঠরোধ করিয়া ধরিল, রক্তোচ্ছ্বাসবেগে কপালের শিরাগুলা টন্ টন্ করিতে লাগিল, এবং জগৎসংসারের সমস্ত দৃশ্য ছায়া-নির্ম্মিত মায়ামরীচিকার মত অত্যন্ত অস্পষ্ট প্রতিভাত হইল।
প্রতিকূল বাতাস অতিশয় বেগে বহিতেছিল, সেই জন্য স্রোত অনুকূল হইলেও নৌকা ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতেছিল। এমন সময়ে নদীর মধ্যে এক কাণ্ড ঘটিল যাহাতে শশিভূষণের যাত্রার ব্যাঘাত করিয়া দিল।
ষ্টেশন ঘাট হইতে সদর মহকুমা পর্য্যন্ত একটি নূতন ষ্টীমার লাইন সম্প্রতি খুলিয়াছে। সেই ষ্টীমারটি সশব্দে পক্ষ সঞ্চালন করিয়া ঢেউ তুলিয়া উজানে আসিতেছিল। জাহাজে নূতন লাইনের অল্পবয়স্ক ম্যানেজার সাহেব এবং অল্প সংখ্যক যাত্রী ছিল। যাত্রীদের মধ্যে শশিভূষণের গ্রাম হইতেও কেহ কেহ উঠিয়াছিল।
একটি মহাজনের নৌকা কিছু দূর হইতে এই ষ্টীমারের সহিত পাল্লা দিয়া আসিতে চেষ্টা করিতেছিল, আবার মাঝে মাঝে ধরিধরি করিতেছিল, আবার মাঝে মাঝে পশ্চাতে পড়িতেছিল। মাঝির ক্রমশঃ রোখ চাপিয়া গেল। সে প্রথম পালের উপর দ্বিতীয় পাল এবং দ্বিতীয় পালের উপরে ক্ষুদ্র তৃতীয় পালটা পর্য্যন্ত তুলিয়া দিল। বাতাসের বেগে সুদীর্ঘ মাস্তুল সম্মুখে আনত হইয়া পড়িল, এবং বিদীর্ণ তরঙ্গরাশি অট্টকলস্বরে নৌকার দুই পার্শ্বে উন্মত্তভাবে নৃত্য করিতে লাগিল। নৌকা তখন ছিন্নবল্গা অশ্বের ন্যায় ছুটিয়া চলিল। এক স্থানে ষ্টীমারের পথ কিঞ্চিৎ বাঁকা ছিল, সেইখানে সংক্ষিপ্ততর পথ অবলম্বন করিয়া নৌকা ষ্টীমারকে ছাড়াইয়া গেল। ম্যানেজার সাহেব আগ্রহভরে রেলের উপর ঝুঁকিয়া নৌকার এই প্রতিযোগিতা দেখিতেছিল। যখন নৌকা তাহার পূর্ণতম বেগ প্রাপ্ত হইয়াছে, এবং ষ্টীমারকে হাত দুয়েক ছাড়াইয়া গিয়াছে এমন সময়ে সাহেব হঠাৎ একটা বন্দুক তুলিয়া স্ফীত পাল লক্ষ্য করিয়া আওয়াজ করিয়া দিল। এক মুহূর্ত্তে পাল ফাটিয়া গেল, নৌকা ডুবিয়া গেল, ষ্টীমার নদীর বাঁকের অন্তরালে অদৃশ্য হইয়া গেল।
ম্যানেজার কেন যে এমন করিল তাহা বলা কঠিন। ইংরাজ নন্দনের মনের ভাব আমরা বাঙ্গালী হইয়া ঠিক বুঝিতে পারি না। হয়ত দিশী পালের প্রতিযোগিতা সে সহ্য করিতে পারে নাই, হয়ত একটা স্ফীত বিস্তীর্ণ পদার্থ বন্দুকের গুলির দ্বারা চক্ষের পলকে বিদীর্ণ করিবার একটা হিংস্র প্রলোভন আছে, হয়ত, এই গর্ব্বিত নৌকাটার বস্ত্রখণ্ডের মধ্যে গুটিকয়েক ফুটা করিয়া নিমেষের মধ্যে ইহার নৌকালীলা সমাপ্ত করিয়া দিবার মধ্যে একটা প্রবল পৈশাচিক হাস্যরস আছে; নিশ্চয় জানি না। কিন্তু ইহা নিশ্চয়, ইংরাজের মনের ভিতরে একটুখানি বিশ্বাস ছিল যে, এই রসিকতাটুকু করার দরুণ সে কোনরূপ শাস্তির দায়িক নহে— এবং ধারণা ছিল, যাহাদের নৌকা গেল এবং সম্ভবতঃ প্রাণ সংশয়, তাহারা মানুষের মধ্যেই গণ্য হইতে পারে না।
সাহেব যখন বন্দুক তুলিয়া গুলি করিল এবং নৌকা ডুবিয়া গেল তখন শশিভূষণের পান্সী ঘটনাস্থলের নিকটবর্ত্তী হইয়াছে। শেষোক্ত ব্যাপারটি শশিভূষণ প্রত্যক্ষ দেখিতে পাইলেন। তাড়াতাড়ি নৌকা লইয়া গিয়া মাঝি এবং মাল্লাদিগকে উদ্ধার করিলেন। কেবল এক ব্যক্তি ভিতরে বসিয়া রন্ধনের জন্য মসলা পিশিতেছিল, তাহাকে আর দেখা গেল না। বর্ষার নদী খরবেগে বহিয়া চলিল।
শশিভূষণের হৃৎপিণ্ডের মধ্যে উত্তপ্ত রক্ত ফুটিতে লাগিল। আইন অত্যন্ত মন্দগতি—সে একটা বৃহৎ জটিল লৌহযন্ত্রের মত; তৌল করিয়া সে প্রমাণ গ্রহণ করে এবং নির্ব্বিকার ভাবে সে শাস্তি বিভাগ করিয়া দেয়, তাহার মধ্যে মানবহৃদয়ের উত্তাপ নাই। কিন্তু ক্ষুধার সহিত ভোজন, ইচ্ছার সহিত উপভোগ ও রোষের সহিত শাস্তিকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেওয়া শশিভূষণের নিকট সমান অস্বাভাবিক বলিয়া বোধ হইল। অনেক অপরাধ আছে যাহা প্রত্যক্ষ করিবামাত্র তৎক্ষণাৎ নিজহস্তে তাহার শাস্তিবিধান না করিলে অন্তর্যামী বিধাতা পুরুষ যেন অন্তরের মধ্যে থাকিয়া প্রত্যক্ষকারীকে দগ্ধ করিতে থাকেন। তখন, আইনের কথা স্মরণ করিয়া সান্ত্বনা লাভ করিতে হৃদয় লজ্জা বোধ করে। কিন্তু কলের আইন এবং কলের জাহাজ ম্যানেজারটিকে শশিভূষণের নিকট হইতে দূরে লইয়া গেল। তাহাতে জগতের আর আর কি উপকার হইয়াছিল বলিতে পারি না কিন্তু সে যাত্রায় নিঃসন্দেহ শশিভূষণের ভারতবর্ষীয় প্লীহা রক্ষা পাইয়াছিল।
মাঝিমাল্লা যাহারা বাঁচিল তাহাদিগকে লইয়া শশি গ্রামে ফিরিয়া আসিলেন। নৌকায় পাট বোঝাই ছিল, সেই পাট উদ্ধারের জন্য লোক নিযুক্ত করিয়া দিলেন এবং মাঝিকে ম্যানেজারের বিরুদ্ধে পুলিসে দরখাস্ত দিতে অনুরোধ করিলেন।
মাঝি কিছুতেই সম্মত হয় না। সে বলিল নৌকা ত মজিয়াছে এক্ষণে নিজেকে মজাইতে পারিব না। প্রথমতঃ পুলিসকে্ দর্শনি দিতে হইবে, তাহার পর কাজকর্ম্ম আহার নিদ্রা ত্যাগ করিয়া আদালতে আদালতে ঘুরিতে হইবে, তাহার পর সাহেবের নামে নালিশ করিয়া কি বিপাকে পড়িতে হইবে ও কি ফল লাভ হইবে তাহা ভগবান জানেন। অবশেষে সে যখন জানিল, শশিভূষণ নিজে উকীল, আদালত-খরচা তিনিই বহন করিবেন এবং মকদ্দমায় ভবিষ্যতে খেষারৎ পাইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা আছে তখন রাজি হইল। কিন্তু শশিভূষণের গ্রামের লোক যাহারা ষ্টীমারে উপস্থিত ছিল তাহারা কিছুতেই সাক্ষ্য দিতে চাহিল না। তাহার শশিভূষণকে কহিল, মহাশয়, আমরা কিছুই দেখি নাই; আমরা জাহাজের পশ্চাৎ ভাগে ছিলাম, কলের ঘট্ঘট্ এবং জলের কল্ কল্ শব্দে সেখান হইতে বন্দুকের আওয়াজ শুনিবারও কোন সম্ভাবনা ছিল না।
দেশের লোককে আন্তরিক ধিক্কার দিয়া শশিভূষণ ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট মকদ্দমা চালাইলেন।
সাক্ষীর কোন আবশ্যক হইল না। ম্যানেজার স্বীকার করিল যে, সে বন্দুক ছুঁড়িয়াছিল। কহিল, আকাশে এক ঝাঁক বক উড়িতেছিল তাহাদেরই প্রতি লক্ষ্য করা হইয়াছিল। ষ্টীমার তখন পূর্ণবেগে চলিতেছিল এবং সেই মুহূর্ত্তেই নদীর বাঁকের অন্তরালে প্রবেশ করিয়াছিল। সুতরাং সে জানিতেও পারে নাই, কাক মরিল, কি বক মরিল, কি নৌকাটা ডুবিল। অন্তরীক্ষে এবং পৃথিবীতে এত শিকারের জিনিষ আছে, যে, কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্ব্বক “ডার্টি র্যাগ্” অর্থাৎ মলিন বস্ত্রখণ্ডের উপর শিকিপয়সা দামেরও ছিটাগুলি অপব্যয় করিতে পারে না।
বেকসুর খালাস পাইয়া ম্যানেজার সাহেব চুরট ফুঁকিতে ফুঁকিতে ক্লাবে হুইষ্ট্ খেলিতে গেল; যে লোকটা নৌকার মধ্যে মশলা পিশিতেছিল, নয় মাইল তফাতে তাহার মৃতদেহ ডাঙ্গায় আসিয়া লাগিল এবং শশিভূষণ চিত্তদাহ লইয়া আপন গ্রামে ফিরিয়া আসিলেন।
যে দিন ফিরিয়া আসিলেন, সে দিন নৌকা সাজাইয়া গিরিবালাকে শ্বশুরবাড়ি লইয়া যাইতেছে। যদিও তাঁহাকে কেহ ডাকে নাই, তথাপি শশিভূষণ ধীরে ধীরে নদীতীরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঘাটে লোকের ভিড় ছিল সেখানে না গিয়া কিছু দূরে অগ্রসর হইয়া দাঁড়াইলেন। নৌকা ঘাট ছাড়িয়া যখন তাঁহার সম্মুখ দিয়া চলিয়া গেল তখন চকিতর মত একবার দেখিতে পাইলেন, মাথায় ঘোমটা টানিয়া নববধূ নতশিরে বসিয়া আছে। অনেক দিন হইতে গিরিবালার আশা ছিল, যে, গ্রাম ত্যাগ করিয়া যাইবার পূর্ব্বে কোন মতে একবার শশিভূষণের সহিত সাক্ষাৎ হইবে কিন্তু আজ সে জানিতেও পারিল না, যে, তাহার গুরু অনতিদূরে তীরে দাঁড়াইয়া আছেন। একবার সে মুখ তুলিয়াও দেখিল না, কেবল নিঃশব্দ রোদনে তাহার দুই কপোল বাহিয়া অশ্রুজল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল।
নৌকা্ ক্রমশঃ দূরে চলিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল। জলের উপর প্রভাতের রৌদ্র ঝিক্ ঝিক্ করিতে লাগিল, নিকটের আম্রশাখায় একটা পাপিয়া উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে মুহুর্মুহু গান গাহিয়া মনের আবেগ কিছুতেই নিঃশেষ করিতে পারিল না, খেয়ানৌকা লোক বোঝাই লইয়া পারাপার হইতে লাগিল, মেয়েরা ঘাটে জল লইতে আসিয়া উচ্চ কলস্বরে গিরির শ্বশুরালয় যাত্রার আলোচনা তুলিল, শশিভূষণ চষমা খুলিয়া চোখ মুছিয়া সেই পথের ধারে সেই গরাদের মধ্যে সেই ক্ষুদ্র গৃহে গিয়া প্রবেশ করিলেন। হঠাৎ একবার মনে হইল যেন গিরিবালার কণ্ঠ শুনিতে পাইলেন! “শশিদাদা!”—কোথায় রে কোথায়? কোথাও না! সে গৃহে না, সে পথে না, সে গ্রামে না—তাঁহার অশ্রুজলাভিষিক্ত অন্তরের মাঝখানটিতে।
অষ্টম পরিচ্ছেদ।
শশিভূষণ পুনরায় জিনিষপত্র বাঁধিয়া কলিকাতা অভিমুখে যাত্রা করিলেন। কলিকাতায় কোন কাজ নাই, সেখানে যাওয়ার কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নাই; সেই জন্য রেলপথে না গিয়া বরাবর নদীপথে যাওয়াই স্থির করিলেন।
তখন পূর্ণবর্ষায় বাঙ্গলা দেশের চারিদিকেই ছোট বড় আঁকাবাঁঁকা সহস্র জলময় জাল বিস্তীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে। সরস শ্যামল বঙ্গভূমির শিরা উপশিরাগুলি পরিপূর্ণ হইয়া তরুলতা তৃণগুল্ম ঝোপঝাড় ধান পাট ইক্ষুতে দশদিকে উন্মত্ত যৌবনের প্রাচুর্য্য যেন একেবারে উদ্দাম উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠিয়াছে।
শশিভূষণের নৌকা সেই সমস্ত সঙ্কীর্ণ বক্র জলস্রোতের মধ্য দিয়া চলিতে লাগিল। জল তখন তীরের সহিত সমতল হইয়া গিয়াছে। কাশবন শরবন এবং স্থানে স্থানে শস্যক্ষেত্র জলমগ্ন হইয়াছে। গ্রামের বেড়া, বাঁশঝাড় ও আমবাগান একেবারে জলের অব্যবহিত ধারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে— দেবকন্যারা যেন বাঙ্গলা দেশের তরুমূলবর্ত্তী আলবালগুলি জলসেচনে পরিপূর্ণ করিয়া দিয়াছেন।
যাত্রার আরম্ভকালে স্নানচিক্কণ বনশ্রী রৌদ্রে উজ্জ্বল হাস্যময় ছিল, অনতিবিলম্বেই মেঘ করিয়া বৃষ্টি আরম্ভ হইল। তখন যে দিকে বৃষ্টি পড়ে সেই দিকই বিষন্ন এবং অপরিচ্ছন্ন দেখাইতে লাগিল। বন্যার সময়ে গরুগুলি যেমন জলবেষ্টিত মলিন পঙ্কিল সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠপ্রাঙ্গণের মধ্যে ভিড় করিয়া করুণনেত্রে সহিষ্ণুভাবে দাঁড়াইয়া শ্রাবণের ধারাবর্ষণে ভিজিতে থাকে, বাঙ্গলা দেশ আপনার কর্দ্দমপিচ্ছিল ঘনসিক্ত রুদ্ধ জঙ্গলের মধ্যে মূক বিষন্নমুখে সেইরূপ পীড়িত ভাবে অবিশ্রাম ভিজিতে লাগিল। চাষীরা টোকা মাথায় দিয়া বাহির হইয়াছে, স্ত্রীলোকের ভিজিতে ভিজিতে বাদলার শীতল বায়ুতে সঙ্কুচিত হইয়া কুটীর হইতে কুটরান্তরে গৃহকার্য্যে যাতায়াত করিতেছে ও পিছল ঘাটে অত্যন্ত সাবধানে পা ফেলিয়া সিক্তবস্ত্রে জল তুলিতেছে, এবং গৃহস্থ পুরুষেরা দাওয়ায় বসিয়া তামাক খাইতেছে, নিতান্ত কাজের দায় থাকিলে কোমরে চাদর জড়াইয়া জুতা হস্তে ছাতি মাথায় বাহির হইতেছে। অবলা রমণীর মস্তকে ছাতি এই রৌদ্রদগ্ধ বর্ষাপ্লাবিত বঙ্গদেশের সনাতন পবিত্র প্রথার মধ্যে নাই।
বৃষ্টি যখন কিছুতেই থামে না তখন রুদ্ধ নৌকার মধ্যে বিরক্ত হইয়া উঠিয়া শশিভূষণ পুনশ্চ রেলপথে যাওয়াই স্থির করিলেন। এক জায়গায় একটা প্রশস্ত মোহানার মত জায়গায় আসিয়া শশিভূষণ নৌকা বাঁধিয়া আহারের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন।
খোঁড়ার পা খানায় পড়ে—সে কেবল খানার দোষ নয়, খোঁড়ার পাটারও পড়িবার দিকে একটু বিশেষ ঝোঁক আছে। শশিভূষণ সে দিন তাহার একটা প্রমাণ দিলেন।
দুই নদীর মোহানার মুখে বাঁশ বাঁধিয়া জেলের একটা প্রকাণ্ড জাল পাতিয়াছে। কেবল একপার্শ্বে নৌকা চলাচলের স্থান রাখিয়াছে। বহুকাল হইতে তাহার এ কার্য্য করিয়া থাকে এবং সে জন্য খাজনাও দেয়। দুর্ভাগ্যক্রমে এ বৎসর এই পথে হঠাৎ জেলার পুলিস্ সুপরিণ্টেণ্ডেণ্ট্ বাহাদুরের শুভাগমন হইয়াছে। তাঁহার বোট আসিতে দেখিয়া জেলেরা পূর্ব্ব হইতে পার্শ্ববর্ত্তী পথ নির্দ্দেশ করিয়া উচ্চৈঃস্বরে সাবধান করিয়া দিল। কিন্তু মনুষ্যরচিত কোন বাধাকে সন্মান প্রদর্শন করিয়া ঘুরিয়া যাওয়া সাহেবের মাঝির অভ্যাস নাই। সে সেই জালের উপর দিয়াই বোট চালাইয়া দিল। জাল অবনত হইয়া বোটকে পথ ছাড়িয়া দিল, কিন্তু, তাহার হাল বাধিয়া গেল। কিঞ্চিৎ বিলম্বে এবং চেষ্টায় হাল ছাড়াইয়া লইতে হইল।
পুলিস সাহেব অত্যন্ত গরম এবং রক্তবর্ণ হইয়া বোট বাঁধিলেন। তাঁহার মূর্ত্তি দেখিয়াই জেলে চারটে উর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল। সাহেব তাঁহার মাল্লাদিগকে, জাল কাটিয়া ফেলিতে আদেশ করিলেন। তাহারা সেই সাত আট শত টাকার বৃহৎ জাল কাটিয়া টুক্রা টুক্রা করিয়া ফেলিল।
জালের উপর ঝাল ঝাড়িয়া অবশেষে জেলেদিগকে ধরিয়া আনিবার আদেশ হইল। কন্ষ্টেবল্ পলাতক জেলে চারিটির সন্ধান না পাইয়া যে চারিজনকে হাতের কাছে পাইল তাহাদিগকে ধরিয়া অনিল। তাহারা আপনাদিগকে নিরপরাধী বলিয়া যোড়হস্তে কাকুতিমিনতি করিতে লাগিল। পুলিস্ বাহাদুর যখন সেই বন্দীদিগকে সঙ্গে লইবার হুকুম দিতেছেন, এমন সময় চস্মা-পরা শশিভূষণ তাড়াতাড়ি একখানা জামা পরিয়া তাহার বোতাম না লাগাইয়া চটিজুতা চট্চট্ করিতে করিতে উর্দ্ধশ্বাসে পুলিসের বোটের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কম্পিতস্বরে কহিলেন, “সার্, জেলের জাল ছিঁড়িবার এবং এই চারিজন লোককে উৎপীড়ন করিবার তোমার কোন অধিকার নাই।”
পুলিসের বড় কর্ত্তা তাঁহাকে হিন্দিভাষায় একটা বিশেষ অসম্মানের কথা বলিবামাত্র তিনি এক মুহূর্ত্তে কিঞ্চিৎ উচ্চ ডাঙ্গা হইতে বোটের মধ্যে লাফাইয়া পড়িয়াই একেবারে সাহেবের উপরে আপনাকে নিক্ষেপ করিলেন। বালকের মত পাগলের মত মারিতে লাগিলেন।
তাহার পর কি হইল তিনি জানেন না। পুলিসের থানার মধ্যে যখন জাগিয়া উঠিলেন, তখন—বলিতে সঙ্কোচ বোধ হয়—যেরূপ ব্যবহার প্রাপ্ত হইলেন তাহাতে মানসিক সন্মান অথবা শারীরিক আরাম বোধ করিলেন না।
নবম পরিচ্ছেদ।
শশিভূষণের বাপ উকীল ব্যারিষ্টার লাগাইয়া প্রথমতঃ শশিকে হাজত হইতে জামিনে খালাস করিলেন। তাহার পরে মকদ্দমার যোগাড় চলিতে লাগিল।
যে সকল জেলের জাল নষ্ট হইয়াছে তাহারা শশিভূষণের এক পরগণার অন্তর্গত, এক জমিদারের অধীন। বিপদের সময় কখন কখন শশির নিকটে তাহারা আইনের পরামর্শ লইতেও আসিত। যাহাদিগকে সাহেব বোটে ধরিয়া আনিয়াছিলেন তাহারাও শশিভূষণের অপরিচিত নহে।
শশি তাহাদিগকে সাক্ষ্য মানিবেন বলিয়া ডাকাইয়া আনিলেন। তাহারা ভয়ে অস্থির হইয়া উঠিল। স্ত্রীপুত্র পরিবার লইয়া যাহাদিগকে সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিতে হয় পুলিসের সহিত বিবাদ করিলে তাহারা কোথায় গিয়া নিস্কৃতি পাইবে? একটার অধিক প্রাণ কাহার শরীরে আছে? যাহা লোক্সান হইবার তাহাত হইয়াছে, এখন আবার সাক্ষ্যের সপিনা ধরাইয়া এ কি মুস্কিল! সকলে বলিল, “ঠাকুর তুমি ত আমাদিগকে বিষম ফেলাদে ফেলিলে!”
বিস্তর বলা কহার পর তাহারা সত্য কথা বলিতে স্বীকার করিল।
ইতিমধ্যে হরকুমার যে দিন বেঞ্চের কর্ম্মোপলক্ষে জেলার সাহেবদিগকে সেলাম করিতে গেলেন পুলিস সাহেব হাসিয়া কহিলেন, নায়েব বাবু শুনিতেছি তোমার প্রজারা পুলিসের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত হইয়াছে। নায়েব সচকিত হইয়া কহিলেন, হাঁ! এও কি কখনো সম্ভব হয়? অপবিত্র জন্তুজাত পুত্রদিগের অস্থিতে এত ক্ষমতা!
সংবাদপত্র পাঠকেরা অবগত আছেন মকদ্দমায় শশিভূষণের পক্ষ কিছুতেই টিঁকিতে পারিল না।
জেলেরা একে একে আসিয়া কহিল, পুলিস সাহেব তাহদের জাল কাটিয়া দেন নাই; বোটে ডাকিয়া তাহাদের নাম ধাম লিখিয়া লইতেছিলেন।
কেবল তাহাই নহে, তাঁহার দেশস্থ গুটিচারেক পরিচিত লোক সাক্ষ্য দিল যে, তাহার সে সময়ে ঘটনাস্থলে বিবাহের বরযাত্র উপলক্ষ্যে উপস্থিত ছিল। শশিভূষণ যে, অকারণে অগ্রসর হইয়া পুলিসের পাহারাওয়ালাদের প্রতি উপদ্রব করিয়াছে তাহা তাহারা প্রত্যক্ষ দেখিয়াছে!
শশিভূষণ স্বীকার করিলেন, যে, গালি খাইয়া বোটের মধ্যে প্রবেশ করিয়া তিনি সাহেবকে মারিয়াছেন। কিন্তু জাল কাটিয়া দেওয়া ও জেলেদের প্রতি উপদ্রবই তাহার মূল কারণ।
এরূপ অবস্থায়, যে বিচারে শশিভূষণ শাস্তি পাইলেন তাহাকে অন্যায় বলা যাইতে পারে না। তবে শাস্তিটা কিছু গুরুতর হইল। তিন চারিটা অভিযোগ, আঘাত, অনধিকার প্রবেশ, পুলিসের কর্ত্তব্যে ব্যাঘাত ইত্যাদি; সব কটাই তাঁহার বিরুদ্ধে পূরা প্রমাণ হইল।
শশিভূষণ তাঁহার সেই ক্ষুদ্র গৃহে তাঁহার প্রিয় পাঠ্য গ্রন্থগুলি ফেলিয়া পাঁচ বৎসর জেল খাটিতে গেলেন। তাঁহার বাপ আপিল করিতে উদ্যত হইল, তাঁহাকে শশিভূষণ বারম্বার নিষেধ করিলেন—কহিলেন, জেল ভাল! লোহার বেড়ি মিথ্যা কথা বলে না, কিন্তু জেলের বাহিরে যে স্বাধীনতা আছে সে আমাদিগকে প্রতারণা করিয়া বিপদে ফেলে। আর যদি সৎসঙ্গের কথা বল, ত, জেলের মধ্যে মিথ্যাবাদী কৃতঘ্ন কাপুরুষের সংখ্যা অল্প, কারণ স্থান পরিমিত—বাহিরে অনেক বেশি!
দশম পরিচ্ছেদ।
শশিভূষণ জেলে প্রবেশ করিবার অনতিকাল পরেই তাঁহার পিতার মৃত্যু হইল। তাঁহার আর বড় কেহ ছিল না। এক ভাই বহুকাল হইতে সেণ্ট্রাল প্রভিন্সে কাজ করিতেন, দেশে আসা তাঁহার বড় ঘটিয়া উঠিত না, সেইখানেই তিনি বাড়ি তৈয়ারি করিয়া সপরিবারে স্থায়ী হইয়া বসিয়াছিলেন। দেশে বিষয় সম্পত্তি যাহা ছিল, নায়েব হরকুমার তাহার অধিকাংশ নানা কৌশলে আত্মসাৎ করিলেন।
জেলের মধ্যে অধিকাংশ কয়েদীকে যে পরিমাণে দুঃখ ভোগ করিতে হয় দৈববিপাকে শশিভূষণকে তদপেক্ষা অনেক বেশি সহ্য করিতে হইয়াছিল। তথাপি দীর্ঘ পাঁচ বৎসর কাটিয়া গেল।
আবার একদা বর্ষার দিনে জীর্ণ শরীর ও শূন্য হৃদয় লইয়া শশিভূষণ কারা-প্রাচীরের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলেন। স্বাধীনতা পাইলেন, কিন্তু তাহা ছাড়া কারার বাহিরে তাঁহার আর কেহ অথবা আর কিছু ছিল না। গৃহহীন আত্মীয়হীন সমাজহীন কেবল তাঁহার একলাটির পক্ষে এতবড় জগৎ সংসার অত্যন্ত ঢিলা বলিয়া-ঠেকিতে লাগিল।
জীবনযাত্রার বিচ্ছিন্ন সূত্র আবার কোথা হইতে আরম্ভ করিবেন এই কথা ভাবিতেছেন এমন সময়ে এক বৃহৎ জুড়ি তাঁহার সম্মুখে আসিয়া দাঁঁড়াইল। এক জন ভৃত্য নামিয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনার নাম শশিভূষণ বাবু?—
তিনি কহিলেন হাঁ।—
সে তৎক্ষণাৎ গাড়ির দরজা খুলিয়া তাঁহার প্রবেশের প্রতীক্ষায় দাঁড়াইল —
তিনি আশ্চর্য্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—আমাকে কোথায় যাইতে হইবে?—
সে কহিল, আমার প্রভু আপনাকে ডাকিয়াছেন।
পথিকদের কৌতূহল দৃষ্টিপাত অসহ্য বোধ হওয়াতে তিনি সেখানে আর অধিক বাদানুবাদ না করিয়া গাড়িতে উঠিয়া পড়িলেন। ভাবিলেন নিশ্চয় ইহার মধ্যে একটা কিছু ভ্রম আছে। কিন্তু একটা কোন দিকে ত চলিতে হইবে—না হয় এমনি করিয়া ভ্রম দিয়াই এই নূতন জীবনের ভূমিকা আরম্ভ হউক।
সে দিনও মেঘ এবং রৌদ্র আকাশময় পরস্পরকে শিকার করিয়া ফিরিতেছিল। পথের প্রান্তবর্ত্তী বর্ষার জলপ্লাবিত গাঢ়শ্যাম শস্যক্ষেত্র চঞ্চল ছায়ালোকে বিচিত্র হইয়া উঠিতেছিল। হাটের কাছে একটা বৃহৎ রথ পড়িয়াছিল এবং তাহার অদূরবর্ত্তী মুদির দোকানে একদল বৈষ্ণব ভিক্ষুক গুপিযন্ত্র ও খোলকরতাল যোগে গান গাহিতেছিল—
এস এস ফিরে এস—নাথ হে ফিরে এস!
আমার ক্ষুধিত তৃষিত তাপিত চিত, বঁধুহে ফিরে এস!
গাড়ি অগ্রসর হইয়া চলিল, গানের পদ ক্রমে দূর হইতে দূরতর হইয়া কানে প্রবেশ করিতে লাগিল—
ওগো নিষ্ঠুর ফিরে এস হে আমার করুণ কোমল এস!
ও গো সজল জলদ স্নিগ্ধকান্ত সুন্দর ফিরে এস!
গানের কথা ক্রমে ক্ষীণতর অস্ফুটতর হইয়া আসিল, আর বুঝা গেল না। কিন্তু গানের ছন্দে শশিভূষণের হৃদয়ে একটা আন্দোলন তুলিয়া দিল, তিনি আপন মনে গুন্গুন্ করিয়া পদের পর পদ রচনা করিয়া যোজনা করিয়া চলিলেন, কিছুতে যেন থামিতে পারিলেন না,—
আমার নিতিমুখ ফিরে এস, আমার চিরদুখ ফিরে এস,
আমার সব সুখ-দুখ মন্থন ধন অন্তরে ফিরে এস!
আমার চিরবাঞ্ছিত এস, আমার চিতসঞ্চিত এস,
ওহে চঞ্চল, হে চিরন্তন, ভুজবন্ধনে ফিরে এস!
আমার বক্ষে ফিরিয়া এস, আমার চক্ষে ফিরিয়া এস,
আমার শয়নে স্বপনে বসনে ভূষণে নিখিল ভুবনে এস!
আমার মুখের হাসিতে এস হে
আমার চোখের সলিলে এস,
আমার আদরে আমার ছলনে
আমার অভিমানে ফিরে এস!
আমার সর্ব্বস্মরণে এস আমার সর্ব্বভরমে এস—
আমার ধরম করম সোহাগ সরম জনম মরণে এস!
গাড়ি যখন একটি প্রাচীরবেষ্টিত উদ্যানের মধ্যে প্রবেশ করিয়া একটি দ্বিতল অট্টালিকার সম্মুখে থামিল তখন শশিভূষণের গান থামিল।
তিনি কোন প্রশ্ন না করিয়া ভৃত্যের নির্দ্দেশক্রমে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিলেন।
যে ঘরে আসিয়া বসিলেন সে ঘরের চারিদিকেই বড় বড় কাঁচের আলমারীতে বিচিত্র বর্ণের বিচিত্র মলাটের সারি সারি বই সাজান। সেই দৃশ্য দেখিবামাত্র তাহার পুরাতন জীবন দ্বিতীয়বার কারামুক্ত হইয়া বাহির হইল। এই সোনার জলে অঙ্কিত নানা বর্ণে রঞ্জিত বইগুলি, আনন্দলোকের মধ্যে প্রবেশ করিবার সুপরিচিত রত্নখচিত সিংহদ্বারের মত তাঁহার নিকটে প্রতিভাত হইল।
টেবিলের উপরেও কি কতকগুলি ছিল। শশিভূষণ তাঁহার ক্ষীণদৃষ্টি লইয়া ঝুঁকিয়া পড়িয়া দেখিলেন, একখানি বিদীর্ণ স্লেট, তাহার উপরে গুটিদুয়েক পুরাতন খাতা, একখানি ছিন্নপ্রায় ধারাপাত কথামালা এবং একখানি কাশিরাম দাসের মহাভারত।
স্লেটের কাঠের ফ্রেমের উপর শশিভূষণের হস্তাক্ষরে কালী দিয়া খুব মোটা করিয়া লেখা—গিরিবালা দেবী। খাতা ও বহিগুলির উপরেও ঐ এক হস্তাক্ষরে এক নাম লিখিত।
শশিভূষণ কোথায় আসিয়াছেন বুঝিতে পারিলেন। তাঁহার বক্ষের মধ্যে রক্তস্রোত তরঙ্গিত হইয়া উঠিল। মুক্ত বাতায়ন দিয়া বাহিরে চাহিলেন—সেখানে কি চক্ষে পড়িল? সেই ক্ষুদ্র গরাদে দেওয়া ঘর, সেই অসমতল গ্রাম্যপথ— সেই ডুরে-কাপড়পরা ছোট মেয়েটি—এবং সেই আপনার শান্তিময় নিশ্চিন্ত নিভৃত জীবনযাত্রা।
সেদিনকার সেই সুখের জীবন কিছুই অসামান্য বা অত্যধিক নহে; দিনের পর দিন ক্ষুদ্র কাজে ক্ষুদ্র মুখে অজ্ঞাতসারে কাটিয়া যাইত, এবং তাঁহার নিজের অধ্যয়ন-কার্য্যের মধ্যে একটি বালিকা ছাত্রীর অধ্যাপন-কার্য্য তুচ্ছ ঘটনার মধ্যেই গণ্য ছিল; কিন্তু গ্রামপ্রান্তের সেই নির্জ্জন দিনযাপন, সেই ক্ষুদ্র শাস্তি, সেই ক্ষুদ্র মুখ, সেই ক্ষুদ্র বালিকার ক্ষুদ্র মুখখানি, সমস্তই যেন স্বর্গের মত দেশ কালের বহির্ভূত এবং আয়ত্তের অতীতরূপে কেবল আকাঙ্ক্ষারাজ্যের কল্পনাচ্ছায়ার মধ্যে বিরাজ করিতে লাগিল। সে দিনকার সেই সমস্ত ছবি এবং স্মৃতি আজিকার এই বর্ষাম্লান প্রভাতের আলোকের সহিত এবং মনের মধ্যে মৃদুগুঞ্জিত সেই কীর্ত্তনের গানের সহিত জড়িত মিশ্রিত হইয়া এক প্রকার সঙ্গীতময় জ্যোতিস্ময় অপূর্ব্বরূপ ধারণ করিল। সেই জঙ্গলে বেষ্টিত কর্দমাক্ত সঙ্কীর্ণ গ্রামপথের মধ্যে সেই অনাদৃত ব্যথিত বালিকার অভিমান-মলিন মুখের শেষ স্মৃতিটি যেন বিধাতা-বিরচিত এক অসাধারণ আশ্চর্য্য অপরূপ, অতি গভীর, অতি বেদনাপরিপূর্ণ স্বর্গীয় চিত্রের মত তাঁহার মানসপটে প্রতিফলিত হইয়া উঠিল। তাহারই সঙ্গে কীর্ত্তনের করুণ সুর বাজিতে লাগিল, এবং মনে হইল যেন সেই পল্লিবালিকার মুখে সমস্ত বিশ্বহৃদয়ের এক অনির্ব্বচনীয় দুঃখ আপনার ছায়া নিক্ষেপ করিয়াছে। শশিভূষণ দুই বাহুর মধ্যে মুখ লুকাইয়া সেই টেবিলের উপর সেই স্লেট বহি খাতার উপর মুখ রাখিয়া অনেক কাল পরে অনেক দিনের স্বপ্ন দেখিতে লাগিলেন।
অনেক ক্ষণ পরে মৃদু শব্দে সচকিত হইয়া মুখ তুলিয়া দেখিলেন। তাঁহার সম্মুখে রূপার থালায় ফলমূল মিষ্টান্ন রাখিয়া গিরিবালা অদূরে দাঁড়াইয়া নীরবে অপেক্ষা করিতেছিল। তিনি মস্তক তুলিতেই নিরাভরণা শুভ্রবসনা বিধবাবেশধারিণী গিরিবালা তাঁহাকে নতজানু হইয়া ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিল।
বিধবা উঠিয়া দাঁড়াইয়া যখন শীর্ণমুখ ম্লানবর্ণ ভগ্নশরীর শশিভূষণের দিকে সকরুণ স্নিগ্ধনেত্রে চাহিয়া দেখিল—তখন তাহার দুই চক্ষু ঝরিয়া দুই কপোল বাহিয়া অশ্রু পড়িতে লাগিল।
শশিভূষণ তাহাকে কুশল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে চেষ্টা করিলেন কিন্তু ভাষা খুঁজিয়া পাইলেন না, নিরুদ্ধ অশ্রুবাস্প তাঁহার বাক্যপথ সবলে অবরোধ করিল—কথা এবং অশ্রু উভয়েই নিরুপায় ভাবে হৃদয়ের মুখে কণ্ঠের দ্বারে বদ্ধ হইয়া রহিল। সেই কীর্ত্তনের দল ভিক্ষা সংগ্রহ করিতে করিতে অট্টালিকার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল এবং পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করিয়া গাহিতে লাগিল—
এস এস হে!
সমাপ্ত।
সাহিত্য-যন্ত্র; ১৩/৭ বৃন্দাবন বসুর লেন; হােগলকুঁড়িয়া, কলিকাতা।
- ↑ খুলনার ম্যাজিষ্ট্রেট্ কর্ত্তৃক মুহুরি মারার বহুপূর্ব্বে এই গল্প রচিত হইয়াছে। বেল্ সাহেবের সহৃদয় বদান্যতার বৃত্তাস্ত আমরা অনেক অব গত আছি, তাঁহার ন্যায় উদার প্রকৃতি ব্যক্তির বিরুদ্ধে কটাক্ষপাত করা আমাদের উদ্দেশ্য নহে।