কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/দ্বিতীয় খণ্ড/প্রথম পরিচ্ছেদ

কপালকুণ্ডলা।

দ্বিতীয় খণ্ড।

প্রথম পরিচ্ছেদ।


রাজপথে।

—————— There——now lean on me;
Place your foot here.——————

Manfred.

কোন জর্ম্মান লেখক বলিয়াছেন “মনুষ্যের জীবন কাব্যবিশেষ।” কপালকুণ্ডলার জীবনকাব্যের এক সর্গ সমাপ্ত হইল। পরে কি হইবে?

 যদি ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে মনুষ্য অন্ধ না হইত, তবে সংসার যাত্রা একেবারে সুখহীন হইত। ভাবী বিপদের সম্ভাবনা নিশ্চিত দেখিতে পাইয়া, কোন সুখেই কেহ প্রবৃত্ত হইত না। মিল্‌টন যদি জানিতেন তিনি অন্ধ হইবেন, তবে কখন বিদ্যাভ্যাস করিতেন না; শাহাজাহান যদি জানিতেন ঔরঙ্গজেব তাঁহাকে প্রাচীন বয়সে করাবদ্ধ রাখিবেন, তবে তিনি কখন দিল্লীর সিংহাসন স্পর্শ করিতেন না। ভাস্করাচার্য্য যদি জানিতেন যে, তাঁহার একমাত্র কন্যা চিরবিধবা হইবে, তবে তিনি কখন দারপরিগ্রহ করিতেন না। নবকুমার বা তাঁহার নূতন পত্নী যদি জানিতেন, যে তাঁহাদিগের বিবাহে কি ফলোৎপত্তি হইবে, তবে কখন তাঁহাদিগের বিবাহ হইত না।

 নবকুমার মেদিনীপুরে আসিয়া অধিকারীর দানকৃত ধনবলে কপালকুণ্ডলার জন্য এক জন দাসী, এক জন রক্ষক ও শিবিকাবাহক নিযুক্ত করিয়া, তাঁহাকে শিবিকারোহণে পাঠাইলেন। অর্থের অপ্রাচুর্য্য হেতুক স্বয়ং পদব্রজে চলিলেন। নবকুমার পূর্ব্ব দিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত ছিলেন, মধ্যাহ্ন ভোজনের পর বাহকেরা তাঁহাকে অনেক পশ্চাৎ করিয়া গেল। ক্রমে সন্ধ্যা হইল। শীত কালের অনিবিড় মেঘে আকাশ আচ্ছন্ন হইয়াছে। সন্ধ্যাও অতীত হইল। পৃথিবী অন্ধকারময়ী হইল। অল্প অল্প বৃষ্টিও পড়িতে লাগিল। নবকুমার কপালকুণ্ডলার সহিত একত্র হইবার জন্য ব্যস্ত হইলেন। মনে মনে স্থির জ্ঞান ছিল, যে প্রথম সরাইতে তাঁহার সাক্ষাৎ পাইবেন, কিন্তু সরাইও আপাততঃ দেখা যায় না। প্রায় রাত্রি চারি ছয় দণ্ড হইল। নবকুমার দ্রুত পাদ বিক্ষেপ করিতে করিতে চলিলেন। অকস্মাৎ কোন কঠিন দ্রব্যে তাঁহার চরণ স্পর্শ হুইল। পদভরে সে বস্তু খড় খড় মড় মড় শব্দে ভাঙ্গিয়া গেল। নবকুমার দাঁড়াইলেন; পুনর্ব্বার পদ চালনা করিলেন; পুনর্ব্বার ঐরূপ হইল। পদসৃষ্ট বস্তু হস্তে করিয়া তুলিয়া লইলেন। দেখিলেন, ঐ বস্তু তক্তাভাঙ্গার মত।

 আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হইলেও সচরাচর এমত অন্ধকার হয় না যে অনারত স্থানে স্থূল বস্তুর অবয়ব লক্ষ্য হয় না। সম্মুখে একটা বৃহৎ বস্তু পড়িয়াছিল; নবকুমার অনুভব করিয়া দেখিলেন যে সে ভগ্ন শিবিকা; অমনি তাঁহার হৃদয়ে কপালকুণ্ডলার বিপদ্ আশঙ্কা হইল। শিবিকার দিকে যাইতে আবার ভিন্ন প্রকার পদার্থে তাঁহার পদস্পর্শ হইল। এ স্পর্শ কোমল মনুষ্যশরীরস্পর্শের ন্যায় বোধ হইল। বসিয়া হস্ত মর্দ্দন করিয়া দেখিলেন, মনুষ্যশরীর বটে। স্পর্শ অত্যন্ত শীতল; তৎসঙ্গে দ্রব পদার্থের স্পর্শ অনুভূত হইল। নাড়ীতে হাত দিয়া দেখিলেন, স্পন্দ নাই, প্রাণবিয়োগ হইয়াছে। বিশেষ মনঃসংযোগ করিয়া দেখিলেন, যেন নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনা যাইতেছে। নিঃশ্বাস আছে তবে নাড়ী নাই কেন? এ কি রোগী? নাসিকার নিকট হাত দিয়া দেখিলেন, নিশ্বাস বহিতেছে না। তবে শব্দ কেন? হয়ত কোন জীবিত ব্যক্তিও এখানে আছে। এই ভাবিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “এখানে কেহ জীবিত ব্যক্তি আছে?”

 মৃদুস্বরে এক উত্তর হইল “আছি।”

 নবকুমার কহিলেন, “কে তুমি?”

 উত্তর হইল “তুমি কে?” নবকুমারের কর্ণে স্বর স্ত্রীকণ্ঠজাত বোধ হইল। ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “কপালকুণ্ডলা না কি?”

 স্ত্রীলোক কহিল, “কপালকুণ্ডলা কে তা জানি না—আমি পথিক, আপাততঃ দস্যূহস্তে নিষ্কুণ্ডলা হইয়াছি।”

 ব্যঙ্গ শুনিয়া নবকুমার ঈষৎ প্রসন্ন হইলেন। জিজ্ঞাসিলেন “কি হইয়াছে?”

 উত্তরকারিণী কহিলেন, “দস্যুতে আমার পালকি ভাঙ্গিয়া দিয়াছে, আমার এক জন বাহককে মারিয়া ফেলিয়াছে; আর সকলে পলাইয়া গিয়াছে। দস্যুরা আমার অঙ্গের অলঙ্কার সকল লইয়া আমাকে পাল্‌কিতে বান্ধিয়া রাখিয়া গিয়াছে।”

 নবকুমার অন্ধকারে অনুধাবন করিয়া দেখিলেন, যথার্থই একটী স্ত্রলোক শিবিকাতে বস্ত্র দ্বারা দৃঢ়তর বন্ধনযুক্ত আছে। নবকুমার শীঘ্রহস্তে তাহার বন্ধন মোচন করিয়া কহিলেন, “তুমি উঠিতে পারিবে কি?” স্ত্রীলোক কহিল, “আমাকেও এক ঘা লাঠি লাগিয়াছিল; এজন্য পায়ে বেদনা আছে; কিন্তু বোধ হয় অল্প সাহায্য করিলে উঠিতে পারিব।”

 নবকুমার হস্ত বাড়াইয়া দিলেন। রমণী তৎ‍সাহায্যে গাত্রোত্থান করিলেন। নবকুমার জিজ্ঞাসা করিলেন, “চলিতে পারিবে কি?”

 স্ত্রীলোক উত্তর না করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার পশ্চাতে কেহ পথিক আসিতেছে দেখিয়াছেন?”

 নবকুমার কহিলেন “না।”

 স্ত্রীলোক পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলেন, “চটী কত দূর?”

 নবকুমার কহিলেন “কত দূর বলিতে পারি না—কিন্তু বোধ হয় নিকট।”

 স্ত্রীলোক কহিল, “অন্ধকারে একাকিনী মাঠে বসিয়া কি করিব, আপনার সঙ্গে চটী পর্য্যন্ত যাওয়াই উচিত। বোধ হয়, কোন কিছুর উপর ভর করিতে পারিলে, চলিতে পারিব।”

 নবকুমার কহিলেন, “বিপৎকালে সঙ্কোচ মূঢ়ের কাজ। আমার কাঁধে ভর করিয়া চল।”

 স্ত্রীলোকটী মূঢ়ের কার্য্য করিল না। নবকুমারের স্কন্ধেই ভর করিয়া চলিল।”

 যথার্থই চটী নিকটে ছিল। এ সকল কালে চটীর নিকটেও দুষ্ক্রিয়া করিতে দস্যুরা সঙ্কোচ করিত না। অনধিক বিলম্বে নবকুমার সমভিব্যাহারিণীকে লইয়া তথায় উপনীত হইলেন।

 নবকুমার দেখিলেন যে ঐ চটীতেই কপালকুণ্ডলা অবস্থিতি করিতেছিলেন। তাঁহার দাস দাসী তজ্জন্য এক খানা ঘর নিযুক্ত করিয়াছিল। নবকুমার স্বীয় সঙ্গিনীর জন্য তৎপার্শ্ববর্ত্তী এক খানা ঘর নিযুক্ত করিয়া তাঁহাকে তন্মধ্যে প্রবেশ করাইলেন। তাঁহার আজ্ঞামত গৃহস্বামীর বনিতা প্রদীপ জ্বালিয়া আনিল। যখন দীপরশ্মিস্রোতঃ তাঁহার সঙ্গিনীর শরীরে পড়িল, তখন নবকুমার দেখিলেন যে ইনি অসামান্যা সুন্দরী। রূপরাশিতরঙ্গে, তাঁহার যৌবনশোভা, শ্রাবণের নদীর ন্যায় উছলিয়া পড়িতেছিল।