কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/তৃতীয় খণ্ড/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

রাজনিকেতনে।

পত্নীভাবে আর তুমি ভেবো না আমারে।

বীরাঙ্গনা কাব্য।

মতি আগ্রায় উপনীতা হইলেন। আর তাঁহাকে মতি বলিবার আবশ্যক করে না। কয় দিনে তাঁহার চিত্তবৃত্তি সকল একেবারে পরিবর্ত্তিত হইয়াছিল।

 জাঁহাগীরের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল। জাঁহাগীর তাঁহাকে পূর্ব্ববৎ সমাদর করিয়া তাঁহার সহোদরের সম্বাদ ও পথের কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন। লুৎফ্-উন্নিসা যাহা মেহের-উন্নিসাকে বলিয়াছিলেন তাহা সত্য হইল। অন্যান্য প্রসঙ্গের পর বর্দ্ধমানের কথা শুনিয়া, জাঁহাগীর জিজ্ঞাসা করিলেন “মেহের-উন্নিসার নিকট দুই দিন ছিলে বলিতেছ, মেহের-উন্নিসা আমার কথা কি বলিল?”

 লুৎফ্-উন্নিসা অকপট হৃদয়ে মেহের-উন্নিসার অনুরাগের পরিচয় দিলেন। বাদসাহ শুনিয়া নীরবে রহিলেন; তাঁহার বিস্ফারিত লোচনে দুই এক বিন্দু অশ্রু বহিল।

 লুৎফ্-উন্নিসা কহিলেন, “জাঁহাপনা! দাসী শুভ সম্বাদ দিয়াছে। দাসীর এখনও কোন পুরস্কারের আদেশ হয় নাই।”

 বাদশাহ হাসিয়া কহিলেন, “বিবি! তোমার আকাঙ্ক্ষা অপরিমিত।”

 লু। “জাঁহাপনা, দাসীর কি দোষ?”

 বাদ। “দিল্লীর বাদশাহকে তোমার গোলাম করিয়া দিয়াছি; আরও পুরস্কার চাহিতেছ?”

 লুৎফ্-উন্নিসা হাসিয়া কহিলেন, “স্ত্রীলোকের অনেক সাধ।”

 বাদ। “আবার কি সাধ হইয়াছে?”

 লু। “আগে রাজাজ্ঞা হউক, যে দাসীর আবেদন গ্রাহ্য হইবে।”

 বাদ। “যদি রাজকার্য্যের বিঘ্ন না হয়।”

 লু। (হাসিয়া) “একের জন্য দিল্লীশ্বরের কার্য্যে বিঘ্ন হয় না।”

 বাদ। “তবে স্বীকৃত হইলাম;—সাধটী কি শুনি।”

 লু। “সাধ হইয়াছে একটী বিবাহ করিব।”

 জাঁহাগীর উচ্চহাস্য করিয়া উঠিলেন। কহিলেন, “এ নূতন তর সাধ বটে। কোথাও সম্বন্ধের স্থিরতা হইয়াছে?”

 লু। “তা হইয়াছে। কেবল রাজাজ্ঞার সাপেক্ষ। রাজার সম্মতি প্রকাশ না হইলে কোন সম্বন্ধ স্থির নহে।”

 বাদ। “আমার সম্মতির প্রয়োজন কি? কাহাকে এ সুখের সাগরে ভাসাইবে অভিপ্রায় করিয়াছ?”

 লু। “দাসী দিল্লীশ্বরের সেবা করিয়াছে বলিয়া দ্বিচারিণী নহে। দাসী আপন স্বামীকেই বিবাহ করিবার অনুমতি চাহিতেছে?”

 বাদ। “বটে। এ পুরাতন নফরের দশা কি করিবে?”

 লু। “দিল্লীশ্বরী মেহের-উন্নিসাকে দিয়া যাইব।”

 বাদ। “দিল্লীশ্বরী মেহের-উন্নিসা কে?”

 লু। “যিনি হইবেন।”

 জাঁহাগীর মনে ভাবিলেন যে মেহের-উন্নিসা যে নিশ্চিত দিল্লীশ্বরী হইবেন তাহা, লুৎফ্-উন্নিসা ধ্রুব জানিয়াছেন। তৎকারণে নিজ মনোভিলাষ বিফল হইল বলিয়া রাজাবরোধ হইতে বীতরাগে অবসর হইতে চাহিতেছেন।

 এইরূপ বুঝিয়া জাঁহাগীর দুঃখিত হইয়া নীরবে রহিলেন। লুৎফ্-উন্নিসা কহিলেন,

 “মহারাজের কি এ সম্বন্ধে সম্মতি নাই?”

 বাদ। “আমার অসম্মতি নাই। কিন্তু স্বামীর সহিত আবার বিবাহের আবশ্যকতা কি?”

 লু। “কপালক্রমে প্রথম বিবাহে স্বামী পত্নী বলিয়া গ্রহণ করিলেন না। এক্ষণে জাঁহাপনার প্রসাদ ত্যাগ করিতে পারিবেন না।”

 বাদশাহ রহস্যে হাস্য করিয়া পরে গম্ভীর হইলেন।

 কহিলেন, “প্রেয়সি! তোমাকে আমার অদেয় কিছুই নাই। তোমার যদি সেই প্রবৃত্তি হয়, তবে তদ্রূপই কর। কিন্তু আমাকে কেন ত্যাগ করিয়া যাইবে? এক আকাশে কি চন্দ্র সূর্য্য উভয়েই বিরাজ করেন না? এক বৃন্তে কি দুটী ফুল ফুটে না?”

 লুৎফ্-উন্নিসা বিস্ফারিত চক্ষে বাদশাহের প্রতি দৃষ্টি করিয়া কহিলেন, “ক্ষুদ্র ফুল ফুটিয়া থাকে, কিন্তু এক মৃণালে দুইটি কমল ফুটে না। আপনার রত্নসিংহাসনতলে কেন কণ্টক হইয়া থাকিব?

 লুৎফ্-উন্নিসা আত্মমন্দিরে প্রস্থান করিলেন। তাঁহার এইরূপ মনোবাঞ্ছা যে কেন জন্মিল তাহা তিনি জাঁহাগীরের নিকট ব্যক্ত করেন নাই। অনুভবে যেরূপ বুঝা যাইতে পারে জাহাগীর সেইরূপ বুঝিয়া ক্ষান্ত হইলেন। নিগূঢ় তত্ত্ব কিছুই জানিলেন না। লুৎফ্-উন্নিসার হৃদয় পাষাণ। সেলিমের রমণীহৃদয়জিৎ রাজকান্তিও কখন তাঁহার মনঃ মুগ্ধ করে নাই। কিন্তু এই বার পাষাণমধ্যে কীট প্রবেশ করিয়াছিল।