কমলাকান্তের পত্র/আঁটকুড়ী

আঁটকুড়ী

 আমি। তুমি অত রাগ করছ কেন তা আমি বুঝে উঠতে পারছি না, প্রসন্ন।

 প্রসন্ন আর থাকিতে পারিল না, তা’র গর্জ্জন তখন বর্ষণে পরিণত হইল। বুঝিলাম ব্যাপার কিছু গুরুতর; কারণ প্রসন্নকে শরতের নির্জ্জলা লঘু মেঘের মতো গর্জ্জন করিতেই শুনিয়াছি, বর্ষণ করিতে দেখি নাই। আর সে মেয়ে গর্জ্জনেই কার্য্যোদ্ধার করিয়া আসিয়াছে, শেষ অস্ত্রটি প্রয়োগের তা’র কখনও প্রয়োজন হয় নাই। আজ তাহাকে কাঁদিয়া ভাসাইয়া দিতে দেখিয়া বিস্মিত হইলাম।

 সে একটু সামলাইয়া লইয়া বলিল-বল কি গো, তুমি আমার রাগও বুঝনা, দুঃখও বুঝনা? আমাকে আঁটকুড়ী বলিয়া গাল দিল তা’ও বুঝনা? কেবল আফিং বুঝ আর মৌতাত বুঝ বুঝি?

 আমি। তা বুঝি বৈ কি; মিথ্যা বলি কেমন করে’। কিন্তু কি জান, হুকুমে রাগও হয় না, অনুরাগও হয় না। তুমি ক্রোধে অধীর হয়েছ বলে’ কি আমিও তোমার মতো লাফাব।

 প্রসন্ন। তা’ত বটেই, আমাকে আঁটকুড়ী না বলে’ তোমাকে আঁটকুড়ো বলত যদি ত দেখতাম।

 আমি। বলতই যদি, তুমি মনে কর কি আমি অমনি তোমার মত ধেই ধেই করতুম? আচ্ছা আমাকে বল দেখি—তোমার ক’টি ছেলে?

 প্রসন্ন। একটিও না।

আমি। ক’টি মেয়ে?

 প্রসন্ন কর্কশ কণ্ঠে বলিল—একটিও না—তা বলে' কি আবাগীরা আমাকে আঁটকুড়ী বলবে? ছেলে-মেয়ে হওয়া না-হওয়া কি মানুষের হাত?

 আমি। হাত যারই হ’ক. হয়নি যখন তখন হয়েছে বলা ত আর চলে না? তোমাকে কেউ যদি পুত্রবতী, জেয়ঁচ বলে—সেটা তুমি গালি বলে’ না নিলেও বিদ্রূপ বলে’ নিতে ত? বিদ্রূপ ত গালাগালিরই ছোট ভাই। সেইটাই বা কি করে’ সহ্য করতে?

 প্রসন্ন। তাই বা বলবে কেন?

 আমি। তবে কি বলবে? ছেলে হয়েছে ত বলবে না, হয়নি ও বলবে না! তোমার একটা স্বরূপ বর্ণনা ত আছে?

 প্রসন্ন। তুমি যেমন ন্যাকা! ছেলে হয়নি আর আঁটকুড়ী বুঝি এক কথা?

 আমি। ঠিক এক কথা নয় বটে; হয়নি বলে’ তুমি যেন একটু ছোট, যেন একটু অপরাধিনী, অভাগিনী; আর যিনি বলেচেন, তাঁর ছেলে হয়েছে বলে’ তিনি একটু বড়, একটু ভাগ্যবতী, এইটে যেন তিনি তোমাকে স্পষ্ট করে' বুঝিয়ে বলেচেন, এইত? কিন্তু গোড়াকার কথাটা ত সত্য?  প্রসন্ন। সত্যি হলেই বুঝি সব হ’ল? বলার কি একটা ধরণ নেই?

 আমি। ধরণ আছে বৈ কি? কিন্তু ধরণটা চাঁচাছোলা করবার জন্যে ত আর সত্যটাকে ডুবিয়ে দেওয়া চলে না।

 প্রসন্ন। তা বলে' কানাকে কানা, আর খোঁড়াকে খোঁড়া বলে’ তাদের মনে কষ্ট দেওয়া বুঝি তোমার শাস্ত্র?

 আমি। না তা নয়, খোঁড়াকে দেখলেই—ওরে খোঁড়া, আর কানাকে দেখলেই—ওরে কানা বলে’ সম্বোধন করতে হবে, তা বলচি না; কিন্তু তাদের স্বরূপ বর্ণনা করতে গিয়ে ধরণের খাতিরে কানাকে ত পদ্মলোচন, আর খোঁড়াকে গিরি— লঙ্ঘনকারী বলা চলে না। সেটা বিদ্রূপও বটে অসত্যও বটে।

 প্রসন্ন। তা বলে' কাটখোট্টার মত কেবল লোকের বুকের উপর দিয়ে চাবুক চালালেই বড় বাহাদুরী হয়, না? লোকে চোয়াড় বলবে না?

 আমি। হয়ত বলবে। কিন্তু লোকে যদি বিচার করে’ দেখে ত দেখবে, সৃষ্টির আদি থেকে আজ পর্য্যন্ত দুনিয়া বিনীতদের হাতে যত ঠকেচে চোয়াড়দের হাতে তা’র সিকির সিকিও ঠকে নি, চোয়াড়দের চিনতে, তাদের বক্তব্য হৃদয়ঙ্গম করতে, আবশ্যক হ’লে তা হ’তে আত্মরক্ষা করতে, এক মুহূর্ত্ত বিলম্ব হয় না; কিন্তু বিনীতের মোলামত্বের অতলস্পর্শ ভেদ করতে গিয়ে অধিকাংশ সময়েই হাবুডুবু খেতে হয়, অনেক সময়ে তলিয়ে যেতে হয়। আমি বিনীতদের বড় ভয় করি—তারা বিনয়ের chloroform দিয়ে আমার কোন মর্ম্মস্থলে ছুরিখানি বেমালুম চালিয়ে দিয়ে বসবে, আমি জানতেও পারব না। সরলতাই যাদের বিনয়, তাদের কথা বলছি না। সাধারণতঃ বিনয় মানে, সবটা না-বলা বা বিষম ঘুরিয়ে বলা; কোদালকে “মৃত্তিকা-খনন-যোগ্য-যন্ত্র-বিশেষঃ” না বলে’ “কোদাল ইতি ভাষা” বল্লেই সর্ব্বনাশ। মনুষ্য প্রকৃতির সহ্য করবার দিক দিয়ে দেখলে, indirect ও direct taxationএ যে প্রভেদ, বিনয় ও স্পষ্টবাদিতায়ও তাই। Direct taxএর সূচী বেধ মানুষ সহা করবে না, পরন্তু indirect taxএর সমগ্র ফালটা চলে’ গেলেও টু শব্দ করবে না। তেমনি একবিন্দু সত্য স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হ’লে মানুষ শিউরে উঠবে, কিন্তু একজালা মিথ্যা বিনয়ের শর্করা মিশ্রিত হ’লে চিনির পানা বলে' সমস্তটাই পান করে ফেলবে।

 প্রসন্ন একেবারে নিস্তব্ধ। আমি বলিলাম— প্রসন্ন, আঁটকুড়ী বলেছে বলে’ তোমার গায়ে ঝাল লেগেছে কেন জান? কথাটা সত্য বলে’; তবে অপ্রিয় সত্য। কিন্তু সত্যের চেয়ে অপ্রিয় কিছু আছে কি? সত্য বল্তে অপ্রিয়, সত্য শুনতে অপ্রিয়; ‘মা ব্রুয়াৎ সত্যমপ্রিয়ম্’—এ উপদেশ যদি মানতে হয়, ত সত্য বলাই হয় না। করুণা যে করে, আর করুণা যে পায়, উভয়ে ধন্য হয় সে কেবল এ সংসার দুঃখের সংসার বলে’। তেমনি, সত্য যে বলে, আর যে শোনে, বক্তা ও শ্রোতা উভয়েই কষ্ট পায়—সে কেবল এ দুনিয়া মিথ্যার রাজ্য বলে’; এই মিথ্যার রাজ্যে তাই আদবকায়দার দরকার, সত্যরূপ কুইনাইনপিলকে আদবকায়দার শর্করাপ্রলেপ দিয়ে চালিয়ে দেবার জন্য। আমার ধারণা প্রকৃত সত্যরাজ্যে অর্থাৎ স্বর্গরাজ্যে, etiquette বলে’ কিছু নেই, আদবকায়দা বলে’ কিছুর প্রয়োজনই নেই। সেখানে কায়মনোবাক্যে দেবতারা সত্য ভিন্ন আর কিছুর আদান প্রদান করে না। তাঁরা সত্য বলেন, সত্য শ্রবণ করেন, সত্য মনন করেন, সত্যকে ধারণ করতে পারেন; তাঁদের আদবকায়দা বলে’ যদি কিছু থাকে তাহাও সত্য; একটা অবগুণ্ঠন নয়, আবরণ নয়। আর মানুষ সত্যের অনাবৃত জ্যোতি বরদাস্ত করতে পারে না বলে’ একটু আদবকায়দার কুজ্ঝটিকায় ঢেকে তা’র প্রখৱ রশ্মিজালকে সংহত ম্লান করে’ তাদের ক্লিন্ন হৃদয় ফলকের উপযুক্ত করে’ নেয়। সত্যের প্রকট উজ্জ্বল আলোক সহ্য করবার অক্ষমতাই আদবকায়দার আকাঙ্ক্ষাকে সৃজন করেছে।

 প্রসন্ন তখনও নিস্তব্ধ।

 আমি বলিলাম—রমণি তোমার বক্ষে হাত দিয়ে দেখ, তথায় যে অমৃতের উৎস তোমার যৌবনের পূর্ণতার সঙ্গে সঙ্গে সঞ্চিত পরিপুষ্ট হ’য়ে সন্তানের আগমন প্রতীক্ষা করেছিল, সন্তানের কুসুমকোমল ওষ্ঠপুটে সংলগ্ন হয়ে সে অমৃতধারা যে তা’র শোণিত প্রবাহ পরিপুষ্ট করে নি, তা’তে কি তোমার নারীজীবন ব্যর্থ হ’য়ে যায় নি? প্রকৃতি তোমাকে নারী করেছিল কেন? পুরুষ বা নপুংসক করে’ নি কেন? তুমি সন্তান ধারণ করবে, পালন করবে, পরিপোষণ করবে, এইজন্য। প্রকৃতি তোমাকে তাঁর সৃষ্টিরক্ষার যন্ত্র হিসাবে সৃজন করেছিলেন। তারপর, সমাজ তোমাকে না-হয় গোপজাতি, অমুকের কন্যা, অমুকের পত্নী করেছে; কিন্তু তুমি যে-জাতিই হও, যারই কন্যা হও, যারই পত্নী হও বা কারো পত্নী না-হও, তুমি মাতা হবার জন্যই রমণী হয়েছিলে; আর তোমার জন্মের মৌলিক উদ্দেশ্য তোমা হ’তে সাধিত হয় নি বলে', ভাল শুনাক আর নাই শুনাক, সত্য সত্যই তুমি প্রকৃতির উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে’ আজ আঁটকুড়ী!

 প্রসন্ন এতক্ষণে মুখ খুলিল, কেননা, আঁটকুড়ী কথাটা সে কিছুতেই বরদাস্ত করিতে পারিতেছিল না।

 প্রসন্ন। মেয়েমানুষকে বিয়েই করতে হবে, আর ছেলে বিয়োতেই হবে, তারই বা মানে কি?

 আমি। প্রসন্ন, আমার মত বুড়ো ভূশুণ্ডীকে আর ও-প্রশ্ন কর’ না; উর্ব্বাচীনদের ও হেঁয়ালি বলে' ধাঁধা লাগাতে চেষ্টা কর'। সাত পাক দিয়ে বিয়ে করতে হবে কি না হবে, সেটা সমাজ বুঝবেন; কিন্তু মেয়েমানুষকে বিয়ে করতেই হবে—তা সাত পাকেই হ’ক, বিনি পাকেই হ’ক, আর বিপাকেই হ’ক। আর যতদিন পুরুষের উরুদেশ ভেদ করে' সন্তানের জন্ম, ও তর্জ্জনী হ’তে দুগ্ধক্ষরণ উপন্যাসের পৃষ্ঠা হ'তে নেমে এসে এই বাস্তবজগতে সত্য হ'য়ে না উঠবে, ততদিন মেয়েমানুষকে ছেলে বিয়োতেই হবে, আর ওটা একমাত্র তাদেরই কৃত্য মধ্যে পরিগণিত থাকবে।

 প্রসন্নর চোখ তখন আবার জলে ভরিয়া উঠিল।

 সে বলিল—তবে কি যার ছেলে হ'ল না সে একেবারে দুনিয়ার বার হ’য়ে গেল? অনেক পুত্রহীন কত সদাব্রত, কত দেউল, কত পুষ্করিণী করে' দিয়েছে, তা’তে কি লোকের উপকার হয় নি? কত পুত্রহীনা নারী ধর্ম্মের পথে, লোকহিতের পথে, কত কীর্ত্তি রেখে গেছে সেগুলা কি অপুত্রক বলে’ ধর্তব্যের মধ্যে নয়?

 আমি। তা কেন? এই তুমি, আঁটকুড়ী হয়েও বা হয়েচ বলেই, এই যে নিরালম্ব বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের পরিচর্য্যা করছ, তা’তে কি আমার উপকার হচ্ছে না, না তোমারই পুণ্য সঞ্চর হচ্ছে না। যদি ক্বচিৎ ফলং নাস্তি ছায়া কেন নিবার্য্যতে—আমার এই দিগন্ত বিস্তৃত বিদগ্ধ জীবন-মরুপ্রান্তরে তুমি যে ফলহীন রসাল, একক আমার মাথার উপর রৌদ্রে শিশিরে পরবাস্তরণ বিছিয়ে দাঁড়িয়ে আছ, তার কি মূল্য নাই? কিন্তু গাছে যখন ফল ধরে নি, তখন তার বৃক্ষ জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য অপূর্ণ থেকে গেছে, তা’ত বলতেই হবে। এখন গাছটাকে কেটে চেলাকাঠ করলেও হয়ত, কুমারের হাঁড়ি পুড়বে, ভাত সিদ্ধ হবে, চিতা জ্বলবে, একটা-না-একটা কাজে লাগবেই, কিন্তু তা’তে আম্রফলের রসাস্বাদ মিলবে কি?

 নারীর অনেক কীর্ত্তি আছে, সেগুলা পুরুষের হলেও বিশেষ প্রভেদ হ’ত না। কিন্তু সুসন্তান প্রসব করে’ তা’কে লালনপালন করে’ নারী তা’কে মানুষ করে’ তুলল, সে কীর্ত্তি তা’র একদিকে যেমন ভগবৎ প্রেরণা সম্পূর্ণ করল, অন্যদিকে তার নারীজীবনও সার্থক হ’ল। এর মত নারীর কৃত্য ও কীর্তি আর কিছুই নাই।

 প্রসন্ন মুখখানা তোলো ছাঁড়ির মত করে’ উঠে গেল; তারপর আমার সঙ্গে সে তিনদিন কথা কয় নি, কিন্তু ঠিক সময়ে দুধ দিয়ে যেত, একটি মিনিট এদিক ওদিক হত না।