কবিতাবলী (হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৮৭১)/প্রিয়তমার প্রতি

প্রিয়তমার প্রতি।

প্রেয়সি রে অধীনেরে জনমে কি ত্যজিলে!
এত আশা ভালবাসা সকলি কি ভুলিলে!
অই দেখ নব ঘন গগনে আসিয়ে পুনঃ,
মৃদু মৃদু গরজন গুরু গুরু ডাকিছে।
দেখ পুনঃ চাঁদ আঁকা, ময়ুর খুলিয়ে পাখা,
কদম্বের ডালে ডালে কুতূহলে নাচিছে।
পুনঃ সেই ধরাতল, পেয়ে জল সুশীতল,
স্নেহ করে তৃণদল বুকে করে রাখিছে।
হের প্রিয়ে পুনরায়, পেয়ে প্রিয় বরষায়,
যমুনা-জাহ্ণবী-কায়া উথলিয়া উঠিছে।
চাতক তাপিতপ্রাণ, পুলকে করিয়ে গান,
দেখ রে জলদ কাছে পুনরায় ছুটিছে।
প্রেয়সি রে সুখোদয় অখিল ব্রহ্মাণ্ডময়,
কেবলি মনের দুখে এ পরাণ কাঁদিছে।


অই পুনঃ জলধরে বারিধারা ঝরিল!
লতায় কুসুমদলে, পাতায় সরসীজলে,
নবীন তৃণের কোলে নেচে নেচে পড়িল।

শ্যামল সুন্দর ধরা শোভা দিল মনোহরা,
শীতল সৌরভ ভরা বাসে বায়ু ভরিল,
মরাল আনন্দ মনে ছুটিল কমলবনে,
চঞ্চল মৃণালদল ধীরে ধীরে দুলিল।
বক হংস জলচর ধৌত করি কলেবর,
কেলি হেতু কলরবে জলাশয়ে নামিল।
দামিনী মেঘের কোলে, বিলাসে বসন খোলে,
ঝলকে ঝলকে রূপ আলো করে উঠিল।
এ শোভা দেখাব করে, দেখায়ে সন্তোষ যারে,
হায় সেই প্রিয়তমা অভাগারে ত্যজিল।


ত্যজিবে কি প্রাণসখি? ত্যজিতে কি পারিবে?
কেমনে সে স্নেহলতা এ জনমে ছিঁড়িবে।
সে যে স্নেহ সুধাময়, ঘেরিয়াছে সমুদয়,
প্রকৃতি পরাণ মন, কিসে তাহা ভুলিবে?
আবার শরত এলে, তেমনি কিরণ ঢেলে
হিমাংশু গগনে কিরে আর নাহি উঠিবে?
বসন্তের আগমনে, সেরূপে সন্ধ্যার সনে
আর কি দক্ষিণ হতে বায়ু নাহি বহিবে?
আর কি রজনীভাগে, সেইরূপ অনুরাগে,
কামিনী, রজনীগন্ধ, বেল নাহি ফুটিবে?

প্রাণেশ্বরি! পুনর্ব্বার, নিশীথে নিস্তব্ধ আর
ধরাতল সেইরূপে নাহি কি রে থাকিবে?
জীবজন্তু কেহ কবে, কখন কি কোন রবে,
ভুলে অভাগার নাম কণ্ঠেতে না আনিবে?
প্রেয়সি রে সুধাময়, স্নেহ ভুলিবার নয়,
কাঁদালি কাঁদিলি সুধু পরিণামে জানিবে!
 * * * * *


অই দেখ প্রিয়তমে বারিধারা ধরিল।
শরতে সুন্দর মহী সুধা মাখি বসিল।
হরিত শস্যের কোলে, দেখ রে মঞ্জরী দোলে,
ভানুছটা তাহে কিবা শোভ দিয়া পড়েছে!
বহিলে মৃদুল বায়, ঢলিয়ে পড়িছে তায়,
তটিনীতরঙ্গলীলা অবনীতে ছুটেছে।
গোঠে গাভী বৃষ সনে, চরিছে আনন্দ মনে,
হরষিত তরুলতা ফলেফুলে সেজেছে।
সরোবরে সরোরুহ, কুমুদ কহ্লার সহ,
শরতে সুন্দর হয়ে শোভা দিয়ে ফুটেছে।
আচম্বিতে দরশন, ঘনঘন গরজন,
উড়িয়ে অম্বরে মেঘ ডেকে ডেকে চলেছে।

প্রেয়সি রে মনোহরা, এমন সুখের ধরা,
বিহনে তোমার আজি অন্ধকার হয়েছে!


আহা কি সুন্দর বেশ সন্ধ্যা অই আইল!
ভাঙা ভাঙা ঘনগুলি, ভানুর কিরণ তুলি
পশ্চিম গগনে আসি ধীরে ধীরে বসিল।
অস্তগিরি আলো করি, বিচিত্র বরণ ধরি,
বিমল আকাশে ছটা উথলিয়া পড়িল।
গোধূলিকিরণমাখা, গৃহচূড়া তরুশাখা,
প্রেয়সি রে মনোহর মাধুরীতে পূরিল।
কাদম্বিনী ধীরে ধীরি, হয়, তরু, গজ, গিরি,
আঁকিয়ে সুন্দর করি ছড়াইতে লাগিল!
দেখ প্রিয়ে শ্বেত আভা গঙ্গাজলে কিবা শোভা,
সুবর্ণের পাতা যেন ছড়াইয়া পড়িল।
কৃষক মঞ্চের পরে উঠিল আনন্দ ভরে,
চঞ্চুপুটে শস্য ধরে নভশ্চর ফিরিল।
এ সুখ সন্ধ্যায় প্রিয়ে, সাধে জলাঞ্জলি দিয়ে,
শূন্য দেহে নিরাসনে এ অভাগা রহিল।


আজি এ পূর্ণিমা নিশি প্রিয়ে কারে দেখাবে।
কার সনে প্রিয়ভাষে দেহ মন জুড়াবে!

এখনি যে সুধাকর, পূর্ণবিম্ব মনোহর,
পূর্ব্বদিকে পরকাশি সুধারাশি ছড়াবে।
এখনি যে নীলাম্বরে, শ্বেতবর্ণ থরে থরে,
আসিয়ে মেঘের মালা সুধাকরে সাজাবে।
তরুগিরি মহীতল শিশির আকাশ জল,
চাঁদের কৌমুদী মাখা কারে আজি দেখাবে!
প্রেয়সি অঙ্গুলি তুলি কুসুম কলিকাগুলি,
শিশিরে ফুটিছে দেখি কারে আজি সুধাবে—
“অই দেখ চক্রবাক, ডাকে অমঙ্গল ডাক’’
বলে সুধাইবে কারে, কে বাসনা পূরাবে!
তনু মন সমর্পণ, করেছিল সেই জন,
তারে কাঁদাইলে, হায়, প্রণয় কি জুড়াবে!