প্রতিনিধি

বসিয়া প্রভাত কালে   সেতারার দুর্গভালে
  শিবাজি হেরিল। একদিন
রামদাস গুরু তাঁর   ভিক্ষা মাগি দ্বার দ্বার
  কিরিছেন যেন অন্নহীন।

ভাবিলা,—এ কি এ কাণ্ড!   গুরুজির ভিক্ষাভাণ্ড!
  ঘরে যার নাই দৈন্য লেশ!
সবই যার হস্তগত   রাজেশ্বর পদানত
  তাঁরো নাই বাসনার শেষ?


এ কেবল দিনে রাত্রে   জল ঢেলে ফুটা পাত্রে
  বৃথা চেষ্টা তৃষ্ণা মিটাবরে!
কহিলা, দেখিতে হবে   কতখানি দিলে তবে
  ভিক্ষা ঝুলি ভরে একেবারে।
তখনি লেখনী আনি   কি লিখি দিল। কি জানি,
  বালাজিরে কহিলা ডাকায়ে
গুরু যবে ভিক্ষা আসে   আসিবেন দুর্গ-পাশে
  এই লিপি দিয়ো তাঁর পায়ে।


গুরু চলেছেন গেয়ে,   সম্মুখে চলেছে ধেয়ে
  কত পান্থ, কত অশ্বরথ।—
“হে ভবেশ, হে শঙ্কর,   সবারে দিয়েছ ঘর,
  আমারে দিয়েছ শুধু পথ।
অন্নপূর্ণ। মা আমার   লয়েছে বিশ্বের ভার,
  সুখে আছে সর্ব্ব চরাচর,
মােরে তুমি হে ভিখারী   মার কাছ হতে কাড়ি
  করেছ আপন অনুচর।”

সমাপন করি গান   সারিয়া মধ্যাহ্নস্নান
  দুর্গদ্বারে আসিলা যখন-
বালাজি নমিয়া তাঁরে   দাঁড়াইল একধারে
  পদমূলে রাখিয়া লিখন।
গুরু কৌতূহলভরে   তুলিয়া লইলা করে,
  পড়িয়া দেখিলা পত্রখানি
বন্দি তাঁর পাদপদ্ম   শিবাজি সঁপিছে অদ্য
  তাঁরে নিজ রাজ্য-রাজধানী।


পর দিনে রামদাস   গেলেন রাজার পাশ,
  কহিলেন, “পুত্র কহ শুনি
রাজ্য যদি মােরে দেবে   কি কাজে লাগিবে এবে
  কোন্ গুণ আছে তব, গুণী?”

"তােমারি দাসত্বে প্রাণ   আনন্দে করিব দান”
  শিবাজি কহিলা নমি তাঁরে,—
গুরু কহে—“এই ঝুলি   লহ তবে স্কন্ধে তুলি।
  চল আজি ভিক্ষা করিবারে।”


শিবাজি গুরুর সাথে   ভিক্ষাপাত্র লয়ে হাতে
  ফিরিলেন পুরদ্বারে দ্বারে।
নৃপে হেরি ছেলে মেয়ে   ভয়ে ঘরে যায় ধেয়ে
  ডেকে আনে পিতারে মাতারে।

অতুল ঐশ্বর্য্যে রত,   তার ভিখারীর ব্রত!
  এ যে দেখি জলে ভাসে শিলা!
ভিক্ষা দেয় লজ্জাভরে,   হস্ত কাঁপে থরথরে,
  ভাবে, ইহা মহতের লীলা।


দুর্গে দ্বিপ্রহর বাজে,   ক্ষান্ত দিয়া কর্ম্মকাজে
  বিশ্রাম করিছে পুরবাসী।
একতারে দিয়ে তান   রামদাস গাহে গান
  আনন্দনয়নজলে ভাসি;—
“ওহে ত্রিভুবনপতি   বুঝি না তােমার মতি,
  কিছু ত অভাব তব নাহি,
হৃদয়ে হৃদয়ে তবু   ভিক্ষা মাগি ফির প্রভু
  সবার সর্ব্বস্বধন চাহি।”


অবশেষে দিবসান্তে   নগরের এক প্রান্তে
  নদীকূলে সন্ধ্যাস্নান সারি-
ভিক্ষা অন্ন রাঁধি সুখে  গুরু কিছু দিলা মুখে
  প্রসাদ পাইল শিষ্য তাঁরি।
রাজা তবে কহে হাসি   “নৃপতির গর্ব্ব নাশি
  করিয়াছ পথের ভিক্ষুক;
প্রস্তুত রয়েছে দাস,—   আরো কিবা অভিলাষ,
  গুরু কাছে লব গুরু দুখ।”

গুরু কহে “তবে শােন্,   করিলি কঠিন পণ
  অনুরূপ নিতে হবে ভার,
এই আমি দিমু কয়ে   মাের নামে মাের হয়ে
  রাজ্য তুমি লহ পুনর্ব্বার।
তোমারে করিল বিধি   ভিক্ষুকের প্রতিনিধি,
  রাজ্যেশ্বর দীন উদাসীন;
পালিবে যে রাজধর্ম্ম   জেনো তাহা মাের কর্ম্ম,
  রাজ্য লয়ে রবে রাজ্যহীন।—


বৎস, তবে এই সহ  মাের আশীর্ব্বাদসহ
  আমার গেরুয়া গাত্রবাস;
বৈরাগীর উত্তরীয়  পতাকা করিয়া নিয়ো”
  কহিলেন গুরু রামদাস।
নৃপশিষ্য নতশিরে  বসি রহে নদীতীরে,
  চিন্তারাশি ঘনায় ললাটে।
খামিল রাখাল-বেণু,   গােঠে ফিরে গেল ধেনু
  পরপারে সূর্য গেল পাটে।


পূরবীতে ধরি তান  একমনে রচি গান
  গাহিতে লাগিলা রামদাস,—
“আমারে রাজার সাজে   বসায়ে সংসার মাঝে
  কে তুমি আড়ালে কর বাস!

হে রাজা রেখেছি আনি   তােমারি পাদুকাখানি,
  আমি থাকি পাদপীঠতলে;
সন্ধ্যা হয়ে এল ওই,   আর কত বসে রই!
  তব রাজ্যে তুমি এস চলে।”[]

৬ই কার্তিক, ১৩০৪


  1. অ্যাকওয়ার্থ সাহেব কয়েকটি মারাঠী গাথার যে ইংরাজি অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশ করিয়াছেন, তাহারই ভূমিকা হইতে বর্ণিত ঘটনা গৃহীত। শিবাজির গেরুয়া পতাকা “ভাগোয়া জেন্দা” নামে খ্যাত।