কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/প্রথম খণ্ড/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

স্তূপশিখরে।

——————“সবিস্ময়ে দেখিলা অদূরে,
ভীষণ-দর্শন—মূর্ত্তি।”

মেঘনাদবধ।

যখন নবকুমারের নিদ্রাভঙ্গ হইল, তখন রজনী গভীরা। এখনও যে তাঁহাকে ব্যাঘ্রে হত্যা করে নাই, ইহা তাঁহার আশ্চর্য্য বোধ হইল। ইতস্ততঃ নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতে লাগিলেন ব্যাঘ্র আসিতেছে কি না। অকস্মাৎ সম্মুখে, বহু দূরে, একটা আলোক দেখিতে পাইলেন। পাছে ভ্রম জন্মিয়া থাকে, এজন্য নবকুমার মনোভিনিবেশ পূর্ব্বক তৎপ্রতি দৃষ্টি করিতে লাগিলেন। আলোকপরিধি ক্রমে বর্দ্ধিতায়তন এবং উজ্জ্বলতর হইতে লাগিল—আগ্নেয় আলোক বলিয়া প্রতীতি জন্মাইল। প্রতীতি মাত্র নবকুমারের জীবনাশা পুনৰুদ্দীপ্ত হইল। মনুষ্য সমাগম ব্যতীত এ আলোকের উৎপত্তি সম্ভবে না। নবকুমার গাত্রোত্থান করিলেন। যথায় আলোক, সেই দিকে ধাবিত হইলেন। একবার মনে ভাবিলেন, “এ আলোক ভৌতিক?—হইতেও পারে, কিন্তু শঙ্কায় নিরস্ত থাকিলেই কোন্ জীবন রক্ষা হয়?” এই ভাবিয়া নির্ভীকচিত্তে আলোক লক্ষ্য করিয়া চলিলেন। বৃক্ষ, লতা, বালুকাস্তূপ পদে পদে তাঁহার গতিরোধ করিতে লাগিল। বৃক্ষলতা দলিত করিয়া, বালুকাস্তূপ লঙ্ঘিত করিয়া নবকুমার চলিলেন। আলোকের নিকটবর্ত্তী হইয়া দেখিলেন, যে এক অত্যুচ্চ বালুকাস্তূপের শিরোভাগে অগ্নি জ্বলিতেছে, তৎপ্রভায় শিখরাসীন মনুষ্যমূর্ত্তি আকাশপটস্থ চিত্রের ন্যায় দেখা যাইতেছে। নবকুমার শিখরাসীন মনুষ্যের সমীপবর্ত্তী হইবেন স্থিরসঙ্কল্প করিয়া, অশিথিলীকৃত বেগে চলিলেন। পরিশেষে স্তূপারোহণ করিতে লাগিলেন। তখন কিঞ্চিৎ শঙ্কা হইতে লাগিল—তথাপি অকম্পিত পদে স্তপারোহণ করিতে লাগিলেন। আসীন ব্যক্তির সম্মুখবর্ত্তী হইয়া যাহা যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহার রোমাঞ্চ হইল। তিষ্ঠিবেন কি প্রত্যাবর্ত্তন করিবেন তাহা স্থির করিতে পারিলেন না।

 শিখরাসীন মনুষ্য নয়ন মুদিত করিয়া ধ্যান করিতেছিল—নবকুমারকে প্রথম দেখিতে পাইল না। নবকুমার দেখিলেন তাহার বয়ঃক্রম প্রায় পঞ্চাশৎ বৎসর হইবেক। পরিধানে কোন কার্পাসবস্ত্র আছে কি না তাহা লক্ষ্য হইল না; কটিদেশ হইতে জানু পর্য্যন্ত শার্দ্দূলচর্ম্মে আবৃত। গলদেশে ৰুদ্রাক্ষমালা; আয়ত মুখমণ্ডল শ্মশ্রুজটা পরিবেষ্টিত। সম্মুখে কাষ্ঠে অগ্নি জ্বলিতেছিল—সেই অগ্নির দীপ্তি লক্ষ্য করিয়া নবকুমার সে স্থলে আসিতে পারিয়া ছিলেন। নবকুমার একটা বিকট দুর্গন্ধ পাইতে লাগিলেন; ইহার আসন প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া তাহার কারণ অনুভূত করিতে পারিলেন। জটাধারী এক ছিন্ন-শীর্ষ গলিত শবের উপর বসিয়া আছেন। আরও সভয়ে দেখিলেন যে সম্মুখে নরকপাল রহিয়াছে; তন্মধ্যে রক্তবর্ণ দ্রব পদার্থ রহিয়াছে। চতুর্দ্দিকে স্থানে স্থানে অস্থি পড়িয়া রহিয়াছে—এমন কি যোগাসীনের কণ্ঠস্থ ৰুদ্রাক্ষমালা মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অস্থিখণ্ড গ্রথিত রহিয়াছে। নবকুমার মন্ত্রমুগ্ধ হইয়া রহিলেন। অগ্রসর হইবেন কি স্থানত্যাগ করিবেন তাহা বুঝিতে পারিলেন না। তিনি কাপালিকদিগের কথা শ্রুত ছিলেন। বুঝিলেন, যে এ ব্যক্তি দুরন্ত কাপালিক।

 যখন নবকুমার উপনীত হইয়াছিলেন, তখন কাপালিক মন্ত্র সাধনে বা জপে বা ধ্যানে মগ্ন ছিলেন, নবকুমারকে দেখিয়া ভ্রূক্ষেপও করিলেন না। অনেক ক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করিলেন “কস্ত্বং” নবকুমার কহিলেন “ব্রাহ্মণ”।

 কাপালিক কহিল “তিষ্ঠ” এই কহিয়া পূর্ব্বকার্য্যে নিযুক্ত হইল। নবকুমার দাঁড়াইয়া রহিলেন।

 এই রূপে প্রহরার্দ্ধ গত হইল। পরিশেষে কাপালিক গাত্রোত্থান করিয়া নবকুমারকে পূর্ব্ববৎ সংস্কৃতে কহিল “মামনুসর।”

 ইহা নিশ্চিত বলা যাইতে পারে যে অন্য সময়ে নবকুমার কদাপি ইহার সঙ্গী হইতেন না। কিন্তু এক্ষণে ক্ষুধা তৃষ্ণায় প্রাণ কণ্ঠাগত। অতএব কহিলেন, “প্রভুর যেমত আজ্ঞা। কিন্তু আমি ক্ষুধা তৃষ্ণায় বড় কাতর। কোথায় গেলে আহার্য্য সামগ্রী পাইব অনুমতি কৰুন।”

 কাপালিক কহিল, “তুমি ভৈরবীর প্রেরিত; আমার সঙ্গে আইস। আহার্য্যসামগ্রী পাইতে পারিবে।”

 নবকুমার কাপালিকের অনুগামী হইলেন। উভয়ে অনেক পথ বাহিত করিলেন—পথিমধ্যে কেহ কোন কথা কহিল না। পরিশেষে এক পর্ণকুটীর প্রাপ্ত হইল—কাপালিক প্রথমে প্রবেশ করিয়া নবকুমারকে প্রবেশ করিতে অনুমতি করিল। এবং নবকুমারের অবোধগম্য কোন উপায়ে এক খণ্ড কাষ্ঠে অগ্নি জ্বালিত করিল। নবকুমার তদালোকে দেখিলেন যে ঐ কুটীর সর্ব্বাংশে কিয়াপাতায় রচিত। তন্মধ্যে কয়েক খানা ব্যাঘ্রচর্ম্ম আছে—এক কলস বারি ও কিছু ফল মূল আছে।

 কাপালিক অগ্নি জ্বালিত করিয়া কহিল “ফল মূল যাহা আছে আত্মসাৎ করিতে পার। পর্ণপাত্র রচনা করিয়া কলস-জল পান করিও। ব্যাঘ্রচর্ম্ম আছে অভিৰুচি হইলে শয়ন করিও। নির্ব্বিঘ্নে তিষ্ঠ—ব্যাঘ্রের ভয় করিও না। সময়ান্তরে আমার সহিত সাক্ষাৎ হইবে। যে পর্য্যন্ত সাক্ষাৎ না হয়, সে পর্য্যন্ত এ কুটীর ত্যাগ করিও না।”

 এই বলিয়া কাপালিক প্রস্থান করিল। নবকুমার সেই সামান্য ফল মূল আহার করিয়া এবং সেই ঈর্ষাত্তক্ত জলপান করিয়া পরম পরিতোষ লাভ করিলেন। পরে ব্যাঘ্রচর্ম্মে শয়ন করিলেন, সমস্ত দিবস জনিত ক্লেশ হেতু শীঘ্রই নিদ্রাভিভূত হইলেন।