যমুনাতটে।



আহা কি সুন্দর নিশি, চন্দ্রমা উদয়,
 কৌমুদীরাশিতে যেন ধৌত ধরাতল
সমীরণ মৃদু মৃদু ফুলমধু বয়,
 কল কল করে ধীরে তরঙ্গিণী জল!
কুসুম, পল্লব, লতা নিশার তুষারে
 শীতল করিয়া প্রাণ শরীর জুড়ায়,
জোনাকির পাঁতি শোভে তরু শাখাপরে,
নিরবিলি ঝিঁ ঝিঁ ডাকে, জগত ঘুমায়;—
হেন নিশি একা আসি, যমুনার তটে বসি,
 হেরি শশী ভুলে ভুলে জলে ভাসি যায়।


কে আছে এ ভূমগুলে, যখন পরাণ
 জীবন-পিঞ্জরে কাঁদে যমের তাড়নে,
যখন পাগল মন ত্যজে এ শ্মশান
 ধায় শূন্যে দিবানিশি প্রাণ অন্বেষণে,

তখন বিজন বন, শান্ত বিভাবরী,
 শান্ত নিশানাথজ্যোতি বিমল আকাশে,
প্রশস্ত নদীর তট, পর্ব্বত উপরি,
 কার না তাপিত মন জুড়ায় বাতাসে।
কি সুখ যে হেনকালে, গৃহ ছাড়ি বনে গেলে,
 সেই জানে প্রাণ যার পুড়েছে হুতাশে।


ভাসায়ে অকুল নীয়ে ভবের সাগরে
 জীবনের ধ্রুবতারা ডুবেছে যাহার,
নিবেছে সুখের দীপ ঘোর অন্ধকারে,
 হু হু করে দিবা নিশি প্রাণ কাঁদে যার,
সেই জানে প্রকৃতির প্রাঞ্জল মূরতি,
 হেরিলে বিরলে বসি গভীর নিশিতে,
শুনিলে গভীর ধ্বনি পবনের গতি,
 কি সাত্ত্বনা হয় মনে মধুর ভাবেতে।
না জানি মানব মন, হয় হেন কি কারণ,
 অনন্ত চিন্তার গামী বিজন ভূমিতে।


হায় রে প্রকৃতি সনে মানবের মন,
 বাঁধা আছে কি বন্ধনে বুঝিতে না পারি,
নতুবা যামিনী দিবা প্রভেদে এমন,
 কেন হেন উঠে মনে চিন্তার লহরী?

কেন দিবসেতে ভুলি থাকি সে সকলে
 শমন করিয়া চুরি নিয়াছে যাহায়?
কেন রজনীতে পুনঃ প্রাণ উঠে জ্বলে,
 প্রাণের দোসর ভাই প্রিয়ার ব্যথায়?
কেন বা উৎসবে মাতি, থাকি কভু দিব রাতি,
আবার নির্জনে কেন কাঁদি পুনরায়?


বসিয়া যমুনাতটে হেরিয়া গগন,
 ক্ষণে ক্ষণে হলো মনে কত যে ভাবনা,
দাসত্ব, রাজত্ব, ধর্ম্ম, আত্ম্যবন্ধুজন,
 জরা, মৃত্যু, পরকাল, যমের তাড়না!
কত আশা, কত ভয়, কতই আহ্লাদ,
 কতই বিষাদ আসি হৃদয় পূরিল,
কত ভাঙি, কত গড়ি, কত করি সাধ,
 কত হাসি, কত কাঁদি, প্রাণ জুড়াইল।
রজনীতে কি আহ্লাদ, কি মধুর রসাস্বাদ,
 বৃন্তভাঙা মন যার সেই সে বুঝিল!