কথা ও কাহিনী/কথা/মস্তকবিক্রয়
মস্তকবিক্রয়
মহাবস্ত্বদান
কোশলনৃপতির তুলনা নাই,
জগৎ জুড়ি যশােগাথা।
ক্ষীণের তিনি সদা শরণ-ঠাই,
দীনের তিনি পিতামাতা।
সে কথা কাশীরাজ শুনিতে পেয়ে
জ্বলিয়া মরে অভিমানে-
“আমার প্রজাগণ আমার চেয়ে
তাহারে বড়াে করি মানে!
আমার হতে যার আসন নীচে
তাহার দান হল বেশি!
ধর্ম দয়া মায়া সকলি মিছে,
এ শুধু তার রেষারেষি।”
কহিলা, “সেনাপতি, ধরাে কৃপাণ,
সৈন্য করাে সব জড়াে।
আমার চেয়ে হবে পুণ্যবান,
স্পর্ধা বাড়িয়াছে বড়ো!”
চলিলা কাশীরাজ যুদ্ধসাজে—
কোশলরাজ হারি রণে
রাজ্য ছাড়ি দিয়া ক্ষুব্ধলাজে
পলায়ে গেল দূর বনে।
কাশীর রাজা হাসি কহে তখন
আপন সভাসদ-মাঝে,
“ক্ষমতা আছে যার রাখিতে ধন
তারেই দাতা হওয়া সাজে।”
সকলে কাঁদি বলে, “দারুণ রাহু
এমন চাঁদেরেও হানে!
লক্ষ্মী খোঁজে শুধু বলীর বাহু
চাহে না ধর্মের পান!।”
“আমরা হইলাম পিতৃহারা”
কাঁদিয়া কহে দশ দিক-
“সকল জগতের বন্ধু যারা
তাঁদের শত্রুরে ধিক্।”
শুনিয়া কাশীরাজ উঠিল রাগি -
নগরে কেন এত শােক!
আমি তো আছি, তবু কাহার লাগি
কাঁদিয়া মরে যত লােক!
আমার বাহুবলে হারিয়া তবু
আমারে করিবে সে জয়।
অরির শেষ নাহি রাখিবে কভু,
শাস্ত্রে এই মতো কয়।
মন্ত্রী, রটি দাও নগর-মাঝে,
ঘােষণা করে চারি ধারে-
যে ধরি আনি দিবে কোশলরাজে
কনকশত দিব তারে।”
ফিরিয়া রাজদূত সকল বাটী
রটনা করে দিন রাত-
যে শোনে আঁখি মুদি রসনা কাটি
শিহরি কানে দেয় হাত।
রাজ্যহীন রাজা গহনে ফিরে
মলিনচীর দীনবেশে -
পথিক একজন অশ্রুনীরে
একদা শুধাইল এসে-
“কোথা গাে বনবাসী, বনের শেষ-
কোশলে যাব কোন্ মুখে।”
শুনিয়া রাজা কহে, “অভাগা দেশ,
সেথায় যাবে কোন্ দুখে।”
পথিক কহে, “আমি বণিকজাতি,
ডুবিয়া গেছে মাের তরী।
এখন দ্বারে দ্বারে হস্ত পাতি
কেমনে রব প্রাণ ধরি!
করুণাপারাবার কোশলপতি,
শুনেছি নাম চারি ধারে-
অনাথনাথ তিনি দীনের গতি,
চলেছে দীন তারি দ্বারে।”
শুনিয়া নৃপসুত ঈষৎ হেসে
রুধিলা নয়নের বারি,
নীরবে ক্ষণকাল ভাবিয়া শেষে
কহিলা নিশ্বাস ছাড়ি-
“পান্থ, যেথা তব বাসনা পুরে
দেখায়ে দিব তারি পথ।
এসেছ বহু দুখে অনেক দূরে,
সিদ্ধ হবে মনােরথ।”
বসিয়া কাশীরাজ সভার মাঝে;
দাঁড়ালাে জটাধারী এসে।
“হেথায় আগমন কিসের কাজে”
নৃপতি শুধাইল হেসে।
“কোশলরাজ আমি, বনভবন”
কহিলা বনবাসী ধীরে-
“আমার ধরা পেলে যা দিবে পণ
দেহাে তা মাের সাথিটিরে।”
উঠিল চমকিয়া সভার লােকে,
নীরব হল গৃহতল -
বর্ম-আবরিত দ্বারীর চোখে
অশ্রু করে ছলছল।
মৌন রহি রাজা ক্ষণেক-তরে
হাসিয়া কহে, “ওহে বন্দী,
মরিয়া হবে জয়ী আমার 'পরে
এমনি করিয়াছ ফন্দি!
তােমার সে আশায় হানিব বাজ,
জিনিব আজিকার রণে -
রাজ্য ফিরি দিব হে মহারাজ,
হৃদয় দিব তারি সনে।”
জীর্ণ-চীর-পরা বনবাসীরে
বসালাে নৃপ রাজাসনে,
মুকুট তুলি দিল মলিন শিরে—
‘ধন্য’ কাহে পুরজনে।