কবিতাবলী (হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৮৭১)/উন্মাদিনী
অঙ্গে মাখ ছাই বলিহারি যাই,
কে রমণী আই পথে পথে গাই
চলেছে মধুর কাকলী করে।
কিবা উষাকাল, কিবা দ্বিপ্রহর,
বীণা ধরে করে ফিরে ঘরে ঘর,
পরাণে বাঁধিয়া মিলায়ে সুতান,
গায় উচ্চস্বরে সুললিত গান,
উতলা করিয়া কামিনী নরে।
অঙ্গে মাখ ছাই বলিহারি যাই,
কে রমণী আই পথে পথে গাই,
চলেছে মধুর কাকলী করে।
নয়নের কোণে চপলা খেলিছে,
নিতম্বের নীচে চিকুর দুলিছে,
করুণা মাখান বদনের ছাঁদ,
যেন অভিনব অবনীর চাদ,
কটি কর পদে ছড়ান মাধুরী,
গেরুয়া বসনে তনুয়া আবরি,
চলেছে সুন্দরী ভাবনা ভরে।
বলিহারি যাই অঙ্গে মাখা ছাই,
কে রমণী অই পথে পথে গাই,
চলেছে মধুর কাকলী করে।
অই শুন গায়, প্রাণের জ্বালায়—
“পাবনা পাবনা পাবনা কি তায়?
নাহি কি বিশাল ধরণী ভিতরে,
যেখানে বসিয়া স্নেহের নির্ঝরে,
মিটাই পিপাসা জুড়াই পরাণ,
দেখাই কিরূপ নারীর পরাণ,
প্রণয়ের দাম হৃদয়ে পর্যে।
যেখানে বহে না কলঙ্কের শ্বাস
কাঁদাতে প্রণয়ী, ঘুচাতে উল্লাস,
বায়ুতে, তরুতে, মাটীতে, আকাশে,
যেখানে মনের সৌরভ প্রকাশে,
ঘরের, পরের, মনের ভাবনা,
লোকের গঞ্জনা, প্রাণের যাতনা,
যেখানে থাকে না সখীর তরে।
“কিবা সে বসন্ত শরত নিদাঘ,
নয়নে নয়নে নব অনুরাগ
ওঠে নিতি নিতি ফোটে অভিলাষ,
নিশিতে যেমন কাননে প্রকাশ
কলিকা কুসুমে ফুটাতে শশী।
দিবা, দণ্ড, পল, প্রভাত, যামিনী,
বার, তিথি, মাস, নক্ষত্র, মেদিনী
থাকে না প্রভেদ, প্রণয় প্রমাদে
হেরি পরস্পর মনের অবাধে;
জীবনে পরাণে মিশিয়া দুজনে
নেহারি আনন্দে মুখের স্বপনে—
নয়নে নয়ন, গণ্ডে গণ্ডতল,
করে করযুগ, কণ্ঠে কণ্ঠস্থল,
যেন পরিমল পবন হিল্লোলে,
যেন তরু লতা তরু শাখা কোলে,
যেমন বেণুতে বাণীর সুস্বর,
যেমন শশীর কিরণে অম্বর,
তেমনি অভেদ দুজনে মিশিয়া,
তনু মন প্রাণ তনু মনে দিয়া,
ভুলে বাহ্যজ্ঞান, ত্যজে নিদ্রা ক্ষুধা,
পান করি সুখে আনন্দের সুধা,
অগাধ প্রেমের সাগরে বসি।
“ত্যজে গৃহবাস, হয়ে সন্ন্যাসিনী,
ভ্রমি পথে পথে দিবস যামিনী,
আকাশের দিকে অবনীর পানে,
দেখি অনিমিষে আকুল পরাণে,
জবাসম রবি, শ্বেত সুধাকর,
মৃদু মৃদু আভা তারকা সুন্দর,
তরু, সরোরর, গিরি, বনস্থল,
বিহঙ্গ, পতঙ্গ, নদ, নদী, জল,
যদি কিছু পাই খুঁজিয়া তাহাতে,
স্নেহের অমিয়া হৃদয়ে মাখাতে,
যদি কিছু পাই তাহারি মতন,
হেরিতে নয়নে করিতে শ্রবণ,
দেবতা মানব নারী কি নরে।
সুখে থাকে তারা, সুখে থাকে ঘরে
পতি পদতল বক্ষঃস্থলে ধরে,
বিবাহিতা নারী—সখের খেলনা,
খায় দায় পরে নাহিক ভাবনা,
জানে না ভাবে না প্রণয় কেমন,
প্রাণের বল্লভ পতি কিবা ধন,
ইহারাই সতী—বিঘত প্রমাণ
আশা, রুচি, স্নেহ, ইহাদের প্রাণ —
নারীর মাহাত্ম্য, রমণীর মন
কত যে গভীর ভাবে কত জন,
প্রণয় কি ধন নারীর তরে?
“আমি মরি ঘুরে পৃথিবী ভিতরে,
প্রাণের মতন প্রাণনাথ তরে;
কই—কই পাই পূরাতে বাসনা?
পেয়ে নাহি পাই হায় কি যাতনা!
আরে মত্ত মন, সে অনিত্য আশা
ত্যজে ধৈর্য্য ধর, মুখে ভালবাসা
ধরে গৃহ কর, করে পরিণয়
না থাকিবে আর কলঙ্কের ভয়,
পাবি অনায়াসে পতি কোন জন,
পাবি অনায়াসে অন্ন আচ্ছাদন,
তবে মিছে কেন এত বিবাদ?
জ্বলিবে না হয় পুড়িয়া পুড়িয়া
পরাণ হৃদয় প্রণয়, স্মরিয়া,
সাহারার[১] মরু তপনে যেমন;
কিম্বা অগ্নিগিরি গর্ভে হুতাশন,
জ্বলে জ্বলে পুড়ে উঠিবে যখন,
হৃদয় পাষাণে রাখিব চাপিয়া,
মরিব না হয় মরমে ফাটিয়া,
তবু ত পূরিবে লোকের সাধ।
সুখে থাকে তারা জানে না কেমন
প্রাণের বল্লভ সখা কিবা ধন,
মনের সুখেতে থাকে রে ঘরে।”
বলিতে বলিতে কাঁদিয়া কাঁদিয়া,
চলিল সুন্দরী নয়ন মুছিয়া;
গাহিয়া মধুর মৃদুল স্বরে।
“কেনই থাকিব কিসেরি তরে,
তনু বাঁধা দিয়ে গৃহের ভিতরে?
কারাবন্দী সম চির-হতাশ্বাস,
কেনই ত্যজিব এমন বাতাস,
এমন আকাশ, রবির কিরণ,
বিশাল ধরণী, রসাল কানন,
প্রাণী কোলাহল, বিহঙ্গের গান,
সাধের প্রমাদ—স্বাধীন পরাণ;
কেনই ত্যজিব, কাহার তরে?
ত্যজিতাম যদি পেতাম তাহায়,
যারে খুঁজে প্রাণ ভুবন বেড়ায়,
যাহার কারণে নারীর ব্যভার
করেছি বর্জ্জন, কলঙ্কের হার
পরেছি হৃদয়ে বাসনা করে।
কোথা প্রাণেশ্বর কই সে আমার,
কিসের কলঙ্ক—সুধার আধার—
সুধার মণ্ডলে সুধারি শশাঙ্ক,
এসো প্রাণনাথ—নহে ও কলঙ্ক
তোমা লয়ে সুখে থাকি হে কাছে!
তবু ও এলে না?—বুঝেছি বুঝেছি,
এ জনমে আর পাব না জেনেছি;
যখন ত্যজিব মাটীর শিকল,
ভ্রমিব শূন্যেতে হইয়া যুগল,
হরি হর রূপে তনু আধ আধ,
তখন মিটিবে মনের এ সাধ,
রবির মণ্ডলে, চাঁদের আলোকে,
কৈলাস শিখরে, শিব ব্রহ্ম লোকে,
বরুণের বারি, পবনের বায়ু,
এই বসুন্ধরা, প্রাণী, পরমায়ু,
হেরিব সুখেতে পলকে ভ্রমিয়া,
আধ আধ তনু একত্র মিশিয়া,
তখন মিটিবে মনের সাধ!—
তখন, পৃথিবী, সাধিস্ বাদ
তুলিস কলঙ্ক যতই আছে।”
- ↑ আফ্রিকা খণ্ডস্থ স্বনাম প্রসিদ্ধ মরুভূমি।