কথা ও কাহিনী/কথা/গুরু গোবিন্দ
গুরু গােবিন্দ
“বন্ধু, তােমরা ফিরে যাও ঘরে,
এখনাে সময় নয়”-
নিশি-অবসান, যমুনার তীর,
ছােটো গিরিমালা বন সুগভীর;
গুরু গােবিন্দ কহিলা ডাকিয়া
অনুচর গুটিছয়।
“যাও রামদাস, যাও গাে লেহারি,
সাহু ফিরে যাও তুমি।
দেখায়ো না লােভ, ডাকিয়ো না মোরে
ঝাঁপায়ে পড়িতে কর্মসাগরে,
এখনাে পড়িয়া থাক্ বহু দূরে
জীবনরঙ্গভূমি।
ফিরায়েছি মুখ, রুধিয়াছি কান,
লুকায়েছি বনমাঝে।
সুদূরে মানবসাগর অগাধ,
চিরক্রন্দিত উর্মিনিনাদ
হেথায় বিজনে রয়েছি মগন
আপন গোপন কাজে।
মানবের প্রাণ ডাকে যেন মােরে
সেই লােকালয় হতে।
সুপ্ত নিশীথে জেগে উঠে তাই
চমকিয়া উঠে বলি 'যাই যাই,
প্রাণ মন দেহ ফেলে দিতে চাই
প্রবল মানবস্রোতে।
তােমাদের হেরি চিত চঞ্চল,
উদ্দাম ধায় মন।
রক্ত-অনল শত শিখা মেলি
সর্প-সমান করি উঠে কেলি,
গঞ্জনা দেয় তরবারি যেন
কোষমাঝে ঝন্ ঝন্।
হায়, সেকি সুখ, এ গহন ত্যজি
হাতে লয়ে জয়তুরী
জনতার মাঝে ছুটিয়া পড়িতে-
রাজ্য ও রাজা ভাঙিতে গড়িতে,
অত্যাচারের বক্ষে পড়িয়া
হানিতে তীক্ষ ছুরি।
তুরঙ্গসম অন্ধ নিয়তি-
বন্ধন করি তায়
রশ্মি পাকড়ি আপনার করে
বিপ্ন বিপদ ঘন ক'রে
আপনার পথে ছুটাই তাহারে
প্রতিকূল ঘটনায়।
সমুখে যে আসে সরে যায় কেহ,
পড়ে যায় কেহ ভূমে।
দ্বিধা হয়ে বাধা হয়েছে ভিন্ন,
পিছে পড়ে থাকে চরণচিহ্ন,
আকাশের আঁখি করিছে খিম্ল
প্রলয়বহ্নিধূমে।
শতবার ক'রে মৃত্যু ডিঙায়ে
পড়ি জীবনের পারে।
প্রান্তগগনে তারা অনিমিখ
নিশীথতিমিরে দেখাইছে দিক,
লােকের প্রবাহ ফেনায়ে ফেনায়ে
গরজিছে দুই ধারে।
কভু অমানিশা নীরব নিবিড়,
কভু বা প্রখর দিন।
কভু বা আকাশে চারি-দিক-ময়
বজ্র লুকায়ে মেঘ জড়াে হয়—
কভু বা ঝটিকা মাথার উপরে
ভেঙে পড়ে দয়াহীন।
‘আয় আয় আয়’ ডাকিতেছি সবে,
আসিতেছে সবে ছুটে।
বেগে খুলে যায় সব গৃহদ্বার,
ভেঙে বাহিরায় সব পরিবার,
মুখসম্পদ-মায়ামমতার
বন্ধন যায় টুটে।
সিন্ধু মাঝারে মিশিছে যেমন
পঞ্চনদীর জল-
আহ্বান শুনে কে কারে থামায়,
ভক্তহৃদয় মিলিছে আমায়,
পঞ্জাব জুড়ি উঠিছে জাগিয়া
উন্মাদ কোলাহল।
কোথা যাবি ভীরু, গহনে গােপনে
পশিছে কণ্ঠ মাের।
প্রভাতে শুনিয়া ‘আয় আয় আয়'
কাজের লােকেরা কাজ ভুলে যায়,
নিশীথে শুনিয়া ‘আয় তােরা আয়’
ভেঙে যায় ঘুমঘাের।
যত আগে চলি বেড়ে যায় লােক,
ভরে যায় ঘাট বাট।
ভুলে যায় সবে জাতি-অভিমান,
অবহেলে দেয় আপনার প্রাণ,
এক হয়ে যায় মান অপমান
ব্রাহ্মণ আর জাঠ।
থাক ভাই, থাক, কেন এ স্বপন-
এখনাে সময় নয়।
এখনাে একাকী দীর্ঘ রজনী
জাগিতে হইবে পল গণি গণি
অনিমেষ চোখে পূর্বগগনে
দেখিতে অরুণােদয়।
এখনাে বিহার কল্পজগতে,
অরণ্য রাজধানী-
এখনাে কেবল নীরব ভাবনা,
কর্মবিহীন বিজন সাধনা,
দিবানিশি শুধু ব'সে ব'সে শােনা
আপন মর্মবাণী।
একা ফিরি তাই যমুনার তীরে,
দুর্গমগিরিমাঝে।
মানুষ হতেছি পাষাণের কোলে,
মিশাতেছি গান নদীকলরােলে,
গড়িতেছি মন আপনার মনে,
যােগ্য হতেছি কাজে।
এমনি কেটেছে দ্বাদশ বরষ,
আরাে কতদিন হবে-
চারি দিক হতে অমর জীবন
বিন্দু বিন্দু করি আহরণ,
আপনার মাঝে আপনারে আমি
পূর্ণ দেখিব কবে।
কবে প্রাণ খুলে বলিতে পারিব-
‘পেয়েছি আমার শেষ।
তােমরা সকলে এসাে মাের পিছে,
গুরু তােমাদের সবারে ডাকিছে-
আমার জীবনে লভিয়া জীবন
জাগাে রে সকল দেশ।
‘নাহি আর ভয়, নাহি সংশয়,
নাহি আর আগুপিছু।
পেয়েছি সত্য, লভিয়াছি পথ,
সরিয়া দাঁড়ায় সকল জগৎ,
নাই তার কাছে জীবন মরণ
নাই নাই আর কিছু।'
হৃদয়ের মাঝে পেতেছি শুনিতে
দৈববাণীর মতাে-
‘উঠিয়া দাঁড়াও আপন আলােতে,
ওই চেয়ে দেখাে কত দূর হতে
তােমার কাছেতে ধরা দিবে ব'লে
আসে লোক কত শত।
'ওই শােনাে শােনাে কল্লোলধ্বনি
ছুটে হৃদয়ের ধারা।
স্থির থাকো তুমি, থাকো তুমি জাগি
প্রদীপের মতাে আলস তেয়াগি-
এ নিশীথমাঝে তুমি ঘুমাইলে
ফিরিয়া যাইবে তারা।'
ওই চেয়ে দেখাে দিগন্ত-পানে
ঘনঘাের ঘটা অতি।
আসতেছে ঝড় মরণেরে লয়ে,
তাই বসে বসে হৃদয়-আলয়ে
জ্বালাতেছি আলাে-নিবিবে না ঝড়ে,
দিবে অনন্ত জ্যোতি।
যাও তবে সাহু, যাও রামদাস,
ফিরে যাও সখাগণ।
এসাে দেখি সবে যাবার সময়-
বলো দেখি সবে ‘গুরুজির জয়’,
দুই হাত তুলি বলল ‘জয় জয়
অলখ নিরঞ্জন'।”