কপালকুণ্ডলা (১৮৭০)/প্রথম খণ্ড/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।


কাপালিকসঙ্গে।

“কথং নিগড়সংযতাসি দ্রুতম্
নয়ামি ভবতীমিতঃ”——————

রত্নাবলী

নবকুমার কুটীরমধ্যে প্রবেশ করিয়া দ্বার সংযোজন পূর্ব্বক করতলে মস্তক দিয়া বসিলেন। শীঘ্র আর মস্তকোত্তোলন করিলেন না।

 “এ কি দেবী—মানুষী—না কাপালিকের মায়া মাত্র!” নবকুমার নিস্পন্দ হইয়া হৃদয় মধ্যে এই কথার আন্দোলন করিতে লাগিলেন। কিছুই বুঝিতে পারিলেন না।

 অন্যমনস্ক ছিলেন বলিয়া, নবকুমার আর একটী ব্যাপার দেখিতে পান নাই। সেই কুটীর মধ্যে তাঁহার আগমন পূর্ব্বাবধি এক খানি কাষ্ঠ জ্বলিতেছিল। পরে যখন অনেক রাত্রে স্মরণ হইল যে সায়াহ্নকৃত্য অসমাপ্ত রহিয়াছে—তখন জলান্বেষণ অনুরোধে চিন্তা হইতে ক্ষান্ত হইয়া এ বিষয়ের অসম্ভাবিতা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিলেন। শুধু আলো নহে, তণ্ডুলাদিপাকোপযোগী কিছু কিছু সামগ্রীও আছে। নবকুমার বিস্মৃত হইলেন না—মনে করিলেন যে এও কাপালিকের কর্ম্ম—এ স্থানে বিস্ময়ের বিষয় কি আছে।

 “শস্যঞ্চ গৃহমাগতং” মন্দ কথা নহে। “ভোজ্যঞ্চ উদরাগতং” বলিলে আরও স্পষ্ট হয়। নবকুমার এ কথার মাহাত্ম্য না বুঝিতেন এমত নহে। সায়ংকৃত্য সমাপনান্তে তণ্ডুল গুলিন কুটীর মধ্যে প্রাপ্ত এক মৃৎপাত্রে সিদ্ধ করিয়া আত্মসাৎ করিলেন।

 পরদিন প্রভাতে চর্ম্মশয্যা হইতে গাত্রোত্থান করিয়াই সমুদ্রতীরাভিমুখে চলিলেন। পূর্ব্বদিনের যাতায়াতের গুণে অদ্য অল্প কষ্টে পথ অনুভূত করিতে পারিলেন। তথায় প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিয়া প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। কাহার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন? পূর্ব্বদৃষ্টা মায়াবিনী পুনর্ব্বার সে স্থলে যে আসিবেন—এমত আশা নবকুমারের হৃদয়ে কত দূর প্রবল হইয়াছিল বলিতে পারি না—কিন্তু সে স্থান তিনি ত্যাগ করিতে পারিলেন না। অনেক বেলাতেও তথায় কেহ আসিল না। তখন নবকুমার সে স্থানের চারি দিকে ভ্রমিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। বৃথা অন্বেষণ মাত্র। মনুষ্য সমাগমের চিহ্নমাত্র দেখিতে পাইলেন না। পুনর্ব্বার ফিরিয়া আসিয়া সেই স্থানে উপবেশন করিলেন। সূর্য্য অস্তগত হইল; অন্ধকার হইয়া আসিতে লাগিল। নবকুমার হতাশ হইয়া কুটীরে ফিরিয়া আসিলেন। সায়াহ্নকালে সমুদ্রতীর হইতে প্রত্যাগমন করিয়া নবকুমার দেখিলেন যে কাপালিক কুটীর মধ্যে ধরাতলে উপবেশন করিয়া নিঃশব্দে আছে। নবকুমার প্রথমে স্বাগত জিজ্ঞাসা করিলেন; তাহাতে কাপালিক কোন উত্তর করিল না।

 নবকুমার কহিলেন, “এ পর্য্যন্ত প্রভুর দর্শনে কি জন্য বঞ্চিত ছিলাম?” কাপালিক কহিল, “নিজব্রতে নিযুক্ত ছিলাম।”

 নবকুমার গৃহ গমনাভিলাষ ব্যক্ত করিলেন। কহিলেন “পথ অবগত নহি—পাথেয় নাই; যদ্বিহিত বিধান প্রভুর সাক্ষাৎ লাভ হইলে হইতে পারিবে এই ভরসায় আছি।”

 কাপালিক কেবল মাত্র কহিল “আমার সঙ্গে আগমন কর।” এই বলিয়া উদাসীন গাত্রোত্থান করিলেন। বাটী যাইবার কোন সদুপায় হইতে পারিবেক প্রত্যাশায় নবকুমারও তাহার পশ্চাদ্বর্ত্তী হইলেন।

 তখনও সন্ধ্যালোক অন্তর্হিত হয় নাই—কাপালিক অগ্রে অগ্রে, নবকুমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতেছিলেন। অকস্মাৎ নবকুমারের পৃষ্ঠদেশে কাহার কোমল করস্পর্শ হইল। পশ্চাৎ ফিরিয়া যাহা দেখিলেন তাহাতে স্পন্দহীন হইলেন। সেই আগুল্‌ফলম্বিত-নিবিড়কেশরাশি-ধারিণী বন্যদেবীমূর্ত্তি! পূর্ব্ববৎ নিঃশব্দ; নিস্পন্দ। কোথা হইতে এ মূর্ত্তি অকস্মাৎ তাঁহার পশ্চাতে আসিল? নবকুমার দেখিলেন, রমণী মুখে অঙ্গুলি প্রদান করিয়াছে। নবকুমার বুঝিলেন যে রমণী বাক্যস্ফূর্ত্তি নিষেধ করিতেছে। নিষেধের বড় প্রয়োজনও ছিল না। নবকুমার কি কথা কহিবেন? তিনি তথায় চমৎকৃত হইয়া দাঁড়াইলেন। কাপালিক এ সকল কিছুই দেখিতে পাইল না, অগ্রসর হইয়া চলিয়া গেল। তাঁহারা উদাসীনের শ্রবণাতিক্রান্ত হইলে রমণী মৃদুস্বরে কি কথা কহিল। নবকুমারের কর্ণে এই শব্দ প্রবেশ করিল,

 “কোথা যাইতেছ? যাইও না। ফিরিয়া যাও—পলায়ন কর।”

 এই কথা সমাপ্ত করিয়াই উক্তিকারিণী সরিয়া গেলেন, প্রত্যুত্তর শুনিবার জন্য তিষ্ঠিলেন না। নবকুমার কিয়ৎকাল অভিভূতের ন্যায় দাঁড়াইলেন; পশ্চাদ্বর্ত্তী হইতে ব্যগ্র হইলেন, কিন্তু রমণী কোন্ দিকে গেল তাহার কিছুই স্থিরতা পাইলেন না। মনে করিতে লাগিলেন—“এ কাহারও মায়া? না আমারই ভ্রম হইতেছে? যে কথা শুনিলাম—সেত আশঙ্কাসূচক; কিন্তু কিসের আশঙ্কা? তান্ত্রিকেরা সকলই করিতে পারে। তবে কি পলাইব? কোথায় পলাইবার স্থান আছে?”

 নবকুমার এই রূপ চিন্তা করিতেছিলেন, এমত সময়ে দেখিলেন কাপালিক তাঁহাকে সঙ্গে না দেখিয়া প্রত্যাবর্ত্তন করিতেছে। কাপালিক কহিল, “বিলম্ব করিতেছ কেন?”

 যখন লোকে ইতিকর্ত্তব্য স্থির না করিতে পারে, তখন তাহাদিগকে যে দিকে প্রথম আহূত করা যায়, সেই দিকেই প্রবৃত্ত হয়। কাপালিক পুনরাহ্বান করাতে বিনা বাক্য ব্যয়ে নবকুমার তাঁহার পশ্চাদ্বর্ত্তী হইলেন।

 কিয়দ্দূর গমন করিয়া সম্মুখে এক মৃৎপ্রাচীরবিশিষ্ট কুটীর দেখিতে পাইলেন। তাহাকে কুটীরও বলা যাইতে পারে, ক্ষুদ্র গৃহও বলা যাইতে পারে। কিন্তু ইহাতে আমাদিগের কোন প্রয়োজন নাই। ইহার পশ্চাতেই সিকতাময় সমুদ্রতীর। গৃহপার্শ্ব দিয়া কাপালিক নবকুমারকে সেই সৈকতে লইয়া চলিলেন; এমত সময়ে তীরের তুল্য বেগে পূর্ব্বদৃষ্টা রমণী তাঁহার পার্শ্ব দিয়া চলিয়া গেল। গমন কালে তাঁহার কর্ণে বলিয়া গেল “এখনও পলাও। নরমাংস নহিলে তান্ত্রিকের পূজা হয় না তুমি কি জান না?”

 নবকুমারের কপালে স্বেদবিগম হইতে লাগিল। দুর্ভাগ্যবশতঃ যুবতীর এই কথা কাপালিকের কর্ণে গেল। সে কহিল, “কপালকুণ্ডলে!”

 স্বর নবকুমারের কর্ণে মেঘগর্জনবৎ ধ্বনিত হইল। কিন্তু কপালকুণ্ডলা কোন উত্তর দিল না।

 কাপালিক নবকুমারের হস্তধারণ করিয়া লইয়া যাইতে লাগিল। মানুষঘাতী করস্পর্শে নবকুমারের শোণিত ধমনীমধ্যে শতগুণ বেগে প্রধাবিত হইল—লুপ্তসাহস পুনর্ব্বার আসিল। কহিলেন, “হস্ত ত্যাগ কৰুন।”

 কাপালিক উত্তর করিল না। নবকুমার পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমায় কোথায় লইয়া যাইতেছেন?”

 কাপালিক কহিল “পূজার স্থানে।”

 নবকুমার কহিলেন “কেন?”

 কাপালিক কহিল “বধার্থ।”

 অতিতীব্রবেগে নবকুমার নিজহস্ত টানিলেন। যে বলে তিনি হস্ত আকর্ষিত করিয়াছিলেন, সচরাচর লোকে হস্তরক্ষা করা দূরে থাকুক—বেগে ভূপতিত হইত। কিন্তু কাপালিকের অঙ্গমাত্রও হেলিল না;—নবকুমারের প্রকোষ্ঠ তাহার হস্তমধ্যেই রহিল। নবকুমারের অস্থিগ্রন্থি সকল যেন ভগ্ন হইয়া গেল। মুমূর্ষুর ন্যায় কাপালিকের সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন।

 সৈকতের মধ্যস্থানে নীত হইয়া নবকুমার দেখিলেন পূর্ব্ব দিনের ন্যায় তথায় বৃহৎকাষ্ঠে অগ্নি জ্বলিতেছে। চতুঃপার্শ্বে তান্ত্রিকপূজার আয়োজন রহিয়াছে, তন্মধ্যে নরকপালপূর্ণ আসব রহিয়াছে—কিন্তু শব নাই। অনুমান করিলেন তাঁহাকেই শব হইতে হইবে।

 কতকগুলিন শুষ্ক কঠিন লতাগুল্ম তথায় পূর্ব্বেই আহরিত ছিল। কাপালিক তদ্দ্বারা নবকুমারকে দৃঢ়তর বন্ধন করিতে আরম্ভ করিলেন। নবকুমার সাধ্যমত বলপ্রকাশ করিলেন। কিন্তু বলপ্রকাশ কিছুমাত্র ফলদায়ক হইল না। তাহার প্রতীতি হইল যে এ বয়সেও কাপালিক মত্ত হস্তীর বল ধারণ করে। নবকুমারের বল প্রকাশ দেখিয়া কাপালিক কহিল।

 “মূর্খ! কি জন্য বলপ্রকাশ কর! তোমার জন্ম আজি সার্থক হইল। ভৈরবীর পূজায় তোমার এই মাংস পিণ্ড অর্পিত হইবেক, ইহার অধিক তোমার তুল্য লোকের আর কি সৌভাগ্য হইতে পারে?”

 কাপালিক নবকুমারকে দৃঢ়তর বন্ধন করিয়া সৈকতোপরি ফেলিয়া রাখিলেন। এবং বধের প্রাক্কালিক পূজাদি ক্রিয়ায় ব্যাপৃত হইলেন।

 শুষ্ক লতা অতি কঠিন—বন্ধন অতিদৃঢ়—মৃত্যু আসন্ন! নবকুমার ইষ্টদেবচরণে চিত্ত নিবিষ্ট করিলেন। এক বার জন্মভূমি মনে পড়িল; নিজ সুখের আলয় মনে পড়িল, এক বার বহুদিন অন্তর্হিত জনক এবং জননীর মুখ মনে পড়িল, দুই এক বিন্দু অশ্রুজল সৈকত বালুকায় শুষিয়া গেল। কাপালিক বলির প্রাক্‌কালিক ক্রিয়া সমাপনাস্তে বধার্থ খড়্গ লইবার জন্য আসন ত্যাগ করিয়া উঠিল। কিন্তু যথায় খড়্গরক্ষণ করিয়াছিল তথায় খড়্গ পাইল না। আশ্চর্য্য! কাপালিক কিছু বিস্মিত হইল। তাহার নিশ্চিত স্মরণ ছিল যে অপরাহ্নে খড়্গ আনিয়া উপযুক্ত স্থানে রাখিয়া ছিল এবং স্থানান্তরও করে নাই, তবে খড়্গ কোথায় গেল? কাপালিক ইতস্ততঃ অনুসন্ধান করিল। কোথাও পাইল না। তখন পূর্ব্ব কথিত কুটীরাভিমুখ হইয়া কপালকুণ্ডলাকে ডাকিল; কিন্তু পুনঃপুনঃ ডাকাতেও কপালকুণ্ডলা কোন উত্তর দিল না। তখন কাপালিকের চক্ষু লোহিত, ভ্রূযুগ আকুঞ্চিত হইল। দ্রুত পাদবিক্ষেপে গৃহাভিমুখে চলিল; এই অবকাশে বন্ধনলতা ছিন্ন করিতে নবকুমার আর এক বার যত্ন পাইলেন—কিন্তু সে যত্নও নিষ্ফল হইল।

 এমত সময়ে নিকটে বালুকার উপর অতি কোমল পদধ্বনি হইল—এ পদধ্বনি কাপালিকের নহে। নবকুমার নয়ন ফিরাইয়া দেখিলেন সেই মোহিনী—কপালকুণ্ডলা। তাঁহার করে খড়্গ দুলিতেছে।

 কপালকুণ্ডলা কহিলেন “চুপ! কথা কহিও না—খড়্গ আমারই কাছে—চুরি করিয়া রাখিয়াছি।”

 এই বলিয়া কপালকুণ্ডলা অতি শীঘ্র হস্তে নবকুমারের লতাবন্ধন খড়্গ দ্বারা ছেদন করিতে লাগিলেন। নিমেষ মধ্যে তাহাকে মুক্ত করিলেন। কহিলেন, “পলায়ন কর; আমার পশ্চাৎ আইস, পথ দেখাইয়া দিতেছি।”

 এই বলিয়া কপালকুণ্ডলা তীরের ন্যায় বেগে পথ দেখাইয়া চলিলেন। নবকুমার লম্ফদান করিয়া তাঁহার পশ্চাৎ অনুসরণ করিলেন।