কমলাকান্ত/কমলাকান্তের পত্র)/তৃতীয় সংখ্যা



তৃতীয় সংখ্যা।


বাঙ্গালির মনুষ্যত্ব।

 মহাশয়! আপনাকে পত্র লিখিব কি— লিখিবার অনেক শক্র। আমি এখন যে কুঁড়ে ঘরে বাস করি, দুর্ভাগ্যবশতঃ তাহার পাশে গোটা দুই তিন ফুলগাছ পুঁতিয়াছি। মনে করিয়াছিলাম, কমলাকান্তের কেহ নাই—এই ফুলগুলি আমার সখা সখী হইবে। খোষামোদ করিয়া ইহাদের ফুটাইতে হইবে না—টাকা ছড়াইতে হইবে না, গহনা দিতে হইবে না, মন-যোগান গোছ কথা বলিতে হইবে না, আপনার সুখে উহার আপনি ফুটিবে। উহাদের হাসি আছে—কান্না নাই; আমোদ আছে— রাগ নাই। মনে করিলাম, যদি প্রসন্ন গোয়ালিনী গিয়াছে তবে এই ফুলের সঙ্গে প্রণয় করিব।

 তা, ফুল ফুটিল—তারা হাসিল। মনে করিলাম-মহাশয় গো! কিছু মনে করিতে না করিতে, ফুটন্ত ফুল দেখিয়া ভোমরার দল, —লাখে লাখে ঝাঁকে ঝাঁকে, ভোমরা বোল‍্তা মৌমাছি—বহুবিধ রসক্ষেপা রসিকের দল, আসিয়া আমার দ্বারে উপস্থিত হইলেন। তখন গুন্‌ গুন্ ভন্ ভন্ ঝন্ ঝন্ ঘ্যান্ ঘ্যান্ করিয়া হাড় জ্বালাইতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহাদিগকে অনেক বুঝাইয়া বলিলাম যে, হে মহাশয়গণ! এ সভা নহে, সমাজ নহে, এসোসিয়েশ্যন, লীগ, সোসাইটি, ক্লব প্রভৃতি কিছুই নহে—কমলাকাস্তের পর্ণকুটীর মাত্র, আপনাদিগের ঘ্যান্ ঘ্যান্ করিতে হয়, অন্যত্র গমন করুন—আমি কোন রিজলিউশ্যনই দ্বিতীয়িত করিতে প্রস্তুত নহি; আপনারা স্থানান্তরে প্রস্থান করুন। গুন্ গুনের দল, তাহাতে কোন মতে সম্মত নহে-বরং ফুলগাছ ছাড়িয়া আমার কুটীরের ভিতর হল্লা করিতে আরম্ভ করিয়াছে। এই মাত্র আপনাকে এক পত্র লিখিতে প্রবৃত্ত হইতেছিলাম— (আফিঙ্গ ফুরাইয়াছ)—এমত সময়ে এক ভ্রমর কুচকুচে কালো আসল বৃন্দাবনী কালাচাঁদ, ভোঁ করিয়া ঘরের ভিতর উড়িয়া আসিয়া কানের। কাছে ঘ্যান্ ঘ্যান্ আরম্ভ করিলেন—লিখিব কি, মহাশয়?

 ভ্রমর বাবাজি নিশ্চিত মনে করেন, তিনি বড় সুরসিক—বড় সদ্বক্তা—তাঁহার ঘ্যান্‌ ঘ্যানানিতে আমার সর্ব্বাঙ্গ জুড়াইয়া যাইবে। আমারই ফুলগাছের ফুলের পাপড়ি ছিঁড়িয়া আসিয়া আমারই কানের কাছে ঘ্যান্ ঘ্যান্? আমার রাগ অসহ্য হইয়া উঠিল; আমি তালবৃন্ত হস্তে ভ্রমরের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলাম। তখন আমি ঘূর্ণন, বিঘূর্ণন, সংঘূর্ণন প্রভৃতি বহুবিধ বক্রগতিতে তালবৃন্তাস্ত্র সঞ্চালন করিতে লাগিলাম; ভ্রমরও ডীন, উডডীন, প্রডীন, সমাডীন প্রভৃতি বহুবিধ কৌশল দেখাইতে লাগিল। আমি কমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী—দপ্তর-মুক্তাবলীর প্রণেতা, কিন্তু হায়, মনুষ্যবীর্য্য! তুমি অতি অসার! তুমি চিরদিন মনুষ্যকে প্রতারিত করিয়া শেষ আপন অসারতা প্রমাণীকৃত কর! তুমি জামার ক্ষেত্রে হানিবলকে, পলটোবার ক্ষেত্রে চালর্সকে, ওয়াটর্লুর ক্ষেত্রে নেপোলিয়নকে, এবং আজি এই ভ্রমরসমরে কমলাকান্তকে বঞ্চিত করিলে! আমি যত পাখা ঘুরাইয়া বায়ু সৃষ্টি করিয়। ভ‍্রমরকে উড়াইতে লাগিলাম, ততই সে দুরাত্মা ঘূরিয়া ঘূরিয়া আমার মাথামুণ্ড বেড়িয়া বেড়িয়া চোঁ বোঁ করিতে লাগিল। কখনও সে আমার বস্ত্রমধ্যে লুক্কায়িত হইয়া, মেঘের আড়াল হইতে ইন্দ্রজিতের ন্যায় রণ করিতে লাগিল, কখনও কুম্ভকর্ণনিপাতী রামসৈন্যের ন্যায় আমার বগলের নীচে দিয়া ছুটিয়া বাহির হইতে লাগিল; কখনও স্যাম্পসনের ন্যায় শিরোরূহমধ্যে আমার বীর্ষ্য সংন্যস্ত মনে করিয়া, আমার নীরদ-নিন্দিত কুঞ্চিত কেশদামমধ্যে প্রবেশ করিয়া ভেরী বাজাইতে লাগিল। তখন দংশনভয়ে অস্থির হইয়া আমি রণে ভঙ্গ দিলাম। ভ্রমর সঙ্গে সঙ্গে ছুটিল। সেই সময়ে চৌকাঠ পায়ে বাধিয়া কমলাকান্ত— “পপাত ধরণীতলে!!!” এই সংসারসমরে মহারথী শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্তী—যিনি দারিদ্র্য, চির-কৌমার এবং অহিফেন প্রভৃতির দ্বারাও কখন পরাজিত হয়েন নাই—হায়! তিনি এই ক্ষুদ্র পতঙ্গ কর্ত্ত‌ৃক পরাজিত হইলেন।

 তখন ধূল্যবলুষ্ঠিত শরীরে দ্বিরেফরাজের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিতে লাগিলাম। যুক্তকরে বলিলাম, “হে দ্বিরেফসত্তম! কোন্ অপরাধে দুঃখী ব্রাহ্মণ তোমার নিকট অপরাধী যে, তুমি তাহার লেখা পড়ার ব্যাঘাত করিতে আসিয়াছ? দেখ, আমি এই বঙ্গদর্শনে পত্র লিখিতে বসিয়াছি—পত্র লিখিলে আফিঙ্গ আসিবে— তুমি কেন ঘ্যান্ ঘ্যান্ করিয়া তাহার বিঘ্ন কর?” আমি প্রাতে একখানি বাঙ্গালা নাটক পড়িতেছিলাম—তখন অকস্মাৎ সেই নাটকীয় রাগগ্রস্ত হইয়া বলিতে লাগিলাম—“হে ভৃঙ্গ! হে অনঙ্গরঙ্গ তরঙ্গবিক্ষেপকারিন্! হে দুর্দ্দান্ত পাষণ্ডভণ্ডচিত্তলণ্ডভণ্ডকারিন্! হে উদ্যানবিহারিন্-কেন তুমি ঘ্যান্ ঘ্যান্ করিতেছ? হে ভৃঙ্গ! হে দ্বিরেফ! হে ষট‍্পদ! হে অলে! হে ভ্রমর! হে ভোমরা! হে ভোঁ ভোঁ! —”

 ভ্রমর ঝুপ করিয়া আসিয়া সাম‍্নে বসিল। তখন গুন গুন করিয়া গলা দুরস্ত করিয়া বলিতে লাগিল—আমি অহিফেন-প্রসাদে সকলেরই কথা বুঝিতে পারি—আমি স্থিরচিত্তে শুনিতে লাগিলাম।  ভৃঙ্গরাজ বলিতে লাগিলেন, “হে বিপ্র! আমার উপর এত চোট কেন? আমি কি একাই ঘ্যান্-ঘেনে! তোমার এ বঙ্গভূমে জন্মগ্রহণ করিয়া ঘ্যান্ ঘ্যান্ করিব না ত কি করিব? বাঙ্গালি হইয়া কে ঘ্যান্ ঘ্যানানি ছাড়া? কোন্, বাঙ্গালির ঘ্যান্ ঘ্যানানি ছাড়া অন্য ব্যবসা আছে? তোমাদের মধ্যে যিনি রাজা মহারাজা কি এমনি একটা কিছু মাথায় পাগড়ি ঙ হইলেন, তিনি গিয়া বেল্ ভিডিয়রে ঘ্যান্ ঘ্যান্ আরম্ভ করিলেন। যিনি হইবেন উমেদ রাখেন, তিনি গিয়া রাত্রিদিবা রাজদ্বারে ঘ্যান্ ঘ্যান্ করেন। যিনি কেবল একটি চাকরির উমেদওয়ার—তাঁর ঘ্যান্ ঘ্যানানির ত আর অন্ত নাই। বাঙ্গালি বাবু যিনিই দুই চারিটা ইংরেজি বোল শিখিয়াছেন, তিনি অমনি উমেদওয়াররূপে পরিণত হইয়া, দরখাস্ত বা টিকিট হাতে দ্বারে দ্বারে ঘ্যান্ ঘ্যান্—ডাঁশমাছির মত খাবার সময়ে, শোবার সময়ে, বস‍্বার সময়ে, দাঁড়াবার সময়ে, দিনে, রাত্রে,প্রাহ্নে,অপরাহ্নে,মধ্যাহ্নে,সায়াহ্নে— ঘ্যান ঘ্যান্ ঘ্যান্! যিনি উমেদওয়ারি ছাড়িয়া স্বাধীন হইয়া উকীল হইলেন, তিনি আবার সনদী ঘ্যান্ ঘেনে। সত্য মিথ্যার সাগরসঙ্গমে প্রাতঃস্নান করিয়া উঠিয়া, যেখানে দেখেন, কাঠগড়ার ভিতর বিড়ে মাথায় সরকারি জুজু বসিয়া আছে—বড় জজ, ছোট জজ, সবজজ, ডিপুটি, মুন্সেফ-সেইখানে গিয়া সেই পেশাদার ঘ্যান্ ঘেনে, ঘ্যান ঘ্যানানির ফোয়ারা খুলিয়া দেন। কেহ বা মনে করেন, ঘ্যান্ ঘ্যানানির চোটে দেশোদ্ধার করিবেন—সভাতলে ছেলে বুড়া জমা করিয়া ঘ্যান্ ঘ্যান্ করিতে থাকেন। কোন দেশে বৃষ্টি হয় নাই—এসো বাপু ঘ্যান্‌ ঘ্যান্, করি; বড় চাকরি পাই না—এসে বাপু ঘ্যান্ ঘ্যান্ করি—রামকান্তের মা মরিয়াছে—এসো বাপু স্মরণার্থ ঘ্যান্ ঘ্যান্ করি। কাহারও বা ভাতেও মন উঠে না—তাঁরা কাগজ কলম লইয়া, হপ্তায় হপ্তায়, মাসে মাসে, দিন দিন ঘ্যান্, ঘ্যান করেন। আর তুমি যে বাপু আমার ঘ্যান্ ঘ্যানানিতে, এত রাগ করিতেছ, তুমি ও কি করিতে বসিয়াছ? বঙ্গদর্শন সম্পাদকের কাছে কিছু আফিঙ্গের যোগাড় করিবে বলিয়া ঘ্যান্, ঘ্যান্ করিতে বসিয়াছ। আমার চোঁ বোঁই কি এত কটু?

 তোমায় সত্য বলিতেছি, কমলাকান্ত! তোমাদের জাতির ঘ্যান্ ঘ্যানানি আর ভাল লাগে না। দেখ আমি যে ক্ষুদ্র পতঙ্গ, আমিও শুধু ঘ্যান্ ঘ্যান্ করি না—মধু সংগ্রহ করি আর হুল ফুটাই। তোমরা না জান মধু সংগ্রহ করিতে,না জান হুল ফুটাইতে—কেবল ঘ্যান্ ঘ্যান্ পার। একটা কাজের সঙ্গে খোঁজ নাই—কেবল কঁদুনে মেয়ের মত দিবারাত্রি ঘ্যান্ ঘ্যান্। একটু বকাবকি লেখালেখি কম করিয়া কিছু কাজে মন দাও—তোমাদের শ্রীবৃদ্ধি হইবে। মধু করিতে শেখ—হুল ফুটাইতে শেখ। তোমাদের রসনা অপেক্ষা আমাদের হুল শ্রেষ্ঠ—বাক্যবাণে মানুষ মরে না; আমাদের হুলের ভয়ে জীবলোক সদা সশঙ্কিত! স্বর্গে ইন্দ্রের বজ্র, মর্ত্ত্যে ইংরেজের কামান, আর আকাশমার্গে আমাদের হুল! সে যাক, মধু কর; কাজে মন দাও। নিতান্ত যদি দেখ, রসনাকণ্ডয়ন রোগ জন্য কাজে মন যায় না —জিবে কাষ্টকি দিয়া ঘা কর—অগত্যা কাজে মন যাইতে পারে। আর শুধু ঘ্যান্ ঘ্যান্, ভাল লাগে না।”

 এই বলিয়া ভমরাজ ভোঁ করিয়া উড়িয়া গেল।

 আমি ভাবিলাম যে, এই ভ্রমর অবশ্য বিশেষ বিজ্ঞ পতঙ্গ। শুনা আছে, মনুষ্যের পদবৃদ্ধি হইলেই সে বিজ্ঞ বলিয়া গণ্য হয়। এই জন্য দ্বিপদ মনুষ্য হইতে চতুষ্পদ পশু—পক্ষান্তরে যে সকল মনুষ্যের পদবৃদ্ধি হইয়াছে—তাহারা অধিক বিজ্ঞ বলিয়া গণ্য। এই ষট‍্পদের—একখানি না দুখানি না—ছয় ছয়খানি পা! অবশ্য এ ব্যক্তি বিশেষ বিজ্ঞ হইবে—ইহার অসামান্য পদবৃদ্ধি দেখা যায়। এই বিজ্ঞ পতঙ্গের পরামর্শ অবহেলন করি কি প্রকারে? অতএব আপাততঃ ঘ্যান্ ঘ্যানানি বন্ধ করিলাম—কিন্তু মধুসংগ্রহের আশাটা রহিল। বঙ্গদর্শন পুষ্প হইতে অহিফেন মধু সংগ্রহ হইবে এই ভরসায় প্রাণ ধারণ করে—

আপনার আজ্ঞাবহ 
শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্তী।